বিপন্ন দেশবাসীকেই প্রতিরোধ গড়তে হবে by একেএম শাহ নাওয়াজ
তবু
ভালো, সরকার পক্ষের এমপিদের কেউ কেউ অবশেষে আইন করে হরতাল বন্ধের দাবি
জানিয়েছেন। এ দাবি সাধারণ মানুষের পক্ষে আমরা অনেক আগে থেকেই জানিয়ে
আসছিলাম। সদিচ্ছার অভাবে এবং হরতাল অস্ত্র ব্যবহার করার লোভে কোনো পক্ষ গা
করেনি। এ সময়ে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে হরতাল যদি গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ কর্মসূচি
হতো তা হলে হরতাল বন্ধের জন্য আইন করার দাবি কেউ করত না। গণতন্ত্র ও
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি গণমানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিকেই নিশ্চিত করে। তাই
কোনো আচরণ যদি গণবিরোধী ও গণসংহারি হয় তবে তা গণতান্ত্রিক পদবাচ্য থাকে না।
এ সূত্রে ব্যবহারিক কারণে আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল কর্তৃক আরোপিত
গণস্বার্থবিরোধী হরতাল কর্মসূচি আইনের আওতায় বন্ধ করে দেয়া উচিত। যেমনটি
নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কয়েকটি
রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বন্ধ বা হরতাল। সাধারণ মানুষ আমাদের রাজনীতিকদের
পরিচালিত হরতাল নামের সন্ত্রাসে বিপন্ন হতে হতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়েছে। তাই এ
বিপন্ন মানুষ এখন নিজের জীবন ও অস্তিত্ব রক্ষায় সব পক্ষের রাজনীতিক ও
রাষ্ট্রের সাহায্য চায়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না কেউ সাহায্যের হাত বাড়াবে। ক্ষমতালোভী ও সন্ত্রাসী মানসিকতার রাজনীতিকরা হরতাল ডাকবেনই। গাড়ি, ঘোড়া ভাংচুুর করবেন, পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালাবেন উৎসাহের সঙ্গে; নিরীহ শিশু, তরুণ অটোরিকশাচালক, পৌঢ় ট্রাক ড্রাইভার পুড়ে মরবে। ব্যবসা লাটে উঠবে। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সূচক নিুমুখী হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ পথে বসবে। বাজারে ক্রমে আগুনের উত্তাপ বাড়বে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থবির হয়ে পড়বে শিক্ষা, পরীক্ষা। এসবের বিনিময়ে ক্ষমতা প্রত্যাশী বিরোধী রাজনীতিকরা মসনদের পথ পরিষ্কার করবেন। পাশাপাশি প্রতারণামূলক নানা শব্দে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মতো প্রগলভ ব্যক্তিরা যন্ত্রের পুতুল হয়ে ক্যামেরার সামনে নিরলস কথা বলতেই থাকবেন। ডাক দিয়ে যেতেই থাকবেন ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতালের। অতঃপর হরতাল শেষে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ হরতাল পালন করার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানাবেন। হরতালে বিপন্ন দেশবাসীকে এসব ভয়ংকর প্রলাপ শুনে যেতেই হবে।
অসহায় মানুষকে নিয়ে এভাবে আগুনে খেলা খেলে যাচ্ছেন আমাদের রাজনীতিকরা। ক্ষমতা কেন্দ্রে পৌঁছার জন্য বা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিরোধী দল জনগণের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে বা গুলি করে দুর্বল করতে চায় সরকারকে। সরকার পক্ষের রাজনীতিকরাও কখনও কখনও সঙ্গোপনে ইন্ধন জোগান বিরোধী পক্ষকে। অথবা বলা যায় ফাঁদ পাতেন। আর সে ফাঁদে পা দিয়ে হরতালের পর হরতাল চাপিয়ে দিতে থাকেন জনগণের ঘাড়ে। কারণ সরকারি হিসেবে এতে জনসমর্থন কমবে বিরোধী পক্ষের। অর্থাৎ দু’পক্ষই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য শেষ পর্যন্ত জনগণেরই কলজে খুবলে খান। হরতালের রাজনৈতিক সৌন্দর্য হারিয়ে যখন তা জীবন ও সম্পদ সংহারি সন্ত্রাসে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন তা থেকে জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব রাজনীতিকদেরই। আর যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার রেসে ছোটা বিরোধী দল হরতাল চর্চা করেন তখন এ ধারার হরতালের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা তেমন প্রতিক্রিয়া দৈবাৎও দেখি না। সরকারের তো কর্তব্যই দেশবাসীর জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। বিশেষ করে এবার আওয়ামী লীগ সরকার যদি নিজেদের গণমুখী সরকার মনে করত, তা হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে সহজেই হরতালের বিরুদ্ধে আইন পাস করতে পারত। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরেও সে পথে হাঁটেনি সরকার। অনাচার করার সুযোগ দিয়েছে জামায়াত ও বিএনপিকে। কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও জানেন, তারা যখন ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে বিরোধী দলের আসনে বসবেন তখন তাদেরও দরকার পড়বে হরতাল অস্ত্রের। কারণ সরকারকে বিব্রত ও দুর্বল করতে জনগণের বুকে অস্ত্র ঠেকানোর মজাটাই আলাদা। জেনে বুঝে সে সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। তাই এ বীভৎস ধারার হরতাল বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার।
এখন দিনকে দিন হরতালের চেহারা অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। অতীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দায়িত্বহীন অনেক হরতাল করেছে। হরতালের নামে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। জীবন সংহারও হয়েছে। তবে সাম্প্র্রতিক সময়ের বিএনপি-জামায়াতের হরতাল সব সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। টানা হরতালের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। হরতালের আগের দিন থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ খুন করে আর মুড়ি মুড়কির মতো ককটেল ফুটিয়ে পেট্রল বোমা ছুড়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে চরম অরাজকতা আর ভীতিকর পরিবেশ। হরতালের দিনগুলোতেও ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে। আগুন দেয়া হচ্ছে বগিতে। বাস ডিপোতে ঢুকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা বাস পুড়িয়ে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করা হচ্ছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এভাবে হরতাল ডাকিয়েরা ভয়ংকর সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। অথচ এজন্য সামান্যতম অনুশোচনা তাদের আছে বলে মনে হয় না।
এমন সব অপকীর্তি করছেন আবার হরতাল ডাকার প্রেস ব্রিফিংয়ে কোনো রকম লাজ-লজ্জার বালাই না রেখে চরম অশান্তি সৃষ্টি করবেন জেনেও বিএনপির মুখপাত্ররা ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতালের কথা বলে যাচ্ছেন। হরতালের আগের দিন কেন ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো শব্দ উচ্চারণ করছেন না। স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় বিঘœ ঘটিয়ে তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন হরতাল। অথচ একটিবারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন না। যেন যথেষ্ট ভোট দিয়ে ক্ষমতায় না বসানোর জন্য এটি জননেতাদের দেয়া জনগণের জন্য বিশেষ শাস্তি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অংক মিলিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এবার তাও তছনছ করে ফেলা হচ্ছে। হরতালের আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছেন শিশু-যুবা-প্রৌঢ়। এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটিও উচ্চারণ করছেন না তারা। এসব দেখে এ ধারার রাজনীতিকদের সুন্দরকান্তি অবয়বের আড়ালে দন্ত বের করা জান্তব চেহারাটাই স্পষ্ট হচ্ছে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে এসব মানুষের হাতে গণতন্ত্র, জনগণের নিরাপত্তা, জনজীবন ও দেশের অর্থনীতি কীভাবে নিরাপদ থাকবে? রাজনীতির এসব নায়ক সরকার গঠন করলে জাতি কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে!
