নির্বাচন- গণতন্ত্রের দাম কত? by এ কে এম জাকারিয়া
গণতন্ত্র সব বিবেচনাতেই দামি জিনিস।
খ্রিষ্টপূর্ব তিন থেকে চার শ বছর আগে গ্রিক নগররাষ্ট্রে যে ‘গণতন্ত্রের’
শুরু, তাকে যতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, শুধু সময়ের হিসাব করলেই তা
মহামূল্যবান।
আর এই দীর্ঘ সময়ে গণতন্ত্রের জন্য এই বিশ্বকে
যা উৎসর্গ করতে হয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে একে অমূল্যই বলতে হবে! আজকের
দুনিয়ায় গণতন্ত্র যেখানে এসে ঠেকেছে, সেখানে স্রেফ এর আর্থিক দিক
হিসাব-নিকাশ করলেও দেখা যাবে যে গণতন্ত্র খুবই দামি একটি বিষয়। আমাদের দেশে
যে গণতন্ত্র আমরা কায়েম করেছি, সেটা আসলে কতটা দামি? কতটা মূল্য আমরা
দিয়েছি ও দিয়ে চলছি এর জন্য? খরচ আর গণতন্ত্র প্রাপ্তির ব্যালান্স শিট কী
বলছে?
দেশ হিসেবে ছোট ও দরিদ্র হলেও গণতন্ত্রের মতো একটি দামি বিষয় আমাদের দেশে রয়েছে। গণতন্ত্র এখন যে রূপ নিয়েছে, তাতে নির্বাচন এর একটি অপরিহার্য দিক। নির্বাচন ছাড়া আর যা-ই হোক গণতন্ত্র চলে না। বাংলাদেশে এখন ‘নির্বাচন পরিস্থিতি’ চলছে। এই নির্বাচন পরিস্থিতির একটি ‘আনুষ্ঠানিক’ যাত্রা শুরু হয়েছে ২৭ অক্টোবর থেকে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য এদিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে দেশে নির্বাচন করতে হবে। দিনটির একটি ভুল হিসাব হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর মুখে দিনটি ২৫ অক্টোবর বলে কয়েক দফা উচ্চারিত হয়েছিল। সর্বশেষ জাতির উদ্দেশে দেওয়া লিখিত ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর থেকে ৯০ দিনের হিসাব গণনা শুরু হবে।’ কলাম লেখক ও সহকর্মী মিজানুর রহমান খান এ নিয়ে তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অনেক আগে থেকেই ২৫ অক্টোবর কথাটি ব্যবহার করেছেন। এরপর তা খালেদা জিয়া লুফে নিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর)। একটি ‘রাজনৈতিক তারিখ’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় ২৫ অক্টোবর দিনটি। ফলে ভুল করে হলেও নির্দিষ্ট দিনের দুই দিন আগের এই দিনকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নির্বাচনের পথে যাওয়ার এই দিনটি ‘উদ্যাপিত’ হলো পাঁচটি প্রাণের বিনিময়ে।
এই যে শুরু, তার আর থামাথামি নেই। এরপর ২৭ অক্টোরব নির্বাচনের প্রকৃত ক্ষণগণনা শুরুর দিনে প্রাণ গেল আরও পাঁচজনের, ২৮ অক্টোবর চারজন ও ২৯ অক্টোরব চারজন। আমরা চাই বা না চাই, মৃত্যুর মিছিলের এই ধারাবাহিকতা সামনের দিনগুলোতেও বজায় থাকবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার টেলিফোন সংলাপ (নাকি ঝগড়া?) আমরা শুনে ফেলেছি। ফলে সংঘাত ও সহিংসতাই যে সামনের দিনগুলোর বাস্তবতা, তা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে। আর আমাদের অভিজ্ঞতাই বলছে, নির্বাচন মানেই নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, তার মূল্য হিসেবে সামনের দিনগুলোতে আমাদের ‘উৎসর্গ’ করতে হবে আরও অনেক জীবন।
জন্মের দিন থেকেই আমাদের এই দেশ ‘গণতান্ত্রিক’। সব দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। সে হিসেবে বাংলাদেশকে একটি ভাগ্যবান দেশই বলতে হবে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে একধরনের জাতীয় ঐকমত্যও রয়েছে দেশে। দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই কাজ করে যাচ্ছে ‘গণতন্ত্রের জন্য’। গণতন্ত্রের প্রতি দেশের সব রাজনৈতিক শক্তির ‘অঙ্গীকার’ এতই ‘দৃঢ়’ যে এ জন্য যেকোনো ‘ত্যাগ’ স্বীকারে তারা সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। ফলে জন্মের ৪২ বছর পরও