সহিংসতায় বিনিয়োগ ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক
সহিংসতা ব্যবসা ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যখন-তখন হরতালের কারণে
বিদেশি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগসংক্রান্ত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সফর বাতিল
হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সাভারে ভবনধস বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্যই নতুন
সংকট তৈরি করেছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক
বিরোধ নিষ্পত্তি এবং দেশের ভাবমূর্তির সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া
সহজ কোনো বিকল্প নেই।গতকাল শনিবার রাজধানীতে বিদেশি চেম্বারগুলোর সংবাদ
সম্মেলনে এই অভিমত দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অব কমার্স
অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির উদ্যোগে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা
হয়।চেম্বারগুলোর যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। বিবৃতিতে
বলা হয়, হরতালের নামে রাজনৈতিক সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগকে বিঘ্নিত করার পাশাপাশি
আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।জার্মান রাষ্ট্রদূত আলব্রেখট
কনজে বলেন, সাভারে ভবনধসের পর বাংলাদেশ নিয়ে ইউরোপে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
সৃষ্টি হয়েছে। ভাবমূর্তির সংকট কাটাতে বাংলাদেশকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ
নিতে হবে। কারণ, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উৎ পাদিত পণ্য ইউরোপের ক্রেতারা কেনেন
না। তিনি বলেন, ‘বন্ধু হিসেবে আমরা বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখতে চাই, থমকে
যাওয়া নয়। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হলে একধরনের
যন্ত্রণা তৈরি হবে। তাই আসুন, কথা ছেড়ে পরিস্থিতির উন্নয়নে পদক্ষেপ
নেওয়া শুরু করি।’রাজনৈতিক অচলাবস্থায় হতাশা প্রকাশ করে এই রাষ্ট্রদূত
বলেন, আড়াই মাস ধরে কোনো প্রতিনিধিদল জার্মানি থেকে বাংলাদেশে আসেনি।
জার্মানির প্রধান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠানের
পরিকল্পিত একটি সফরও বাতিল হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত
কারেল রিখটার বলেন, সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাভারে ভবনধস—বাংলাদেশের
ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সময়টা বেশ কঠিন। বিশেষ করে ভবনধসের পর
বাংলাদেশকে ইউরোপ কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা সমন্বয়ের জন্য
নেদারল্যান্ডসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার নেদারল্যান্ডস সরকার
বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় ৯০ লাখ ইউরো
(এক ইউরো = প্রায় ১০০ টাকা) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে রিখটারও বলেন,
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ উদ্বেগজনক হারে কমছে।
বিনিয়োগকারীদের সফর ঘন ঘন বাতিল হচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে যেভাবে
বাংলাদেশকে তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ-সহায়ক
দেশ নয়। জার্মানির একটি সাপ্তাহিকীর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘সাময়িকীর
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এখন যুদ্ধপরিস্থিতি বিরাজ করছে।’ রিখটার
বলেন, ‘তবে কাউকে দোষারোপের জন্য আমরা এখানে আসিনি। পরিস্থিতির উন্নতি হলে
বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পণ্য কিনতে তৈরি আছে ইউরোপের দেশগুলো।’
নরডিক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা
সভাপতি আরিল্ড ক্লোকেরহগ বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ধরনের
পরিস্থিতি চলতে দেওয়া বাংলাদেশের জন্য সুখকর নয়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি
অব্যাহত থাকলে অন্য গন্তব্য খুঁজতে শুরু করবেন অনেকে।’
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির
সহসভাপতি হিরোইউকি ওয়াতাবে বলেন, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা
বাড়াতে চাই। তবে দুঃখজনক হলো, বর্তমান সহিংসতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের
বাংলাদেশ সফরে নিরুৎ সাহিত করছে। যদি সহিংস পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তবে
আমরা ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নিতে বাধ্য হব। সংশ্লিষ্ট
সবার প্রতি আমাদের আহ্বান, আপনারা আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সহায়ক
পরিবেশ তৈরি করুন।’
জার্মান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির
সভাপতি সাখাওয়াত আবু খায়ের বলেন, দুই বছর ধরে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির
উত্থান চোখে পড়ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে এরা
ক্ষমতায় এলে নারীরা কী অবস্থায় পড়বেন, সেটি গভীরভাবে ভাবার আছে। তিনি
বলেন, ‘হরতালের কারণে মার্চে মাত্র ১৩টি কর্মদিবস পেয়েছি। বিশ্বে আমাদের
ভাবমূর্তির সংকট তৈরি হচ্ছে। কাজেই হরতাল ও সহিংসতার পথ ছেড়ে আসতে বিরোধী
দলকে অনুরোধ জানাই। অচলাবস্থার নিরসন করতে সরকার ও বিরোধী দলকে অনুরোধ
জানাই। আপনারা সংলাপে বসুন, দেশকে অভিশাপের হাত থেকে বাঁচান। মধ্যস্থতার
জন্য বাইরের কারও প্রয়োজন নেই।’
মৌলবাদের উত্থান কেন হয়েছে—জানতে চাইলে সাখাওয়াত আবু
খায়ের বলেন, এক পক্ষ ক্ষমতায় থাকতে চায়, আরেক পক্ষ ক্ষমতায় যেতে চায়।
আর তাদের কারণেই মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড
ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র
হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এমন একটি রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সহিংসতা আর
ধর্মীয় গোঁড়ামির উত্থান আমাদের জন্য উদ্বেগ তৈরি করে। দেশে রাজনৈতিক সংকট
চলছে, তা রাজনীতিবিদদের সমাধান করা উচিত।’
ডাচ-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির
সভাপতি শাহজাদা হামিদ বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি অসাম্প্রদায়িক দেশে
মৌলবাদের উত্থান উদ্বেগের। তিনি বলেন, ‘অব্যাহত হরতাল-সহিংসতা আমাদের
উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। বর্তমান বিরোধ রাজনীতিবিদদেরই সমাধান করতে দেওয়া
উচিত।’
ফ্রান্স-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির
সভাপতি হুমায়ন রশীদ বলেন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে
রাজনীতিবিদেরা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করলে বিদেশিরা এখানে অনেক বেশি পরিমাণে
বিনিয়োগে উৎ সাহিত হবেন। স্থিতিশীলতা না থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য
পরিকল্পিত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ অন্য গন্তব্যে চলে যাবে।
অবশ্য জার্মান রাষ্ট্রদূত ও নেদারল্যান্ডসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের
প্রত্যাশা, জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা
সফরের কারণে পরিস্থিতির উন্নয়নে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক
দলগুলো খুব শিগগির সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে পাবে।
No comments