প্রাণের আশায় ছুটছে প্রাণ by আনোয়ার হোসেন ও অরূপ রায়
বিস্ময়কন্যা রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন স্বজনহারা অনেক ব্যক্তি। কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো সুখবর ছিল না গতকাল শনিবার। আবার যেন থেমে গেছে প্রাণের স্পন্দন। গতকাল এই অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের চোখের সামনে দিয়ে একে একে বেরিয়ে এসেছে ৫০টি মৃতদেহ। তবু রানা প্লাজার আশপাশে স্বজনেরা ছুটে বেড়িয়েছেন প্রাণের আশায়। সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের যে স্থান থেকে ১৭ দিন পর রেশমা উদ্ধার হয়েছিলেন, সেই জায়গার স্ল্যাবগুলো গতকাল সরানো হয়েছে। এ নিয়ে ভবনটির মাঝখানের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সামনে ও পেছনের ধ্বংসস্তূপ প্রায় সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনের মাঝখানের জায়গা থেকে এখনো মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল বিকেল চারটার দিকেই মাঝখান থেকে একসঙ্গে আটটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও কিছু মৃতদেহ দেখা গেছে। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ধসে পড়া ভবনের সামনে ও পেছনে নিচতলার মেঝে পর্যন্ত সরানো হয়ে গেছে। মাঝখানে কিছু অংশে দু-তিনতলার কিছু স্ল্যাব রয়েছে। আজ রোববার সেগুলো সরানো সম্ভব হতে পারে। তবে ধসে পড়া ভবনের বেজমেন্টে (যেখানে গাড়ি রাখা হয়) পানি জমে আছে। রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের পর যেসব স্বজন প্রিয়জনের জীবিত উদ্ধার হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে লাশের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, তাঁদের অনেককেই গতকাল রানা প্লাজার আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। আরও কেউ বেঁচে থাকতে পারেন—এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাঁরা। সাভারের গেণ্ডা এলাকার বাসিন্দা নাসির আরাফাত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে এসে জানান, হানিফ খান নামে তাঁর এক চাচাতো ভাই ধ্বংসস্তূপের ভেতর বেঁচে আছেন। সেখান থেকে মুঠোফোনে বিদেশে অবস্থানরত বন্ধু মুরাদের নম্বরে ফোন করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। মুরাদের মা রহিমা বেগম এ কথা জানান নাসির আরাফাতকে। এরপরই নাসির ছুটে আসেন নিয়ন্ত্রণকক্ষে।
সেনা কর্মকর্তারা নাসিরের দাবি করা ওই নম্বরের তথ্য সংগ্রহ করে জানান, এটি দুই মাস ধরে বন্ধ, ব্যবহার হচ্ছে না। তাই নাসিরের দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। পরে নাসির চলে যান।
টানাপোড়েন: রানা প্লাজার পাঁচতলার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মনোয়ারা বেগম। গত শুক্রবার সকালে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধারের পর দুপুরে শনাক্ত করেন স্বজনেরা। নিশ্চিত হয়ে জেলা প্রশাসন মনোয়ারার বাবার কাছে মৃতদেহ হস্তান্তরের উদ্যোগও নেয়। কিন্তু বাদ সাধেন স্বামী মুস্তাফিজুর রহমান। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর মরদেহ দাবি করলে শুরু হয় বিবাদ। হস্তান্তর স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। মনোয়ারার বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ গ্রামে। বছর দশেক আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। তাঁদের পুষ্প নামের সাত বছরের একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। মনোয়ারার বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, মনোয়ারার স্বামী তাঁদের লাশ নিতে বাধা দেন। পরে উভয় পক্ষের সম্মতিতে দুপুরে তাঁর কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের সময় শনাক্তকারী হিসেবে বাবা ও স্বামী দুজনের নামই উল্লেখ করা হয়। তবে জেলা প্রশাসন হস্তান্তর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লিখে দিয়েছে, ‘মনোয়ারার মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেলে এর একমাত্র ভাগীদার হবে মেয়ে পুষ্প।’
