সংলাপের স্বার্থেই মন্ত্রীদের পদত্যাগ by আবদুল বাছেত মজুমদার
মন্ত্রীদের পদত্যাগ নিয়ে অনেকের মত হচ্ছে, পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর হয়ে গেছে। আবার অনেকের মতে, রাষ্ট্রপতির কাছে জমা না দেওয়ায় কার্যকর হয়নি। এ নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া তো বলেই আসছেন, একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক।
আমি মনে করি, মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার ঘটনা জাতীয় সংলাপের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমি বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। নির্বাচন আসন্ন। প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকার গঠন করার প্রয়োজনে মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। এই পদত্যাগের বিধান সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে লেখা আছে। এতে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের পদ শূন্য হবে, যখন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার জন্য মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্রগুলো দেবেন। কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলছেন, পদত্যাগপত্র প্রদান করা হলেই মন্ত্রীদের পদ শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক তাঁদের এই ব্যাখ্যা যথার্থ নয় বলেই মনে করি। প্রশ্নটি হলো, প্রস্তাবিত যে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা করা হবে, তার পথ সুগম করার জন্যই প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রগুলো নিয়েছেন। এটা দ্বারা যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মন্ত্রীদের পদগুলো শূন্য হয়ে গেছে, সে কথা বলা যায় না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দল থেকেও মন্ত্রী নিতে চান। যখন তিনি মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করবেন, তখনই বর্তমান পদগুলো শূন্য ঘোষণা করা ঠিক হবে।
এখানে টেকনিক্যাল দিকের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়ার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উদারতা ও শুভেচ্ছাকে বড় করে দেখতে হবে। নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করার স্বার্থেই তিনি মন্ত্রীদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রগুলো জমা নিয়েছেন বলে ধারণা করি। এখন মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্রের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন না তুলে বিরোধী দলের উচিত হবে খোলা মন নিয়ে সমঝোতার পথে এগিয়ে আসা। তারা প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে অরাজকতার পথ পরিহার করে একটি গঠনমূলক পথে আসুক—এটাই এ মুহূর্তে জনগণের ঐকান্তিক অভিপ্রায়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মন্ত্রীদের পদগুলো এ মুহূর্তে শূন্য হলো কি শূন্য হলো না, সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো কি ক্ষুণ্ন হলো না, সে বিতর্কে অযথা সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পরে মন্ত্রীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ল কি উড়ল না, সেই বিষয়ে বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতার বিরাট উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখতে পাচ্ছি। অথচ তাঁরা হরতাল ডেকে দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন। আমরা আশা করব, তাঁরা হরতালের পথ পরিহার করে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারে যোগ দিয়ে নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখবেন। তাই বলব, মন্ত্রীদের পদত্যাগ প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের দাবিও অনেকাংশে মেনে নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি একচুলও নড়বেন না। কিন্তু সেখান থেকে সরে এসে তিনিই কিন্তু সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন।
এমনকি তিনি যখন নিজে থেকেই বিরোধীদলীয় নেতার দাবি অনুযায়ী তাঁর কাছে টেলিফোন করেছেন, গণভবনে তাঁকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন; তখন আমরা দেখলাম, বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর দেওয়া কথা থেকে সরে এলেন। তিনি ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে হরতাল প্রত্যাহার করলেন না। অর্থাৎ আলোচনার সুযোগটি তিনি নষ্ট করলেন। এখনো আবার একইভাবে কারিগরি প্রশ্নটি বড় করে সমঝোতার পথ রুদ্ধ করা সমীচীন হবে না। বিরোধী দলকে বুঝতে হবে, এই পদত্যাগপত্রগুলো প্রধানমন্ত্রী তাঁর হাতে নিয়েছেন রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে নয়; নিয়েছেন, তাঁরা যাতে আস্থার সঙ্গে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারেন। বিরোধী দলের মনে আস্থা বাড়াতেই পদত্যাগপত্রগুলো জমা নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ের প্রতি তাঁদের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ নিয়ে কূটতর্কে যাওয়া উচিত হবে না। এটা তাঁদের করতে হবে দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থেই। সর্বদলীয় সরকারে তাঁরা কোন কোন মন্ত্রণালয় চান,
সেই বিষয়ের সরাসরি প্রস্তাব দিতে এখন বাধা নেই। বিরোধী দলকে মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে তাঁদের সঙ্গে কে কথা বলবেন? এই প্রেক্ষাপটে তাই সংঘাত ছেড়ে তাঁরা সংলাপে বসুক জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। এমনকি আমি তো বলব, তাঁরা যদি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানের পদও আশা করেন, তাহলে সেটাও প্রধানমন্ত্রীর কাছেই বলতে হবে। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদে বহাল থাকতে হবে। সুতরাং মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়া নিয়ে বিতর্ক করার সময় এখন নয়। দেশের এই সন্ধিক্ষণে একটু প্রশস্ত মন নিয়ে উভয় পক্ষের একত্রে বসা উচিত। আবদুল বাছেত মজুমদার: আহ্বায়ক, সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ, সাবেক সভাপতি, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি।
No comments