গণতন্ত্র ধরে রাখতে সামনে যে নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে, সেটার জন্য সব পক্ষই ‘ত্যাগ স্বীকার’ করতে প্রস্তুত হয়ে মাঠে নেমেছে। সবাই নির্বাচন চায়, কিন্তু নিজেদের মতো করে। আমাদের দেশে এখন নির্বাচনকে নিজেদের মনের মতো করতে পারাই যে ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠেছে! বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট ৬০ ঘণ্টার যে হরতাল পালন করল, সামনে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিসহ আরও যেসব কর্মসূচি আসছে, যে মানুষগুলো প্রাণ দিল বা সামনে যারা দেবে, এর সবই হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’। আর আওয়ামী লীগ বা মহাজোট নিজেদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করে যে নির্বাচন করতে চাইছে, সেটাও পুরোপুরি ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’। এ পর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানিতে যে দলের যারাই মারা গেছে, প্রাণ হারিয়েছে বা দিয়েছে, সব প্রাণই গেছে গণতন্ত্রের জন্য। সবকিছুরই একটি আর্থিক হিসাব করা যায়, যেকোনো ক্ষতিকেই অর্থমূল্যে বিবেচনা করা যায়। আগের সব হিসাব যদি বাদও দিই, ২৫ অক্টোবর থেকে ‘গণতন্ত্রের’ জন্য যে জনা বিশেক লোক প্রাণ দিল, এই মৃত্যুগুলোকে কী কোনোভাবে আর্থিক ক্ষতিতে রূপান্তর করা যাবে? হিসাব করা যাবে, কত ক্ষতি হলো? কতটা মূল্য দিন পাঁচেকের মধ্যেই আমরা দিলাম গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার একটি নির্বাচনের জন্য!
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের যে চর্চা দুনিয়াজুড়ে চলছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের জন্য ‘খরচের’ একটা হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব। গণতন্ত্র বজায় রাখতে যে নির্বাচন করতে হয়, তার খরচের হিসাব সহজেই করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচনগুলোতে প্রার্থীরা, রাজনৈতিক দলগুলো ও বিভিন্ন স্বাধীন গ্রুপ মিলিয়ে নির্বাচনে খরচ করেছিল ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন দল, প্রার্থী ও প্রতিষ্ঠান মিলে প্রচারণার কাজে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বলে মার্কিন ফেডারেল নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। ‘গণতন্ত্রের জন্য’ মার্কিনরা কতটা ‘খরচ’ করছে বা মূল্য দিচ্ছে, তার একটি হিসাব হলেও করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বছর বছর যেমন সবকিছুরই খরচ বাড়ে, গণতন্ত্রের জন্য খরচও একইভাবে বাড়ে। অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রেই এ ধরনের একটি হিসাব বের করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের হিসাবটি আমরা কীভাবে করব? আমাদের তো শুধু নির্বাচনী খরচ নয়, নির্বাচনের জন্য ‘খরচ’ হয়ে যাওয়া জীবনগুলোর হিসাব আমরা ব্যালান্স শিটে কীভাবে ঢোকাব? প্রশ্নটি যেখানে জীবনের, সেখানে ১ সংখ্যাটিও যে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংখ্যা।
২০০৬ সালের অক্টোবরে এর আগে যখন বাংলাদেশে আরেকটি নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল, তখন মাসের শেষ চার দিনে ‘খরচ’ হয়ে গিয়েছিল জনা তিরিশেক লোক। এবার ২৫ অক্টোবর থেকে এই সময় পর্যন্ত মাত্র ৬০ ঘণ্টার হরতাল গেছে, প্রাণ গেছে জনা বিশেকের। সামনে ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর সারা দেশে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি আসছে। আগের নির্বাচন থেকে পরের নির্বাচনে খরচ বাড়ে—এই নিয়ম কি প্রাণ ‘খরচের’ ক্ষেত্রেও খাটবে?