ডিএনএ পরীক্ষার পরও লাশ মিলছে না: বগুড়ার সোনাতলার সুরুজ মিয়া কাজ করতেন সাততলার নিউ ওয়েভ স্টাইল পোশাক কারখানায়। ভবনের পেছনের অংশের একটি বড় বিমের আড়ালে আটকা পড়েন সুরুজসহ কয়েকজন। আলতাফ নামের আরেকজনের শরীরের নিম্নাংশ বিমের নিচে চাপা পড়ে আটকে ছিলেন। এই প্রতিবেদকসহ অনেকেই সুরুজ ও আলতাফের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তখন। ধসের প্রথম দুই দিন তাঁদের সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এরপর আর সাড়া পাওয়া যায়নি। সুরুজের মা জ্যোৎস্না বেগম কয়েক দিন ধরে অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অঝোরে কাঁদছেন। খাবার দেওয়া হলেও খাচ্ছেন না। গত শুক্রবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি শুধু বলছেন, ‘আমার সুরুজের সঙ্গে সবাই কথা বলেছে। ও জীবিত ছিল। এখন লাশও পাচ্ছি না।’ সুরুজের ভাই সুজন চার দিন আগে রক্ত দিয়ে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাইয়ের লাশ পাননি। সুজন জানান, সুরুজ তাঁর ছোট ভাই। বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই আর মা একসঙ্গে সাভার সিআরপির কাছে থাকতেন। সুজনও অন্য একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের আবুল কাশেমের মেয়ে কামনা আক্তার কাজ করতেন রানা প্লাজার পঞ্চম তলায়। গতকাল পর্যন্ত তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাননি স্বজনেরা। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৬ মে কামনার ভাই মোস্তাক আহাম্মেদ নমুনা দিয়ে আসেন হাসপাতালে। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ছিটকিবাড়ি গ্রামের আবুল কালাম ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সপ্তাহ খানেক আগে নমুনা দিয়ে এসেছেন। তিনিও মেয়ে নাছিমা আক্তারের লাশের কোনো হদিস পাচ্ছেন না। বরগুনার বেতাগীর আল-আমিনের লাশের খোঁজে তাঁর ভাই ইদ্রিসও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছেন হাসপাতালে। এখনো মৃতদেহের সন্ধান পাননি। জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরি প্রধান শরিফ আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটা নির্ভর করবে কত নমুনা পাওয়া যাচ্ছে তার পর। সাভারের ঘটনায় যত নমুনা পাওয়া গেছে, তাতে পরীক্ষা শেষ করতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে।
এক বছরের ব্যবধানে দুই ছেলে আর মেয়ে নেই: জাহানারা, সেলিনা, তহুরা, মাহমুদা, আবদুল কাদের, আবদুল খালেক—তাঁরা সবাই ভাই-বোন। এক বছরের ব্যবধানে কাদের ও খালেক চলে যান না-ফেরার দেশে। রানা প্লাজা ধসের পর ওই ভবনে কাজ করা মাহমুদাও বেঁচে নেই—এটা ধরেই নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। কারণ, গতকাল পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি।
তাঁদের বাবা শামসুল আলম বলেন, ‘বছর খানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কাদের। এর চার মাস পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান খালেক। সর্বশেষ রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আটকা পড়েন মাহমুদা। এখন তাঁর জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু লাশও খুঁজে পাচ্ছি না।’
শোকে পাথর শামসুল আলম ও স্ত্রী রাবেয়া বেগমের দিন কাটছে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। শামসুল আলমের বড় মেয়ে জাহানারা বলেন, ছোট বোন মাহমুদা আর তিনি কাজ করতেন আটতলায়। ঘটনার দিন একসঙ্গেই তাঁরা কর্মস্থলে যান। ছিলেনও পাশাপাশি। কিন্তু ভবনধসের দেড় ঘণ্টা পর তিনি অক্ষত অবস্থায় বের হতে সক্ষম হলেও বোন বের হতে পারেননি। এই জাহানারার স্বামী মোসলেম উদ্দিন বছর চারেক আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যান। বৃদ্ধ শামসুল আলম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘উপার্জনক্ষম দুই ছেলে মারা যাওয়ার পর বিধবা মেয়ে জাহানারার আয়ে সংসার চলত। এরপর বোনের সঙ্গে কাজ নেয় মাহমুদা। সেও মনে হয় চলে গেল। এখন আমি বড় অসহায়।’
সর্বশেষ তথ্য: গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক হাজার ১১২টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। তার মধ্যে ১২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। এই ভবনধসে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ১২৪-এ।
গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৮২২টি মৃতদেহ। হস্তান্তরের অপেক্ষায় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ ও বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে রয়েছে ৬৮টি মৃতদেহ। আর জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাম-পরিচয়হীন ২৩৪টি মৃতদেহ। গতকালও ৭৮টি মৃতদেহ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ভবনের মাঝখানের জায়গা থেকে এখনো মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল বিকেল চারটার দিকেই মাঝখান থেকে একসঙ্গে আটটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও কিছু মৃতদেহ দেখা গেছে। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ধসে পড়া ভবনের সামনে ও পেছনে নিচতলার মেঝে পর্যন্ত সরানো হয়ে গেছে। মাঝখানে কিছু অংশে দু-তিনতলার কিছু স্ল্যাব রয়েছে। আজ রোববার সেগুলো সরানো সম্ভব হতে পারে। তবে ধসে পড়া ভবনের বেজমেন্টে (যেখানে গাড়ি রাখা হয়) পানি জমে আছে। রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের পর যেসব স্বজন প্রিয়জনের জীবিত উদ্ধার হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে লাশের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন, তাঁদের অনেককেই গতকাল রানা প্লাজার আশপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। আরও কেউ বেঁচে থাকতে পারেন—এমন আশায় বুক বেঁধেছিলেন তাঁরা। সাভারের গেণ্ডা এলাকার বাসিন্দা নাসির আরাফাত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে এসে জানান, হানিফ খান নামে তাঁর এক চাচাতো ভাই ধ্বংসস্তূপের ভেতর বেঁচে আছেন। সেখান থেকে মুঠোফোনে বিদেশে অবস্থানরত বন্ধু মুরাদের নম্বরে ফোন করে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন। মুরাদের মা রহিমা বেগম এ কথা জানান নাসির আরাফাতকে। এরপরই নাসির ছুটে আসেন নিয়ন্ত্রণকক্ষে।
সেনা কর্মকর্তারা নাসিরের দাবি করা ওই নম্বরের তথ্য সংগ্রহ করে জানান, এটি দুই মাস ধরে বন্ধ, ব্যবহার হচ্ছে না। তাই নাসিরের দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। পরে নাসির চলে যান।
টানাপোড়েন: রানা প্লাজার পাঁচতলার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মনোয়ারা বেগম। গত শুক্রবার সকালে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধারের পর দুপুরে শনাক্ত করেন স্বজনেরা। নিশ্চিত হয়ে জেলা প্রশাসন মনোয়ারার বাবার কাছে মৃতদেহ হস্তান্তরের উদ্যোগও নেয়। কিন্তু বাদ সাধেন স্বামী মুস্তাফিজুর রহমান। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর মরদেহ দাবি করলে শুরু হয় বিবাদ। হস্তান্তর স্থগিত করে কর্তৃপক্ষ। মনোয়ারার বাবার বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ গ্রামে। বছর দশেক আগে তাঁর বিয়ে হয়েছিল কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। তাঁদের পুষ্প নামের সাত বছরের একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। মনোয়ারার বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, মনোয়ারার স্বামী তাঁদের লাশ নিতে বাধা দেন। পরে উভয় পক্ষের সম্মতিতে দুপুরে তাঁর কাছে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তরের সময় শনাক্তকারী হিসেবে বাবা ও স্বামী দুজনের নামই উল্লেখ করা হয়। তবে জেলা প্রশাসন হস্তান্তর তালিকার মন্তব্যের ঘরে লিখে দিয়েছে, ‘মনোয়ারার মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেলে এর একমাত্র ভাগীদার হবে মেয়ে পুষ্প।’
ডিএনএ পরীক্ষার পরও লাশ মিলছে না: বগুড়ার সোনাতলার সুরুজ মিয়া কাজ করতেন সাততলার নিউ ওয়েভ স্টাইল পোশাক কারখানায়। ভবনের পেছনের অংশের একটি বড় বিমের আড়ালে আটকা পড়েন সুরুজসহ কয়েকজন। আলতাফ নামের আরেকজনের শরীরের নিম্নাংশ বিমের নিচে চাপা পড়ে আটকে ছিলেন। এই প্রতিবেদকসহ অনেকেই সুরুজ ও আলতাফের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তখন। ধসের প্রথম দুই দিন তাঁদের সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এরপর আর সাড়া পাওয়া যায়নি। সুরুজের মা জ্যোৎস্না বেগম কয়েক দিন ধরে অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে অঝোরে কাঁদছেন। খাবার দেওয়া হলেও খাচ্ছেন না। গত শুক্রবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি শুধু বলছেন, ‘আমার সুরুজের সঙ্গে সবাই কথা বলেছে। ও জীবিত ছিল। এখন লাশও পাচ্ছি না।’ সুরুজের ভাই সুজন চার দিন আগে রক্ত দিয়ে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাইয়ের লাশ পাননি। সুজন জানান, সুরুজ তাঁর ছোট ভাই। বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই আর মা একসঙ্গে সাভার সিআরপির কাছে থাকতেন। সুজনও অন্য একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের আবুল কাশেমের মেয়ে কামনা আক্তার কাজ করতেন রানা প্লাজার পঞ্চম তলায়। গতকাল পর্যন্ত তাঁর মৃতদেহ খুঁজে পাননি স্বজনেরা। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৬ মে কামনার ভাই মোস্তাক আহাম্মেদ নমুনা দিয়ে আসেন হাসপাতালে। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের ছিটকিবাড়ি গ্রামের আবুল কালাম ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সপ্তাহ খানেক আগে নমুনা দিয়ে এসেছেন। তিনিও মেয়ে নাছিমা আক্তারের লাশের কোনো হদিস পাচ্ছেন না। বরগুনার বেতাগীর আল-আমিনের লাশের খোঁজে তাঁর ভাই ইদ্রিসও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য রক্ত দিয়েছেন হাসপাতালে। এখনো মৃতদেহের সন্ধান পাননি। জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরি প্রধান শরিফ আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটা নির্ভর করবে কত নমুনা পাওয়া যাচ্ছে তার পর। সাভারের ঘটনায় যত নমুনা পাওয়া গেছে, তাতে পরীক্ষা শেষ করতে ছয় মাসের বেশি সময় লাগবে।
এক বছরের ব্যবধানে দুই ছেলে আর মেয়ে নেই: জাহানারা, সেলিনা, তহুরা, মাহমুদা, আবদুল কাদের, আবদুল খালেক—তাঁরা সবাই ভাই-বোন। এক বছরের ব্যবধানে কাদের ও খালেক চলে যান না-ফেরার দেশে। রানা প্লাজা ধসের পর ওই ভবনে কাজ করা মাহমুদাও বেঁচে নেই—এটা ধরেই নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। কারণ, গতকাল পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান মেলেনি।
তাঁদের বাবা শামসুল আলম বলেন, ‘বছর খানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কাদের। এর চার মাস পর জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান খালেক। সর্বশেষ রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আটকা পড়েন মাহমুদা। এখন তাঁর জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু লাশও খুঁজে পাচ্ছি না।’
শোকে পাথর শামসুল আলম ও স্ত্রী রাবেয়া বেগমের দিন কাটছে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠে। শামসুল আলমের বড় মেয়ে জাহানারা বলেন, ছোট বোন মাহমুদা আর তিনি কাজ করতেন আটতলায়। ঘটনার দিন একসঙ্গেই তাঁরা কর্মস্থলে যান। ছিলেনও পাশাপাশি। কিন্তু ভবনধসের দেড় ঘণ্টা পর তিনি অক্ষত অবস্থায় বের হতে সক্ষম হলেও বোন বের হতে পারেননি। এই জাহানারার স্বামী মোসলেম উদ্দিন বছর চারেক আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা যান। বৃদ্ধ শামসুল আলম চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘উপার্জনক্ষম দুই ছেলে মারা যাওয়ার পর বিধবা মেয়ে জাহানারার আয়ে সংসার চলত। এরপর বোনের সঙ্গে কাজ নেয় মাহমুদা। সেও মনে হয় চলে গেল। এখন আমি বড় অসহায়।’
সর্বশেষ তথ্য: গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এক হাজার ১১২টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। তার মধ্যে ১২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। এই ভবনধসে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল এক হাজার ১২৪-এ।
গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ৮২২টি মৃতদেহ। হস্তান্তরের অপেক্ষায় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ ও বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে রয়েছে ৬৮টি মৃতদেহ। আর জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাম-পরিচয়হীন ২৩৪টি মৃতদেহ। গতকালও ৭৮টি মৃতদেহ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
No comments