জীবন্ত কিংবদন্তি মালালা ইউসুফজাই by কামরান রেহমাত
পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আজকের মতো এত বেশি ঐকমত্যে পৌঁছতে পারে- এমন উদাহরণ সমকালীন ইতিহাসে নেই। আর এর সূত্র হিসেবে কাজ করেছে ১৪ বছর বয়সের এক স্কুলছাত্রী- মালালা ইউসুফজাইর রক্ত। এই ঐক্য আর এমন ঘটনার কথা কেউ হয়তো এর আগে কল্পনাও করতে পারেনি।
গত ৯ অক্টোবর অষ্টম শ্রেণীর এই ছাত্রী স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে গোটা দেশই স্তব্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। কী ছিল তার অপরাধ? সে তো শুধু বলছিল, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। তাদের শিক্ষালাভের পথ প্রশস্ত করতে হবে। পাকিস্তানের সুইজারল্যান্ডখ্যাত সোয়াতের তালেবানরা সেই পদক্ষেপ মেনে নিতে পারেনি। এমন একটি নিষ্পাপ কিশোরীর ওপর এ ধরনের বর্বরোচিত হামলায় জাতিকে নাড়া দিয়ে যায়। এমন কোনো মানুষ নেই, এ ঘটনার কারণে যার চোখের কোণে জল জমা হয়নি। তালেবানের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এই কিশোরী বিবিসি ব্লগে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, তাঁর এলাকায় এর প্রতিবন্ধকতা এবং সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করার ব্যাপারে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। ১১ বছর বয়সে সে সেই ব্লগ লিখতে শুরু করে। আর ওই সময়টা ছিল ওই এলাকায় তালেবানের উত্থানের কাল। এভাবে দিনের আলোয় একটি স্কুলছাত্রীর ওপর গুলি করাকে বর্বরোচিত বললেও তাই কম বলা হয়। আর এই ঘটনার পর পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যমগুলো যে ভূমিকা পালন করেছে, তাকেও সাধুবাদ জানাতে হয়। সবাই অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এই সংবাদ প্রচারে। মালালা তখন গোটা পাকিস্তানের কন্যা হয়ে দাঁড়ায়। মালালার স্নেহময় মুখ, তার সাক্ষাৎকার ও লেখা ব্লগ পাকিস্তানের ঘরে ঘরে সমাদৃত হতে থাকে। মানুষের মধ্যে অন্যরকম একটা অনুভূতি তৈরি হয় এ ঘটনার সূত্র ধরে।
সে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় শান্তি পুরস্কার অর্জনকারী। আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল গত বছর। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার জন্যও প্রস্তাব করেন গেল সপ্তাহে। তিনি বলেন, নোবেল কমিটির বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। তিনি বলেন, এই পুরস্কারের জন্য মালালা অবশ্যই যোগ্য বিবেচিত হতে পারে।
মালালার এই সাহসী ভূমিকার কথা বিবিসি অত্যন্ত গুরুত্বসহ প্রচার করে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী আজ মালালা ব্যাপক আলোচিত নামে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়। এই কিশোরী যখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে, তখনই বোঝা গিয়েছিল তাঁর মধ্যে প্রতিবাদী একটি সত্তা রয়েছে। তার লেখার শুরু তখন থেকেই। আর তখনই বোঝা গিয়েছিল কোনো একদিন তার বিরুদ্ধশক্তি ৯ অক্টোবরের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।
২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারিতে মালালা ইউসুফজাই বিবিসি ব্লগে লেখে, 'গত রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি মিলিটারির একটি হেলিকপ্টার আর তালেবানের মুখোমুখি অবস্থান। সোয়াতে যখন থেকে সামরিক অভিযান শুরু হয়, তখন থেকে প্রায়ই আমি এমন স্বপ্ন দেখি। আমার মা আমাকে নাস্তা খাইয়ে দেন। তার পর আমি স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার সময় আমি ভীত ছিলাম। কারণ তালেবানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল পূর্বাহ্নেই। ক্লাসের ২৭ জন মেয়ের মধ্যে মাত্র ১১ জন উপস্থিত ছিল সেদিন। এর আগে এই নিষেধাজ্ঞা প্রদানের পর আমার তিন বান্ধবী লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ারে চলে গেছে। তাদের লেখাপড়ার কারণেই তাদের পরিবার-পরিজনকে সোয়াত ছাড়তে হয়েছে।
স্কুল থেকে ফেরার সময় পথে আমি শুনতে পাই একজন বলছে, 'আমি তোমাকে খুন করব। আমি দ্রুত চলতে থাকি। কিছু দূর যাওয়ার পর আবার ফিরে তাকাই। উদ্দেশ্য, লোকটি আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করেছে কি না তা দেখা। দেখি লোকটি তার মোবাইল ফোনে কাকে যেন ধমকাচ্ছে।'
এর পর নিউইয়র্ক টাইমসের এক পাঠক মন্তব্য করেন, 'আমরা পশ্চিমের মানুষ, যারা শিক্ষাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি, তাদের জন্য এই বালিকা হতে পারে আরো অনুপ্রেরণার সূত্র।'
যা হোক, পাকিস্তানের বুকে এ ধরনের ঘটনায় এমন কেউ নেই যে ধিক্কার জানায়নি।
