কালান্তরের কড়চা-তুরস্কে শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
রাবেয়া ইশতাদায়ি একটি টার্কিশ দৈনিকের
লন্ডন প্রতিনিধি। লন্ডনে উচ্চশিক্ষার জন্য ছাত্রী হিসেবে এসেছিলেন। এক
ইংরেজ সহপাঠীর প্রেমে পড়ে এ দেশেই থেকে গেছেন। বয়স ত্রিশের মতো। সুন্দরী ও
বিদূষী। তাঁর সঙ্গে লন্ডনের সু-লেনের এককালের প্রেসক্লাবে পরিচয়।
তারপর দীর্ঘকাল আর যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি আকস্মিকভাবে আমাকে টেলিফোন
করে তিনি জানতে চাইলেন, ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান
অবস্থা কী? বললাম, মঞ্চটি আপাতত নিষ্ক্রিয়। তবে আন্দোলন টিকে আছে।
প্রয়োজনের মুহূর্তে তা আবার সক্রিয় হবে। রাবেয়া বললেন, তিনি এ সম্পর্কে
একটু বিশদ তথ্য জানার জন্য আমার বাড়িতে আসতে চান, আসতে পারেন কি? বলেছি,
আসুন।
সপ্তাহখানেক আগের কথা। রাবেয়া ইশতাদায়ি বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সেক্যুলার ও ফান্ডামেন্টালিস্ট রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব ও পাওয়ার স্ট্রাগল সম্পর্কে তাঁদের 'হুররিয়াত' কাগজে একটি প্রতিবেদন লিখছেন, তাতে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আমার কাছে তিনি ঢাকার শাহবাগ চত্বরে গড়ে ওঠা আন্দোলন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চেয়েছেন। তাঁর আসল জানতে চাওয়া ছিল, মৌলবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য শাহবাগ আন্দোলন কি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা আয়োজিত তাদের শক্তি প্রদর্শনের একটি মহড়া, না এটি প্রকৃতই সেক্যুলার যুবশক্তি এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত জনশক্তির জাগরণ?
রাবেয়ার মতো লন্ডনে বেশ কিছু বিদেশি সাংবাদিকের ধারণা, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সেক্যুলার দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দেশটিতে 'ক্রমাগত ইসলামীকরণ' (creeping islamisation) চলছে। সরকার একদিকে তাদের বিরোধী মৌলবাদীদের উত্থান ঠেকানোর জন্য শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকে ব্যবহার করেছে, অন্যদিকে মৌলবাদীদের আপসপন্থী একটা অংশের সঙ্গে সমঝোতা করে বিএনপি ও জামায়াতের ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাসী আন্দোলন ব্যর্থ করতে চাইছে। বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত কারা জয়ী হবে এ সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক মহলের একটা অংশের মধ্যে সংশয় রয়েছে। যদিও তারা চায়, দেশটিতে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের জয় হোক। মধ্যযুগীয় মৌলবাদী অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হোক।
বাংলাদেশ সম্পর্কে তুরস্কের এক সাংবাদিকের আগ্রহী হওয়া ও ঔৎসুক্য প্রকাশের কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণসমাবেশের মতো তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের সেন্ট্রাল টাকসিম স্কয়ারের গেজি পার্কে লাখ লাখ তরুণ তুর্কির সমাবেশ ঘটেছে এবং তারা এরদোয়ান-সরকারের ইসলামীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। দিন দিন সমাবেশের পরিধি ও জনসংখ্যা বাড়ছে এবং শাহবাগ চত্বরের মতোই প্রতিবাদী জনতা নাচ-গান এবং গিটারসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাদের দাবিদাওয়া জানাচ্ছে।
গত সপ্তাহেই পুলিশের সঙ্গে গেজি চত্বরের সমাবেশে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। হাজার হাজার নর-নারী তাতে আহত হয়। কিন্তু পুলিশ সমাবেশ ভাঙতে পারেনি। এ সম্পর্কে লন্ডনের 'সানডে টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত (৯ জুন রবিবার) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, As protests spread all over the country, the 'tent city' in Taksim seemed to grow bigger and bigger. (বিক্ষোভ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে এবং ছাউনির শহরটি মনে হচ্ছে বড় থেকে বড় হয়ে উঠছে।)। এ সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের পদত্যাগও দাবি করা হয়েছে। ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণের সঙ্গে গেজি চত্বরের গণজাগরণের আশ্চর্য মিল দেখছেন রাবেয়ার মতো সাংবাদিকরা। কেউ কেউ একে তুরস্কের 'আরব বসন্ত' বলে অভিহিত করতে চাইছেন। কিন্তু রাবেয়া মনে করেন, এর সঙ্গে ঢাকার শাহবাগ চত্বরের মিল বেশি।
তবে দুই দেশের এ ঘটনায় একটি অমিল আছে। শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং সরকার তাতে কোনো বাধাদানের নীতি গ্রহণ করেনি। কারণ হাসিনা সরকার চরিত্রে সেক্যুলার। অন্যদিকে তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান এবং তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ঢাকার বিএনপির মতো নামে অসাম্প্রদায়িক দল হলেও কাজে একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল পার্টি। এই দল নারীদের হিজাব পরা থেকে শুরু করে মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতির পিতা কামাল আতাতুর্ক যে সেক্যুলার রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, এরদোয়ান সরকার সেই ভিত্তিকে ক্রমাগত ভাঙতে শুরু করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত কামাল আতাতুর্ক ও তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধে কোনো অবমাননাকর কথা বলা দণ্ডনীয় অপরাধ।
ঢাকার শাহবাগ আন্দোলন একটি সেক্যুলারপন্থী সরকারের কাছ থেকে কোনো বাধা পায়নি। তুরস্কের গেজি পার্কের আন্দোলন তাদের ধর্মীয় রক্ষণশীল সরকারের কাছ থেকে সেই বাধা পেয়েছে। অনেকের ধারণা, গত রবিবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল তুরস্ক সফর শেষে চলে গেছে, এখন এরদোয়ান সরকার সর্বশক্তি নিয়ে গেজি পার্কের সমাবেশ ভাঙার চেষ্টা করবে। দেশটিতে হয় ভয়াবহ রক্তপাত শুরু হয়ে যাচ্ছে অথবা তা আসন্ন।
এই রক্তপাত দুই ভাবে ঘটতে পারে। এরদোয়ান হুমকি দিয়েছেন, তিনি তাঁর নিজস্ব সমর্থক বাহিনী পাঠিয়ে এই সমাবেশ ভেঙে দেবেন। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তাতে রক্তপাত হবেই। অথবা তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে 'ইয়ংটার্ক'দের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করতে পারেন। তাতেও রক্তপাত অনিবার্য। এরদোয়ান সরকারের পক্ষে সমস্যা হয়েছে, গেজি পার্কের বিদ্রোহের কোনো চিহ্নিত নেতৃত্ব নেই, যাদের তিনি গ্রেপ্তার করতে পারে। অনেকটা ঢাকার শাহবাগ চত্বরের জনজাগরণের মতো। গেজি চত্বরে জনসমাবেশের আহ্বান জানাচ্ছে সামাজিক মিডিয়াগুলো- যেমন ফেসবুক অথবা টুইটার। পুলিশ রাউন্ডআপ করবে কাদের? ঢাকার এক শ্রেণীর ব্লগার একদিকে সরকারি নির্যাতন এবং অন্যদিকে মৌলবাদী সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিক থেকেই তুরস্কে মার্কিন প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দেশটিকে ক্লায়েন্ট স্টেটে পরিণত করে পেন্টাগন। বলা হয়, কামালের সেক্যুলারিজম রক্ষা করার স্বার্থে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে। এই ছদ্মবেশী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তুরস্কে জনজাগরণ শুরু হওয়ার আভাস দেখা গেলেও ওয়াশিংটন তাদের প্রতি নমনীয় মৌলবাদীদের তোল্লা দিতে শুরু করে। যেমন- তারা বাংলাদেশে একসময় দিয়েছে জামায়াতিদের। তুরস্কে এই মার্কিন নীতির ফলেই মধ্যপন্থী বলে পরিচিত এরদোয়ান এবং তাঁর জাস্টিস দলের ক্ষমতা লাভ এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠান।
