লাশের দ্বীপ ফিলিপিন্সে নৈরাজ্যের দাপট
নিষ্প্রাণ ফিলিপিন্সের এলাকাগুলোতে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবাধ অরাজকতা। নিষ্ঠুর নৈরাজ্যে নাজেহাল সদ্য হুঁশে আসা দ্বীপরাষ্ট্রের ডাঙা। প্রকৃতি দৈত্য টাইফুনের কবল থেকে মুক্ত হতে না হতেই মানুষের জঙলে বসবাসরত বর্বর ক্ষুধা দানবের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বিশেষ বাহিনী নামাতে হয়েছে ফিলিপিন্স সরকারকে। উদ্ধারকাজের পাশাপাশি চলেছে আইন-শৃংখলা ফেরানোর চেষ্টাও। রাতে ‘কারফিউ’ জারি করা হয়েছে তাকলোবানে। তথ্য বলছে, মঙ্গলবার তাকলোবানের মোট ২৯৩ জন পুলিশকর্মীর মধ্যে কাজে এসেছিলেন মাত্র ২০ জন।
বাকিদের বেশিরভাগই মৃত অথবা নিখোঁজ। তাকলোবান আপাতত তাই প্রশাসনহীন। সুযোগ বুঝে জাঁকিয়ে বসছে অপরাধ চক্র। মঙ্গলবারই সেখানকার একটি জেল ভেঙে পালিয়েছে বেশ ক’জন বন্দি। এদিকে মঙ্গলবার নতুন একটি নিরক্ষীয় ঝড়ের জেরে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে। ফলে বাধা পাচ্ছে উদ্ধারকাজ। তাকলোবানের বহু এলাকায় এখনও কোমর সমান জল। তাতে ভেসে বেড়াচ্ছে অগনতি দেহ। গণসমাধির আয়োজন করছে প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কুলোচ্ছে না। আর যারা কোনোক্রমে বেঁচে গেছেন, তাদের কী অবস্থা? খাবার নেই, ওষুধ নেই। পানীয়জল তা-ও মিলছে না। সহায়সম্বলহীন মানুষগুলো তাই মারমুখী হয়ে উঠেছেন। তাকলোবানের এক দোকান-মালিক এমা বারমেজো বললেন, ‘মানুষ অসম্ভব ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। আর ক’দিনের মধ্যে এরা নিজেরাই একে অপরকে মারতে শুরু করবেন।’ কিন্তু তার পরই এমার প্রশ্ন, ‘আমার ব্যবসা শেষ। দোকানটা পুরোটাই লুট হয়ে গেছে। যদি খাবার এবং পানি চুরির জন্য এসব হতো, তার মানে ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও টিভি, ওয়াশিং মেশিন চুরি? লজ্জার ব্যাপার।’ লজ্জার কথা স্বীকার করছেন এডওয়ার্ড গুয়ালবের্তোও। হাইয়ানের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত একটি গ্রামের কাউন্সিলর তিনি। তিনদিন ধরে পেটে একফোঁটাও দানাপানি পড়েনি। বাধ্য হয়ে তাই অন্যের ঘরে ঢুকে তাদের খাবার চুরি করে খেয়েছেন। তবে সে বাড়িতে কারও অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ বাসিন্দারা সবাই মৃত। আর সেই লাশের উপর পা রেখেই ঘরে ঢুকেছেন এডওয়ার্ড।
ম্লান মুখে বললেন, ‘এই কালান্তক টাইফুন সভ্যতার পাঠ ভুলিয়েছে আমাদের।’ বাস্তবিক। ফি বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৪টি টাইফুন আছড়ে পড়ে ফিলিপাইনে। কিন্তু এবারের মতো অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি প্রদেশ লেইট এবং সামারের অবস্থা শোচনীয় বললেও কম। বহু এলাকা পানির নিচে। পথে প্রান্তরে ভাসছে দেহ। বেশিরভাগই শিশুর। দেখেশুনে উদ্ধারকারী দলের ধারণা, এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি প্রাণ গেছে খুদেদেরই। অথচ পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। পানি পেরিয়ে এখনও প্রত্যন্ত জায়গায় পৌঁছতেই পারছে না উদ্ধারকারী দল। অগত্যা তাই বাবার কোলে সওয়ার হয়েই মর্গে পৌঁছচ্ছে শিশুকন্যার দেহ। কোথাও বা কোলের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মা। শোক, হাহাকার, কখনও বা পরিচিত মুখ খুঁজে বেড়ানো। ফিলিপিন্সের সমুদ্র-সংলগ্ন এলাকার ছবিটা কিছুটা এ রকমই। কিন্তু হাইয়ানের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে যে বেশ অনেকটা সময় লেগে যাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত প্রশাসন। ফিলিপিন্সের অর্থসচিব সিজার পুরিসিমার আশংকা, ঝড়ের ফলে নারকেল এবং ধানের ফলনে যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তাতেই আগামী বছরে আর্থিক বৃদ্ধি অন্তত ১ শতাংশ কমবে। সম্পত্তি, পরিকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি, তার হিসাব এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু সব কিছু পেরিয়ে ভেসে আসছে ক্যারল মামপাসের কণ্ঠস্বর ‘আমাদের আর কিছু রইল না। বাড়ি নেই, টাকা নেই, কোনো তথ্য-নথি নেই, পাসপোর্ট, স্কুলের রেকর্ড কিছুই নেই।’
No comments