৮ কিলোমিটার যেখানে ১১ কিলোমিটার, সিএনজি অটোরিকশার মিটার টেম্পারিং by সিরাজুল ইসলাম
বাংলাদেশ অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বি এম সিরাজুল ইসলাম। শনিবার তিনি সকালে এয়ারপোর্ট
থেকে বনানীস্থ কাকলী মোড়ে আসবেন। নিজের পরিচয় না দিয়ে বেশ কয়েকটি সিএনজি
অটোরিকশার সঙ্গে দরদাম করলেন। কোন অটোরিকশাই মিটারে যেতে রাজি হলো না।
অবশেষে
রাজি হলো একটি অটোরিকশা। কাকলীতে এসেই বি এম সিরাজের চোখ কপালে। কারণ,
তিনি জানেন এয়ারপোর্ট থেকে কাকলীর দূরত্ব কত কিলোমিটার। আর আটোরিকশায়
দূরত্ব উঠলো কত কিলোমিটার। বি এম সিরাজুল ইসলাম জানান, এয়ারপোর্ট টু কাকলীর
দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। কিন্তু অটোরিকশার মিটারে দূরত্ব দেখালো ১১ কিলোমিটার।
প্রকৃত দূরত্ব অনুযায়ী বিল ওঠার কথা ৭০ টাকা ৮৪ পয়সা। কিন্তু বিল উঠলো ৯৩
টাকা ৭৬ পয়সা। বি এম সিরাজ তার পরিচয় দেয়ার পর আটোরিকশাচারক প্রকৃত বিলের
চেয়ে ২০ টাকা ৮৪ পয়সা কম নিয়ে তড়িগড়ি চলে গেলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল-
সিএনজিচালক আপেল মাহমুদ গাড়ির মিটারে টেম্পারিং করেছেন ধোলাইপাড়ের একটি
মিটার সার্ভিসিং সেন্টার থেকে। ওই সার্ভিসিং সেন্টারের মালিক মো. আলী।
রোববার দুপুরে ধোলাইপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের ডান পাশে অবস্থিত ওই সার্ভিসিং
সেন্টারের গিয়ে দেখা গেল- আলী ৩-৪টি গাড়ির মিটার সংক্রান্ত কাজ করছেন।
গাড়ির মালিক সেজে তাকে প্রস্তাব দেয়া হলো ১৫টি গাড়ির মিটার টেম্পারিং করার।
তিনি রাজি হলেন না। কারণ, এ প্রতিবেদককে দেখে তার সন্দেহ হয়। তিনি মনে
করলেন, সাদা পোশাকে কোন আইন প্রযোগকারী সংস্থার লোক এসেছে। আলী জানালেন,
গাড়ির মিটারে যদি বিল কম আসে তাহলে সেটা বাড়িয়ে সঠিক রেটে এনে দিতে পারবো।
কিন্তু রেটের চেয়ে বাড়িয়ে দিতে পারবো না।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী যে সব প্রতিষ্ঠান গাড়িতে মিটার সরবরাহ করেছে তারাই কেবল মিটার মেরামত করতে পারে। অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিটার মেরামত করতে পারে না। তাই আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়- আপনি যে মিটারে কাজ করছেন এর অনুমতি দিলো কে? তিনি বললেন, কেউ অনুমতি দেয়নি। আমি নিজ উদ্যোগে কাজ শিখেছি। তাই কারখানা দিয়ে কাজ করছি। তিনি জানান, অনুমোদিত সার্ভিসিং সেন্টারের গেলে মিটার মেরামত করতে বেশি টাকা লাগে। তাই চালকরা কম টাকায় মিটার মেরামত করতে আমার কাছে আসে। আলীর সঙ্গে কথোপকথন শেষে একটু দূরে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন মানবজমিন প্রতিবেদক। আলী তার গ্যারেজ থেকেই তা লক্ষ্য করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ ফেলে গ্যারেজ বন্ধ করে চলে যান তিনি। তাকে আর পাওয়া গেল না। সেখানে থাকা কয়েকজন অটোরিকশাচালক জানান, এখানে অনেক দিন ধরেই মিটার টেম্পারিংয়ের কাজ হয়। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের লোক গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার কাজ এবং বক্তব্য ভিডিও করে। পরে তা প্রচার করা হয়। এ কারণে আলী আগের চেয়ে অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। এখন কেবল পরিচিত সিএনজিচালকরা এলেই এখানে মিটার টেম্পারিং করা হয়। অন্যথায় না।
৩১৯, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে দেখা গেল- মিলন মিটার সার্ভিসিং সেন্টার। সেন্টার মালিক মিলন নিজেই মিটার মেরামত করছেন একটি সিএনজিতে। আরও কয়েকটি সিএনজিকে লাইনে রাখা হয়েছে। মিলনকে প্রশ্ন করা হলো- মিটার মেরামত করার কোন অনুমোদন আপনার আছে? তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন- অনুমতি না থাকলে কাজ করছি কিভাবে? তার কাছে অনুমতিপত্র চাইলে বলেন, আমার কাছে কোন লিখিত কাজগপত্র নেই। কোন সার্টিফিকেটও নেই। ছোটকাল থেকেই কাজ শিখেছি। এরপর কারখানা দিয়েছি।
২৫৮, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত এসএস অটো ইঞ্জিনিয়ারিং। এর মালিক শামীম মিস্ত্রি। তিনিও কোন অনুমোদন ছাড়া মিটার মেরামত করছেন। এখানে যেসব গাড়ির মিটার মেরামত করা হচ্ছে সেসব গাড়িতে বিল উঠছে অস্বাভাবিক বেশি। রোববার তার সার্ভিস সেন্টারে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে ছিলেন তার শ্যালক সাইফুল। সাইফুল জানান, দুলাভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আমিই সার্ভিস সেন্টার চালাই। মিটার মেরামত সংক্রান্ত আপনার কোন প্রশিক্ষণ আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আমার কোন প্রশিক্ষণ নেই। তবে দুলাভাইয়ের আছে। তিনি এ প্রতিবেদককে তার দুলাভাই শামীম মিস্ত্রির একটি সার্টিফিকেট দেখান। সেখানে লেখা আছে, মো. শামীম ১৩/১ তোপখানা রোডের সপ্তসিন্ধু লিমিটেডে ২০০৫ সালের ৫ই মে থেকে ২০০৭ সালের ৬ই মে পর্যন্ত সময়ে আমদানিকৃত সাংসুই মিটারে সার্ভিসিং কাজ করেছেন। তবে ওই সার্টিফিকেটে কারও কোন স্বাক্ষর নেই। পরে তোপখানা রোডে খোঁজা হয় সপ্তসিন্ধু লিমিটডের অফিস। ৮/৪-এ তোপখানা রোডে সাইনবোর্ড পাওয়া গেলেও ওই ভবনে সপ্তসিন্ধু লিমিটেডের কোন অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে টেলিফোনে শামীম মিস্ত্রি জানান, আমি কোন টেম্পারিংয়ের কাজ করি না। মিটারের ক্যাবল আইসি, চুমুক বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো মেরামত করে দিই। টেম্পারিং করতে হলে কম্পিউটার দরকার। আমার কাছে কোন কম্পিউটার নেই।
কেবল আলীর সার্ভিসিং সেন্টার, মিলন সার্ভিসিং সেন্টার বা এসএস অটো ইঞ্জিনিয়ারিংই নয়। অবৈধভাবে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে ২০-২৫টি মিটার সার্ভিসিং সেন্টার। এসব সার্ভিসিং সেন্টারের মধ্যে রয়েছে- মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার আবুল হোটেলের পাশে বেলায়েত এবং ফজলু মিয়ার মিটার সার্ভিসিং সেন্টার, খিলগাঁও বালুর মাঠ এলাকার দেলোয়ার হোসেন এবং আনোয়ার হোসেনের সার্ভিসিং সেন্টার, মিরপুর কালসি রোডের শাহ আলমের কারখানা, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প সংলগ্ন জুয়েল এবং স্বপনের সার্ভিসিং সেন্টার প্রভৃতি। এসব সার্ভিসিং সেন্টারে মিটার মেরামত করার নামে অসাধু সিএনজিচালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। মিটার মেরামতের কাজ কমিউটারাইজড পদ্ধতিতে করার বিধান থাকলেও অবৈধভাবে কাজ করছেন হাতুড়ে মিস্ত্রিরা। এ কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনুমোদিত কোম্পানিগুলোও। এর বিরুদ্ধে বিআরটিএ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানও চোখে পড়ছে না। আর প্রতিদিন ভুক্তভোগী হচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রী। এ নিয়ে প্রতিদিনই রাজধানীতে যাত্রী এবং এনজিচালকদের মধ্যে ঘটছে কথা কাটাকাটি, অপ্রীতিকর ঘটনা।
ধোলাই পাড় ডিপটি গলির তোরাব আলী জানান, কয়েক দিন আগে আমি ধোলাই পাড় থেকে খিলক্ষেত গিয়েছি। ১৫ কিলোমিটার এ রাস্তায় ৪০ মিনিট ওয়েটিং বিলসহ মোট বিল আসার কথা ১৬৬ টাকা। কিন্তু বিল এসেছে ৩৫০ টাকা। এ বিল দেখে আমি অবাক হয়ে সিএনজিচালককে বললাম- তোমার গাড়িতে মিটার টেম্পারিং করা আছে। চল তোমাকে পুলিশে দেবো। এরপর সে জানায়- স্যার, আমার গাড়ির মিটার নষ্ট হয়ে গেছে। সাধরণত বিল যত আসার কথা ততই দিন। পরে তাকে আমি ২০০ টাকা দিলাম। ঢাকা মেট্রো থ ১৩-৪৬৫১ নম্বর সিএনজিচালক মজিবর জানান, ৬০০ টাকার জমা মালিকরা নিচ্ছে ৮০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত। তাই স্বাভাবিক মিটারে গেলে আমাদের পোষে না। লস হয় অনেক। আবার মিটারে না গেলে পুলিশি হয়রানি শিকার হতে হয়। এ কারণে অনেকে মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে গাড়ি চালায়। যাদের গাড়ির মিটারে টেম্পারিং করা আছে তারাই কেবল মিটারে যেতে আগ্রহী হয়। অন্যরা মিটারে যায় না। মিটারে না গেলেও গাড়িতে ওঠার সময় যাত্রীদের বলে দেয়া হয়- পুলিশ ধরলে তারা যেন বলে আমি মিটারে যাচ্ছি। তিনি জানান, আমার জানা মতে অনেক গাড়ির মিটার টেম্পারিং করা আছে। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৩-৩৮৮৫ নম্বর গাড়িতে শতকরা ২৫ ভাগ বিল বেশি ওঠে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীতে চলাচলকৃত ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মিটার সরবরাহ এবং মিটার মেরামতের জন্যে সরকার ১৪টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে ৯টি কোম্পানি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চলমান আছে ৫টি কোম্পানি। এগুলো হলো- ক্রিস্টাল এজেন্সি, হলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ডিস্ট্রবিউশন ওয়ান, ক্যাবেক্স বিডি লিমিটেড এবং অভিজাত ইন্টারন্যাশনাল। হলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাহবুব আলম বলেন, রাজধানীতে আমরা ৮০০ সিএনজিতে মিটার সরবরাহ করেছি। কোন সিএনজির মিটার নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের কাছে এলে তা মেরামত করে সিলগালা করে দিই। অনেক সময় দেখা যায় তারা হাতুড়ে মিস্ত্রির কাছে গিয়ে সিলগালা উঠিয়ে ফেলে। ওই গাড়ি আবার আমাদের কাছে এলে আমরা সিএনজিচালকের কাছে কৈফিয়ৎ চাই। এ কারণে তারা আমাদের কাছে না এসে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে হাতুড়ে মিস্ত্রিদের কাছে মিটার ঠিক করে। তিনি জানান, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর এলাকার কোন সিএনজিই এখন আমাদের কাছে আসছে না। প্রতিদিন গড়ে ২-৩টি আটোরিকশা আমাদের কাছে আসছে। কোন কোনদিন একটিও আসছে না। মাহবুব জানান, গাড়ি না আসার কারণে ইতিমধ্যে কযেকটি বৈধ প্রতিষ্ঠান তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলেছে। আমাদের অবস্থাও গুটিয়ে ফেলার মতো।
ঢাকা মহানগর অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন জানান, অতীতে অনেকবার বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সভায় আমরা মিটার টেম্পারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ কারণে এ সেক্টরে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। আমরা অনতিবিলম্বে মিটার টেম্পরিংয়ের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। বিআরটিএ-র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলাম জানান, মিটার টেম্পারিংকারীদের আমরা খুঁজছি। সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। কোথায়, কারা অবৈধভাবে মিটার মেরামত বা মিটার টেম্পারিং করছে সেসব বিষয়ে তথ্য পেলে কালবিলম্ব না করেই অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবো।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী যে সব প্রতিষ্ঠান গাড়িতে মিটার সরবরাহ করেছে তারাই কেবল মিটার মেরামত করতে পারে। অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিটার মেরামত করতে পারে না। তাই আলীকে জিজ্ঞেস করা হয়- আপনি যে মিটারে কাজ করছেন এর অনুমতি দিলো কে? তিনি বললেন, কেউ অনুমতি দেয়নি। আমি নিজ উদ্যোগে কাজ শিখেছি। তাই কারখানা দিয়ে কাজ করছি। তিনি জানান, অনুমোদিত সার্ভিসিং সেন্টারের গেলে মিটার মেরামত করতে বেশি টাকা লাগে। তাই চালকরা কম টাকায় মিটার মেরামত করতে আমার কাছে আসে। আলীর সঙ্গে কথোপকথন শেষে একটু দূরে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন মানবজমিন প্রতিবেদক। আলী তার গ্যারেজ থেকেই তা লক্ষ্য করছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ ফেলে গ্যারেজ বন্ধ করে চলে যান তিনি। তাকে আর পাওয়া গেল না। সেখানে থাকা কয়েকজন অটোরিকশাচালক জানান, এখানে অনেক দিন ধরেই মিটার টেম্পারিংয়ের কাজ হয়। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলের লোক গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার কাজ এবং বক্তব্য ভিডিও করে। পরে তা প্রচার করা হয়। এ কারণে আলী আগের চেয়ে অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। এখন কেবল পরিচিত সিএনজিচালকরা এলেই এখানে মিটার টেম্পারিং করা হয়। অন্যথায় না।
৩১৯, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে গিয়ে দেখা গেল- মিলন মিটার সার্ভিসিং সেন্টার। সেন্টার মালিক মিলন নিজেই মিটার মেরামত করছেন একটি সিএনজিতে। আরও কয়েকটি সিএনজিকে লাইনে রাখা হয়েছে। মিলনকে প্রশ্ন করা হলো- মিটার মেরামত করার কোন অনুমোদন আপনার আছে? তিনি উল্টো প্রশ্ন করলেন- অনুমতি না থাকলে কাজ করছি কিভাবে? তার কাছে অনুমতিপত্র চাইলে বলেন, আমার কাছে কোন লিখিত কাজগপত্র নেই। কোন সার্টিফিকেটও নেই। ছোটকাল থেকেই কাজ শিখেছি। এরপর কারখানা দিয়েছি।
২৫৮, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে অবস্থিত এসএস অটো ইঞ্জিনিয়ারিং। এর মালিক শামীম মিস্ত্রি। তিনিও কোন অনুমোদন ছাড়া মিটার মেরামত করছেন। এখানে যেসব গাড়ির মিটার মেরামত করা হচ্ছে সেসব গাড়িতে বিল উঠছে অস্বাভাবিক বেশি। রোববার তার সার্ভিস সেন্টারে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে ছিলেন তার শ্যালক সাইফুল। সাইফুল জানান, দুলাভাইয়ের অনুপস্থিতিতে আমিই সার্ভিস সেন্টার চালাই। মিটার মেরামত সংক্রান্ত আপনার কোন প্রশিক্ষণ আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আমার কোন প্রশিক্ষণ নেই। তবে দুলাভাইয়ের আছে। তিনি এ প্রতিবেদককে তার দুলাভাই শামীম মিস্ত্রির একটি সার্টিফিকেট দেখান। সেখানে লেখা আছে, মো. শামীম ১৩/১ তোপখানা রোডের সপ্তসিন্ধু লিমিটেডে ২০০৫ সালের ৫ই মে থেকে ২০০৭ সালের ৬ই মে পর্যন্ত সময়ে আমদানিকৃত সাংসুই মিটারে সার্ভিসিং কাজ করেছেন। তবে ওই সার্টিফিকেটে কারও কোন স্বাক্ষর নেই। পরে তোপখানা রোডে খোঁজা হয় সপ্তসিন্ধু লিমিটডের অফিস। ৮/৪-এ তোপখানা রোডে সাইনবোর্ড পাওয়া গেলেও ওই ভবনে সপ্তসিন্ধু লিমিটেডের কোন অফিস খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে টেলিফোনে শামীম মিস্ত্রি জানান, আমি কোন টেম্পারিংয়ের কাজ করি না। মিটারের ক্যাবল আইসি, চুমুক বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলো মেরামত করে দিই। টেম্পারিং করতে হলে কম্পিউটার দরকার। আমার কাছে কোন কম্পিউটার নেই।
কেবল আলীর সার্ভিসিং সেন্টার, মিলন সার্ভিসিং সেন্টার বা এসএস অটো ইঞ্জিনিয়ারিংই নয়। অবৈধভাবে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে ২০-২৫টি মিটার সার্ভিসিং সেন্টার। এসব সার্ভিসিং সেন্টারের মধ্যে রয়েছে- মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার আবুল হোটেলের পাশে বেলায়েত এবং ফজলু মিয়ার মিটার সার্ভিসিং সেন্টার, খিলগাঁও বালুর মাঠ এলাকার দেলোয়ার হোসেন এবং আনোয়ার হোসেনের সার্ভিসিং সেন্টার, মিরপুর কালসি রোডের শাহ আলমের কারখানা, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প সংলগ্ন জুয়েল এবং স্বপনের সার্ভিসিং সেন্টার প্রভৃতি। এসব সার্ভিসিং সেন্টারে মিটার মেরামত করার নামে অসাধু সিএনজিচালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। মিটার মেরামতের কাজ কমিউটারাইজড পদ্ধতিতে করার বিধান থাকলেও অবৈধভাবে কাজ করছেন হাতুড়ে মিস্ত্রিরা। এ কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনুমোদিত কোম্পানিগুলোও। এর বিরুদ্ধে বিআরটিএ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অভিযানও চোখে পড়ছে না। আর প্রতিদিন ভুক্তভোগী হচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রী। এ নিয়ে প্রতিদিনই রাজধানীতে যাত্রী এবং এনজিচালকদের মধ্যে ঘটছে কথা কাটাকাটি, অপ্রীতিকর ঘটনা।
ধোলাই পাড় ডিপটি গলির তোরাব আলী জানান, কয়েক দিন আগে আমি ধোলাই পাড় থেকে খিলক্ষেত গিয়েছি। ১৫ কিলোমিটার এ রাস্তায় ৪০ মিনিট ওয়েটিং বিলসহ মোট বিল আসার কথা ১৬৬ টাকা। কিন্তু বিল এসেছে ৩৫০ টাকা। এ বিল দেখে আমি অবাক হয়ে সিএনজিচালককে বললাম- তোমার গাড়িতে মিটার টেম্পারিং করা আছে। চল তোমাকে পুলিশে দেবো। এরপর সে জানায়- স্যার, আমার গাড়ির মিটার নষ্ট হয়ে গেছে। সাধরণত বিল যত আসার কথা ততই দিন। পরে তাকে আমি ২০০ টাকা দিলাম। ঢাকা মেট্রো থ ১৩-৪৬৫১ নম্বর সিএনজিচালক মজিবর জানান, ৬০০ টাকার জমা মালিকরা নিচ্ছে ৮০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত। তাই স্বাভাবিক মিটারে গেলে আমাদের পোষে না। লস হয় অনেক। আবার মিটারে না গেলে পুলিশি হয়রানি শিকার হতে হয়। এ কারণে অনেকে মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে গাড়ি চালায়। যাদের গাড়ির মিটারে টেম্পারিং করা আছে তারাই কেবল মিটারে যেতে আগ্রহী হয়। অন্যরা মিটারে যায় না। মিটারে না গেলেও গাড়িতে ওঠার সময় যাত্রীদের বলে দেয়া হয়- পুলিশ ধরলে তারা যেন বলে আমি মিটারে যাচ্ছি। তিনি জানান, আমার জানা মতে অনেক গাড়ির মিটার টেম্পারিং করা আছে। উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১৩-৩৮৮৫ নম্বর গাড়িতে শতকরা ২৫ ভাগ বিল বেশি ওঠে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানীতে চলাচলকৃত ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মিটার সরবরাহ এবং মিটার মেরামতের জন্যে সরকার ১৪টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে ৯টি কোম্পানি ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এখন চলমান আছে ৫টি কোম্পানি। এগুলো হলো- ক্রিস্টাল এজেন্সি, হলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ডিস্ট্রবিউশন ওয়ান, ক্যাবেক্স বিডি লিমিটেড এবং অভিজাত ইন্টারন্যাশনাল। হলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাহবুব আলম বলেন, রাজধানীতে আমরা ৮০০ সিএনজিতে মিটার সরবরাহ করেছি। কোন সিএনজির মিটার নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের কাছে এলে তা মেরামত করে সিলগালা করে দিই। অনেক সময় দেখা যায় তারা হাতুড়ে মিস্ত্রির কাছে গিয়ে সিলগালা উঠিয়ে ফেলে। ওই গাড়ি আবার আমাদের কাছে এলে আমরা সিএনজিচালকের কাছে কৈফিয়ৎ চাই। এ কারণে তারা আমাদের কাছে না এসে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে হাতুড়ে মিস্ত্রিদের কাছে মিটার ঠিক করে। তিনি জানান, যাত্রাবাড়ী ও মিরপুর এলাকার কোন সিএনজিই এখন আমাদের কাছে আসছে না। প্রতিদিন গড়ে ২-৩টি আটোরিকশা আমাদের কাছে আসছে। কোন কোনদিন একটিও আসছে না। মাহবুব জানান, গাড়ি না আসার কারণে ইতিমধ্যে কযেকটি বৈধ প্রতিষ্ঠান তাদের কাজকর্ম গুটিয়ে ফেলেছে। আমাদের অবস্থাও গুটিয়ে ফেলার মতো।
ঢাকা মহানগর অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন জানান, অতীতে অনেকবার বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সভায় আমরা মিটার টেম্পারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ কারণে এ সেক্টরে ব্যাপক নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। আমরা অনতিবিলম্বে মিটার টেম্পরিংয়ের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাই। বিআরটিএ-র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নজরুল ইসলাম জানান, মিটার টেম্পারিংকারীদের আমরা খুঁজছি। সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নেই। কোথায়, কারা অবৈধভাবে মিটার মেরামত বা মিটার টেম্পারিং করছে সেসব বিষয়ে তথ্য পেলে কালবিলম্ব না করেই অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবো।
No comments