এখন ধীরে ধীরে এরদোয়ানের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। তাঁর মধ্যপন্থার মুখোশটি ছিঁড়ে গিয়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার আসল চেহারাটি বেরিয়ে আসছে। যেমন বাংলাদেশে বেরিয়ে আসছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিতে গিয়ে বিএনপির আসল চেহারা। আমেরিকাও এরদোয়ানকে নিয়ে এখন বিপাকে। তাঁর উচ্চাভিলাষ এখন ক্রমাগত বাড়ছে। তিনি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির ওল্ড রোমান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখার মতো ওল্ড অটোমান সাম্রাজ্য (ওসমানিয়া সাম্রাজ্য) প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন এবং নিজেকে সুলতান খেতাবে ভূষিত করার অভিলাষ পোষণ করেন। অটোমান এমপায়ারের সম্রাটকে বলা হতো সুলতান।
এই অভিলাষ পূর্ণ করার লক্ষ্যে তাঁর ইচ্ছা তুরস্কের সংবিধান পাল্টানো। এই সংবিধানের ধারা অনুযায়ী তিনি আর ২০১৫ সালের পর প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। ফলে তিনি সংবিধান সংশোধন করে এক্সিকিউটিভ পাওয়ারসহ রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে চান। এই উদ্দেশ্যে মৌলবাদীদের সমর্থন লাভের জন্য ধীরে ধীরে তুরস্কে শরিয়াহ শাসন প্রবর্তন করতেও চান। এরই মধ্যে তিনি তুরস্কে প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরাধরি করে রাস্তায় চলতে নিষিদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে জামায়াতিদের তুষ্ট করার জন্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর অবৈধ চাপ সৃষ্টি করেছিলেন এই এরদোয়ান সরকার। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য তার মুখের মতো জবাব দিয়েছে। এরদোয়ান গণতন্ত্রের বিধিবিধানও মেনে চলতে চান না।
বাংলাদেশ ও তুরস্ক- দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তুরস্কে জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলারিজমের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দেশটিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের রাষ্ট্রাদর্শ বিসর্জন দিয়ে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতায় ফিরে যাওয়ার চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। তাই প্রকরণে যত পার্থক্য থাক ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ এবং ইস্তাম্বুলের গেজি চত্বরের ইয়ংটার্কস আন্দোলনের লক্ষ্য ও চরিত্র এক।
দুটি দেশেই গণজাগরণ ও আধুনিক গণতন্ত্রের জয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লন্ডন, ১০ জুন, সোমবার, ২০১৩
সপ্তাহখানেক আগের কথা। রাবেয়া ইশতাদায়ি বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সেক্যুলার ও ফান্ডামেন্টালিস্ট রাজনৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব ও পাওয়ার স্ট্রাগল সম্পর্কে তাঁদের 'হুররিয়াত' কাগজে একটি প্রতিবেদন লিখছেন, তাতে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আমার কাছে তিনি ঢাকার শাহবাগ চত্বরে গড়ে ওঠা আন্দোলন সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে চেয়েছেন। তাঁর আসল জানতে চাওয়া ছিল, মৌলবাদীদের শায়েস্তা করার জন্য শাহবাগ আন্দোলন কি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বারা আয়োজিত তাদের শক্তি প্রদর্শনের একটি মহড়া, না এটি প্রকৃতই সেক্যুলার যুবশক্তি এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত জনশক্তির জাগরণ?
রাবেয়ার মতো লন্ডনে বেশ কিছু বিদেশি সাংবাদিকের ধারণা, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সেক্যুলার দল ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দেশটিতে 'ক্রমাগত ইসলামীকরণ' (creeping islamisation) চলছে। সরকার একদিকে তাদের বিরোধী মৌলবাদীদের উত্থান ঠেকানোর জন্য শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনকে ব্যবহার করেছে, অন্যদিকে মৌলবাদীদের আপসপন্থী একটা অংশের সঙ্গে সমঝোতা করে বিএনপি ও জামায়াতের ক্ষমতা দখলের সন্ত্রাসী আন্দোলন ব্যর্থ করতে চাইছে। বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত কারা জয়ী হবে এ সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক মহলের একটা অংশের মধ্যে সংশয় রয়েছে। যদিও তারা চায়, দেশটিতে গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের জয় হোক। মধ্যযুগীয় মৌলবাদী অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হোক।
বাংলাদেশ সম্পর্কে তুরস্কের এক সাংবাদিকের আগ্রহী হওয়া ও ঔৎসুক্য প্রকাশের কারণ রয়েছে। বর্তমানে ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণসমাবেশের মতো তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের সেন্ট্রাল টাকসিম স্কয়ারের গেজি পার্কে লাখ লাখ তরুণ তুর্কির সমাবেশ ঘটেছে এবং তারা এরদোয়ান-সরকারের ইসলামীকরণ নীতির বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। দিন দিন সমাবেশের পরিধি ও জনসংখ্যা বাড়ছে এবং শাহবাগ চত্বরের মতোই প্রতিবাদী জনতা নাচ-গান এবং গিটারসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাদের দাবিদাওয়া জানাচ্ছে।
গত সপ্তাহেই পুলিশের সঙ্গে গেজি চত্বরের সমাবেশে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। হাজার হাজার নর-নারী তাতে আহত হয়। কিন্তু পুলিশ সমাবেশ ভাঙতে পারেনি। এ সম্পর্কে লন্ডনের 'সানডে টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত (৯ জুন রবিবার) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, As protests spread all over the country, the 'tent city' in Taksim seemed to grow bigger and bigger. (বিক্ষোভ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে এবং ছাউনির শহরটি মনে হচ্ছে বড় থেকে বড় হয়ে উঠছে।)। এ সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ানের পদত্যাগও দাবি করা হয়েছে। ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণের সঙ্গে গেজি চত্বরের গণজাগরণের আশ্চর্য মিল দেখছেন রাবেয়ার মতো সাংবাদিকরা। কেউ কেউ একে তুরস্কের 'আরব বসন্ত' বলে অভিহিত করতে চাইছেন। কিন্তু রাবেয়া মনে করেন, এর সঙ্গে ঢাকার শাহবাগ চত্বরের মিল বেশি।
তবে দুই দেশের এ ঘটনায় একটি অমিল আছে। শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং সরকার তাতে কোনো বাধাদানের নীতি গ্রহণ করেনি। কারণ হাসিনা সরকার চরিত্রে সেক্যুলার। অন্যদিকে তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান এবং তাঁর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ঢাকার বিএনপির মতো নামে অসাম্প্রদায়িক দল হলেও কাজে একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল পার্টি। এই দল নারীদের হিজাব পরা থেকে শুরু করে মদ্যপান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জাতির পিতা কামাল আতাতুর্ক যে সেক্যুলার রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন, এরদোয়ান সরকার সেই ভিত্তিকে ক্রমাগত ভাঙতে শুরু করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত কামাল আতাতুর্ক ও তাঁর আদর্শের বিরুদ্ধে কোনো অবমাননাকর কথা বলা দণ্ডনীয় অপরাধ।
ঢাকার শাহবাগ আন্দোলন একটি সেক্যুলারপন্থী সরকারের কাছ থেকে কোনো বাধা পায়নি। তুরস্কের গেজি পার্কের আন্দোলন তাদের ধর্মীয় রক্ষণশীল সরকারের কাছ থেকে সেই বাধা পেয়েছে। অনেকের ধারণা, গত রবিবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল তুরস্ক সফর শেষে চলে গেছে, এখন এরদোয়ান সরকার সর্বশক্তি নিয়ে গেজি পার্কের সমাবেশ ভাঙার চেষ্টা করবে। দেশটিতে হয় ভয়াবহ রক্তপাত শুরু হয়ে যাচ্ছে অথবা তা আসন্ন।
এই রক্তপাত দুই ভাবে ঘটতে পারে। এরদোয়ান হুমকি দিয়েছেন, তিনি তাঁর নিজস্ব সমর্থক বাহিনী পাঠিয়ে এই সমাবেশ ভেঙে দেবেন। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তাতে রক্তপাত হবেই। অথবা তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে 'ইয়ংটার্ক'দের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করতে পারেন। তাতেও রক্তপাত অনিবার্য। এরদোয়ান সরকারের পক্ষে সমস্যা হয়েছে, গেজি পার্কের বিদ্রোহের কোনো চিহ্নিত নেতৃত্ব নেই, যাদের তিনি গ্রেপ্তার করতে পারে। অনেকটা ঢাকার শাহবাগ চত্বরের জনজাগরণের মতো। গেজি চত্বরে জনসমাবেশের আহ্বান জানাচ্ছে সামাজিক মিডিয়াগুলো- যেমন ফেসবুক অথবা টুইটার। পুলিশ রাউন্ডআপ করবে কাদের? ঢাকার এক শ্রেণীর ব্লগার একদিকে সরকারি নির্যাতন এবং অন্যদিকে মৌলবাদী সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিক থেকেই তুরস্কে মার্কিন প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দেশটিকে ক্লায়েন্ট স্টেটে পরিণত করে পেন্টাগন। বলা হয়, কামালের সেক্যুলারিজম রক্ষা করার স্বার্থে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে। এই ছদ্মবেশী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তুরস্কে জনজাগরণ শুরু হওয়ার আভাস দেখা গেলেও ওয়াশিংটন তাদের প্রতি নমনীয় মৌলবাদীদের তোল্লা দিতে শুরু করে। যেমন- তারা বাংলাদেশে একসময় দিয়েছে জামায়াতিদের। তুরস্কে এই মার্কিন নীতির ফলেই মধ্যপন্থী বলে পরিচিত এরদোয়ান এবং তাঁর জাস্টিস দলের ক্ষমতা লাভ এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠান।
এখন ধীরে ধীরে এরদোয়ানের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। তাঁর মধ্যপন্থার মুখোশটি ছিঁড়ে গিয়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার আসল চেহারাটি বেরিয়ে আসছে। যেমন বাংলাদেশে বেরিয়ে আসছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিতে গিয়ে বিএনপির আসল চেহারা। আমেরিকাও এরদোয়ানকে নিয়ে এখন বিপাকে। তাঁর উচ্চাভিলাষ এখন ক্রমাগত বাড়ছে। তিনি ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির ওল্ড রোমান সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখার মতো ওল্ড অটোমান সাম্রাজ্য (ওসমানিয়া সাম্রাজ্য) প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন এবং নিজেকে সুলতান খেতাবে ভূষিত করার অভিলাষ পোষণ করেন। অটোমান এমপায়ারের সম্রাটকে বলা হতো সুলতান।
এই অভিলাষ পূর্ণ করার লক্ষ্যে তাঁর ইচ্ছা তুরস্কের সংবিধান পাল্টানো। এই সংবিধানের ধারা অনুযায়ী তিনি আর ২০১৫ সালের পর প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। ফলে তিনি সংবিধান সংশোধন করে এক্সিকিউটিভ পাওয়ারসহ রাষ্ট্রপতির পদ সৃষ্টি করে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে চান। এই উদ্দেশ্যে মৌলবাদীদের সমর্থন লাভের জন্য ধীরে ধীরে তুরস্কে শরিয়াহ শাসন প্রবর্তন করতেও চান। এরই মধ্যে তিনি তুরস্কে প্রেমিক-প্রেমিকার হাত ধরাধরি করে রাস্তায় চলতে নিষিদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে জামায়াতিদের তুষ্ট করার জন্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য হাসিনা সরকারের ওপর অবৈধ চাপ সৃষ্টি করেছিলেন এই এরদোয়ান সরকার। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য তার মুখের মতো জবাব দিয়েছে। এরদোয়ান গণতন্ত্রের বিধিবিধানও মেনে চলতে চান না।
বাংলাদেশ ও তুরস্ক- দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তুরস্কে জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলারিজমের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দেশটিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের রাষ্ট্রাদর্শ বিসর্জন দিয়ে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতায় ফিরে যাওয়ার চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। তাই প্রকরণে যত পার্থক্য থাক ঢাকার শাহবাগ চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ এবং ইস্তাম্বুলের গেজি চত্বরের ইয়ংটার্কস আন্দোলনের লক্ষ্য ও চরিত্র এক।
দুটি দেশেই গণজাগরণ ও আধুনিক গণতন্ত্রের জয় হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লন্ডন, ১০ জুন, সোমবার, ২০১৩
No comments