১৩৯ দিনেও চার্জশিটের নাম নেই- সালিশের হোতা তদন্তকারী কর্মকর্তা!
সালিশের উদ্যোক্তা মামলার তদন্তকারী
কর্মকর্তা নিজেই। ঘটনার নিষ্পত্তিতে মরিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার এই
সাব-ইন্সপেক্টর তাই সাড়ে ৪ মাস ধরে আটকে রেখেছেন একটি নারী ও শিশু নির্যাতন
আইনে দায়ের করা মামলার চার্জশিট।
জেলা পুলিশের
শীর্ষকর্তা, থানার বড় কর্তা সবার কাছে বাদীর বারবার চার্জশিট দেয়ার অনুরোধ
আবদার বিফল হয়ে গেছে এই সাব-ইন্সপেক্টরের মিশনের কাছে। তার মিশন অনুসারে
গতকাল শনিবার বসেছিল আপস-নিষ্পত্তির বহু কাঙিক্ষত এই সালিশ। আর সেখানে সাদা
পোশাকে হাজির হন আলোচিত ওই তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আবদুর রশিদ। শুধু তাই
নয়, একজন সালিশকারকের ভূমিকায়ও লিপ্ত হন তিনি। কথা বলেন সালিশের মধ্যমণি
জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট সৈয়দ
এমদাদুল বারীর সঙ্গে। এই দারোগার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন কুমিল্লায়
সিআইডিতে কর্মরত আরেক সাব-ইন্সপেক্টর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা সাজিদুল হক।
তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা এক ডিআইজি’র ভাগ্নে।
আলোচিত এই সালিশটি বসেছিল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের জিলবাংলা চিনিকলের কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন ওরফে রিপনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে তার স্ত্রীর দায়ের করা মামলার আপস মীমাংসা করতে। ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর এই মামলাটি দায়ের করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায়। ৪ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন এবং হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তুহিন আক্তার বাদী হয়ে মোট ৫ জনের বিরুদ্ধে এ মামলাটি করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় তার স্বামী আলাউদ্দিনকে। অন্য আসামিরা হচ্ছে শাশুড়ি শামীমা আক্তার, ননদ লুবনা আক্তার, ননদের স্বামী খোকন মিয়া ও দেবর সালাউদ্দিন সুমন। এই মামলায় গত ৬ই মার্চে আলাউদ্দিন আদালতে হাজির হলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠায়। ১০ই মার্চ আদালত থেকে আপসের শর্তে জামিন পায় সে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আইনানুসারে ৬০ দিনের মধ্যে এই মামলার চার্জশিট দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৩৯ দিন পার হলেও পুলিশের এই দারোগা মামলাটির চার্জশিট দেয়নি। বরং মামলাটি মিটিয়ে ফেলার জন্য বাদীর পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। দিন-রাত যখন তখন বাদীর বয়স্ক পিতাকে ডেকে এনে আপস করে ফেলার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে এই দারোগা। শুধু তাই নয়, ঢাকায় গিয়ে আসামি পক্ষের সঙ্গে বসে শেষ করার জন্যও চাপ দেয় সে। এদিকে গতকাল দৈনিক মানবজমিনে মো. আলাউদ্দিন ওরফে রিপনের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। শুধু যৌতুকের জন্য স্ত্রী নির্যাতন নয়, পরকীয়ায় মত্ত আলাউদ্দিন সর্বনাশ করেছে আরও অনেক নারীর জীবন। ঘরে স্ত্রী রেখে অভিসার করে বেড়িয়েছে সে। আর তাকে রক্ষা করতেই তৎপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ। গতকালের সালিশে উপস্থিত ছিলেন আলাউদ্দিনের এমনই এক প্রেমিকার মা। সালিশের মাঝামাঝি সময়ে তিনি অবশ্য চলে যান। নাসরিন নামের ওই মহিলা আলাউদ্দিনের খালা এবং নিজেকে আওয়ামী লীগ নেত্রী পরিচয় দিয়ে ঘটনাটি মিটিয়ে ফেলতে ধরনা দেন প্রভাবশালীদের কাছে। এক প্রতিমন্ত্রীর ভাইকে দিয়েও জেলা পরিষদ প্রশাসকের কাছে ফোন করান। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি শেষ করে দিতে বলেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে জেলা পরিষদ প্রশাসক এডভোকেট সৈয়দ একেএম এমদাদুল বারীর মালিকানাধীন ক্ষণিকা কমিউনিটি সেন্টারে বসে আলোচিত এই সালিশটি। সেখানে উপস্থিত লোকজন জানান, সালিশ আরম্ভ হতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নাসরিন। প্রশাসককে উদ্দেশ্য করে বলেন- আমরা এতক্ষণ ধরে বসে আছি। বাদীপক্ষ আসছে না। আজকের পর আমাদের আর আপসের দরকার নাই। মামলার গতিতে মামলা চলুক। এরপর সেখানে সাংবাদিকরা উপস্থিত হলে আলাউদ্দিনের ভাই সালাউদ্দিন সুমন আপত্তি তোলেন। বলেন- সাংবাদিকরা কেন এলো এখানে? ছবি তোলা নিয়েও আপত্তি করে সে। এমনি অবস্থায় সালিশ শুরু হলে সালিশকারকরা জানতে চান মামলার ১ নম্বর আসামি আলাউদ্দিন ও বাদী কোথায়? তখন আলাউদ্দিনের ভাই সুমন জানায়, মেয়ে আসেনি বলে তার ভাই আসেনি। এর জবাবে মেয়ে পক্ষের আইনজীবী ওসমান গনি বলেন- মেয়েকে আনতে ১০ মিনিটের ব্যাপার। এখানে মেয়ের বাড়ি। এদেরকে বাদ দিয়ে সালিশ চলতে পারে না বলে প্রায় সব সালিশকারক একপর্যায়ে সম্মত হন। তখন এস আই আবদুর রশিদ। প্রস্তাব দেন এদেরকে বাদ দিয়ে ছেলে ও মেয়ের পক্ষ সম্মত থাকলে সালিশ করা যাবে কিনা। তখন সালিশকারকরা না বললে সে জানায়, আমার ৬০ দিনের কার্যদিবস (চার্জশিট প্রদানের সময়) শেষ। আমার আর কোন কিছু করার নেই। সালিশে এই দারোগার পাশে বসা আলাউদ্দিনের ভাই মামলার ৫ নম্বর আসামি সালাউদ্দিন সুমন বলেন- ১০ মিনিটের মধ্যে মামলাটি যে মিথ্যা তা প্রমাণ করে দেয়া হবে। তখন অন্য সালিশকারকরা বলেন, আপনি বলবেন একথা আর মেয়ে এসে বলবে তার অভিযোগ সত্য। তাই তাদেরকে বাদ দিয়ে সালিশ হবে না। সালিশে অংশগ্রহণকারী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা এতদিন জানতাম না আমাদের এলাকার একটি মেয়েকে এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলা হয়েছে। তিনি দারোগাকে লক্ষ্য করে বলেন- আপনি আইনগত ব্যবস্থা নিন। মেয়ে যদি লক্ষ্মীপুরের হতো তাহলেও আমি তার পক্ষেই থাকতাম। পত্রিকায় যে অবস্থা দেখলাম তা খুবই উদ্বেগজনক। সালাউদ্দিন সুমন সাংবাদিকরা ছবি ওঠাতে গেলে আপত্তি করে বলেন, আমরা কি চোর? এর জবাবে বিশিষ্ট সর্দার ও লোকাল বাস মালিক সমিতির নেতা আবদুল আউয়াল মিয়া বলেন, তোরা শুধু চোরই না। লম্পটের গোষ্ঠী। তোর ভাই একটা লম্পট। সেটি আমিও ১০ মিনিটের মধ্যেই প্রমাণ করে দেবো। সালিশে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী মিনারা আলম, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাসলিমা সুলতানা খানম নিশাত, জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনসুর আলী দানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি হাসান সারোয়ার, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাদেকা বেগম প্রমুখ। সালিশে আসামি পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বিয়ের ঘটক ছেলের মামা জিলানী, মামী রেহনুমা, আলাউদ্দিনের মা শামীমা ও বোন লুবনা। এছাড়াও তাদের পক্ষে সেখানে ছিলেন কুমিল্লায় সিআইডিতে কর্মরত এক এসআই সাজিদুল হক। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাড়ি পুলিশের এক ডিআইজি’র ভাগ্নে।
উল্লেখ্য, লক্ষ্মীপুর জেলার দালাল বাজার গ্রামের সামসুদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে মো. আলাউদ্দিন ওরফে রিপনের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাইকপাড়ার কবির মিয়ার মেয়ে অনার্স মাস্টার্স পাস তুহিনের বিয়ে হয় ২০১০ সালের ১১ই নভেম্বর। বিয়ের পরই সে পরনারীতে আসক্ত হয়ে ওঠে। এ কারণে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে থাকে। স্ত্রীকে ঢাকায় বাসায় রেখে জামালপুরে কর্মস্থলে চলতে থাকে তার পরকীয়া। বিয়ের আগেও নারীঘটিত নানা ঘটনায় জড়িয়ে ছিল আলাউদ্দিন। তুহিন আলাউদ্দিনের বিভিন্ন অপকর্ম এবং তার জেলে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন।
No comments