তাহরিক তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) দিকে নজর সবার। মালালার প্রতি বিশ্বব্যাপী সমর্থন ঘোষণাকে জেইউআই (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম) ভালো চোখে দেখছে না। তারা বলছে, এটা সরাসরি ইসলামী পণ্ডিতদের বিরোধিতা করার শামিল। আবার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান কাজী হোসাইনের কন্যা ড. সামিয়া রাহিল কাজি টুইটারের মাধ্যমে মালালার ছবি ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেখানে দেখা যায়, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে মালালা কথা বলছেন। আর এই ছবিতে তিনি মন্তব্য করেন, আসলে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও যোগসূত্র থাকতে পারে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে সেই ভিডিও এখনো দেখা যায়। তবে এটা মনে রাখার প্রয়োজন আছে, মালালার ওপর এই হামলা পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের সঙ্গে সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের একটা মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করছে। মালালা সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। আর মালালা যে আগামীতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত করতে পারে, এমন চিন্তা করাও অপ্রাসঙ্গিক নয়।
লেখক : পাকিস্তানের সাংবাদিক
গালফ টাইমস থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
সে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় শান্তি পুরস্কার অর্জনকারী। আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল গত বছর। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করার জন্যও প্রস্তাব করেন গেল সপ্তাহে। তিনি বলেন, নোবেল কমিটির বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। তিনি বলেন, এই পুরস্কারের জন্য মালালা অবশ্যই যোগ্য বিবেচিত হতে পারে।
মালালার এই সাহসী ভূমিকার কথা বিবিসি অত্যন্ত গুরুত্বসহ প্রচার করে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী আজ মালালা ব্যাপক আলোচিত নামে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়। এই কিশোরী যখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে, তখনই বোঝা গিয়েছিল তাঁর মধ্যে প্রতিবাদী একটি সত্তা রয়েছে। তার লেখার শুরু তখন থেকেই। আর তখনই বোঝা গিয়েছিল কোনো একদিন তার বিরুদ্ধশক্তি ৯ অক্টোবরের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে।
২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারিতে মালালা ইউসুফজাই বিবিসি ব্লগে লেখে, 'গত রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি মিলিটারির একটি হেলিকপ্টার আর তালেবানের মুখোমুখি অবস্থান। সোয়াতে যখন থেকে সামরিক অভিযান শুরু হয়, তখন থেকে প্রায়ই আমি এমন স্বপ্ন দেখি। আমার মা আমাকে নাস্তা খাইয়ে দেন। তার পর আমি স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার সময় আমি ভীত ছিলাম। কারণ তালেবানরা মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল পূর্বাহ্নেই। ক্লাসের ২৭ জন মেয়ের মধ্যে মাত্র ১১ জন উপস্থিত ছিল সেদিন। এর আগে এই নিষেধাজ্ঞা প্রদানের পর আমার তিন বান্ধবী লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি ও পেশোয়ারে চলে গেছে। তাদের লেখাপড়ার কারণেই তাদের পরিবার-পরিজনকে সোয়াত ছাড়তে হয়েছে।
স্কুল থেকে ফেরার সময় পথে আমি শুনতে পাই একজন বলছে, 'আমি তোমাকে খুন করব। আমি দ্রুত চলতে থাকি। কিছু দূর যাওয়ার পর আবার ফিরে তাকাই। উদ্দেশ্য, লোকটি আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করেছে কি না তা দেখা। দেখি লোকটি তার মোবাইল ফোনে কাকে যেন ধমকাচ্ছে।'
এর পর নিউইয়র্ক টাইমসের এক পাঠক মন্তব্য করেন, 'আমরা পশ্চিমের মানুষ, যারা শিক্ষাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি, তাদের জন্য এই বালিকা হতে পারে আরো অনুপ্রেরণার সূত্র।'
যা হোক, পাকিস্তানের বুকে এ ধরনের ঘটনায় এমন কেউ নেই যে ধিক্কার জানায়নি।
তাহরিক তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) দিকে নজর সবার। মালালার প্রতি বিশ্বব্যাপী সমর্থন ঘোষণাকে জেইউআই (জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম) ভালো চোখে দেখছে না। তারা বলছে, এটা সরাসরি ইসলামী পণ্ডিতদের বিরোধিতা করার শামিল। আবার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান কাজী হোসাইনের কন্যা ড. সামিয়া রাহিল কাজি টুইটারের মাধ্যমে মালালার ছবি ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেখানে দেখা যায়, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাবেক বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুকের সঙ্গে মালালা কথা বলছেন। আর এই ছবিতে তিনি মন্তব্য করেন, আসলে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রেরও যোগসূত্র থাকতে পারে। নিউ ইয়র্ক টাইমসে সেই ভিডিও এখনো দেখা যায়। তবে এটা মনে রাখার প্রয়োজন আছে, মালালার ওপর এই হামলা পাকিস্তানের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের সঙ্গে সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের একটা মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করছে। মালালা সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। আর মালালা যে আগামীতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত করতে পারে, এমন চিন্তা করাও অপ্রাসঙ্গিক নয়।
লেখক : পাকিস্তানের সাংবাদিক
গালফ টাইমস থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments