চালচিত্র-জাতীয় নির্বাচন কি অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে না! by শুভ রহমান
নির্বাচন সব সময়ই একটি বিরাট আবেগের
ব্যাপার। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র, সবখানেই। এর সঙ্গে জড়িয়ে
যেমন আছে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল, জড়িয়ে আছে মানুষের ভাগ্যও।
মোটা
দাগে, সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদল তেমন একটা হয় না জাতীয় নির্বাচনের মধ্য
দিয়ে। তবে মানুষের বিরাট আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিপুল প্রত্যাশা জড়িয়ে থাকে এ
নির্বাচনের সঙ্গে। স্বার্থের লড়াই, ক্ষমতার লড়াই যেমন হয় ক্ষমতাবান,
ক্ষমতালিপ্সু শ্রেণীর মধ্যে, তেমনি সচেতন সাধারণ মানুষ তাদের জীবনযাত্রার
উন্নতির আশায়, উন্নতমানের জীবনযাপনের আশায় একে নিছক নির্বাচনী
প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, জীবন-মরণ ভোটযুদ্ধ হিসেবেই গ্রহণ করে থাকে। ভোটের
গণতন্ত্রে সারা বিশ্বে এটাই গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রীতি।
এখন পর্যন্ত সামনের ভোটযুদ্ধটা ঠিক কেমন হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। আদৌ নির্বাচন হবে কি না, সে ব্যাপারেও যেন সংশয়ের কালো মেঘ কিছুতেই কাটছে না।
অনেক ঝড়ঝাপ্টার পর নবম জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশন শুরুর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও জনজীবনের অনেক প্রার্থিত, বহু প্রত্যাশিত একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিকে টেনশন থেকে মুক্ত করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবশেষে তার সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল হওয়ার উপক্রম হওয়ার মুখে শুরু থেকেই বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত একাধিকবার অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করলেও বিএনপি জোটের সদস্যরা সংসদ বর্জন করেননি। সংসদ দীর্ঘকাল থেকে বর্জন করে আসার পর এই অধিবেশনেই তাঁরা সংসদ বর্জনে ক্ষান্ত হলেন। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে মানুষ পুরোপুরি স্বস্তি পেত যদি তাঁরা আরেকটু এগিয়ে তাঁদের দীর্ঘ সময়ের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য পূর্বাহ্নে দাখিলকৃত মুলতবি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার না করে তার ওপর আলোচনার সূত্রপাত করতেন। প্রস্তাবটি দলের নয়, মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপির ব্যক্তিগত বলে দাবি করে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো বিল উত্থাপন করা হয়নি এবং হবে বলেও মনে হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বরং আবারও সাংবিধানিক ধারায় দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বক্তব্যকেই আঁকড়ে ধরা হচ্ছে। সরকার আগে যা-ও বা নির্দলীয় বা সর্বদলীয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থায় সম্মত হওয়ার আভাস দিচ্ছিল, বিএনপির উল্লিখিত মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহারের পর এখন আর সাংবিধানিক অবস্থান থেকে এক চুল নড়ার কোনো আভাস দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সর্বশেষ এই বক্তব্যই দিয়েছেন যে বিএনপি ফের মুলতবি প্রস্তাবটি দিক এবং তাঁরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন না, সেটি সংসদে আলোচনা করা হবে। বিএনপি এটাকে একটা 'ফাঁদ' বলে অভিহিত করছে এবং তার ভেতরে কিছুতেই পা দিতে রাজি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই যেন অনড় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দফায় দফায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দলের তৃণমূল কর্মীদের সভায় অন্তত একবারের জন্য সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারার তথা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন শুরু করার আবেদন জানিয়ে চলেছেন। তিনি এর আগে মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ওই ধারাতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যে ভিন্ন হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে আরো বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত, এমন কোনো বিবেচনা তাঁর এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
সরকার পক্ষের সব যুক্তি সত্ত্বেও বিরাজমান বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হচ্ছে না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুধু যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করবেন না, তা নয়, নির্বাচন হতে দেবেন না বলেও ঘোষণা করে আসছেন।
এই জেদাজেদির ফলে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভবিষ্যৎ বস্তুত এখন পর্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্নই হয়ে আছে।
এ ব্যাপারে একটা সুষ্ঠু নিষ্পত্তির জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ দফায় দফায় বিদেশি কূটনীতিক, এমনকি সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত তারানকোর দৌত্যও বলতে গেলে কার্যত ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়েছে।
জাতি এ অচলাবস্থা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে, কিভাবে দেশে অর্থবহ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো একটি জাতীয় সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব করা যাবে, তার বস্তুত কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছে না। অথচ নির্বাচন ছাড়া অথবা কার্যত মাত্র ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা জাতিকে একটা লক্ষ্যহারা তরীতেই পরিণত করা হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যত অস্তিত্বহীন করে দেয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একবার সে সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ তার পুনরাবৃত্তি কখনোই কাম্য হতে পারে না, জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। নির্বাচন যেমন গণতন্ত্রকে অর্থবহ করার জন্য হতে হবে, তেমনি প্রধান বিরোধী দলসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই তা করতে হবে। এ জন্য গণতন্ত্রের স্বার্থেই দুই পক্ষকে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েই চূড়ান্ত অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে তা করতে হবে, জনগণের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে।
বেশ একটা দীর্ঘসময় ধরে হরতালের পর হরতাল দিয়ে, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-সম্পদ ধ্বংসের দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে প্রধান বিরোধী দলের অবশেষে যদিও বা সংসদে ফেরার সুমতি হলো, দেখা যাচ্ছে, সরকার পক্ষের সহনশীলতা, দূরদর্শিতা ও অ্যাডজাস্টিবিলিটির অভাবেই হয়তো আবার তারা সংসদ থেকে রাজপথে নেমে সহিংস কার্যকলাপ শুরু করে দেবে। সেটা হলে জাতি নিশ্চিতভাবেই সরকার পক্ষকেই দুষবে। এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটভুক্ত জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক তাদের তিন নেতাকে জেল-জরিমানা দণ্ড দানের প্রতিবাদে নতুন করে হরতাল ডেকেছে আজ (সোমবার) দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ভয় হয়, ১৮ দলীয় জোটের টানে না কি বিএনপিও ফের রাস্তায় নেমে হরতাল শুরু করে দেয়, বড় স্পর্শকাতর সময় পার করছে এখন সংসদ।
তবে বিরোধী দল অন্তত এটা তো প্রমাণ করেছে, নিছক সংসদ সদস্যপদ বহাল রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে তারা এবার সংসদে ফেরেনি, তারা বাজেট আলোচনাতেও আগ্রহী এবং সরকার পক্ষের দাবি অনুযায়ীই সংসদে এসে আলোচনা করার বিষয়টিও আমলে এনে সংসদে আলোচনাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে দলগতভাবে মুলতবি প্রস্তাবটি আর পেশ করতে চাইছে না। ঠিক এ অবস্থাটিতেই সরকার পক্ষের একটু ধৈর্য, সহনশীল, ইতিবাচক ও উদার মনোভাব অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, যার অভাবে হয়তো বর্তমানে দৃষ্ট আলোচনার অনুকূল সুযোগটুকু লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সরকার পক্ষের মুহূর্তের ভুলেই দেশে আবার পাশার দান উল্টে গিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কাল সূচিত হয়ে যাবে। সচেতন দেশবাসীর কাছে তা আদৌ কাম্য নয়। সবাই অধীর আগ্রহে সংসদের দিকে তাকিয়ে আছে, কখন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ওপর সরকার পক্ষের উদ্যোগেই আলোচনার সূত্রপাত হয়ে প্রয়োজনে তা সংসদের বাইরেও অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপি এরই মধ্যে সংসদের বাইরে আলোচনাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
প্রধান বিরোধী দলের রাজপথে এ যাবৎকালের সহিংস কার্যকলাপ, জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ও কথিত আঁতাত এবং দেশের রাজনৈতিক সংকটকে ক্রমেই সমাধানহীন সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়ার মহাবিপদকে প্রতিহত করার যে সুযোগ আজ উপস্থিত হয়েছে, প্রকৃত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে শাসক মহাজোটকে আজ তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেই হবে। এ সুযোগ হেলায় হারালে সমগ্র জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শাসক মহাজোটকে ক্ষমাহীন এক ভ্রান্তির জন্যই দায়ী করবে। তত্ত্বগত ও ঐতিহাসিকভাবেই প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, কোনো অবস্থাতেই তা বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে স্বীকৃতি পাবে না।
বস্তুত শাসক মহাজোটের ক্ষমতা হারানোর কোনো রকম সংগত কারণই থাকতে পারে না। হলমার্ক, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ বেশ কিছু অপকর্মের অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ যেমন তার গায়ে লেগে আছে, তেমনি শেষ পর্যন্ত বাজেটে বরাদ্দ রেখে মেয়াদকালেই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেওয়া, সমুদ্রজয়, এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট প্রণয়ন, সাভারের রানা প্লাজার মতো ভয়াবহ ভবনধসের প্রশংসনীয় মোকাবিলা, অসহায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রতি সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা প্রদানে সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়ানো, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দৃঢ়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা, শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ গ্রহণ তেমনি তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উজ্জ্বলতম আশ্বাসের ভিত্তিও রচনা করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এতসব বড় বড় সাফল্য ছিল না, যার ফলে তার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিঃশঙ্কচিত্তে ও নির্দ্বিধায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে পারে। পৃথিবীর কোনো দেশে ক্ষমতাসীন দল ১০০ ভাগ সাফল্য নিয়ে নির্বাচনে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় না, কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোথাও নির্বাচন থেকে কোনো রকম সংকীর্ণতা দেখিয়ে দূরে রাখার কল্পনাও করে না। নির্বাচন সব অবস্থায় পরিপূর্ণ সমঝোতার মধ্য দিয়ে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই করা হয়। গণতান্ত্রিক উদারতা ও আন্তরিকতাই ভোটারদের নির্মোহভাবে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করে, সব ভুলত্রুটি বিচার-বিবেচনা করেই তারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিককেই বেছে নেয় এবং তাদের হিসাবে কখনো ভুল হয় না। নির্বাচনে ভোটাররা আসলে কোনো একটি পক্ষকে জেতায় না, বিজয়ী করে গণতন্ত্রকেই। এ গণতন্ত্র নিছক ভোটের গণতন্ত্র মনে হলেও ধনিক ও ক্ষমতাবান শ্রেণীর জন্য তা যতটা দরকার, শোষিত-বঞ্চিত দরিদ্র জনগণের জন্য তার প্রয়োজন হয় অনেক বেশি। তাদের বাঁচার অবলম্বন এ গণতন্ত্র। গণতন্ত্র তাদের সুদীর্ঘ গণসংগ্রামের রক্ত-ফসল। গণতন্ত্রই তাদের চোখের মণি, মাথার মুকুট। তাদের প্রাণাধিক প্রিয় স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। নির্বাচন নিশ্চিত হোক। গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।
১০.৬.২০১৩
এখন পর্যন্ত সামনের ভোটযুদ্ধটা ঠিক কেমন হবে, তা বোঝা যাচ্ছে না। আদৌ নির্বাচন হবে কি না, সে ব্যাপারেও যেন সংশয়ের কালো মেঘ কিছুতেই কাটছে না।
অনেক ঝড়ঝাপ্টার পর নবম জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশন শুরুর মধ্য দিয়ে জাতীয় ও জনজীবনের অনেক প্রার্থিত, বহু প্রত্যাশিত একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিকে টেনশন থেকে মুক্ত করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অবশেষে তার সংসদ সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল হওয়ার উপক্রম হওয়ার মুখে শুরু থেকেই বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত একাধিকবার অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করলেও বিএনপি জোটের সদস্যরা সংসদ বর্জন করেননি। সংসদ দীর্ঘকাল থেকে বর্জন করে আসার পর এই অধিবেশনেই তাঁরা সংসদ বর্জনে ক্ষান্ত হলেন। জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তবে মানুষ পুরোপুরি স্বস্তি পেত যদি তাঁরা আরেকটু এগিয়ে তাঁদের দীর্ঘ সময়ের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য পূর্বাহ্নে দাখিলকৃত মুলতবি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার না করে তার ওপর আলোচনার সূত্রপাত করতেন। প্রস্তাবটি দলের নয়, মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপির ব্যক্তিগত বলে দাবি করে সেটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারপক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো বিল উত্থাপন করা হয়নি এবং হবে বলেও মনে হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বরং আবারও সাংবিধানিক ধারায় দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের বক্তব্যকেই আঁকড়ে ধরা হচ্ছে। সরকার আগে যা-ও বা নির্দলীয় বা সর্বদলীয় একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থায় সম্মত হওয়ার আভাস দিচ্ছিল, বিএনপির উল্লিখিত মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহারের পর এখন আর সাংবিধানিক অবস্থান থেকে এক চুল নড়ার কোনো আভাস দিচ্ছে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সর্বশেষ এই বক্তব্যই দিয়েছেন যে বিএনপি ফের মুলতবি প্রস্তাবটি দিক এবং তাঁরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন না, সেটি সংসদে আলোচনা করা হবে। বিএনপি এটাকে একটা 'ফাঁদ' বলে অভিহিত করছে এবং তার ভেতরে কিছুতেই পা দিতে রাজি হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই যেন অনড় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দফায় দফায় বিভিন্ন জেলা থেকে আগত দলের তৃণমূল কর্মীদের সভায় অন্তত একবারের জন্য সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারার তথা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন শুরু করার আবেদন জানিয়ে চলেছেন। তিনি এর আগে মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ওই ধারাতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যে ভিন্ন হতে পারে এবং এ ক্ষেত্রে আরো বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত, এমন কোনো বিবেচনা তাঁর এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
সরকার পক্ষের সব যুক্তি সত্ত্বেও বিরাজমান বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হচ্ছে না। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শুধু যে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন করবেন না, তা নয়, নির্বাচন হতে দেবেন না বলেও ঘোষণা করে আসছেন।
এই জেদাজেদির ফলে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভবিষ্যৎ বস্তুত এখন পর্যন্ত অন্ধকারাচ্ছন্নই হয়ে আছে।
এ ব্যাপারে একটা সুষ্ঠু নিষ্পত্তির জন্য দীর্ঘকাল যাবৎ দফায় দফায় বিদেশি কূটনীতিক, এমনকি সর্বশেষ জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত তারানকোর দৌত্যও বলতে গেলে কার্যত ব্যর্থতাতেই পর্যবসিত হয়েছে।
জাতি এ অচলাবস্থা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসবে, কিভাবে দেশে অর্থবহ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো একটি জাতীয় সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব করা যাবে, তার বস্তুত কোনো কূলকিনারাই পাচ্ছে না। অথচ নির্বাচন ছাড়া অথবা কার্যত মাত্র ক্ষমতাসীনদের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা জাতিকে একটা লক্ষ্যহারা তরীতেই পরিণত করা হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যত অস্তিত্বহীন করে দেয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন একবার সে সত্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। আজ তার পুনরাবৃত্তি কখনোই কাম্য হতে পারে না, জাতির জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। নির্বাচন যেমন গণতন্ত্রকে অর্থবহ করার জন্য হতে হবে, তেমনি প্রধান বিরোধী দলসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই তা করতে হবে। এ জন্য গণতন্ত্রের স্বার্থেই দুই পক্ষকে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েই চূড়ান্ত অ্যাডজাস্টমেন্টের মাধ্যমে তা করতে হবে, জনগণের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে।
বেশ একটা দীর্ঘসময় ধরে হরতালের পর হরতাল দিয়ে, জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-সম্পদ ধ্বংসের দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে প্রধান বিরোধী দলের অবশেষে যদিও বা সংসদে ফেরার সুমতি হলো, দেখা যাচ্ছে, সরকার পক্ষের সহনশীলতা, দূরদর্শিতা ও অ্যাডজাস্টিবিলিটির অভাবেই হয়তো আবার তারা সংসদ থেকে রাজপথে নেমে সহিংস কার্যকলাপ শুরু করে দেবে। সেটা হলে জাতি নিশ্চিতভাবেই সরকার পক্ষকেই দুষবে। এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটভুক্ত জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক তাদের তিন নেতাকে জেল-জরিমানা দণ্ড দানের প্রতিবাদে নতুন করে হরতাল ডেকেছে আজ (সোমবার) দেশজুড়ে জামায়াত-শিবিরের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ভয় হয়, ১৮ দলীয় জোটের টানে না কি বিএনপিও ফের রাস্তায় নেমে হরতাল শুরু করে দেয়, বড় স্পর্শকাতর সময় পার করছে এখন সংসদ।
তবে বিরোধী দল অন্তত এটা তো প্রমাণ করেছে, নিছক সংসদ সদস্যপদ বহাল রাখার বাধ্যবাধকতার কারণে তারা এবার সংসদে ফেরেনি, তারা বাজেট আলোচনাতেও আগ্রহী এবং সরকার পক্ষের দাবি অনুযায়ীই সংসদে এসে আলোচনা করার বিষয়টিও আমলে এনে সংসদে আলোচনাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে দলগতভাবে মুলতবি প্রস্তাবটি আর পেশ করতে চাইছে না। ঠিক এ অবস্থাটিতেই সরকার পক্ষের একটু ধৈর্য, সহনশীল, ইতিবাচক ও উদার মনোভাব অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, যার অভাবে হয়তো বর্তমানে দৃষ্ট আলোচনার অনুকূল সুযোগটুকু লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সরকার পক্ষের মুহূর্তের ভুলেই দেশে আবার পাশার দান উল্টে গিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতার কাল সূচিত হয়ে যাবে। সচেতন দেশবাসীর কাছে তা আদৌ কাম্য নয়। সবাই অধীর আগ্রহে সংসদের দিকে তাকিয়ে আছে, কখন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ওপর সরকার পক্ষের উদ্যোগেই আলোচনার সূত্রপাত হয়ে প্রয়োজনে তা সংসদের বাইরেও অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। বিএনপি এরই মধ্যে সংসদের বাইরে আলোচনাতেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
প্রধান বিরোধী দলের রাজপথে এ যাবৎকালের সহিংস কার্যকলাপ, জামায়াত-শিবির ও হেফাজতের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা ও কথিত আঁতাত এবং দেশের রাজনৈতিক সংকটকে ক্রমেই সমাধানহীন সাংবিধানিক সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়ার মহাবিপদকে প্রতিহত করার যে সুযোগ আজ উপস্থিত হয়েছে, প্রকৃত সংসদীয় গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে শাসক মহাজোটকে আজ তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেই হবে। এ সুযোগ হেলায় হারালে সমগ্র জাতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শাসক মহাজোটকে ক্ষমাহীন এক ভ্রান্তির জন্যই দায়ী করবে। তত্ত্বগত ও ঐতিহাসিকভাবেই প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, কোনো অবস্থাতেই তা বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে স্বীকৃতি পাবে না।
বস্তুত শাসক মহাজোটের ক্ষমতা হারানোর কোনো রকম সংগত কারণই থাকতে পারে না। হলমার্ক, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ বেশ কিছু অপকর্মের অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ যেমন তার গায়ে লেগে আছে, তেমনি শেষ পর্যন্ত বাজেটে বরাদ্দ রেখে মেয়াদকালেই পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে দেওয়া, সমুদ্রজয়, এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট প্রণয়ন, সাভারের রানা প্লাজার মতো ভয়াবহ ভবনধসের প্রশংসনীয় মোকাবিলা, অসহায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের প্রতি সর্বোচ্চ মানবিক সহায়তা প্রদানে সর্বশক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়ানো, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দৃঢ়তার সঙ্গে সম্পন্ন করা, শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ গ্রহণ তেমনি তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উজ্জ্বলতম আশ্বাসের ভিত্তিও রচনা করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের এতসব বড় বড় সাফল্য ছিল না, যার ফলে তার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিঃশঙ্কচিত্তে ও নির্দ্বিধায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে পারে। পৃথিবীর কোনো দেশে ক্ষমতাসীন দল ১০০ ভাগ সাফল্য নিয়ে নির্বাচনে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় না, কিন্তু তাই বলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কোথাও নির্বাচন থেকে কোনো রকম সংকীর্ণতা দেখিয়ে দূরে রাখার কল্পনাও করে না। নির্বাচন সব অবস্থায় পরিপূর্ণ সমঝোতার মধ্য দিয়ে সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই করা হয়। গণতান্ত্রিক উদারতা ও আন্তরিকতাই ভোটারদের নির্মোহভাবে ভোটদানে উদ্বুদ্ধ করে, সব ভুলত্রুটি বিচার-বিবেচনা করেই তারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিককেই বেছে নেয় এবং তাদের হিসাবে কখনো ভুল হয় না। নির্বাচনে ভোটাররা আসলে কোনো একটি পক্ষকে জেতায় না, বিজয়ী করে গণতন্ত্রকেই। এ গণতন্ত্র নিছক ভোটের গণতন্ত্র মনে হলেও ধনিক ও ক্ষমতাবান শ্রেণীর জন্য তা যতটা দরকার, শোষিত-বঞ্চিত দরিদ্র জনগণের জন্য তার প্রয়োজন হয় অনেক বেশি। তাদের বাঁচার অবলম্বন এ গণতন্ত্র। গণতন্ত্র তাদের সুদীর্ঘ গণসংগ্রামের রক্ত-ফসল। গণতন্ত্রই তাদের চোখের মণি, মাথার মুকুট। তাদের প্রাণাধিক প্রিয় স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। নির্বাচন নিশ্চিত হোক। গণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক।
১০.৬.২০১৩
No comments