আমজাদ : এক সহযোদ্ধার স্মৃতি by ফকীর আবদুর রাজ্জাক
গত
১ জুলাই অনেকটা কাউকে জানান না দিয়েই আমাদের অকৃত্রিম সহযোদ্ধা বন্ধু
খোন্দকার আমজাদ আলী চিরবিদায় নিয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে। আমজাদ ছিলেন
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গভীর ভালোবাসায় সিক্ত একজন মানুষ। ’৭১-এ
যেহেতু কোনো কিছুর পরোয়া না করে সবে পাওয়া চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতার ডাকে
নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেহেতু আমরা যারা তার মতো একই পথের পথিক ছিলাম
তারাও সর্বক্ষণ তাকে কাছে পেয়েছি একান্ত বিশ্বস্ত মুক্তিকামী সাহসী মানুষ
হিসেবে।
’৬৯-এর ছাত্র গণআন্দোলনে গোটা বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রকম্পিত হতে থাকে। ওই সময় দু’দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে যোগ দিতে ঢাকায় এসে আমজাদের মেসে উঠি। তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র হিসেবে আমজাদ তার বন্ধুদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ছাত্র আন্দোলনে চাকরি সত্ত্বেও দিনরাত মিছিল-মিটিং করত। আমজাদ জগন্নাথ কলেজের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা রাজিউদ্দিন আহমদ রাজু, সাইফুদ্দিন আহমদ প্রমুখের সংস্পর্শে থেকে ছাত্রলীগের তৎকালীন রাজনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছিল। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে পাকিস্তানের তথাকথিত লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন জনতার মাঝে। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ধারাবাহিকতায় আসে ৭ মার্চ। দু’দিন আগেই আমি আবার ঢাকায় আসি। আমজাদ ও তার বন্ধুদের নিয়ে ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিই। সভা শেষে আমজাদের মাথায় এলো, কত লোক হয়েছিল তার হিসাব বের করতে হবে। সে আমাদের নিয়ে গোটা রেসকোর্স মাঠের (পরবর্তী সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হেঁটে একটা অংক বের করল। এক পা থেকে অন্য পা পর্যন্ত যদি একটি লোক বসে তাহলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসাবে কাগজ-কলমের দ্বারা আমজাদ আনুমানিক হিসাব বের করল- সাত লাখের কিছু বেশি।
’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় আমজাদ অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এলো। ততদিনে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে রাজশাহীর পাঠ চুকিয়ে রাজবাড়ী, পরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি। শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনার পর আমাদের বালিয়াকান্দি ও বোয়ালমারীর একাংশ আসনে বঙ্গবন্ধু মনোনয়ন দিলেন গৌরচন্দ্র বালাকে। অগত্যা তাকে নিয়েই আমরা মাঠে নেমে পড়লাম। আমজাদ ও অন্য সমমনা বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতে শুরু করলাম। সে সময় দেখেছি আমজাদের কী দারুণ মনোবল। আমরা যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে আমজাদকে সঠিক মূল্যায়নে খানিকটা ঘাটতি থেকে যাবে। আমার বড় ভাই ড. ফকীর আবদুর রশীদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্র। একদিন বাড়ি এসে আমজাদ, সৈয়দ মঞ্জুরুল হক, পিয়ারা মিয়া ও কমরউদ্দিনকে ডেকে বললেন, নবাব বাড়ির গহিন জঙ্গলের কোথাও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ মীর মশাররফ হোসেনের কবর রয়েছে, যা খুঁজে বের করা উচিত। একদিন আমরা সবাইকে নিয়ে ভাইয়ের নেতৃত্বে নবাব বাড়ির ধ্বংসস্তূপ ও জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সাপ ও শূকরের আস্তানা ছিল ওই জঙ্গলে। অবশেষে দু’দিন ধরে খোঁজাখুঁজির পর মীরের কবরস্থান নতুন করে আমরা আবিষ্কার করলাম। সেই খবর ও ছবি ইত্তেফাক, আজাদ, সংবাদ পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হল। ঘটনাটি ’৬২ সালের।
এরপর নানা ঘটনার পর একদিন এলো সেই চরম মুহূর্ত ’৭১-এর মার্চ মাস। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করল। আমজাদ পরদিনই ঢাকা থেকে নৌকা ও হাঁটাপথে মুন্সীগঞ্জ-মানিকগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। এতদিনে আমি মানিকগঞ্জ কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে রাজবাড়ীর প্রতিরোধ আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে আমজাদ ঢাকা থেকে বাড়ি চলে আসায় আমাদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামে যাদের বন্দুক ছিল তা সংগ্রহ করে নিয়ে প্রতিদিন রাতে আমরা বহরপুর-রামদিয়া-সোনাপুরসহ হিন্দুপ্রধান এলাকায় ব্যাপক পাহারা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলাম। আমজাদ ছিল সর্বক্ষণ সঙ্গী। এপ্রিলের ’৭১-এর মাঝামাঝিতে গোয়ালন্দঘাটের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর তথা দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করল যে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারত চলে যাব। আমজাদ, বাবলু গোস্বামী ও আমি একদিন বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। সম্পূর্ণ হেঁটে কয়েকদিন ধরে এপ্রিলের শেষের দিকে আমরা কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছলাম।
আমজাদ আগে থেকেই সুনীল কুমার দাসের ঠিকানাটা নিয়ে এসেছিল। সুনীলদা আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। এমএ পাস করার পর চাকরি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। আমজাদ ও আমার ঘনিষ্ঠজন। ক’দিন তার বাসায় থাকার পর কলকাতায় একটি শিখ মুসাফিরখানায় প্রায় দুই সপ্তাহ খেয়ে-থেকে মুজিবনগর সরকারের হদিস খুঁজতে লাগলাম। কিছু খোঁজখবর পেলেও আমজাদ বেশি খুশি হতে পারল না। হতাশা তাকে চরমভাবে পেয়ে বসল। তার একই কথা- পাকবাহিনীর মতো শক্তিধরদের পরাজিত করার মতো কোনো আয়োজনই আমাদের নেই। মুজিবনগর সরকার তো গুছিয়েই উঠতে পারেনি, যুদ্ধ করবে কবে? বোধহয় মাস দুয়েক হতাশা বুকে নিয়ে ঘুরেফিরে অবশেষে আমজাদ আমাকে রেখেই দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে আর নিবৃত্ত করতে পারলাম না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমজাদ যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক, বাঙালির স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় গিয়ে জেনেছি চাকরি সূত্রে ঢাকায় থেকেও আমজাদ ও তার কয়েক সহকর্মী সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে।
স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেয়ার কাজ শেষ করে প্রথমে আমজাদের কাছে একদিন থেকে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তিনি রাজি হলেন এবং একদিন আরামবাগে তার বাসার চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন, বউ-ছেলে নিয়ে এসে ওই বাসাতে থাক। ২১ ফেব্র“য়ারি ’৭২ বাংলার বাণী প্রথম প্রকাশ পেল। কিছুদিন যেতেই একদিন আমজাদ তার দেশে রেখে আসা স্ত্রী, যে আমারই ধর্মবোন, রওশন আরা বেগম বাচ্চুকে নিয়ে বাসায় এসে উঠল। ওরা মাসাধিককাল আমাদের এখানে ছিল। এরপর আমজাদ তার বড় ভাইয়ের কাছে কিছুদিন থেকে মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির প্রজেশন কিনে বাস করতে থাকল। তারপর সেই বাড়িই একসময় সরকারের কাছ থেকে কিনে স্থায়ীভাবে তার বসবাস। আমরাও একসময় স্ত্রীর সরকারি চাকরির সুবাদে ওই জাকির হোসেন রোডেই একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে থেকেছি প্রায় ৩২ বছর। ফলে আমজাদের থেকে আমাকে বেশিদিন আলাদা থাকতে হয়নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই জাকির হোসেন রোডেই ছিল আমজাদ।
’৬৯-এর ছাত্র গণআন্দোলনে গোটা বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) প্রকম্পিত হতে থাকে। ওই সময় দু’দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে যোগ দিতে ঢাকায় এসে আমজাদের মেসে উঠি। তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র হিসেবে আমজাদ তার বন্ধুদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ছাত্র আন্দোলনে চাকরি সত্ত্বেও দিনরাত মিছিল-মিটিং করত। আমজাদ জগন্নাথ কলেজের প্রখ্যাত ছাত্রনেতা, ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা রাজিউদ্দিন আহমদ রাজু, সাইফুদ্দিন আহমদ প্রমুখের সংস্পর্শে থেকে ছাত্রলীগের তৎকালীন রাজনীতিতে বিরাট অবদান রেখেছিল। আন্দোলনের চরম মুহূর্তে পাকিস্তানের তথাকথিত লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসেন জনতার মাঝে। আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ধারাবাহিকতায় আসে ৭ মার্চ। দু’দিন আগেই আমি আবার ঢাকায় আসি। আমজাদ ও তার বন্ধুদের নিয়ে ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দিই। সভা শেষে আমজাদের মাথায় এলো, কত লোক হয়েছিল তার হিসাব বের করতে হবে। সে আমাদের নিয়ে গোটা রেসকোর্স মাঠের (পরবর্তী সময়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দৈর্ঘ্য-প্রস্থ হেঁটে একটা অংক বের করল। এক পা থেকে অন্য পা পর্যন্ত যদি একটি লোক বসে তাহলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসাবে কাগজ-কলমের দ্বারা আমজাদ আনুমানিক হিসাব বের করল- সাত লাখের কিছু বেশি।
’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনের সময় আমজাদ অফিসে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এলো। ততদিনে মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে রাজশাহীর পাঠ চুকিয়ে রাজবাড়ী, পরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছি। শেষ পর্যন্ত অনেক ঘটনার পর আমাদের বালিয়াকান্দি ও বোয়ালমারীর একাংশ আসনে বঙ্গবন্ধু মনোনয়ন দিলেন গৌরচন্দ্র বালাকে। অগত্যা তাকে নিয়েই আমরা মাঠে নেমে পড়লাম। আমজাদ ও অন্য সমমনা বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতে শুরু করলাম। সে সময় দেখেছি আমজাদের কী দারুণ মনোবল। আমরা যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখনকার একটি ঘটনা উল্লেখ না করলে আমজাদকে সঠিক মূল্যায়নে খানিকটা ঘাটতি থেকে যাবে। আমার বড় ভাই ড. ফকীর আবদুর রশীদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্র। একদিন বাড়ি এসে আমজাদ, সৈয়দ মঞ্জুরুল হক, পিয়ারা মিয়া ও কমরউদ্দিনকে ডেকে বললেন, নবাব বাড়ির গহিন জঙ্গলের কোথাও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ মীর মশাররফ হোসেনের কবর রয়েছে, যা খুঁজে বের করা উচিত। একদিন আমরা সবাইকে নিয়ে ভাইয়ের নেতৃত্বে নবাব বাড়ির ধ্বংসস্তূপ ও জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সাপ ও শূকরের আস্তানা ছিল ওই জঙ্গলে। অবশেষে দু’দিন ধরে খোঁজাখুঁজির পর মীরের কবরস্থান নতুন করে আমরা আবিষ্কার করলাম। সেই খবর ও ছবি ইত্তেফাক, আজাদ, সংবাদ পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হল। ঘটনাটি ’৬২ সালের।
এরপর নানা ঘটনার পর একদিন এলো সেই চরম মুহূর্ত ’৭১-এর মার্চ মাস। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করল। আমজাদ পরদিনই ঢাকা থেকে নৌকা ও হাঁটাপথে মুন্সীগঞ্জ-মানিকগঞ্জ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো। এতদিনে আমি মানিকগঞ্জ কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে রাজবাড়ীর প্রতিরোধ আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে শেষ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে আমজাদ ঢাকা থেকে বাড়ি চলে আসায় আমাদের শক্তি আরও বেড়ে গেল। আমাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামে যাদের বন্দুক ছিল তা সংগ্রহ করে নিয়ে প্রতিদিন রাতে আমরা বহরপুর-রামদিয়া-সোনাপুরসহ হিন্দুপ্রধান এলাকায় ব্যাপক পাহারা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলাম। আমজাদ ছিল সর্বক্ষণ সঙ্গী। এপ্রিলের ’৭১-এর মাঝামাঝিতে গোয়ালন্দঘাটের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর তথা দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। অবশেষে পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করল যে আমরা কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারত চলে যাব। আমজাদ, বাবলু গোস্বামী ও আমি একদিন বাড়ি ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিলাম। সম্পূর্ণ হেঁটে কয়েকদিন ধরে এপ্রিলের শেষের দিকে আমরা কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতায় গিয়ে পৌঁছলাম।
আমজাদ আগে থেকেই সুনীল কুমার দাসের ঠিকানাটা নিয়ে এসেছিল। সুনীলদা আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। এমএ পাস করার পর চাকরি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দেশত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। আমজাদ ও আমার ঘনিষ্ঠজন। ক’দিন তার বাসায় থাকার পর কলকাতায় একটি শিখ মুসাফিরখানায় প্রায় দুই সপ্তাহ খেয়ে-থেকে মুজিবনগর সরকারের হদিস খুঁজতে লাগলাম। কিছু খোঁজখবর পেলেও আমজাদ বেশি খুশি হতে পারল না। হতাশা তাকে চরমভাবে পেয়ে বসল। তার একই কথা- পাকবাহিনীর মতো শক্তিধরদের পরাজিত করার মতো কোনো আয়োজনই আমাদের নেই। মুজিবনগর সরকার তো গুছিয়েই উঠতে পারেনি, যুদ্ধ করবে কবে? বোধহয় মাস দুয়েক হতাশা বুকে নিয়ে ঘুরেফিরে অবশেষে আমজাদ আমাকে রেখেই দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। তাকে আর নিবৃত্ত করতে পারলাম না। তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমজাদ যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক, বাঙালির স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় গিয়ে জেনেছি চাকরি সূত্রে ঢাকায় থেকেও আমজাদ ও তার কয়েক সহকর্মী সাধ্যমতো মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে।
স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দেয়ার কাজ শেষ করে প্রথমে আমজাদের কাছে একদিন থেকে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। তিনি রাজি হলেন এবং একদিন আরামবাগে তার বাসার চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন, বউ-ছেলে নিয়ে এসে ওই বাসাতে থাক। ২১ ফেব্র“য়ারি ’৭২ বাংলার বাণী প্রথম প্রকাশ পেল। কিছুদিন যেতেই একদিন আমজাদ তার দেশে রেখে আসা স্ত্রী, যে আমারই ধর্মবোন, রওশন আরা বেগম বাচ্চুকে নিয়ে বাসায় এসে উঠল। ওরা মাসাধিককাল আমাদের এখানে ছিল। এরপর আমজাদ তার বড় ভাইয়ের কাছে কিছুদিন থেকে মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির প্রজেশন কিনে বাস করতে থাকল। তারপর সেই বাড়িই একসময় সরকারের কাছ থেকে কিনে স্থায়ীভাবে তার বসবাস। আমরাও একসময় স্ত্রীর সরকারি চাকরির সুবাদে ওই জাকির হোসেন রোডেই একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে থেকেছি প্রায় ৩২ বছর। ফলে আমজাদের থেকে আমাকে বেশিদিন আলাদা থাকতে হয়নি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই জাকির হোসেন রোডেই ছিল আমজাদ।
আমজাদের চলে যাওয়া আমার
জীবনের সবচেয়ে বড় শূন্যতা। আমি ও আমরা কতিপয় এমন এক অভিভাবকসম পরম বন্ধুকে
হারিয়েছি, যা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। দেশ ও সমাজ হারিয়েছে সত্যিকার
দেশপ্রেমিক এক মুক্তিকামী মানুষকে।
ফকীর আবদুর রাজ্জাক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ফকীর আবদুর রাজ্জাক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
No comments