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, ‘পরিস্থিতির বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এসব প্রস্তাব ও পাল্টা-প্রস্তাব এবং দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপ শুরু হলো বলে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো আসলে মুখোশ।...এই যে আশাবাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই মুখোশের আড়ালে থাকা দল দুটির মুখটি সম্ভবত এ রকম: আওয়ামী লীগের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁর অবস্থানে অনড় থাকবেন এবং দলটি যেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে, সেভাবেই নির্বাচন করবে। অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থান হচ্ছে অন্য যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া ও নির্বাচন ঠেকানোর জন্য শেষ পর্যন্ত সংঘাত ও সহিংসতার পথ বেছে নেওয়া। পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে না? গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ‘খরচ’ আরও বাড়বে বলেই তো মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন মহামূল্যবান হতে পারে, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার মূল্যকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে রূপান্তর করা যেতে পারে, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র অমূল্য। আমরা এখনো গণতন্ত্রের মূল্য শোধ করে যাচ্ছি জীবনের বিনিময়ে। জীবনের দাম যেহেতু নির্ধারণ করা যায় না, আমাদের গণতন্ত্র তো অমূল্যই। আমরা কবে আমাদের গণতন্ত্রকে ‘অমূল্য’ অবস্থান থেকে মুক্তি দিতে পারব?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
দেশ হিসেবে ছোট ও দরিদ্র হলেও গণতন্ত্রের মতো একটি দামি বিষয় আমাদের দেশে রয়েছে। গণতন্ত্র এখন যে রূপ নিয়েছে, তাতে নির্বাচন এর একটি অপরিহার্য দিক। নির্বাচন ছাড়া আর যা-ই হোক গণতন্ত্র চলে না। বাংলাদেশে এখন ‘নির্বাচন পরিস্থিতি’ চলছে। এই নির্বাচন পরিস্থিতির একটি ‘আনুষ্ঠানিক’ যাত্রা শুরু হয়েছে ২৭ অক্টোবর থেকে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য এদিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে দেশে নির্বাচন করতে হবে। দিনটির একটি ভুল হিসাব হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর মুখে দিনটি ২৫ অক্টোবর বলে কয়েক দফা উচ্চারিত হয়েছিল। সর্বশেষ জাতির উদ্দেশে দেওয়া লিখিত ভাষণেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর থেকে ৯০ দিনের হিসাব গণনা শুরু হবে।’ কলাম লেখক ও সহকর্মী মিজানুর রহমান খান এ নিয়ে তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী অনেক আগে থেকেই ২৫ অক্টোবর কথাটি ব্যবহার করেছেন। এরপর তা খালেদা জিয়া লুফে নিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ২১ অক্টোবর)। একটি ‘রাজনৈতিক তারিখ’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় ২৫ অক্টোবর দিনটি। ফলে ভুল করে হলেও নির্দিষ্ট দিনের দুই দিন আগের এই দিনকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নির্বাচনের পথে যাওয়ার এই দিনটি ‘উদ্যাপিত’ হলো পাঁচটি প্রাণের বিনিময়ে।
এই যে শুরু, তার আর থামাথামি নেই। এরপর ২৭ অক্টোরব নির্বাচনের প্রকৃত ক্ষণগণনা শুরুর দিনে প্রাণ গেল আরও পাঁচজনের, ২৮ অক্টোবর চারজন ও ২৯ অক্টোরব চারজন। আমরা চাই বা না চাই, মৃত্যুর মিছিলের এই ধারাবাহিকতা সামনের দিনগুলোতেও বজায় থাকবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার টেলিফোন সংলাপ (নাকি ঝগড়া?) আমরা শুনে ফেলেছি। ফলে সংঘাত ও সহিংসতাই যে সামনের দিনগুলোর বাস্তবতা, তা নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে। আর আমাদের অভিজ্ঞতাই বলছে, নির্বাচন মানেই নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতা। যে গণতন্ত্রের জন্য আমরা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, তার মূল্য হিসেবে সামনের দিনগুলোতে আমাদের ‘উৎসর্গ’ করতে হবে আরও অনেক জীবন।
জন্মের দিন থেকেই আমাদের এই দেশ ‘গণতান্ত্রিক’। সব দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। সে হিসেবে বাংলাদেশকে একটি ভাগ্যবান দেশই বলতে হবে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে একধরনের জাতীয় ঐকমত্যও রয়েছে দেশে। দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলই কাজ করে যাচ্ছে ‘গণতন্ত্রের জন্য’। গণতন্ত্রের প্রতি দেশের সব রাজনৈতিক শক্তির ‘অঙ্গীকার’ এতই ‘দৃঢ়’ যে এ জন্য যেকোনো ‘ত্যাগ’ স্বীকারে তারা সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। ফলে জন্মের ৪২ বছর পরও গণতন্ত্র ধরে রাখতে সামনে যে নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে, সেটার জন্য সব পক্ষই ‘ত্যাগ স্বীকার’ করতে প্রস্তুত হয়ে মাঠে নেমেছে। সবাই নির্বাচন চায়, কিন্তু নিজেদের মতো করে। আমাদের দেশে এখন নির্বাচনকে নিজেদের মনের মতো করতে পারাই যে ‘গণতন্ত্র’ হয়ে উঠেছে! বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট ৬০ ঘণ্টার যে হরতাল পালন করল, সামনে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচিসহ আরও যেসব কর্মসূচি আসছে, যে মানুষগুলো প্রাণ দিল বা সামনে যারা দেবে, এর সবই হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’। আর আওয়ামী লীগ বা মহাজোট নিজেদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করে যে নির্বাচন করতে চাইছে, সেটাও পুরোপুরি ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’। এ পর্যন্ত রাজনৈতিক হানাহানিতে যে দলের যারাই মারা গেছে, প্রাণ হারিয়েছে বা দিয়েছে, সব প্রাণই গেছে গণতন্ত্রের জন্য। সবকিছুরই একটি আর্থিক হিসাব করা যায়, যেকোনো ক্ষতিকেই অর্থমূল্যে বিবেচনা করা যায়। আগের সব হিসাব যদি বাদও দিই, ২৫ অক্টোবর থেকে ‘গণতন্ত্রের’ জন্য যে জনা বিশেক লোক প্রাণ দিল, এই মৃত্যুগুলোকে কী কোনোভাবে আর্থিক ক্ষতিতে রূপান্তর করা যাবে? হিসাব করা যাবে, কত ক্ষতি হলো? কতটা মূল্য দিন পাঁচেকের মধ্যেই আমরা দিলাম গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার একটি নির্বাচনের জন্য!
