কৌশলে ভুল করেছে বিরোধী দল by বদিউর রহমান
রাজনীতির
মারপ্যাঁচের কৌশলটাই বড় মজাদার। যারা সরাসরি এসব কৌশল আঁটেন, প্রয়োগ করেন
এবং অনেক সময়ে ঝুঁকি নেন, তাদের রাজনৈতিক বুকের পাটা বেশ বড় মাপের। তাদের
বুদ্ধিশুদ্ধি অবশ্যই সুদূরপ্রসারী। তাদের প্রাপ্তি বা পরিণতিও হয় দেখার
মতো। মওলানা ভাসানীর বেশ কিছু কৌশল আমরা দেখেছি, উপলব্ধি করেছি এবং তা
বাস্তবায়নের বড় ফলও সবাই দেখেছে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার কৌশলী সমর্থন
মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনকে আরও
জনপ্রিয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর ’৬৬-এর ছয়দফা এবং পরে ’৭১-এর ৭ মার্চ তখনকার
রেসকোর্স ময়দানের এক ঐতিহাসিক অদ্বিতীয় ভাষণ আরেক অকল্পনীয় কৌশলই বটে- যার
যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ এবং শেষ কথা, এবারের সংগ্রাম
আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। অথচ তারপরও
তিনি আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন, নিজে পালিয়ে না গিয়ে পাকিস্তানিদের হাতে ধরাও
দিয়েছেন। কিন্তু বাঙালির রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। ফলে বঙ্গবন্ধু
নেই, পাকিস্তানি কারাগারে, অথচ যুদ্ধ চলেছে তার নামে। কী আশ্চর্য জাদু যেন।
এটাই নেতৃত্ব, এটাই রাজনীতির কৌশল, আর এটাই হল বড় ঝুঁকি নেয়ার বড় বুকের
পাটা। সেই বঙ্গবন্ধুই আবার কৌশলের মারপ্যাঁচে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে
চরমভাবে ব্যর্থ হলেন। বাকশাল করে সমর্থন হারালেন, ঘৃণিত হলেন। সারা জীবন
গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে নিজেই নিজের হাতে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে শেষতক
নিজেও মরলেন, জাতিকেও অনেক বছরের জন্য মেরে গেলেন। তার উত্থান আর পতন দেখে
আমার কেবল ‘প্যাট্রিয়ট’ কবিতার কথা মনে পড়ে- ‘দাজ আই এন্টার অ্যান্ড দাজ আই
গো!’ মনে হয় যেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই অনেক আগে এ কবিতাটি লেখা হয়েছিল। একজন
পোয়েট অব পলিটিক্সের জন্য আরেকজন পোয়েট কী এক অনবদ্য কবিতাই না লিখে রেখে
গেলেন!
বাংলাদেশে হালে দু’নেতার কৌশল নিয়ে ভাবতে গেলে আমার আরও মজা লাগে। শেখ হাসিনা আর বেগম জিয়া কী কৌশল যে শুরু করলেন! একজন চেলাচামুণ্ডাদের দেয়া খেতাব জননেত্রী থেকে এখন যেন এফিডেভিট করে ‘দেশরত্ন’ হওয়ার মহাজোটের মহাখায়েশে ব্যস্ত। গাজীপুরের জনসভায় বড় ব্যানারে দেখা গেল তাকে দেশরত্ন লেখা হল। কারা যে এসব লেখে বুঝি না, কিন্তু শেখ হাসিনা কেন যে তা মেনে নেন তা তো আরও বুঝি না। দেশরত্ন বোধকরি চেলাচামুণ্ডাদের ভাষায় জননেত্রী থেকেও বড়, হয়তো হবেও বা, কিন্তু রাজনীতির এ সময়ে ‘খেতাব’ নিয়ে এ ব্যস্ততা বড় দৃষ্টিকটু বটে। হতে পারে ভাবটা এমন যে, ভোটের প্রচারণার এ সময়েই নাম ফাটানোর বড় সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। আর ডজন ডজন পাথরের যে সমাহার দেখা যায় তাতে মনে হয়, পারলে কেয়ামত পর্যন্ত এ দেশের যত উন্নয়ন হবে, সবই যেন তিনি এখনই উদ্বোধন করে দিয়ে যাবেন। সম্প্রতি প্রয়াত মান্না দের পাথরে নাম লেখা নিয়ে যে গান তার কথাও যেন আলীর (আওয়ামী লীগ) চাটুকাররা ভুলে গিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে তার তোষামোদকারীদের কেউ কেউ হালে রাষ্ট্রনায়কও বলা শুরু করেছেন। তারা বলতেই পারেন, তারা যে চাটুকার! কিন্তু আমি বলি, রাষ্ট্রনায়করা কি এভাবে ডজনে ডজনে উদ্বোধনের ভিত্তিপ্রস্তরের পাথরের নামের মেলা বসায়? হতে পারে, এগুলো ওই এলাকার জনগণের ভোট পাওয়ার একটা সস্তা কৌশল। কিন্তু জনগণ কি এখন এত বোকা নাকি? ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হলে এসব পাথরের অপব্যবহার হলেও কি আমরা অবাক হব? রাষ্ট্রনায়ক হলে তো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের সমাপ্তিতে উদ্বোধনেই তিনি যেতেন না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ একটা খবরের ঘোষণা দিয়েই তা চালু করে দিত। জনগণ কি বুঝত না কোন আমলে কারা এ উন্নয়ন করেছেন? হৃদয়ে নাম লেখালে পাথরের নাম কি আর থাকে? আবার মান্না দে! মান্না দে জিন্দাবাদ, মান্না দে চিরজীবী হোন।
তবে শেখ হাসিনা এক চুল নড়ে বেশ কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। টেলিফোনের আলাপের সময়ের আচরণ/মেজাজও তাকে সুবিধাজনক অবস্থানে এনেছে বলা যায়। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও তার অনেক অরাজনৈতিক আচরণসুলভ আচরণ থেকে এবার তিনি তুলনামূলকভাবে মুক্ত ছিলেন বলা চলে। টকশো আর লেখালেখিতে এসব নিয়ে, ৩৭ মিনিটের ‘ক্যারিকেচার’ নিয়ে কত যে বিশ্লেষণ, কত যে আঁতলামি আর মাতলামি! কেউ কেউ তো দু’নেত্রীর ফোনালাপকে ঐতিহাসিকও বলছেন। আমি বলি, এ ধরনের কথাবার্তা অর্থাৎ এ সংলাপকে ঐতিহাসিক বলাটা আস্ত ছাগলামি। বড় অসৌজন্যমূলক হয়ে গেল নাকি? বড় অভদ্রতা হল নাকি? সন্তান যদি মাকে মা বলে, বাপকে বাপ বলে- তা ঐতিহাসিক হবে কেন? এটা তো স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। হতে পারে কোনো কারণে সন্তান অনেক দিন মা-বাপের সঙ্গে কথা বলেনি, তাই বলে পরে বলাটা ঐতিহাসিক হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে কথা হওয়া তো দেশের জন্য, জাতির কাছে সন্তানের মা-বাপকে মা-বাপ বলার মতোই। এতদিন যে তাদের কথা হয়নি, সেটাই বরং ঐতিহাসিক, নজিরবিহীন ও আশ্চর্যের বিষয়। এতদিন কথা না বলে তারা দু’জন শুধু অপরাধই করেননি, তারা জাতির সঙ্গে বেয়াদবিই করেছেন। এ বেয়াদবির জন্য তাদের দু’জনেরই জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত। জাতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন, জাতিকে নিয়ে খেলবেন, এ খেলা থেকে জননেত্রী-দেশনেত্রী খেতাব ভোগ করবেন, অথচ দু’জন কারও সঙ্গে কেউ কথা না বলে জাতির সঙ্গে বেয়াদবি করবেন- এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
যাক, তবুও শেষতক টেলিফোনে তাদের সংলাপ হল, কখনও কখনও এ সংলাপকে ‘সঙের লাফ’ মনে হয়েছে। বেগম জিয়ার হাবভাব বেশ কঠোর ঠেকেছে। তিনি যে আপসহীন নেত্রী! হয়তো এবারও তিনি তাই হতে চেয়েছেন, আচরণে তাই দেখাতে চেয়েছেন, আলাপের সময়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ্য হয়েছে। হয়তো এ আলাপের রেকর্ড যে আমজনতা দেখে ফেলবে তা তিনি ভাবেননি, হতে পারে আলীর কূটকৌশল তিনি টের পাননি। তবে আমরা দু’নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশকে সাধুবাদ জানাই। রাজনৈতিক আলাপ কেন গোপন থাকবে? শেখ হাসিনা যদি প্রকাশের মানসিকতা নিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে থাকেন, আমি বলব এ কৌশলে তিনি লাভবান হয়েছেন। তার জনসমর্থন বেড়েছে। আমজনতা দু’নেত্রীর অঙ্গভঙ্গি, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, উচ্চারণের আবেগ-বিরক্তি সবই মূল্যায়ন করেছে। আমার দু’গ্রামের লড়াইয়ের কথা মনে পড়ল। কারা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তের জন্য শেষতক ঠিক হল দু’গ্রামের দু’পণ্ডিতের মধ্যে জ্ঞানের বচসা হবে, জ্ঞানের লড়াই হবে। যে পণ্ডিত হারবেন, সেই গ্রামের লোকই পরাজয় মেনে নেবে। উত্তম সিদ্ধান্ত, কেন অযথা রক্তক্ষয়, জীবননাশ। জ্ঞানী পণ্ডিত শক্ত ইংরেজির বাংলা জিজ্ঞেস করলেন- হর্নস অব ডাইলেমার অর্থ কী? কপাল গুণে অন্য গ্রামের কম জ্ঞানী-মূর্খ পণ্ডিত পেরে গেলেন- উভয় সংকট। এবার তার জিজ্ঞাসার পালা। জ্ঞান কম হলেও তার ধূর্ততা বেশ, তিনি বোঝেন মূর্খ গ্রামবাসী ইংরেজির আর কিই বা জানেন, তারা বাংলাই যা বোঝে। অতএব, তিনি জ্ঞানী পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন তো, আই ডু নট নো- এর বাংলা কী? যেইমাত্র জ্ঞানী পণ্ডিত জবাব দিলেন, আমি জানি না, অমনি মূর্খ পণ্ডিতের গ্রামবাসী লাঠি নিয়ে বিপক্ষ দলকে ‘হেরে গেছে, জানে না’ বলে তাড়াল। দু’নেত্রীর ফোনালাপের মধ্যে এমন কৌশল যদি থেকেও থাকে তবে বলতে হবে যে, তা-ও তো কৌশল, নাকি? খালেদা জিয়ার জন্মদিনকে নিয়ে রাসেলের প্রসঙ্গ টেনে এনে সস্তা সহানুভূতি পাওয়ার কৌশলী আকুতি আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, জনগণের মন জয়ের এবং খালেদা জিয়াকে খাটো করার লক্ষ্যেই এমনটি করা হয়েছে। কেউ ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করল কী করল না, তাতে ১৫ আগস্টের শোক বা ভাবগাম্ভীর্য কী করে কমে? শেখ হাসিনার এ ধরনের কথা বড় বিরক্তিকর বটে। খালেদা জিয়া ঠিকই বলেছেন, ১৫ আগস্ট কি কেউ জন্মাতে পারেন না? ১৯৪৬-এ তার জন্ম হলে তা তো ১৯৭৫-এর অনেক আগে, নয় কি? অতএব আমি বলি, জন্মদিন মিথ্যে হলেও খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, বঙ্গবন্ধুর শোকে তিনি কেন কেক কাটবেন না? যত বছর, তত পাউন্ডের কেক, বেশ মজা, তাই না?
সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়ে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার দু’দিনের আলটিমেটাম রক্ষা করেছেন। আলোচনার ব্যবস্থা তো শেখ হাসিনা করেছেন, নাকি? অতএব, খালেদা জিয়ার নিজের ঘোষিত ওয়াদা অনুসারে ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। হতে পারে শেখ হাসিনা নির্দলীয় সরকারের কথা বলেননি, সর্বদলীয় সরকারের কথা বলেছেন; আলোচনার কথা তো বলেছেন। অতএব, হরতাল প্রত্যাহার করলে বাজাদের জনসমর্থন বাড়ত, খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি উন্নত হতো, তার সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। ১৮ দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়- তার এ ধরনের বক্তব্য জনগণ গিলেনি, তাকে ‘বেইমান’ ভেবেছে, এবার কিন্তু আপসহীন ভাবেনি। ’৮৬-এ শেখ হাসিনা যখন এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে ‘জাতীয় বেইমান’ হবেন জেনেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটার্ন নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ‘জাতীয় বেইমান’ হয়েছিলেন, এবার খালেদাও তা-ই হলেন, অর্থাৎ ৮৬’র শেখ হাসিনার খেতাবটা ’১৩-এ এসে খালেদা নিলেন। আলোচনায় গিয়ে অবশ্যই সর্বদলীয় সরকার না মানতে পারতেন তিনি। নির্দলীয় সরকারের দাবি করতে পারতেন। হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলতে পারতেন, সংলাপে আসব, তবে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করছি না। তা না করে বাজাদ একটা বড় ‘মার’ খেল বটে। এবার আবার ৬০ ঘণ্টার, ৮৪ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে জেএসসি পরীক্ষাকে বেকায়দায় ফেলে বাজাদ আরেকটা বড় ‘মার’ খেল। বাজাদ সমর্থক জনগণের সন্তানদের মধ্যেও লাখ লাখ পরীক্ষার্থী রয়েছে, তারাও অসন্তুষ্ট। হরতাল ঘোষণা কৌশল হিসেবে ঠিক ছিল, কিন্তু সরকারের অনুরোধের পর প্রত্যাহার করা হতো আরও বড় লাভজনক কৌশল। তাতে জনসমর্থন অনেক বাড়ত, ঘোষণা দেয়া যেত- ঠিক আছে, ৬০ ঘণ্টার, ৮৪ ঘণ্টার হরতাল পরীক্ষার পরে দেয়া হবে। রাজনৈতিক কৌশলে পরপর দু’বার ৬০ ঘণ্টা করে এবং পরে ৮৪ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে, সংলাপে না গিয়ে বাজাদ মারই খেল। কোনো অর্জন হল না। জনসমর্থনের বেলায় বৃষ্টি বুঝে ছাতা ধরতে না পারলে গোঁয়ার্তুমি টিকে থাকে হয়তো, কিন্তু তা আপসহীন হয় না; তা হয় বরং রাজনৈতিক মার খাওয়া। বাজাদ এ বড় দুটি মার খেয়ে অবশ্যই বেশ জনসমর্থন হারিয়েছে এবং এতে আলী ফাউ সুবিধা পেয়ে গেল। একেই বলে রাজনীতি!
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
বাংলাদেশে হালে দু’নেতার কৌশল নিয়ে ভাবতে গেলে আমার আরও মজা লাগে। শেখ হাসিনা আর বেগম জিয়া কী কৌশল যে শুরু করলেন! একজন চেলাচামুণ্ডাদের দেয়া খেতাব জননেত্রী থেকে এখন যেন এফিডেভিট করে ‘দেশরত্ন’ হওয়ার মহাজোটের মহাখায়েশে ব্যস্ত। গাজীপুরের জনসভায় বড় ব্যানারে দেখা গেল তাকে দেশরত্ন লেখা হল। কারা যে এসব লেখে বুঝি না, কিন্তু শেখ হাসিনা কেন যে তা মেনে নেন তা তো আরও বুঝি না। দেশরত্ন বোধকরি চেলাচামুণ্ডাদের ভাষায় জননেত্রী থেকেও বড়, হয়তো হবেও বা, কিন্তু রাজনীতির এ সময়ে ‘খেতাব’ নিয়ে এ ব্যস্ততা বড় দৃষ্টিকটু বটে। হতে পারে ভাবটা এমন যে, ভোটের প্রচারণার এ সময়েই নাম ফাটানোর বড় সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। আর ডজন ডজন পাথরের যে সমাহার দেখা যায় তাতে মনে হয়, পারলে কেয়ামত পর্যন্ত এ দেশের যত উন্নয়ন হবে, সবই যেন তিনি এখনই উদ্বোধন করে দিয়ে যাবেন। সম্প্রতি প্রয়াত মান্না দের পাথরে নাম লেখা নিয়ে যে গান তার কথাও যেন আলীর (আওয়ামী লীগ) চাটুকাররা ভুলে গিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে তার তোষামোদকারীদের কেউ কেউ হালে রাষ্ট্রনায়কও বলা শুরু করেছেন। তারা বলতেই পারেন, তারা যে চাটুকার! কিন্তু আমি বলি, রাষ্ট্রনায়করা কি এভাবে ডজনে ডজনে উদ্বোধনের ভিত্তিপ্রস্তরের পাথরের নামের মেলা বসায়? হতে পারে, এগুলো ওই এলাকার জনগণের ভোট পাওয়ার একটা সস্তা কৌশল। কিন্তু জনগণ কি এখন এত বোকা নাকি? ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হলে এসব পাথরের অপব্যবহার হলেও কি আমরা অবাক হব? রাষ্ট্রনায়ক হলে তো কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের সমাপ্তিতে উদ্বোধনেই তিনি যেতেন না, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ একটা খবরের ঘোষণা দিয়েই তা চালু করে দিত। জনগণ কি বুঝত না কোন আমলে কারা এ উন্নয়ন করেছেন? হৃদয়ে নাম লেখালে পাথরের নাম কি আর থাকে? আবার মান্না দে! মান্না দে জিন্দাবাদ, মান্না দে চিরজীবী হোন।
তবে শেখ হাসিনা এক চুল নড়ে বেশ কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। টেলিফোনের আলাপের সময়ের আচরণ/মেজাজও তাকে সুবিধাজনক অবস্থানে এনেছে বলা যায়। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও তার অনেক অরাজনৈতিক আচরণসুলভ আচরণ থেকে এবার তিনি তুলনামূলকভাবে মুক্ত ছিলেন বলা চলে। টকশো আর লেখালেখিতে এসব নিয়ে, ৩৭ মিনিটের ‘ক্যারিকেচার’ নিয়ে কত যে বিশ্লেষণ, কত যে আঁতলামি আর মাতলামি! কেউ কেউ তো দু’নেত্রীর ফোনালাপকে ঐতিহাসিকও বলছেন। আমি বলি, এ ধরনের কথাবার্তা অর্থাৎ এ সংলাপকে ঐতিহাসিক বলাটা আস্ত ছাগলামি। বড় অসৌজন্যমূলক হয়ে গেল নাকি? বড় অভদ্রতা হল নাকি? সন্তান যদি মাকে মা বলে, বাপকে বাপ বলে- তা ঐতিহাসিক হবে কেন? এটা তো স্বাভাবিক, খুবই স্বাভাবিক। হতে পারে কোনো কারণে সন্তান অনেক দিন মা-বাপের সঙ্গে কথা বলেনি, তাই বলে পরে বলাটা ঐতিহাসিক হবে কেন? প্রধানমন্ত্রী আর বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যে কথা হওয়া তো দেশের জন্য, জাতির কাছে সন্তানের মা-বাপকে মা-বাপ বলার মতোই। এতদিন যে তাদের কথা হয়নি, সেটাই বরং ঐতিহাসিক, নজিরবিহীন ও আশ্চর্যের বিষয়। এতদিন কথা না বলে তারা দু’জন শুধু অপরাধই করেননি, তারা জাতির সঙ্গে বেয়াদবিই করেছেন। এ বেয়াদবির জন্য তাদের দু’জনেরই জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত। জাতিকে নিয়ে রাজনীতি করবেন, জাতিকে নিয়ে খেলবেন, এ খেলা থেকে জননেত্রী-দেশনেত্রী খেতাব ভোগ করবেন, অথচ দু’জন কারও সঙ্গে কেউ কথা না বলে জাতির সঙ্গে বেয়াদবি করবেন- এটা তো মেনে নেয়া যায় না।
যাক, তবুও শেষতক টেলিফোনে তাদের সংলাপ হল, কখনও কখনও এ সংলাপকে ‘সঙের লাফ’ মনে হয়েছে। বেগম জিয়ার হাবভাব বেশ কঠোর ঠেকেছে। তিনি যে আপসহীন নেত্রী! হয়তো এবারও তিনি তাই হতে চেয়েছেন, আচরণে তাই দেখাতে চেয়েছেন, আলাপের সময়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ্য হয়েছে। হয়তো এ আলাপের রেকর্ড যে আমজনতা দেখে ফেলবে তা তিনি ভাবেননি, হতে পারে আলীর কূটকৌশল তিনি টের পাননি। তবে আমরা দু’নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশকে সাধুবাদ জানাই। রাজনৈতিক আলাপ কেন গোপন থাকবে? শেখ হাসিনা যদি প্রকাশের মানসিকতা নিয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে থাকেন, আমি বলব এ কৌশলে তিনি লাভবান হয়েছেন। তার জনসমর্থন বেড়েছে। আমজনতা দু’নেত্রীর অঙ্গভঙ্গি, প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন, উচ্চারণের আবেগ-বিরক্তি সবই মূল্যায়ন করেছে। আমার দু’গ্রামের লড়াইয়ের কথা মনে পড়ল। কারা শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তের জন্য শেষতক ঠিক হল দু’গ্রামের দু’পণ্ডিতের মধ্যে জ্ঞানের বচসা হবে, জ্ঞানের লড়াই হবে। যে পণ্ডিত হারবেন, সেই গ্রামের লোকই পরাজয় মেনে নেবে। উত্তম সিদ্ধান্ত, কেন অযথা রক্তক্ষয়, জীবননাশ। জ্ঞানী পণ্ডিত শক্ত ইংরেজির বাংলা জিজ্ঞেস করলেন- হর্নস অব ডাইলেমার অর্থ কী? কপাল গুণে অন্য গ্রামের কম জ্ঞানী-মূর্খ পণ্ডিত পেরে গেলেন- উভয় সংকট। এবার তার জিজ্ঞাসার পালা। জ্ঞান কম হলেও তার ধূর্ততা বেশ, তিনি বোঝেন মূর্খ গ্রামবাসী ইংরেজির আর কিই বা জানেন, তারা বাংলাই যা বোঝে। অতএব, তিনি জ্ঞানী পণ্ডিতকে জিজ্ঞেস করলেন, বলুন তো, আই ডু নট নো- এর বাংলা কী? যেইমাত্র জ্ঞানী পণ্ডিত জবাব দিলেন, আমি জানি না, অমনি মূর্খ পণ্ডিতের গ্রামবাসী লাঠি নিয়ে বিপক্ষ দলকে ‘হেরে গেছে, জানে না’ বলে তাড়াল। দু’নেত্রীর ফোনালাপের মধ্যে এমন কৌশল যদি থেকেও থাকে তবে বলতে হবে যে, তা-ও তো কৌশল, নাকি? খালেদা জিয়ার জন্মদিনকে নিয়ে রাসেলের প্রসঙ্গ টেনে এনে সস্তা সহানুভূতি পাওয়ার কৌশলী আকুতি আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, জনগণের মন জয়ের এবং খালেদা জিয়াকে খাটো করার লক্ষ্যেই এমনটি করা হয়েছে। কেউ ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করল কী করল না, তাতে ১৫ আগস্টের শোক বা ভাবগাম্ভীর্য কী করে কমে? শেখ হাসিনার এ ধরনের কথা বড় বিরক্তিকর বটে। খালেদা জিয়া ঠিকই বলেছেন, ১৫ আগস্ট কি কেউ জন্মাতে পারেন না? ১৯৪৬-এ তার জন্ম হলে তা তো ১৯৭৫-এর অনেক আগে, নয় কি? অতএব আমি বলি, জন্মদিন মিথ্যে হলেও খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, বঙ্গবন্ধুর শোকে তিনি কেন কেক কাটবেন না? যত বছর, তত পাউন্ডের কেক, বেশ মজা, তাই না?
সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়ে শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার দু’দিনের আলটিমেটাম রক্ষা করেছেন। আলোচনার ব্যবস্থা তো শেখ হাসিনা করেছেন, নাকি? অতএব, খালেদা জিয়ার নিজের ঘোষিত ওয়াদা অনুসারে ৬০ ঘণ্টার হরতাল প্রত্যাহার করা উচিত ছিল। হতে পারে শেখ হাসিনা নির্দলীয় সরকারের কথা বলেননি, সর্বদলীয় সরকারের কথা বলেছেন; আলোচনার কথা তো বলেছেন। অতএব, হরতাল প্রত্যাহার করলে বাজাদের জনসমর্থন বাড়ত, খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি উন্নত হতো, তার সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটত। ১৮ দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়- তার এ ধরনের বক্তব্য জনগণ গিলেনি, তাকে ‘বেইমান’ ভেবেছে, এবার কিন্তু আপসহীন ভাবেনি। ’৮৬-এ শেখ হাসিনা যখন এরশাদের অধীনে নির্বাচনে গেলে ‘জাতীয় বেইমান’ হবেন জেনেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউটার্ন নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ‘জাতীয় বেইমান’ হয়েছিলেন, এবার খালেদাও তা-ই হলেন, অর্থাৎ ৮৬’র শেখ হাসিনার খেতাবটা ’১৩-এ এসে খালেদা নিলেন। আলোচনায় গিয়ে অবশ্যই সর্বদলীয় সরকার না মানতে পারতেন তিনি। নির্দলীয় সরকারের দাবি করতে পারতেন। হরতাল প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে বলতে পারতেন, সংলাপে আসব, তবে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করছি না। তা না করে বাজাদ একটা বড় ‘মার’ খেল বটে। এবার আবার ৬০ ঘণ্টার, ৮৪ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে জেএসসি পরীক্ষাকে বেকায়দায় ফেলে বাজাদ আরেকটা বড় ‘মার’ খেল। বাজাদ সমর্থক জনগণের সন্তানদের মধ্যেও লাখ লাখ পরীক্ষার্থী রয়েছে, তারাও অসন্তুষ্ট। হরতাল ঘোষণা কৌশল হিসেবে ঠিক ছিল, কিন্তু সরকারের অনুরোধের পর প্রত্যাহার করা হতো আরও বড় লাভজনক কৌশল। তাতে জনসমর্থন অনেক বাড়ত, ঘোষণা দেয়া যেত- ঠিক আছে, ৬০ ঘণ্টার, ৮৪ ঘণ্টার হরতাল পরীক্ষার পরে দেয়া হবে। রাজনৈতিক কৌশলে পরপর দু’বার ৬০ ঘণ্টা করে এবং পরে ৮৪ ঘণ্টার হরতাল দিয়ে, সংলাপে না গিয়ে বাজাদ মারই খেল। কোনো অর্জন হল না। জনসমর্থনের বেলায় বৃষ্টি বুঝে ছাতা ধরতে না পারলে গোঁয়ার্তুমি টিকে থাকে হয়তো, কিন্তু তা আপসহীন হয় না; তা হয় বরং রাজনৈতিক মার খাওয়া। বাজাদ এ বড় দুটি মার খেয়ে অবশ্যই বেশ জনসমর্থন হারিয়েছে এবং এতে আলী ফাউ সুবিধা পেয়ে গেল। একেই বলে রাজনীতি!
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
No comments