সংবাদমাধ্যম আমার দেশ-এর ‘সাংবাদিকতা’ by মশিউল আলম
গত ১১ এপ্রিল সকালে পুলিশ দৈনিক আমার
দেশ-এর কার্যালয়ে ঢুকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করে নিয়ে
যাওয়ার দুই দিন পর ১৪ এপ্রিল থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে গেছে।
তারপর দুই মাস হতে চলল, মাহমুদুর রহমান এখনো বিনা বিচারে কারাগারে আটক
রয়েছেন, তাঁর পত্রিকার পাঠকেরাও পত্রিকাটি পড়তে পারছেন না। সংবাদমাধ্যমের
স্বাধীনতাপ্রত্যাশী গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এ রকম ঘটনা অনভিপ্রেত।
আমরা জানি, বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় সংবাদপত্রের রাজনৈতিক অবস্থান আছে। কোনোটার অবস্থান বেশি স্পষ্ট, কোনোটার কম। আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের রাজনৈতিক অবস্থান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। সর্বশেষ কয়েক মাস এই পত্রিকার আচরণ ছিল বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক মুখপত্রের মতো। স্বনামে মাহমুদুর রহমানের লেখাগুলো যতটা না সাংবাদিকসুলভ, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রচারকসুলভ। অবশ্য অন্য অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের জন্যও এসব কথা কমবেশি সত্য।
আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের অতিসাম্প্রতিক কালের সাংবাদিকতার বিশেষত্ব হলো, ইসলাম ধর্মকে সাংবাদিকতায় ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা কিছু ফল পেয়েছেন। সাময়িকভাবে পত্রিকাটির কাটতিও বেড়েছে। কিন্তু পত্রিকাটি এমন আচরণও করেছে, যা সাংবাদিকতার সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিরোধী এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। এই লেখায় সে রকম সব দৃষ্টান্ত তুলে ধরার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে দু-একটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
তার আগে সাংবাদিকতার কিছু প্রাথমিক নীতি আমরা দেখে নিতে পারি। একটি মৌলনীতি হচ্ছে: এমন তথ্য, ছবি, মন্তব্য, আহ্বান ইত্যাদি প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না, যার ফলে একজন মানুষেরও জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিলেতের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস ও অন্য তিন দেশের তিনটি সংবাদপত্র যখন উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপনীয় মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তার ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের প্রথম কাজটিই ছিল তারবার্তাগুলো থেকে সেসব মানুষের নাম মুছে দেওয়া, নাম প্রকাশিত হওয়ার পর যাঁদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। আফগান যুদ্ধের সময় দেশটির যেসব সাধারণ নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, ছাত্র ও সরকারি কর্মকর্তা তালেবান ও আল-কায়েদা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আমেরিকানদের সহযোগিতা করেছিলেন, পত্রিকাগুলো সংবাদ পরিবেশন করেছে তাঁদের নাম-পরিচয় মুছে দিয়ে। কারণ, নাম প্রকাশ পেলে ওই লোকগুলোকে তালেবানরা হত্যা করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে এই নীতির উল্টো কাজ করেছে দৈনিক আমার দেশ। শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল পর্বে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হওয়ার চার দিন পর ২০ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘ব্লগে নাস্তিকতার নামে কুৎসিত অসভ্যতা।’ ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছে দুজন ব্লগারের ছবি ও নাম; কৌশলে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘নাস্তিক’ ও ‘ইসলামবিদ্বেষী’ হিসেবে। নাস্তিকতা ও ইসলামবিদ্বেষের অভিযোগে সদ্যই একজন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে, এমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আরও দুজন ব্লগারের ছবি ও নাম প্রথম পাতায় প্রকাশ করে আমার দেশ আসলে কী চেয়েছিল? আরও কয়েকজন ব্লগারের নাম ‘নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী’ বিশেষণসহ ছাপা হয়েছে একাধিকবার। সদ্য নিহত ব্লগার রাজীবের মতো পরিণতি এই ব্লগারদেরও হোক—এ রকমই কি ছিল আমার দেশ-এর প্রচ্ছন্ন আহ্বান?