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের যে চর্চা দুনিয়াজুড়ে চলছে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রের জন্য ‘খরচের’ একটা হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব। গণতন্ত্র বজায় রাখতে যে নির্বাচন করতে হয়, তার খরচের হিসাব সহজেই করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরি। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচনগুলোতে প্রার্থীরা, রাজনৈতিক দলগুলো ও বিভিন্ন স্বাধীন গ্রুপ মিলিয়ে নির্বাচনে খরচ করেছিল ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন দল, প্রার্থী ও প্রতিষ্ঠান মিলে প্রচারণার কাজে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বলে মার্কিন ফেডারেল নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। ‘গণতন্ত্রের জন্য’ মার্কিনরা কতটা ‘খরচ’ করছে বা মূল্য দিচ্ছে, তার একটি হিসাব হলেও করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বছর বছর যেমন সবকিছুরই খরচ বাড়ে, গণতন্ত্রের জন্য খরচও একইভাবে বাড়ে। অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের ক্ষেত্রেই এ ধরনের একটি হিসাব বের করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের হিসাবটি আমরা কীভাবে করব? আমাদের তো শুধু নির্বাচনী খরচ নয়, নির্বাচনের জন্য ‘খরচ’ হয়ে যাওয়া জীবনগুলোর হিসাব আমরা ব্যালান্স শিটে কীভাবে ঢোকাব? প্রশ্নটি যেখানে জীবনের, সেখানে ১ সংখ্যাটিও যে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংখ্যা।
২০০৬ সালের অক্টোবরে এর আগে যখন বাংলাদেশে আরেকটি নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিল, তখন মাসের শেষ চার দিনে ‘খরচ’ হয়ে গিয়েছিল জনা তিরিশেক লোক। এবার ২৫ অক্টোবর থেকে এই সময় পর্যন্ত মাত্র ৬০ ঘণ্টার হরতাল গেছে, প্রাণ গেছে জনা বিশেকের। সামনে ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর সারা দেশে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি আসছে। আগের নির্বাচন থেকে পরের নির্বাচনে খরচ বাড়ে—এই নিয়ম কি প্রাণ ‘খরচের’ ক্ষেত্রেও খাটবে?
গত সপ্তাহে লিখেছিলাম, ‘পরিস্থিতির বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এসব প্রস্তাব ও পাল্টা-প্রস্তাব এবং দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বা সংলাপ শুরু হলো বলে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো আসলে মুখোশ।...এই যে আশাবাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই মুখোশের আড়ালে থাকা দল দুটির মুখটি সম্ভবত এ রকম: আওয়ামী লীগের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁর অবস্থানে অনড় থাকবেন এবং দলটি যেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে, সেভাবেই নির্বাচন করবে। অন্যদিকে, বিএনপির অবস্থান হচ্ছে অন্য যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া ও নির্বাচন ঠেকানোর জন্য শেষ পর্যন্ত সংঘাত ও সহিংসতার পথ বেছে নেওয়া। পরিস্থিতি কি সেদিকেই যাচ্ছে না? গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ‘খরচ’ আরও বাড়বে বলেই তো মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র রক্ষার নির্বাচন মহামূল্যবান হতে পারে, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার মূল্যকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে রূপান্তর করা যেতে পারে, কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র অমূল্য। আমরা এখনো গণতন্ত্রের মূল্য শোধ করে যাচ্ছি জীবনের বিনিময়ে। জীবনের দাম যেহেতু নির্ধারণ করা যায় না, আমাদের গণতন্ত্র তো অমূল্যই। আমরা কবে আমাদের গণতন্ত্রকে ‘অমূল্য’ অবস্থান থেকে মুক্তি দিতে পারব?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments