খোলা চোখে- নির্বাচন, তারপর কী? by হাসান ফেরদৌস
বাংলাদেশে এখন আলোচনার একটাই
বিষয়—রাজনীতি। পত্রপত্রিকা, টিভি বা ইন্টারনেট যা-ই বলুন—সবখানেই আলোচনা
ঘুরেফিরে ওই এক বিষয়েই, তাও মুখ্যত নির্বাচন যথাসময়ে হবে কি না, আর হলে
তাতে জিত হবে কার।
বলাই বাহুল্য, আমরা সবাই যে যার নিজের
ঝান্ডার নিচে, যার যার দলের পক্ষে তারস্বরে চেঁচাচ্ছি। একই কথা ঘুরেফিরে
এতবার এতভাবে যে বলা যায়, বাংলাদেশের কলাম লেখক ও টিভির টক শোওয়ালাদের
চলতি কসরত না দেখলে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব ছিল।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্নে নাগরিক সংলাপ গণতন্ত্রের একটি আবশ্যকীয় উপাদান। বাংলাদেশের চলতি বাদানুবাদকে সুস্থ ভাবা যেত, যদি এর ফলে দেশের মৌল সমস্যাগুলো চিহ্নিত হতো ও তার সমাধানের একটি রূপরেখা পাওয়া যেত। বলাই বাহুল্য, সে আশায় গুড়ে বালি। নির্বাচন যদি সময়মতো হয়, তাতে দুই প্রধান দলের কেউ একটি জিতবে, কিন্তু তারপর কী? যাঁরা দেশ চালাবেন, তাঁরা কি জানেন দেশের মুখ্য সমস্যাগুলো কী এবং সেসবের সমাধানে তাঁরা কী ব্যবস্থা নেবেন? ধরে নিই তাঁরা জানেন, কিন্তু সেসব নিয়ে তো দুই দলের কেউই খোলাসা করে দেশের মানুষকে কিছু বুঝিয়ে বলেননি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে নির্বাচকেরা তাঁদের ভোটের সিদ্ধান্ত নেবেন? এমপি সাহেব-সাহেবানরা তাঁদের নেতা-নেত্রীর মুখ চেয়ে আইন পরিষদে ভোট দেন। দেশের মানুষকেও কি সেই পথই ধরতে হবে?
সাবালক গণতন্ত্রের একটি লক্ষণ হলো, সব প্রধান জাতীয় প্রশ্নে নাগরিক সংলাপ। যেকোনো নতুন জাতীয় নীতি গৃহীত হলে তার প্রভাব পড়বে দেশের মানুষের ওপর। সে কারণে ক্ষমতায় আছি বলেই একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শাসক দলের নেই। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক আমেরিকার নতুন স্বাস্থ্যবিমা আইন। প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ, যাদের কোনো স্বাস্থ্যবিমা নেই, এই আইন বাস্তবায়িত হলে তাদের অধিকাংশ বিমা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে। যেহেতু এই স্বাস্থ্যবিমা একটি ম্যান্ডেট, অর্থাৎ এই বিমা গ্রহণ বাধ্যতামূলক, ফলে কেউ সে বিমা গ্রহণ না করলে অল্পবিস্তর জরিমানার সম্মুখীন হবে। এত বড় একটা নীতিগত প্রশ্ন, নেতা-নেত্রীরা ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ওবামা প্রশাসন গত চার বছর এই নিয়ে শত শত মিটিং করেছে, পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে কথা বলেছে, রেডিও-টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছে, নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রীয় বিষয় থেকেছে স্বাস্থ্যবিমার প্রশ্নটি। ওবামা নিজে ২০০৯ ও ২০১০ সালে মোট ৪২৩ দিনে ৪৭১টি ভাষণ দিয়েছেন স্বাস্থ্যবিমা প্রশ্নে। সিবিএস নিউজ সেসব ভাষণের প্রতিটি গুনে গুনে তার একটি তালিকাও তৈরি করেছিল।
আমাদের দেশে অবশ্য সেসবের কোনো বালাই নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো এত বড় একটা মৌলিক শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে পরিবর্তন আনা হলো। অথচ সরকারি দল নিজেদের বাইরে এ নিয়ে কারও সঙ্গে মতবিনিময়ের কোনো প্রয়োজন দেখেনি। টক শোতে ‘বাচাল শ্রেণী’ (ইংরেজিতে বলে ‘চ্যাটারিং ক্লাস, আমি কেবল তার একটি শোভন প্রতিশব্দ ব্যবহার করেছি) অবশ্য হাম্বা-হাম্বা অথবা হালুম-হুলুম নিনাদে যার যার দলের অভিমত তুলে ধরেছেন। কিন্তু সে তো টক শো, অর্থাৎ মধ্যরাতের মনোরঞ্জন। সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ তাকে জাতীয় প্রশ্নে সংলাপ বলবেন না। সুশীল শ্রেণীও যে এ নিয়ে কিছু করেছে, তা নজরে আসেনি। পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে বটে, কিন্তু তার অধিকাংশই বাতাসে তরবারি ঘোরানো ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচনের অর্থ আগামী পাঁচ বছরের জন্য নতুন শাসকমণ্ডলী নির্ধারণ। যাঁরা নির্বাচিত হতে চান, তাঁদের কাছে আমাদের প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত: আপনি কেন নির্বাচিত হতে চান? নির্বাচিত হলে আপনি অথবা আপনার দল ঠিক কী কাজটা করবে, এখন যা হচ্ছে তার চেয়ে ভিন্ন? এখানে আমি নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বলছি না, নির্বাচনের আগে দু-চারজন ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী এক ঘরে বসে সে ইশতেহার দুই দিনে লিখে সারবেন, তা আমরা জানি। আমাদের মৌলিক সমস্যাগুলো কী, তা নিয়ে একটি ধোঁয়াটে ধারণা আমাদের হয়তো আছে। যাঁদের পক্ষে বা বিপক্ষে আমরা ভোট দেব, তার আগে সেসব ইস্যু নিয়ে প্রতিটি প্রার্থীর নিজের বা তাঁর দলের অবস্থান কী, তা খোলাসা করে জানানো।
ধরা যাক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন, দেশের অধিকাংশ মানুষের এই প্রশ্নে একটি সুনির্দিষ্ট অভিমত রয়েছে। চলতি ক্ষমতাসীন দল এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে, কিন্তু প্রধান বিরোধী দলের কাছ থেকে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু শোনা যায়নি। শিক্ষানীতি, বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে, চলতি সরকার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সে প্রস্তাব উত্থাপনের আগে এ শিক্ষা খাতে যাঁরা জড়িত, তাঁদের মতামত নেওয়া প্রয়োজন। ভোটপ্রার্থী প্রতিটি প্রধান দলের কাছেই আমাদের জিজ্ঞাস্য, মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান কী? পরিবেশ ভারসাম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুন্দরবন এলাকায় কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বর্তমান সরকার। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়েছে, সেটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। বাকি দল এ নিয়ে কী ভাবে? সারা বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। দেশের মানুষকে এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে চলতি সরকার রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র তৈরির চুক্তি করে ফেলল। এই প্রশ্নে ভোটপ্রার্থী সব দলের অবস্থান খোলাসা হওয়া প্রয়োজন। পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম ঘণ্টাওয়ারি বেতন ও তাঁদের কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা একটি পুরোনো সমস্যা। অথচ এ নিয়েও কোনো দল থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো কথা শুনিনি। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের হরেক রকম জটিলতা আছে। সেসব প্রশ্নেই বা কার কী অবস্থান?
এর বাইরেও রয়েছে আরও অসংখ্য মৌলিক প্রশ্ন। এখানে তার তালিকা দেওয়া অবান্তর, সে তালিকা প্রস্তাব করাও আমার আলোচনার লক্ষ্য নয়। আমি শুধু এই দাবিটুকু উত্থাপন করতে চাই, যাঁরা এখন নির্বাচনের দামামা বাজাচ্ছেন, তাঁদের স্পষ্ট করে জানাতে হবে, নির্বাচিত হলে তাঁরা প্রতিটি প্রধান জাতীয় প্রশ্নে কোন নীতি অনুসরণ করবেন। তাঁদের নির্বাচনী প্রতীক দেখে নয়, জাতীয় প্রশ্নে তাঁদের প্রমাণিত-পরীক্ষিত অবস্থানের ভিত্তিতে কাকে ভোট দেবেন, সে সিদ্ধান্ত নেবেন দেশের মানুষ। মানছি, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ভোটের প্রশ্নে এখনো মোড়ল সাহেব যা বলেন, তা-ই সহি বলে মেনে নেন। কিন্তু সে অবস্থার পরিবর্তন দরকার, অন্যথায় গণতন্ত্র তার শৈশব অবস্থা অতিক্রম করতে পারবে না।
ভোটারদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে দেশের তথ্যমাধ্যম। আমাদের দেশের তথ্যমাধ্যম, বিশেষত ইলেকট্রনিক তথ্যমাধ্যম গণতন্ত্র ব্যাপারটাকে এখনো ‘এন্টারটেইনমেন্ট’-এর বাইরে কিছু বলে ভাবে না। তাদের কাছ থেকে দায়িত্ববোধের আশা দূর অস্ত। কিন্তু মুদ্রণমাধ্যম, বিশেষত দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে অধিকতর দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবে, এমন আশা আমরা করতে পারি। প্রথম আলোর কাছেই আমি প্রস্তাব রাখছি। দেশের সামনে ২০ বা ৩০টি প্রধান ইস্যু চিহ্নিত করে প্রতিদিন তার একটি করে আলোচনা হোক। (নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের আগে দুই প্রধান প্রার্থীর অবস্থান জানার জন্য এই শহরের পাবলিক রেডিও ‘থার্টি ইস্যুজ ইন থার্টি ডেজ’ প্রচার করেছে। আইডিয়াটা সেখান থেকে ধার করা।) প্রধান দলগুলোর কাছ থেকে জানতে চাওয়া হোক, সেসব প্রশ্নে তাদের অবস্থান কী। অনুমান করি, দলগুলো নিজেরাই সে প্রশ্নের উত্তর জানে না। কিন্তু তথ্যমাধ্যমের মুখোমুখি হলে নিজের অবস্থান খোলাসা তাদের করতেই হবে।
যাঁরা এই মৌলিক দায়িত্বটুকু পালনে ব্যর্থ হবেন, দেশের মানুষের কাছে ভোটের দাবি তোলার যোগ্যতা তাঁদের নেই, এমন সিদ্ধান্ত আমরা অনায়াসেই নিতে পারি।
নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments