তীব্র হচ্ছে গণপরিবহন সংকট যাত্রীস্বার্থ দেখার কি কেউ নেই? by ডক্টর তুহিন মালিক
নগর পরিবহনে চরম নৈরাজ্য এখন রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা। কয়েক বছর ধরে ঢাকাবাসীর কাছে গণপরিবহন একটি চরম ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার নাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নগরবাসীর শান্তিপূর্ণ যাত্রীসেবা পাওয়ার অধিকার যে রয়েছে এটা কেউ স্বীকারই করতে চায় না।
এসি গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে চলাচলকারীদের চোখে সাধারণ নগরবাসীর এই ভোগান্তি কখনো দৃষ্টিগোচর হয় না। নগর পরিবহনে নেওয়া হয় মহাপরিকল্পনা, পাতালরেল, এমআরটি, বিদ্যুৎগতির ট্রেন- আরো কত কী! অথচ ঢাকাবাসীর কপালে জোটে না পাবলিক বাসে ঠেলাঠেলি করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো এতটুকু জায়গা। বাসের ভেতরের মানুষগুলোও যে দেশের নাগরিক এ কথা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হয়তো এত দিনে ভুলেই বসেছেন।
সেই সঙ্গে নগর পরিবহনে ভাড়া নিয়েও চলছে চরম নৈরাজ্য। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব ও কাউন্টার বাস সার্ভিস কোনো রকম নিয়মনীতি মেনে চলছে না। দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রীরা তাদের হাতে জিম্মি। অসহায় যাত্রীরা উপায়হীন হয়ে তাদের জ্বালাতন সয়ে যাচ্ছে। এদের যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপকৌশল দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা কোনো রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা এখন সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মনীতির মধ্যে চলার ও দেখভালের দায়দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা এত উদাসীন কেন? রাজধানীতে চলাচলকারী বেশির ভাগ ট্যাক্সিক্যাব চলাচলের অনুপযোগী কিংবা ত্রুটিপূর্ণ হলেও থেমে নেই চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা আর দৌরাত্ম্য।
বর্তমানে রাজধানীতে লোকাল বাসের পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন ধরনের কাউন্টার সার্ভিস। আর এ সার্ভিসের নামে একই রুটে একই দূরত্বে আদায় করা হচ্ছে একেক রকমের ভাড়া। অন্যদিকে সিটিং সার্ভিস লিখে বেশি ভাড়া নেওয়া হলেও বেশির ভাগ বাসে দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়। দু-একটি রুটে বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু হলেও সেবার মান নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, বিআরটিসি ও অন্য পরিবহনগুলো সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করে না। নানা অজুহাতে এরা বেশি ভাড়া আদায় করছে। এ ছাড়া গণপরিবহনের তীব্র সংকট নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ অবস্থায় নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব যাতে মিটারে চলে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী যেন গন্তব্যে যায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বাস, মিনিবাসগুলো যেন ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চালাতে না পারে, সেটিও দেখতে হবে। গণপরিবহনের সংকট দূর করতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএর হিসাবে ঢাকায় মোটরযানের মোট সংখ্যা ছয় লাখ ৭৪ হাজার ৫১০। মোটরসাইকেল বাদে মোটরযানের সংখ্যা তিন লাখ ৯০ হাজার ৪৪৬টি। যার মধ্যে প্রাইভেট কার, জিপ, ট্যাক্সি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা দুই লাখ ৭৭ হাজার ২১৬। অন্যদিকে বাস ও মিনিবাস মিলিয়ে গণপরিবহনের সংখ্যা মাত্র ১৯ হাজার ৮৮। উল্লেখ্য, বিআরটিএর খাতায় একবার কোনো গাড়ির নিবন্ধন হলে তা আর কখনোই বাদ দেওয়া হয় না। ফলে ইতিমধ্যে লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে কিংবা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, সেসব গাড়ির সংখ্যা বাদ দেওয়া হয়নি এই ১৯ হাজার বাসের মধ্য থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ঢাকায় চালিত বাসের সংখ্যা পাঁচ থেকে সাত হাজার। বাকি বাসগুলো বিকল হয়ে গেছে কিংবা ঢাকার বাইরে চলাচল করছে। দিন দিন এ সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। ২০১১ সালে রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা বেড়েছে ৭১ হাজার ৩৪৪। এই বিশালসংখ্যক মোটরযানের মধ্যে সাধারণ যাত্রীবাহী বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র এক হাজার ৩১৮টি। এ ধারা অব্যাহত থাকায় বাসের প্রতিটি আসনের বিপরীতে যাত্রীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এ দৃশ্য শুধু রাজধানীর নয়, সারা দেশের। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মোটরযানের সংখ্যা ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮১। এর বিপরীতে বাস ও মিনিবাস মাত্র ৭৬ হাজার ১৫১টি। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ। তবে প্রকৃত জনসংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখের ওপরে বলে মনে করা হয়। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য গণপরিবহন বলতে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার বাস-মিনিবাস, ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রায় দুই হাজার হিউম্যান হলার। মোটরযান আইনে সিটিং সার্ভিস বলতে কোনো পরিবহনের উল্লেখ নেই। কিন্তু বেশির ভাগ বাস অফিস সময়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে সিটিং সার্ভিস নামে চালানোর কারণে দুর্ভোগে পড়ছে সাধারণ যাত্রীরা।
বর্তমানে ঢাকায় বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া এক টাকা ৫৫ পয়সা এবং মিনিবাসে এক টাকা ৪৫ পয়সা। দূরপাল্লার পথে কিলোমিটার-প্রতি ভাড়া এক টাকা ২০ পয়সা। রাজধানীতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বাস সিএনজিচালিত হলেও তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। কোথাও কোথাও নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করা হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। অভিযোগ উঠেছে কাউন্টার বাসে অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়, যে স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলা হয়, তার চেয়ে এক-দুই কিলোমিটার পেছন থেকে ভাড়া আদায় ও টিকিট দেওয়া হয় যাত্রীদের। বাড়তি ভাড়া কেন আদায় করা হচ্ছে? এর কোনো কৈফিয়ত দিতে নারাজ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা তাদের হাতে জিম্মি। যাত্রীস্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই। যাওয়া না যাওয়া কিংবা ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের হরহামেশাই ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এত বড় একটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, নির্বিকারত্ব অবশ্যই প্রশ্নবোধক। এ অবস্থা চলতে পারে না। সিএনজি অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাবে মিটার ব্যবহার, যাত্রীদের চাহিদামাফিক স্থানে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করাসহ এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরি। যাত্রী হয়রানির বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে আর কালক্ষেপণ না করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। ঢাকায় যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৪৯ হাজারের ফিটনেস সনদ নেই। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মোট যানবাহনের পাঁচ লাখই ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি ও মোটরসাইকেল। এই শ্রেণীর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় না। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বেশির ভাগই বাস-মিনিবাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার ও ট্যাক্সিক্যাব। ঢাকায় গণপরিবহন বলতে বাস-মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, হিউম্যান হলার ও অল্প কিছু ট্যাক্সিক্যাব। নামে গণপরিবহন হলেও এর কোনোটাই যাত্রীবান্ধব নয়। বাস-মিনিবাসের ৮০ শতাংশই রংচটা, লক্কড়ঝক্কড় ও চলাচলের অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন)। হিউম্যান হলার ও অল্প যে কটা ট্যাক্সিক্যাব চলাচল করে সেগুলোতেও ওঠার জো নেই। এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের উপযোগী হলেও সেগুলোর চালকদের দৌরাত্ম্যে মানুষ অতিষ্ঠ। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত নগর পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। বাসমালিকরা যেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এবং যাত্রীদের হয়রানি করতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
