রাষ্ট্র ও রাজনীতি- নিজের মঙ্গল নিজেকেই বুঝতে হবে by আবদুল মান্নান
দেশে এখন ক্ষমতার জন্য একরকম মরণপণ যুদ্ধ
চলছে। খালেদা জিয়া তাঁর নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট নিয়ে সামনের নির্বাচনে
যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া।
এই ১৮ দলকে
জনগণ সমর্থন দিলে বেগম জিয়ার বিএনপিই ক্ষমতায় যেতে পারে। বাকিদের মধ্যে
জামায়াত ছাড়া অন্যরা হচ্ছে ওয়ানম্যান পার্টি। কোনো কোনোটিতে আসলে
ওয়ানম্যানও নেই। জামায়াতের এই মুহূর্তে ক্ষমতায় যাওয়ার বা তার অংশীদার
হওয়ার তেমন খায়েশ নেই। তারা চায়, তাদের বড় মিত্র বিএনপি ক্ষমতায় যাক
এবং তা যদি সম্ভব হয়, তাহলে তাদের শীর্ষপর্যায়ের যেসব নেতা বর্তমানে
মানবতাবিরোধী আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে দেশের শীর্ষ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়ে
কারা ভোগ করছেন, তাঁরা মুক্তি পাবেন। খালেদা জিয়া একাধিকবার পরিষ্কার
ভাষায় বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের এই ঘাতকদের (রাজবন্দীদের)
মুক্তি দেবেন এবং এঁদের বিচারকার্য বন্ধ করে দেবেন।
বলা বাহুল্য, ক্ষমতায় যেতে পারলে বেগম জিয়া ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলার মামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্র খালাস মামলা, তারেক রহমান আর কোকোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাসহ তাঁদের বিরুদ্ধে অন্য যেসব বিচারাধীন মামলা চলমান আছে, তার সবগুলোরই পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। বেগম জিয়া আর তাঁর মিত্ররা ঠিক এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন, এই নির্বাচনে জিততে হলে তা আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে হতে হবে। এই ব্যবস্থা যদিও সংবিধানবহির্ভূত ছিল, তা ১৯৯৬ সালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছিল তাঁর সেই সময়কার শাসনামলের মাগুরা আর ঢাকা-১০ উপনির্বাচনের নামে জাতিকে এক তামাশা উপহার দেওয়ার কারণে। সেই ব্যবস্থাকে আবার তিনিই ২০০৬ সালে নষ্ট করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় বলতে হয়, এটি ছিল দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার, যা বেগম জিয়া নিজেই ২০০৬ সালে করাপ্ট করেছেন। করাপ্ট সফটওয়্যার দিয়ে প্রোগ্রাম চালু করা যায় না।
বর্তমানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য খালেদা জিয়া আর তাঁর মিত্ররা দেশকে জিম্মি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাকে আবার দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১১ সালে সংবিধানের মূল চেতনা ও কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্যক্তি ও গণমাধ্যম প্রায়ই বলে থাকে, উচ্চ আদালত নাকি আগামী দুটি নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এটি অর্ধসত্য বক্তব্য। যে মামলাটি নিয়ে এত কথাবার্তা, সেই মামলার তর্কিত বিষয় ছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বৈধতা নিয়ে। সেই মামলায় অন্য কোনো বিষয় বিচার্য ছিল না। আদালতের রায়টি (কোর্ট অর্ডার) এক লাইনের ছিল এবং তাতে বলা হয়, ‘তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ’ (মূল আদেশটি ইংরেজিতে দেওয়া)।
রায়ের বাইরে আদালত একাধিক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যাকে বলা হয় অবশ্যপালনীয় নয় (নন-বাইন্ডিং)। এর একটি ছিল এই রকম: ‘...তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাময়িকভাবে শুধুমাত্র পরবর্তী দুইটি সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে থাকিবে কি না, সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদ লইতে পারে।...তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণকে বাদ দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করিতে পারে...বরঞ্চ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধুমাত্র জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে। কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের basic structure এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির উপর সার্বিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে।’
ত্রয়োদশ সংশোধনীবিষয়ক রায় পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, কোনো কোনো বিশ্লেষক অনেকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুই মেয়াদের বিষয়টিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন এবং এই ব্যাখ্যাগুলোকে কেন্দ্র করে গত দুই বছর বিরোধী দল দেশে একটি চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করে প্রচুর জানমালের ক্ষতি সাধন করেছে। কেউ কেউ আবার ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিনের হরতাল প্রসঙ্গটি তুলে আনেন। প্রথমে বলে নিই, জনজীবন বিপর্যস্তকারী জবরদস্তিমূলক হরতালে আমার সমর্থন নেই। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য যে হরতালগুলো হয়েছিল, তার ক্ষেত্র অনেকটা তিনি নিজেই তৈরি করেছিলেন। তা না হলে সেই সময়কার বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী তাঁর সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। ২০১১ বা তার পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকার তো সে রকম কোনো পরিস্থিতি তৈরি করেননি। তাহলে কেন দেশে এমন একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা?
আমার সঙ্গে হয়তো অনেকে দ্বিমত পোষণ করবেন। তার পরও বলতে হয়, বরং সার্বিক বিচারে এটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে বর্তমান সরকার নির্বাচনের পুরো বিষয়টাকে একটি সাংবিধানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে একটা গোঁজামিলের ব্যবস্থা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। আর কী বিশ্বাসেই বা এটি মনে করা যথাযথ হবে যে বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদ দুই মেয়াদ পর ফেরেশতা হয়ে যাবেন? পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ সংবিধান পরিবর্তন করে বিচারব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণের নামে দেশের ছয়টি জেলায় স্থায়ীভাবে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করেন। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা হয় এবং সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রায় সব প্রথিতযশা আইনবিদ মামলার বাদীর পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত সংবিধানের এই ধারাকে সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী বলে তা বাতিল করে দেন। এরপর সংবিধান তার আগের অবস্থায় ফিরে যায় এবং এ সম্পর্কে কোনো মহল থেকে আর কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়নি।
সবাই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন, দুই নেত্রীর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটি সংলাপ হলে সমস্যাটি সমাধানের হয়তো একটা সূত্রপাত হবে। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু সেই ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধীদলীয় নেতার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে দেশের মানুষ শুনেছে এবং দেখেছে বিরোধীদলীয় নেতার উত্তেজিত ভাষায় কথা বলার ভঙ্গি। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর চরম সমালোচনাকারীও তাঁর নমনীয় আচরণের প্রশংসা করবেন। বিরোধীদলীয় নেতা শুক্রবার বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আলোচনার উদ্যোগ না নিলে রোববার ভোর থেকে (তখন আসলে ৩৬ ঘণ্টা হবে) টানা ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরু হবে। শেখ হাসিনা ২৪ ঘণ্টা আগেই তাঁকে ফোন করে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করলেন। কিন্তু বেগম জিয়া তাঁর আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে না এসে বললেন, হরতাল চলবে।
কার ক্ষতি হলো এই গণবিরোধী হরতালে? নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির। হাজার হাজার হাজি দেশে ফিরে বিমানবন্দরের বাইরে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হলেন। ‘ও’ লেভেলের প্রায় ১০ হাজার পরীক্ষার্থী তাদের পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে শিক্ষাজীবনের একটি বছর হারিয়ে ফেলেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল ঘোষণা দিয়েছে, পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে তারা বাংলাদেশে পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে দেবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে দেশের প্রায় চার কোটি পরীক্ষার্থী বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে এবং তারাও একই ভোগান্তিতে পড়বে।
কারণ, এরই মধ্যে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে, তারা ৪ থেকে ৬ নভেম্বর দেশের রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করবে। তিন দিনের হরতালে প্রাণহানি হয়েছে ১৫ জনের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলার চিফ প্রসিকিউটর ও তুরিন আফরোজের বাসায় বোমা হামলা হয়েছে। ঢাকা সিএমএম কোর্টে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সাঈদীর মামলার সাক্ষীর বাড়িতে শিবিরের দুর্বৃত্তরা হামলা করে লুটপাট করেছে। একই সঙ্গে তারা বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে। প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের বাড়িতে হামলা হয়েছে। হরতাল শুরু হওয়ার আগে থেকেই গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে। একাত্তর টিভির বার্তাকক্ষের সম্পাদক বিপ্লব পিকেটারদের হামলার স্বীকার হয়ে একটি পা হারানোর পথে।
এসব দুর্বৃত্তপনা আর নৈরাজ্যের দায়িত্ব তো অবশ্যই বিরোধী দলকে নিতে হবে; যদিও যারা নিরপেক্ষতার ভান করে গা বাঁচাতে চায়, তারা বলবে, এর দায়দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। আসল বাস্তবতা হচ্ছে, খালেদা জিয়া বর্তমানে কাগজে-কলমে বিএনপির প্রধান; কিন্তু কাজ, কথাবার্তা ও আচার-আচরণে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, তিনি জামায়াতের স্বার্থ রক্ষা করতে অনেক বেশি তৎপর। সদ্য সমাপ্ত হরতালটিও অনেকের মতে জামায়াতের কারণে প্রত্যাহার করা হয়নি এবং এমনটা চলতে থাকলে তিনি নিজের দলের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলবেন বলে অনেকের ধারণা। এটি বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য কখনো মঙ্গল হতে পারে না। নিজে নিজের মঙ্গল না বুঝলে অন্যের পক্ষে তা বোঝানো সম্ভব নয়।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments