কথা সামান্যই-সরলীকরণের যুগে জ্ঞানচর্চা by ফজলুল আলম

আধুনিক সময়ে একেকটা বিষয়ের ওপর এত বেশি পড়াশোনা, গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে যে বিশেষজ্ঞ ব্যতিরেকে সেসব বিষয় বোঝা দুরূহ। তার পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারি অঙ্গনে উচ্চ পদাধিকারী অনেককে প্রশাসন
মন্ত্রণালয় এমন এমন বিষয়ের ভার দেয়, যাঁদের সেসব বিষয়ে কস্মিনকালেও কোনো জ্ঞান ছিল না- এমনও উদাহরণ আছে যে সেসব বিষয়ের নামের বানান পর্যন্ত শুদ্ধ করে লিখতে অনেকের কসরত করতে হয়। মন্ত্রী, সচিব, যুগ্ম সচিব, যুক্ত সচিব, উপসচিব- তাঁরা সবাই এত এত দুস্তর পারাবার পার হয়ে এসব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, যেকোনো দায়িত্ব নিতেই পিছপা হন না। বিধি বাম, তাই তাঁরা নতুন দায়িত্বে বেশি দিন থেকে যে নতুন বিষয়ে কিছু সত্যিকার জ্ঞান অর্জন করবেন, তার সুযোগও তাঁরা পান না। ঝট করে তাঁদের অন্য চারণভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি অবাক বিস্ময়ে নতুন বিষয়ে তাঁদের ভারিক্কি কথাবার্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ আচরণ দেখি আর মুগ্ধ হই। তাঁদের অভিনন্দন। এই বিশ্লেষণ থেকে এখন বুঝতে পারছি, কেন সচিবরা (বড় বা ছোট) অত্যন্ত গর্বিত থাকেন এবং নিজেদের উন্নাসিকতা বজায় রেখে চলেন- এই আচরণ তাঁদের ইচ্ছাকৃত নয়, আমলাতন্ত্র কর্তৃক তাঁদের ওপরে আরোপিত।
অনুরূপভাবে বেসরকারি অঙ্গনে লেখালেখি, বিশেষত পত্রপত্রিকায় কলাম লেখকদের ক্ষেত্রে তাঁদের বিশাল সীমানাবিহীন জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করে (আমি নিজেও বোধ হয় তাঁদের মধ্যে একজন, তবে আমার জ্ঞানের অপ্রতুলতায় আমি লজ্জিত, হাজার বইপত্র উল্টিয়েও জ্ঞানী হতে পারলাম না।)। সরকারি ও বেসরকারি এই দুই পক্ষেরই কর্মতৎপরতা নিয়েই পৃথিবী এগিয়ে চলছে। চলমান এই পৃথিবীর বিশ্লেষণ করে দিয়ে অনেক মনীষী গত হয়েছেন এবং সেসবের অকাট্যতা এখনো অখণ্ডনীয় বিধায় সেসব সম্পর্কে অনেক আধুনিক পণ্ডিত উল্লেখ করা থেকেই বিরত থাকা শ্রেয় মনে করেন। তার পরও কেমন করে যেন সেসব অবাঞ্ছিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমাজতাত্তি্বক বিশ্লেষণ সামনে চলে আসে। অবশ্য সেগুলোকে খণ্ডন করার জন্য 'পোস্টমডার্নিজম', 'ইতিহাসের সমাপ্তি', 'সাড়ম্বর ভাষ্যচিত্র' ইত্যাদি অসার তত্ত্ব হাজির করেন। তাঁরা সফল না হলেও খাঁটি তত্ত্বগুলোকে পরাস্ত করা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব হয়েছে কিন্তু সেটা যে ক্ষণস্থায়ী, তা সবাই জানে। ফলে ইউরোপের 'রাইজিং স্পেকটার' দূর হচ্ছে না।
এ ক্ষেত্রে যার যেটা বিষয় নয়, সেসব আলোচনা গণমুখী করার প্রশ্ন ওঠে। সেদিন এই পত্রিকায় একজন বিশাল মাপের সরকারি, আধাসরকারি ও পণ্ডিত লেখক বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত মন্তব্য করেছেন, 'যতই অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও নৈতিকতাবর্জিত কোনো শাসক হোক না কেন, এ দেশের মানুষ সেসব খুব একটা গায়ে মাখে না।' তিনি এরশাদের আমলের কথা লিখছিলেন এবং অতি সরল মনেই কথাটি লিখেছেন। তার পর তিনি তাঁর মতামত দিয়েছেন, 'তারা [জনগণ] ক্ষমতার শীর্ষে দেখতে চায় একজন কর্মসম্পাদক- যা এরশাদ সাহেবের মতোই প্রায় আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী' ... 'ফলে কোনো ভালো মানুষ তাঁর নীতি-আদর্শ নিয়ে এ দেশে রাজনীতি করার অযোগ্য।' (কালের কণ্ঠ, জুন ২, ২০১৩)
এই বাক্যগুলোর অর্থ তলিয়ে দেখলে যা বিকশিত হবে, তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হয় না। লেখক অবশ্য নষ্ট সময়ের রাজনীতি নিয়ে লিখছিলেন, কিন্তু সেই নষ্ট সময় কি সর্বকালীন? বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কর্মনিষ্ঠার সঙ্গে এরশাদের কর্মনিষ্ঠা এক করা কি ঠিক হলো? লেখালেখির (এবং নেতাদের বক্তৃতার) একটা উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণের মুখে ভাষার জোগান দেওয়া। এই ভাষার জোগান দেওয়ার কাজটা বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা অবলীলায় করে থাকেন। কিন্তু সেসব অধিকাংশই ক্ষতিকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেমন, এ দেশে 'ভালো মানুষ রাজনীতি করার অযোগ্য' কথাটি জনগণের মুখে ধরিয়ে দেওয়ার আগে কিছু ভাবনাচিন্তা করলে ভালো হতো। আমি বলছি না যে 'অন্যায় দেখিব না' বা 'বাস্তব মানিব না' বলে বালুতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখলেই অন্যায় বা বাস্তবতা বদলে যাবে। কিন্তু অন্যায় আর বাস্তবতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রতিহত করার প্রস্তাব বুদ্ধিবৃত্তিতে অগ্রসর লেখকদের কাছ থেকে আশা করতে দোষ কী?
(২)
আমার মনে হচ্ছে আমিই সম্ভবত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বসে আছি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে কার কী বিষয় ছিল, সেটা কর্মজীবনে আর ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া উচিত কর্ম নয়। উচ্চশিক্ষার অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে 'কিভাবে পড়তে হয় বা গবেষণা করতে হয়, তা শেখানো।' সেটা শিখতে পারলে বিষয়ের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। সুতরাং আমলা বা আমলা নন এমন সব ব্যক্তি যখন বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দেন বা লেখেন তখন সেটাকে মূল্যহীন বলা যায় না।
এই উপলব্ধির পরও আমার শঙ্কা যায় না। আমার ভয় হয় যে বিষয়ের সীমাহীন বিস্তৃতির জন্য গণমুখী কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তার সীমারেখা টানা দরকার। কী হতে পারে বা হয়ে গেছে এই সীমারেখা? একটা উপায় সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে সম্ভবত স্বাভাবিক নিয়মে পাওয়া গেছে এবং সেটা এখন স্বীকৃত। সেটা হচ্ছে সব কিছুতে ইংরেজিতে 'ডাক্কা'র বদলে 'ঢাকা' লেখার মতো সরলীকরণ। যেহেতু বর্তমান উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় (শত শত ফার্স্ট ক্লাস) ও মুখস্থ বিদ্যার (সরকারি আমলাদের) পরীক্ষায় পাস করা বিষয়জ্ঞানী প্রার্থী পাওয়া প্রায় অসম্ভব, সে জন্য বিষয়গুলোর সরলীকরণেই সমস্যা মিটে যায় না কি। এমনকি মন্ত্রীদের ও উচ্চ আমলাদের বক্তৃতালেখকরাও (যাঁরা অনেকেই সত্যিকার বিষয়-পণ্ডিত) তাঁদের কলম সংযত করে সরল করে লেখা শিখতে বাধ্য হয়েছেন।
এই সরলীকরণে আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার অনেক ক্ষতি হচ্ছে, কারণ কোনো বিষয়েরই সত্যিকার বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার প্রয়োজন আর রইল না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.