২৫ ফেব্রুয়ারি ‘নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি চাই’ সাধারণ শিরোনামে ‘অনলাইন পাঠকের ভাবনা’য় ছাপা হয়েছে একজন ব্লগারের সঙ্গে জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ছবি। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘নাস্তিক ব্লগার (...)-এর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে লেখক জাফর ইকবাল।’ কয়েকজন ব্লগারের ধর্ম অবমাননার সঙ্গে ওই লেখককে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে এই ছবি ও এর উদ্দেশ্যপূর্ণ ক্যাপশন ছাপানোর মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরেক জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হকেরও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করেছে পত্রিকাটি। ২৮ মার্চ আনিসুল হকের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর আমার দেশ-এর অনলাইন সংস্করণে কিছু পাঠক লেখককে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার উসকানি দিলে সেটা আবার মুদ্রণ সংস্করণে ছাপা হয়েছে। ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর হুমকি সৃষ্টিকারী এমন আচরণ শুধু সাংবাদিকতার নৈতিকতাবিরোধীই নয়, গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও বটে।
সাংবাদিকতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি: ব্যক্তিমানুষের সম্মানহানি ঘটে এমন সংবাদ, ছবি ও মন্তব্য প্রকাশ না করা। আমার দেশ এই নীতিটিও ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার লঙ্ঘন করেছে। যেমন, ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার তিন দিন পরই ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম পাতায় দুই কলামে রাজীবের ছবিসহ একটি লেখা ছাপা হয়েছে ‘ধর্মদ্রোহী নষ্ট তরুণের প্রতিকৃতি ব্লগার রাজীব’ শিরোনামে। সদ্য নিহত তরুণটির চরিত্র হননের মাধ্যমে তাঁর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ বলে মত গঠনের চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তা ছাড়া ওই লেখায় রাজীবের সঙ্গে জড়িয়ে যে দুই নারীর নাম ছাপা হয়েছে, তাতে তাঁদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্মানের হানি ঘটেছে। লেখাটির শুরু: ‘প্রচণ্ড ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার রাজীবের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে তার গার্লফ্রেন্ড...। ...ছাড়াও আরেক প্রেমিকা...-এর সঙ্গে অবাধ মেলামেশার তথ্য পাওয়া গেছে...।’ এই নারীদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে ওই লেখাটিতে। তাঁরা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ চাইতে পারতেন।
আমার দেশ কিছু তথ্য ও ছবি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করে ছেপেছে। কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের ছবি হিসেবে প্রচার করা একটি আলোচিত দৃষ্টান্ত। পরে বিষয়টি ধরা পড়লে পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণ থেকে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে কোনো দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই। এটা কী ধরনের সাংবাদিকতা?
ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার পর থেকে আমার দেশ শাহবাগ আন্দোলনকে ‘নাস্তিক ব্লগারদের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ’ হিসেবে প্রচার করেছে। ঢালাওভাবে শাহবাগের সব তরুণ-তরুণীকে ‘নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী’ বলতে চেয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘থাবা বাবা গংদের ব্লগে চোখ বুলালে স্পষ্ট ধরা পড়ে যে আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ একেবারে পচে গেছে। শাহবাগ চত্বরে তাদের কথার তালে তালে তালি দিয়ে নৃত্যরতদের সংখ্যা দেখে বলা যায়, এই পচে যাওয়া তারুণ্যের অবয়ব একেবারে ক্ষুদ্র নয়। এরা শিক্ষিত, ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং অবশ্যই কোনো না কোনো বিবাহিত দম্পতির সন্তান।’ শেষ বাক্যের দ্বিতীয় অংশটির ইঙ্গিত শুধু ভব্যতাবর্জিত নয়, মারাত্মকভাবে উসকানিমূলকও বটে। উত্তপ্ত সময়ে এমন উসকানি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।
একই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছে, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুকে নিজস্ব ব্লগ বানিয়ে তারা যেসব কল্পনাতীত অশালীন শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস ঘটিয়েছে, তা উদ্ধৃত করলে আমার দেশের সম্পাদকীয় পাতা অপবিত্র হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।’ মজার বিষয়, ওই দিনই পত্রিকাটির প্রথম পাতা ‘অপবিত্র’ করে ফেলা হয়েছে। অর্ধেক পাতাজুড়ে হেফাজতে ইসলামের নামে এক বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, যেখানে কয়েকজন ব্লগারের ওই সব লেখাসংবলিত ব্লগপোস্টের স্ক্রিনশট ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া কয়েকজন ব্লগারের এ রকম লেখালেখি ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করে আমার দেশ যেসব প্রতিবেদন তৈরি করে প্রচার করেছে, সেসব প্রতিবেদনেও কোরআন, মহানবী (সা.) ও আল্লাহ সম্পর্কে মুদ্রণের অযোগ্য শব্দ ও বাক্য হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে মানহানি, অপবাদ ইত্যাদির (লাইবেল) সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানিকর উক্তি, শব্দ বা ছবি হুবহু উদ্ধৃত বা পুনঃপ্রকাশ করা হলে আবারও মানহানি ঘটে, অপবাদের পুনঃপ্রচার ঘটে। সাধারণত এর উদ্দেশ্য হয় অসৎ, প্রতিহিংসামূলক। আমার দেশ দৃশ্যত এসব করেছে সমাজে অস্থিরতা বাড়ানো ও সহিংসতা সৃষ্টির লক্ষ্যে।
পৃথিবীর কোনো দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটকে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উৎস হিসেবে ব্যবহার করে না। আমার দেশ বিপজ্জনকভাবে সেটা করেছে। ইসলাম ধর্ম, মহানবী (সা.), পবিত্র কোরআন ও আল্লাহ সম্পর্কে কয়েকজন ব্লগারের আপত্তিকর লেখালেখি ইন্টারনেটের সীমিত অঙ্গন থেকে তুলে এনে সমগ্র জাতির সামনে দিনের পর দিন প্রচার করেছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট-জগৎ বা ব্লগ-ভুবন যখন অনেক ক্ষেত্রে গুজব, উসকানি ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর নেটওয়ার্ক হয়ে উঠেছে, তখন আমার দেশ বিশেষত ইসলাম সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বা উসকানিমূলক বিষয়গুলো সংগ্রহ করেছে ইন্টারনেট থেকেই। ব্লগের সীমিত পরিসরে অল্প কিছু মানুষের মধ্যে প্রচারিত অত্যন্ত আপত্তিকর ও উসকানিমূলক লেখালেখি জাতীয় সংবাদপত্রে বারবার প্রকাশের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া মোটেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়। ইসলামের অবমাননার দায়ে যে ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ-উসকানি ছড়িয়ে তাদের চরম শাস্তির পক্ষে কথা বলেছে আমার দেশ, তাদের অবমাননাকর কথাগুলোই উদ্দেশ্যমূলকভাবে বারবার প্রচারের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটির দ্বারাও একই অপরাধ বারবার সংঘটিত হয়েছে। উপরন্তু অনেকে দাবি করেছেন, ব্লগের ওই লেখাগুলো যাদের নামে ছাপা হয়েছে সেগুলো আসলে তাদের লেখা নয়। ইন্টারনেটে তাদের নাম দিয়ে অন্যরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব লেখা লিখে প্রচার করেছে।