প্রচারিত আছে, এবার বিএনপির ডাকা হরতালের সহিংসতার ধরন জামায়াতের ডাকা হরতালের জঙ্গি রূপের মতোই। বোমাবাজি, আগুনের ব্যবহার এবং হাসতে হাসতে মানুষ পুড়িয়ে মারা একাত্তরের জামায়াতেরই প্রতিরূপ। বিএনপি হরতালে জঙ্গিবাদী জামায়াত-শিবিরকেই ব্যবহার করছে বলে মানুষের ধারণা। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সব অপকীর্তির দায় নিতে হচ্ছে বিএনপিকেই। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টিতে মানতেই হচ্ছে, নিজেদের রাজনৈতিক লাভ অর্জনের জন্য আমাদের রাজনীতিকরা দিন দিন আরও বড় সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। জনগণের জানমাল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিপর্যস্ত করে তুলবেন।
এসব কারণে দেশবাসীকে আজ নতুনভাবে বাস্তবতা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের হাতে এখন সাধারণ মানুষ জিম্মি। সরকারকে দুর্বল আর অস্থির করে তুলতে বিরোধী দল হাতে তুলে নিয়েছে হরতাল অস্ত্র। এতে যে দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ ক্ষতি হচ্ছে তা এদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। তাই ৬০ ঘণ্টা হরতালের রেশ না কাটতেই ৭২ ঘণ্টার হরতাল চাপিয়ে দেয়া হল। আবার সরকার কেন বিএনপির জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করল তার দায়ও নিতে হল জনগণকে। ৭২ ঘণ্টার টানা হরতালকে আরেকটু টেনে চারদিন পূরণ করে দেয়া হল।
এখন বিএনপির অফিস যেন হয়ে গেছে মৃত্যুদূতের চেম্বার। সেখানকার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে নানা চ্যানেলের টিভি ক্যামেরার সামনে হরতাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিপন্ন মানুষ, সম্পদ আর দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার রায় ঘোষণা করে দেন নেতারা। এরপর মাঠে নেমে পড়েন যুক্তিবুদ্ধিহীন নির্বোধ দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। তারা পিকেটিং করেন। জীবন সংহার করেন স্বদেশী নিরপরাধ ভাইবোনের। গাড়ি, ঘোড়া ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগ করেন। আবার পুলিশের লাঠিপেটা ও বুলেট হজম করতে হয় তাদেরই। অন্যদিকে সন্ধ্যায় বেশ তৃপ্তির সঙ্গে রাস্তায় না নামা নেতারা দলীয় কর্মীদের ওপর পুলিশ কতটা নির্যাতন করেছে- কজনকে গ্রেফতার করেছে, এসব ফিরিস্তি দিয়ে টিভির পর্দা গুলজার করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিরোধী দলের প্রতি যদি সরকার অন্যায়ই করে থাকে তবে তার দায় জনগণকে নিতে হবে কেন?
এমন সব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এমন বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষকেই প্রতিবাদী হতে হবে। নিজেদের টিকে থাকার জন্য, সন্তানের ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাহাড় সরাতে এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ার আগে ঘুরে দাঁড়াতে হবে দেশবাসীকেই। অপশক্তির ভয়ে ভীত হয়ে ঘরে বসে আত্মরক্ষার সময় নয় এটি। খড়ের গাদায় যখন আগুন লেগেছে তখন তা পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বেই। তাই সব ভীতি আর অবসাদ ঝেরে ফেলে দেশবাসীকেই নেমে আসতে হবে রাস্তায়। ধাওয়া দিয়ে হরতাল ডাকিয়ে আর নির্মম পিকেটারদের দিগন্ত রেখা পার করে দিতে হবে। জনরোষের বারুদ ওদের ককটেল বোমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইদানীং বিএনপি নেতারা খুব ‘গণঅভ্যুত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্য না বুঝেই বোধহয় এমনটি বলেন তারা। দেয়ালে পিঠ ঠেকা দেশবাসীকেই বুঝিয়ে দিতে হবে গণঅভ্যুত্থান কাকে বলে।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না কেউ সাহায্যের হাত বাড়াবে। ক্ষমতালোভী ও সন্ত্রাসী মানসিকতার রাজনীতিকরা হরতাল ডাকবেনই। গাড়ি, ঘোড়া ভাংচুুর করবেন, পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালাবেন উৎসাহের সঙ্গে; নিরীহ শিশু, তরুণ অটোরিকশাচালক, পৌঢ় ট্রাক ড্রাইভার পুড়ে মরবে। ব্যবসা লাটে উঠবে। দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির সূচক নিুমুখী হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ পথে বসবে। বাজারে ক্রমে আগুনের উত্তাপ বাড়বে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থবির হয়ে পড়বে শিক্ষা, পরীক্ষা। এসবের বিনিময়ে ক্ষমতা প্রত্যাশী বিরোধী রাজনীতিকরা মসনদের পথ পরিষ্কার করবেন। পাশাপাশি প্রতারণামূলক নানা শব্দে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মতো প্রগলভ ব্যক্তিরা যন্ত্রের পুতুল হয়ে ক্যামেরার সামনে নিরলস কথা বলতেই থাকবেন। ডাক দিয়ে যেতেই থাকবেন ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতালের। অতঃপর হরতাল শেষে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে’ হরতাল পালন করার জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানাবেন। হরতালে বিপন্ন দেশবাসীকে এসব ভয়ংকর প্রলাপ শুনে যেতেই হবে।
অসহায় মানুষকে নিয়ে এভাবে আগুনে খেলা খেলে যাচ্ছেন আমাদের রাজনীতিকরা। ক্ষমতা কেন্দ্রে পৌঁছার জন্য বা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য বিরোধী দল জনগণের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে বা গুলি করে দুর্বল করতে চায় সরকারকে। সরকার পক্ষের রাজনীতিকরাও কখনও কখনও সঙ্গোপনে ইন্ধন জোগান বিরোধী পক্ষকে। অথবা বলা যায় ফাঁদ পাতেন। আর সে ফাঁদে পা দিয়ে হরতালের পর হরতাল চাপিয়ে দিতে থাকেন জনগণের ঘাড়ে। কারণ সরকারি হিসেবে এতে জনসমর্থন কমবে বিরোধী পক্ষের। অর্থাৎ দু’পক্ষই নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য শেষ পর্যন্ত জনগণেরই কলজে খুবলে খান। হরতালের রাজনৈতিক সৌন্দর্য হারিয়ে যখন তা জীবন ও সম্পদ সংহারি সন্ত্রাসে রূপান্তরিত হয়েছে, তখন তা থেকে জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব রাজনীতিকদেরই। আর যখন রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার রেসে ছোটা বিরোধী দল হরতাল চর্চা করেন তখন এ ধারার হরতালের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা তেমন প্রতিক্রিয়া দৈবাৎও দেখি না। সরকারের তো কর্তব্যই দেশবাসীর জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। বিশেষ করে এবার আওয়ামী লীগ সরকার যদি নিজেদের গণমুখী সরকার মনে করত, তা হলে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার কারণে সহজেই হরতালের বিরুদ্ধে আইন পাস করতে পারত। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছরেও সে পথে হাঁটেনি সরকার। অনাচার করার সুযোগ দিয়েছে জামায়াত ও বিএনপিকে। কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও জানেন, তারা যখন ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে বিরোধী দলের আসনে বসবেন তখন তাদেরও দরকার পড়বে হরতাল অস্ত্রের। কারণ সরকারকে বিব্রত ও দুর্বল করতে জনগণের বুকে অস্ত্র ঠেকানোর মজাটাই আলাদা। জেনে বুঝে সে সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। তাই এ বীভৎস ধারার হরতাল বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার।
এখন দিনকে দিন হরতালের চেহারা অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠছে। অতীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দায়িত্বহীন অনেক হরতাল করেছে। হরতালের নামে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। জীবন সংহারও হয়েছে। তবে সাম্প্র্রতিক সময়ের বিএনপি-জামায়াতের হরতাল সব সময়ের সীমা অতিক্রম করেছে। টানা হরতালের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। হরতালের আগের দিন থেকে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ খুন করে আর মুড়ি মুড়কির মতো ককটেল ফুটিয়ে পেট্রল বোমা ছুড়ে সৃষ্টি করা হচ্ছে চরম অরাজকতা আর ভীতিকর পরিবেশ। হরতালের দিনগুলোতেও ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে। আগুন দেয়া হচ্ছে বগিতে। বাস ডিপোতে ঢুকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা বাস পুড়িয়ে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করা হচ্ছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি করে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এভাবে হরতাল ডাকিয়েরা ভয়ংকর সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। অথচ এজন্য সামান্যতম অনুশোচনা তাদের আছে বলে মনে হয় না।
এমন সব অপকীর্তি করছেন আবার হরতাল ডাকার প্রেস ব্রিফিংয়ে কোনো রকম লাজ-লজ্জার বালাই না রেখে চরম অশান্তি সৃষ্টি করবেন জেনেও বিএনপির মুখপাত্ররা ‘শান্তিপূর্ণ’ হরতালের কথা বলে যাচ্ছেন। হরতালের আগের দিন কেন ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো শব্দ উচ্চারণ করছেন না। স্কুল-মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় বিঘœ ঘটিয়ে তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন হরতাল। অথচ একটিবারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছেন না। যেন যথেষ্ট ভোট দিয়ে ক্ষমতায় না বসানোর জন্য এটি জননেতাদের দেয়া জনগণের জন্য বিশেষ শাস্তি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অংক মিলিয়ে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এবার তাও তছনছ করে ফেলা হচ্ছে। হরতালের আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছেন শিশু-যুবা-প্রৌঢ়। এ বিষয়ে টুঁ-শব্দটিও উচ্চারণ করছেন না তারা। এসব দেখে এ ধারার রাজনীতিকদের সুন্দরকান্তি অবয়বের আড়ালে দন্ত বের করা জান্তব চেহারাটাই স্পষ্ট হচ্ছে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে এসব মানুষের হাতে গণতন্ত্র, জনগণের নিরাপত্তা, জনজীবন ও দেশের অর্থনীতি কীভাবে নিরাপদ থাকবে? রাজনীতির এসব নায়ক সরকার গঠন করলে জাতি কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে!
প্রচারিত আছে, এবার বিএনপির ডাকা হরতালের সহিংসতার ধরন জামায়াতের ডাকা হরতালের জঙ্গি রূপের মতোই। বোমাবাজি, আগুনের ব্যবহার এবং হাসতে হাসতে মানুষ পুড়িয়ে মারা একাত্তরের জামায়াতেরই প্রতিরূপ। বিএনপি হরতালে জঙ্গিবাদী জামায়াত-শিবিরকেই ব্যবহার করছে বলে মানুষের ধারণা। কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে সব অপকীর্তির দায় নিতে হচ্ছে বিএনপিকেই। বাস্তব অবস্থাদৃষ্টিতে মানতেই হচ্ছে, নিজেদের রাজনৈতিক লাভ অর্জনের জন্য আমাদের রাজনীতিকরা দিন দিন আরও বড় সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। জনগণের জানমাল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিপর্যস্ত করে তুলবেন।
এসব কারণে দেশবাসীকে আজ নতুনভাবে বাস্তবতা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের হাতে এখন সাধারণ মানুষ জিম্মি। সরকারকে দুর্বল আর অস্থির করে তুলতে বিরোধী দল হাতে তুলে নিয়েছে হরতাল অস্ত্র। এতে যে দেশের মানুষের প্রত্যক্ষ ক্ষতি হচ্ছে তা এদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। তাই ৬০ ঘণ্টা হরতালের রেশ না কাটতেই ৭২ ঘণ্টার হরতাল চাপিয়ে দেয়া হল। আবার সরকার কেন বিএনপির জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করল তার দায়ও নিতে হল জনগণকে। ৭২ ঘণ্টার টানা হরতালকে আরেকটু টেনে চারদিন পূরণ করে দেয়া হল।
এখন বিএনপির অফিস যেন হয়ে গেছে মৃত্যুদূতের চেম্বার। সেখানকার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে নানা চ্যানেলের টিভি ক্যামেরার সামনে হরতাল ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিপন্ন মানুষ, সম্পদ আর দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার রায় ঘোষণা করে দেন নেতারা। এরপর মাঠে নেমে পড়েন যুক্তিবুদ্ধিহীন নির্বোধ দলীয় কর্মী-সমর্থকরা। তারা পিকেটিং করেন। জীবন সংহার করেন স্বদেশী নিরপরাধ ভাইবোনের। গাড়ি, ঘোড়া ভাংচুর আর অগ্নিসংযোগ করেন। আবার পুলিশের লাঠিপেটা ও বুলেট হজম করতে হয় তাদেরই। অন্যদিকে সন্ধ্যায় বেশ তৃপ্তির সঙ্গে রাস্তায় না নামা নেতারা দলীয় কর্মীদের ওপর পুলিশ কতটা নির্যাতন করেছে- কজনকে গ্রেফতার করেছে, এসব ফিরিস্তি দিয়ে টিভির পর্দা গুলজার করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিরোধী দলের প্রতি যদি সরকার অন্যায়ই করে থাকে তবে তার দায় জনগণকে নিতে হবে কেন?
এমন সব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এমন বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষকেই প্রতিবাদী হতে হবে। নিজেদের টিকে থাকার জন্য, সন্তানের ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাহাড় সরাতে এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ার আগে ঘুরে দাঁড়াতে হবে দেশবাসীকেই। অপশক্তির ভয়ে ভীত হয়ে ঘরে বসে আত্মরক্ষার সময় নয় এটি। খড়ের গাদায় যখন আগুন লেগেছে তখন তা পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বেই। তাই সব ভীতি আর অবসাদ ঝেরে ফেলে দেশবাসীকেই নেমে আসতে হবে রাস্তায়। ধাওয়া দিয়ে হরতাল ডাকিয়ে আর নির্মম পিকেটারদের দিগন্ত রেখা পার করে দিতে হবে। জনরোষের বারুদ ওদের ককটেল বোমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইদানীং বিএনপি নেতারা খুব ‘গণঅভ্যুত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। গণঅভ্যুত্থানের তাৎপর্য না বুঝেই বোধহয় এমনটি বলেন তারা। দেয়ালে পিঠ ঠেকা দেশবাসীকেই বুঝিয়ে দিতে হবে গণঅভ্যুত্থান কাকে বলে।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments