মেয়েটা যেন ‘মাঝপথে দারুণ দিশেহারা’!

তুমি তো সেজন্য এলে। এসে, ডান পা দিয়ে
দরজাটা বন্ধ করে দুটো হাতে দুটো কাঁধ ধরে/ মুখে মুখ ঠেসে ধরলে ভেজানো কপাটে
আমি এটুকুর জন্য এতদিন বসে রইলাম। (জয় গোস্বামী)
প্রথম কবে, মানে কবে! কবে যেন উড়ুক মেয়ে রঞ্জার খপ্পরে পড়লাম প্রথম? দিন ক্ষণ মনে নেই! হাওয়ার উত্তেজনায় ওকে দেখে ফেলেছিলাম সিক্স, জেবিএস হ্যালডেন অ্যাভেনিউ-এর এক প্রাসাদে। হঠাৎ-ই! মনে হয়েছিল যেন, কপাট ভাঙতে ভাঙতে এসেছিল ও।

 ‘ঝড়ের লক্ষ ফণা’! এও মনে হয়েছিল, মেয়েটা যেন ‘মাঝপথে দারুণ দিশেহারা’! আর এখন এতদিন পর কেবল মনে হয়, সুন্দরী মেধাবিনীর মনের মন্দর-ই একমাত্র ফকিরের নিরাপদ ডেরা, নিহিত নিভৃত আশ্রয়।

ও কিন্তু এই ‘খপ্পর’ শব্দটা শুনে একটুও রাগে না। বরং ওর স্বভাবসুলভ দুষ্টুমিতে, মৃদু রহস্য আর আলগা ইশারায় চোখের হরিণকে প্রশয় দেয়। রঞ্জাবতীর এই চাহনিবিলাস ফকিরের চেনা। চাহনি বিলিয়ে দীপন দ্বিপ্রহরে ফিচেল ফতুয়া বা, বদনামি ব্লাউজকে যখন ও সহবত শেখায়, ঠিক তখন ফকিরের মনে রোম্যান্সের অভিলাসও বেপরোয়া হয়ে ওঠে! যেন অহঙ্কারে টই-টম্বুর এক অপ্সরী!

না, না রঞ্জাবতী মোটেই অহঙ্কারী নয়। ও তো সুন্দরের নিজস্ব নিখিল! মধুশালার সন্ধে কাটিয়ে যখনই আখড়ায় ফিরি, কামনা-বাসনার টেক্সচার বদলে যায় ওর শরীরী বিভঙ্গের বায়নাক্কায়! এই এখন যেমন এস্কিমোর পোশাক পরে স্রেফ চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার ছন্নছাড়া মতিকে!

- কলকাতা এবার সরগরমে প্রাণ জুড়োবে এখানে!
রঞ্জার কথায় হাসি পেল। বললাম,
- তেমন অগ্নিনির্ঝরের খবর পেলে কোথায়? তুমি তো কেবল ফকিরকে পোড়াও। নিত্য সে দহন!
- এই যে বলো, মধুর সে দহন! দহন কি জ্বালা?
রঞ্জার হাত ধরে মাইনাস সিক্স ডিগ্রির ভিতরমহলে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,
- রবিঠাকুর ‘মধুর বেদন’-এর কথা বলেছিলেন। ফকির না হয় তোমাকে মধুর দহন সইবার কথা শোনাল!

কথাটা ফুরোতেই রঞ্জাবতী থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকাল। ওর মুখে ওর সহজাত সারল্য। ওর চোখের তারায় এক জীবনের জন্য উপুড় করা শর্তহীন আকাশের স্বপ্ন-কথামালা। যেন সাদা চন্দনের বিন্দিতে সেজে উঠল মেয়ে, মুহূর্তে মনে মনে লহরি!

লাউঞ্জের ভিতরে এসে সব কিছু কেমন মায়াময় মনে হল। চার দিকে নানা ধরনের নীল আলোর কোলাজ। নীলের স্নিগ্ধতা সবখানে। সর্বত্র বরফের বিলাস। বরফের শেলফে সার সার ঝুটা উইন্টার প্রুফ মোমবাতি। বসার ব্যবস্থা এসবের মাঝেই। মানে ক্রিস্টাল-ক্লিয়ার বরফের তৈরি চেয়ার অথবা টুলে। সামনের টেবিল, সেও বরফের নির্মাণ। কেতদার একটা জায়গা বেছে বসার কথা ভাবছি আমরা, ঠিক তখনই লাউঞ্জের এক কর্মী এগিয়ে এলেন সাহায্যের জন্য। বরফের ফিক্সড চেয়ারের ওপর পশমের চাদর পেতে দিলেন। রঞ্জা বসতে বসতে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস বসিনি’!

এতক্ষণে ভিতরের নীলে চোখ সয়ে গেছে আমাদের। দুজনেই নির্মিতি দেখছিলাম বিস্ময়ে। কানে আসছে ধীর লয়ে সুখ-সঙ্গীত। লাউঞ্জের একদিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে হাওড়া ব্রিজের আইস কার্ভিং। তার ঠিক পাশেই বরফের ট্যাক্সি। বরফের ওপর ভিক্টোরিয়ার ছবিও রয়েছে দেওয়ালজুড়ে।

এর মধ্যে বারটেন্ডার মকটেলের মেনু ধরিয়ে অর্ডার নিয়ে গিয়েছিল। এখানে শুধু মকটেল। অন্য খাবারের জন্য পাশের মাল্টি ক্যুইজিন রেস্তোরাঁ। টেন্ডার বরফের গ্লাসে দিয়ে গেল সুস্বাদ পানীয়। বরফের গ্লাস দেখে রঞ্জা বেশ মজা পেয়েছে। সুদর্শন-সুমিষ্ট ও সুরভিত মকটেলে ঠোঁট ডুবিয়ে সেই খুশখবরি ঘোষণা করল পিচরঙা লিপস্টিকের চুমু ভাসিয়ে। বলল,
- ধন্যবাদ ফকির। বাকিটা ফিরতি পথে!
ওর কথায় তক্ষুনি কপট ভঙ্গিতে উঠতে যাচ্ছিলাম। সেই দেখে বলল,
- এ কী! এক্ষুনি নাকি! দিন দিন তোমার হ্যাংলামি বাড়ছে ফকির। বুড়ো হয়ে যাচ্ছো। যাচ্ছেতাই!
ওর কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলাম। হাসিতে ভেঙে পড়ল ও। এই বরফের গ্লাসগুলো বেশ অদ্ভুত দেখতে! বারটেন্ডারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, রোজ এই গ্লাস ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয় নাকি। বিশেষ ছাঁচে জল জমিয়ে তৈরি করে নেওয়া হয় গ্লাস।
কথায় কথায় বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ পানপাত্রে চুমুক দিতে গিয়ে রঞ্জা খুব অবাক হয়ে রীতিমতো গোল বাধিয়ে বলল,
- এই, এ কী! মকটেল তো জমে বরফ হয়ে গেছে!

সর্বনাশ! দেখি, দু’জনের পাত্রেই জমাট বরফ! ততক্ষণে বারটেন্ডার এগিয়ে এসেছে। কিছু বলার আগেই গলিয়ে দিয়ে গেল খটখটে মকটেল! আইস লাউঞ্জের মজা তো এ সব নিয়েই। সত্যি কথা কি, ভিতরের এই মাইনাস এগারো ডিগ্রি টেম্পারেচারের কোনও বিকল্প নেই। বরফি বিলাসের ভুবনে বসে মনে জাগে, রতি রাগে পাহাড়চুড়োয় হিমস্পর্শের ইচ্ছে। অন্দরের সে জাগৃতি অন্য এক সম্পর্কের সূচনা করে। সে সূচনা না হয় হোক, এই পোড়া শহরের দগ্ধ দিনেই। দড়িরখাটে নাগরদোলার স্বপ্ন নিয়ে, প্রজাপতি ফিনফিনে ডানা মেলুক বরফিভুবনের গোপন থেকে!

বরফকুচির মিঠে স্বপ্ন-বিভায় বিভোর হয়ে রঞ্জাকে তাই ফিরতি পথে জয় গোসাঁই বলছিলাম। ট্যাক্সির ব্যাকসিটে আমার বুকের গহনে মাথা রেখে ও শুনছিল চুপটি করে। যেমন শোনে!
- ‘এইবার উঠে পড়ো। মেঝে থেকে ঠান্ডা লাগবে। ওঠো।/ আমার ঘরের ওই হাঁড়ি/ চলো তবে তুলে নিয়ে দু’জনে বেরোই/ ভেঙে ফেলি হাটে’।

ক্রমশ…

লেখক : আবীর মুখোপাধ্যায়

No comments

Powered by Blogger.