তবু, এসব সত্ত্বেও মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া, ১৩ দিন ধরে তাঁকে পুলিশি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তাঁর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, প্রায় দুই মাস ধরে বিনা বিচারে তাঁর আটক থাকা এবং আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ থাকা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রত্যাশী সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদমাধ্যমের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনকও বটে।
আগামীকাল পড়ুন: সম্পাদকদের বিবৃতি ও সংবাদমাধ্যমের আত্মনিয়ন্ত্রণ
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
আমরা জানি, বাংলাদেশের অধিকাংশ জাতীয় সংবাদপত্রের রাজনৈতিক অবস্থান আছে। কোনোটার অবস্থান বেশি স্পষ্ট, কোনোটার কম। আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের রাজনৈতিক অবস্থান সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। সর্বশেষ কয়েক মাস এই পত্রিকার আচরণ ছিল বিএনপি-জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক মুখপত্রের মতো। স্বনামে মাহমুদুর রহমানের লেখাগুলো যতটা না সাংবাদিকসুলভ, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রচারকসুলভ। অবশ্য অন্য অনেক সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের জন্যও এসব কথা কমবেশি সত্য।
আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমানের অতিসাম্প্রতিক কালের সাংবাদিকতার বিশেষত্ব হলো, ইসলাম ধর্মকে সাংবাদিকতায় ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা কিছু ফল পেয়েছেন। সাময়িকভাবে পত্রিকাটির কাটতিও বেড়েছে। কিন্তু পত্রিকাটি এমন আচরণও করেছে, যা সাংবাদিকতার সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিরোধী এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। এই লেখায় সে রকম সব দৃষ্টান্ত তুলে ধরার সুযোগ নেই। সংক্ষেপে দু-একটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
তার আগে সাংবাদিকতার কিছু প্রাথমিক নীতি আমরা দেখে নিতে পারি। একটি মৌলনীতি হচ্ছে: এমন তথ্য, ছবি, মন্তব্য, আহ্বান ইত্যাদি প্রকাশ বা প্রচার করা যাবে না, যার ফলে একজন মানুষেরও জীবনের নিরাপত্তার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। বিলেতের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস ও অন্য তিন দেশের তিনটি সংবাদপত্র যখন উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপনীয় মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তার ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের প্রথম কাজটিই ছিল তারবার্তাগুলো থেকে সেসব মানুষের নাম মুছে দেওয়া, নাম প্রকাশিত হওয়ার পর যাঁদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে। আফগান যুদ্ধের সময় দেশটির যেসব সাধারণ নাগরিক, মানবাধিকারকর্মী, ছাত্র ও সরকারি কর্মকর্তা তালেবান ও আল-কায়েদা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আমেরিকানদের সহযোগিতা করেছিলেন, পত্রিকাগুলো সংবাদ পরিবেশন করেছে তাঁদের নাম-পরিচয় মুছে দিয়ে। কারণ, নাম প্রকাশ পেলে ওই লোকগুলোকে তালেবানরা হত্যা করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে এই নীতির উল্টো কাজ করেছে দৈনিক আমার দেশ। শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল পর্বে ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হওয়ার চার দিন পর ২০ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির প্রথম পাতায় প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘ব্লগে নাস্তিকতার নামে কুৎসিত অসভ্যতা।’ ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে ছাপা হয়েছে দুজন ব্লগারের ছবি ও নাম; কৌশলে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘নাস্তিক’ ও ‘ইসলামবিদ্বেষী’ হিসেবে। নাস্তিকতা ও ইসলামবিদ্বেষের অভিযোগে সদ্যই একজন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে, এমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে আরও দুজন ব্লগারের ছবি ও নাম প্রথম পাতায় প্রকাশ করে আমার দেশ আসলে কী চেয়েছিল? আরও কয়েকজন ব্লগারের নাম ‘নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী’ বিশেষণসহ ছাপা হয়েছে একাধিকবার। সদ্য নিহত ব্লগার রাজীবের মতো পরিণতি এই ব্লগারদেরও হোক—এ রকমই কি ছিল আমার দেশ-এর প্রচ্ছন্ন আহ্বান?
২৫ ফেব্রুয়ারি ‘নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি চাই’ সাধারণ শিরোনামে ‘অনলাইন পাঠকের ভাবনা’য় ছাপা হয়েছে একজন ব্লগারের সঙ্গে জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ছবি। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘নাস্তিক ব্লগার (...)-এর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে লেখক জাফর ইকবাল।’ কয়েকজন ব্লগারের ধর্ম অবমাননার সঙ্গে ওই লেখককে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে এই ছবি ও এর উদ্দেশ্যপূর্ণ ক্যাপশন ছাপানোর মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরেক জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হকেরও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করেছে পত্রিকাটি। ২৮ মার্চ আনিসুল হকের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর আমার দেশ-এর অনলাইন সংস্করণে কিছু পাঠক লেখককে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার উসকানি দিলে সেটা আবার মুদ্রণ সংস্করণে ছাপা হয়েছে। ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য ভয়ংকর হুমকি সৃষ্টিকারী এমন আচরণ শুধু সাংবাদিকতার নৈতিকতাবিরোধীই নয়, গুরুতর ফৌজদারি অপরাধও বটে।
সাংবাদিকতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি: ব্যক্তিমানুষের সম্মানহানি ঘটে এমন সংবাদ, ছবি ও মন্তব্য প্রকাশ না করা। আমার দেশ এই নীতিটিও ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার লঙ্ঘন করেছে। যেমন, ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার তিন দিন পরই ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম পাতায় দুই কলামে রাজীবের ছবিসহ একটি লেখা ছাপা হয়েছে ‘ধর্মদ্রোহী নষ্ট তরুণের প্রতিকৃতি ব্লগার রাজীব’ শিরোনামে। সদ্য নিহত তরুণটির চরিত্র হননের মাধ্যমে তাঁর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ বলে মত গঠনের চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। তা ছাড়া ওই লেখায় রাজীবের সঙ্গে জড়িয়ে যে দুই নারীর নাম ছাপা হয়েছে, তাতে তাঁদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্মানের হানি ঘটেছে। লেখাটির শুরু: ‘প্রচণ্ড ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার রাজীবের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে তার গার্লফ্রেন্ড...। ...ছাড়াও আরেক প্রেমিকা...-এর সঙ্গে অবাধ মেলামেশার তথ্য পাওয়া গেছে...।’ এই নারীদের ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সংক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ঘটেছে ওই লেখাটিতে। তাঁরা পত্রিকাটির বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ চাইতে পারতেন।
আমার দেশ কিছু তথ্য ও ছবি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করে ছেপেছে। কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের ছবি হিসেবে প্রচার করা একটি আলোচিত দৃষ্টান্ত। পরে বিষয়টি ধরা পড়লে পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণ থেকে ছবিটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে কোনো দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই। এটা কী ধরনের সাংবাদিকতা?
ব্লগার রাজীব খুন হওয়ার পর থেকে আমার দেশ শাহবাগ আন্দোলনকে ‘নাস্তিক ব্লগারদের তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ’ হিসেবে প্রচার করেছে। ঢালাওভাবে শাহবাগের সব তরুণ-তরুণীকে ‘নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী’ বলতে চেয়েছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটির এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘থাবা বাবা গংদের ব্লগে চোখ বুলালে স্পষ্ট ধরা পড়ে যে আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ একেবারে পচে গেছে। শাহবাগ চত্বরে তাদের কথার তালে তালে তালি দিয়ে নৃত্যরতদের সংখ্যা দেখে বলা যায়, এই পচে যাওয়া তারুণ্যের অবয়ব একেবারে ক্ষুদ্র নয়। এরা শিক্ষিত, ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং অবশ্যই কোনো না কোনো বিবাহিত দম্পতির সন্তান।’ শেষ বাক্যের দ্বিতীয় অংশটির ইঙ্গিত শুধু ভব্যতাবর্জিত নয়, মারাত্মকভাবে উসকানিমূলকও বটে। উত্তপ্ত সময়ে এমন উসকানি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক।