নগরবাসীর কাছে এখন নতুন আরেকটি আতঙ্ক যোগ দিয়েছে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে আরেক দফা বাড়ানো হচ্ছে সিএনজির দাম। ২০০৮ সাল থেকে সরকার সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম চারবার বৃদ্ধি করে। প্রতিবারই সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে গ্যাসচালিত পরিবহনের ভাড়াও বৃদ্ধি পায়। তবে বাসমালিকরা প্রতিবারই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আগেই তাঁদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছেন। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে যোগ হচ্ছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সাধারণ মানুষের স্বল্প ভাড়া যাতায়াত ও যাত্রীসেবা পাওয়ার অধিকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকার পরিবহন সেক্টরে এমন নৈরাজ্য অবিলম্বে বন্ধ করবে এমনটাই প্রত্যাশা। নগরবাসী ট্যাঙ্ ফ্রি গাড়ি চায় না, নির্বিঘ্নে চলাচলের এতটুকু সুযোগ চায়।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
সেই সঙ্গে নগর পরিবহনে ভাড়া নিয়েও চলছে চরম নৈরাজ্য। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব ও কাউন্টার বাস সার্ভিস কোনো রকম নিয়মনীতি মেনে চলছে না। দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রীরা তাদের হাতে জিম্মি। অসহায় যাত্রীরা উপায়হীন হয়ে তাদের জ্বালাতন সয়ে যাচ্ছে। এদের যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপকৌশল দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তারা কোনো রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা এখন সংকটে রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মনীতির মধ্যে চলার ও দেখভালের দায়দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা এত উদাসীন কেন? রাজধানীতে চলাচলকারী বেশির ভাগ ট্যাক্সিক্যাব চলাচলের অনুপযোগী কিংবা ত্রুটিপূর্ণ হলেও থেমে নেই চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা আর দৌরাত্ম্য।
বর্তমানে রাজধানীতে লোকাল বাসের পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন ধরনের কাউন্টার সার্ভিস। আর এ সার্ভিসের নামে একই রুটে একই দূরত্বে আদায় করা হচ্ছে একেক রকমের ভাড়া। অন্যদিকে সিটিং সার্ভিস লিখে বেশি ভাড়া নেওয়া হলেও বেশির ভাগ বাসে দাঁড় করিয়ে যাত্রী নেওয়া হয়। দু-একটি রুটে বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু হলেও সেবার মান নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, বিআরটিসি ও অন্য পরিবহনগুলো সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া আদায় করে না। নানা অজুহাতে এরা বেশি ভাড়া আদায় করছে। এ ছাড়া গণপরিবহনের তীব্র সংকট নাগরিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ অবস্থায় নাগরিক দুর্ভোগ কমাতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাব যাতে মিটারে চলে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী যেন গন্তব্যে যায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। বাস, মিনিবাসগুলো যেন ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চালাতে না পারে, সেটিও দেখতে হবে। গণপরিবহনের সংকট দূর করতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএর হিসাবে ঢাকায় মোটরযানের মোট সংখ্যা ছয় লাখ ৭৪ হাজার ৫১০। মোটরসাইকেল বাদে মোটরযানের সংখ্যা তিন লাখ ৯০ হাজার ৪৪৬টি। যার মধ্যে প্রাইভেট কার, জিপ, ট্যাক্সি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা দুই লাখ ৭৭ হাজার ২১৬। অন্যদিকে বাস ও মিনিবাস মিলিয়ে গণপরিবহনের সংখ্যা মাত্র ১৯ হাজার ৮৮। উল্লেখ্য, বিআরটিএর খাতায় একবার কোনো গাড়ির নিবন্ধন হলে তা আর কখনোই বাদ দেওয়া হয় না। ফলে ইতিমধ্যে লক্কড়ঝক্কড় যেসব বাস ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে কিংবা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে, সেসব গাড়ির সংখ্যা বাদ দেওয়া হয়নি এই ১৯ হাজার বাসের মধ্য থেকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে ঢাকায় চালিত বাসের সংখ্যা পাঁচ থেকে সাত হাজার। বাকি বাসগুলো বিকল হয়ে গেছে কিংবা ঢাকার বাইরে চলাচল করছে। দিন দিন এ সংকট আরো তীব্র হচ্ছে। ২০১১ সালে রাজধানীতে মোটরযানের সংখ্যা বেড়েছে ৭১ হাজার ৩৪৪। এই বিশালসংখ্যক মোটরযানের মধ্যে সাধারণ যাত্রীবাহী বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র এক হাজার ৩১৮টি। এ ধারা অব্যাহত থাকায় বাসের প্রতিটি আসনের বিপরীতে যাত্রীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এ দৃশ্য শুধু রাজধানীর নয়, সারা দেশের। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট মোটরযানের সংখ্যা ১৬ লাখ ৭৭ হাজার ৩৮১। এর বিপরীতে বাস ও মিনিবাস মাত্র ৭৬ হাজার ১৫১টি। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ২৫ লাখ। তবে প্রকৃত জনসংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখের ওপরে বলে মনে করা হয়। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য গণপরিবহন বলতে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার বাস-মিনিবাস, ১৩ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রায় দুই হাজার হিউম্যান হলার। মোটরযান আইনে সিটিং সার্ভিস বলতে কোনো পরিবহনের উল্লেখ নেই। কিন্তু বেশির ভাগ বাস অফিস সময়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে সিটিং সার্ভিস নামে চালানোর কারণে দুর্ভোগে পড়ছে সাধারণ যাত্রীরা।
বর্তমানে ঢাকায় বড় বাসে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া এক টাকা ৫৫ পয়সা এবং মিনিবাসে এক টাকা ৪৫ পয়সা। দূরপাল্লার পথে কিলোমিটার-প্রতি ভাড়া এক টাকা ২০ পয়সা। রাজধানীতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বাস সিএনজিচালিত হলেও তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেন মালিকরা। কোথাও কোথাও নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ আদায় করা হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। অভিযোগ উঠেছে কাউন্টার বাসে অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়, যে স্টপেজ থেকে যাত্রী তোলা হয়, তার চেয়ে এক-দুই কিলোমিটার পেছন থেকে ভাড়া আদায় ও টিকিট দেওয়া হয় যাত্রীদের। বাড়তি ভাড়া কেন আদায় করা হচ্ছে? এর কোনো কৈফিয়ত দিতে নারাজ পরিবহন কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা তাদের হাতে জিম্মি। যাত্রীস্বার্থ দেখার যেন কেউ নেই। যাওয়া না যাওয়া কিংবা ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের হরহামেশাই ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এত বড় একটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, নির্বিকারত্ব অবশ্যই প্রশ্নবোধক। এ অবস্থা চলতে পারে না। সিএনজি অটোরিকশা ও ট্যাক্সিক্যাবে মিটার ব্যবহার, যাত্রীদের চাহিদামাফিক স্থানে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করাসহ এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরি। যাত্রী হয়রানির বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে আর কালক্ষেপণ না করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। ঢাকায় যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৪৯ হাজারের ফিটনেস সনদ নেই। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মোট যানবাহনের পাঁচ লাখই ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি ও মোটরসাইকেল। এই শ্রেণীর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয় না। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বেশির ভাগই বাস-মিনিবাস, ট্রাক, হিউম্যান হলার ও ট্যাক্সিক্যাব। ঢাকায় গণপরিবহন বলতে বাস-মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, হিউম্যান হলার ও অল্প কিছু ট্যাক্সিক্যাব। নামে গণপরিবহন হলেও এর কোনোটাই যাত্রীবান্ধব নয়। বাস-মিনিবাসের ৮০ শতাংশই রংচটা, লক্কড়ঝক্কড় ও চলাচলের অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন)। হিউম্যান হলার ও অল্প যে কটা ট্যাক্সিক্যাব চলাচল করে সেগুলোতেও ওঠার জো নেই। এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের উপযোগী হলেও সেগুলোর চালকদের দৌরাত্ম্যে মানুষ অতিষ্ঠ। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত নগর পরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। বাসমালিকরা যেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এবং যাত্রীদের হয়রানি করতে না পারে, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
নগরবাসীর কাছে এখন নতুন আরেকটি আতঙ্ক যোগ দিয়েছে। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে আরেক দফা বাড়ানো হচ্ছে সিএনজির দাম। ২০০৮ সাল থেকে সরকার সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম চারবার বৃদ্ধি করে। প্রতিবারই সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে গ্যাসচালিত পরিবহনের ভাড়াও বৃদ্ধি পায়। তবে বাসমালিকরা প্রতিবারই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির আগেই তাঁদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছেন। আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে যোগ হচ্ছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। সাধারণ মানুষের স্বল্প ভাড়া যাতায়াত ও যাত্রীসেবা পাওয়ার অধিকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের কথা বিবেচনা করে সরকার পরিবহন সেক্টরে এমন নৈরাজ্য অবিলম্বে বন্ধ করবে এমনটাই প্রত্যাশা। নগরবাসী ট্যাঙ্ ফ্রি গাড়ি চায় না, নির্বিঘ্নে চলাচলের এতটুকু সুযোগ চায়।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
No comments