একই সম্পাদকীয়তে আরও লেখা হয়েছে, ‘ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুকে নিজস্ব ব্লগ বানিয়ে তারা যেসব কল্পনাতীত অশালীন শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস ঘটিয়েছে, তা উদ্ধৃত করলে আমার দেশের সম্পাদকীয় পাতা অপবিত্র হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।’ মজার বিষয়, ওই দিনই পত্রিকাটির প্রথম পাতা ‘অপবিত্র’ করে ফেলা হয়েছে। অর্ধেক পাতাজুড়ে হেফাজতে ইসলামের নামে এক বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, যেখানে কয়েকজন ব্লগারের ওই সব লেখাসংবলিত ব্লগপোস্টের স্ক্রিনশট ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া কয়েকজন ব্লগারের এ রকম লেখালেখি ইন্টারনেট ঘেঁটে বের করে আমার দেশ যেসব প্রতিবেদন তৈরি করে প্রচার করেছে, সেসব প্রতিবেদনেও কোরআন, মহানবী (সা.) ও আল্লাহ সম্পর্কে মুদ্রণের অযোগ্য শব্দ ও বাক্য হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে মানহানি, অপবাদ ইত্যাদির (লাইবেল) সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মানহানিকর উক্তি, শব্দ বা ছবি হুবহু উদ্ধৃত বা পুনঃপ্রকাশ করা হলে আবারও মানহানি ঘটে, অপবাদের পুনঃপ্রচার ঘটে। সাধারণত এর উদ্দেশ্য হয় অসৎ, প্রতিহিংসামূলক। আমার দেশ দৃশ্যত এসব করেছে সমাজে অস্থিরতা বাড়ানো ও সহিংসতা সৃষ্টির লক্ষ্যে।
পৃথিবীর কোনো দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যম এখন পর্যন্ত ইন্টারনেটকে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উৎস হিসেবে ব্যবহার করে না। আমার দেশ বিপজ্জনকভাবে সেটা করেছে। ইসলাম ধর্ম, মহানবী (সা.), পবিত্র কোরআন ও আল্লাহ সম্পর্কে কয়েকজন ব্লগারের আপত্তিকর লেখালেখি ইন্টারনেটের সীমিত অঙ্গন থেকে তুলে এনে সমগ্র জাতির সামনে দিনের পর দিন প্রচার করেছে। বাংলাদেশের ইন্টারনেট-জগৎ বা ব্লগ-ভুবন যখন অনেক ক্ষেত্রে গুজব, উসকানি ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর নেটওয়ার্ক হয়ে উঠেছে, তখন আমার দেশ বিশেষত ইসলাম সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বা উসকানিমূলক বিষয়গুলো সংগ্রহ করেছে ইন্টারনেট থেকেই। ব্লগের সীমিত পরিসরে অল্প কিছু মানুষের মধ্যে প্রচারিত অত্যন্ত আপত্তিকর ও উসকানিমূলক লেখালেখি জাতীয় সংবাদপত্রে বারবার প্রকাশের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা ছড়িয়ে দেওয়া মোটেই দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়। ইসলামের অবমাননার দায়ে যে ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ-উসকানি ছড়িয়ে তাদের চরম শাস্তির পক্ষে কথা বলেছে আমার দেশ, তাদের অবমাননাকর কথাগুলোই উদ্দেশ্যমূলকভাবে বারবার প্রচারের মধ্য দিয়ে পত্রিকাটির দ্বারাও একই অপরাধ বারবার সংঘটিত হয়েছে। উপরন্তু অনেকে দাবি করেছেন, ব্লগের ওই লেখাগুলো যাদের নামে ছাপা হয়েছে সেগুলো আসলে তাদের লেখা নয়। ইন্টারনেটে তাদের নাম দিয়ে অন্যরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব লেখা লিখে প্রচার করেছে।
তবু, এসব সত্ত্বেও মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া, ১৩ দিন ধরে তাঁকে পুলিশি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা, তাঁর ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, প্রায় দুই মাস ধরে বিনা বিচারে তাঁর আটক থাকা এবং আমার দেশ-এর প্রকাশনা বন্ধ থাকা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রত্যাশী সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। সংবাদমাধ্যমের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনকও বটে।
আগামীকাল পড়ুন: সম্পাদকদের বিবৃতি ও সংবাদমাধ্যমের আত্মনিয়ন্ত্রণ
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments