চরাচর-সত্তরের প্রলয় by জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
'খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু আনমনে/প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা/নিরজনে প্রভু নিরজনে।' কাজী নজরুলের কল্পনার সেই শিশু প্রলয় খেলা খেলেছিল ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এই বাংলার উপকূলে। দশ লক্ষাধিক মানুষ, অসংখ্য গবাদিপশু জলোচ্ছ্বাসের প্রলয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল এই ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাস।
রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রকে দেখতেন খাঁচাবন্দি সিংহ হিসেবে। এই সিংহ সেদিন যেন মুক্ত হয়ে অসহায় বঙ্গবাসীর ওপর মরণতাণ্ডব চালায়। উপকূলের প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে সেই মুক্ত সিংহের থাবায়।
ঝড়ের তিন দিন আগেই আমেরিকা তাদের স্যাটেলাইট থেকে ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেছিল পাকিস্তান আবহাওয়া দপ্তরকে। কিন্তু কেউ সতর্কবাণী প্রচার করেনি গুরুত্বসহকারে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তখন ব্যস্ত তাঁর চীন সফরে। তাঁকে ঝড়ের বার্তা জানানোর পর তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু রিলিফ পাঠিয়ে দিতে বলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনের হাওয়া তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, সবাই ব্যস্ত জনসংযোগে। সরকার আগাম দুর্যোগের কথা কাউকেই কিছু জানতে দেয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে তা নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা আগেভাগে টের পায়। নদীতে বিরল প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে, পাখিদের অস্থির আচরণ শুরু হয়, রাতের বেলা শিয়াল-কুকুর অস্থির ডাকাডাকি করে। সবই দেখা দিয়েছিল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। মুরবি্বরা ঝড়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ঝড় যে এমন প্রলয়ঙ্করী হবে, তা কেউ আঁচ করেনি। তখন চরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত ভালো ছিল না। এমনকি ছিল না বনাঞ্চল। ছিল না দুর্যোগ ব্যবস্থা সামাল দেওয়ার মতো কোনো কিছু। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে খুলনার সুন্দরবন পর্যন্ত ছিল বিরাণ জনপদ। এত এত লাশ সমাহিত করার মতো অবস্থাও ছিল না, গণকবর দিতে হয়েছিল হাজার হাজার লাশ। এ যেন রুদ্রর সেই 'বাতাসে লাশের গন্ধ পাই।' নোয়াখালীর সদর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। হাতিয়া আর সন্দ্বীপে অসংখ্য মানুষ জলে ভেসে গেছে। বিদেশি পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হলো না পূর্ব পাকিস্তানে। সজন হারানোর চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল ক্ষুধার জ্বালা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন টের পেল, তারা কত অসহায়। দুই পাকিস্তান যে আসলে এক দেশ নয়, তা বুঝতে কারো বাকি রইল না। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে দাঁড়ালেন মানুষের পাশে। তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধু মত দিলেন, উপকূলাঞ্চল ছাড়া অন্য আসনে নির্বাচন করা যেতে পারে। ১৬৯ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু পেলেন ১৬৭ আসন। বাঙালি ভোট দিয়ে প্রমাণ করে দিল, তারা পূর্ববঙ্গে নিজেদের মানুষ চায়। আর এরই সূত্র ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সূর্য দেখতে পেল।
মাত্র কিছু দিন আগে আমেরিকায় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ঘূর্ণিঝড় 'স্যান্ডি' আক্রমণ করে। আগাম সতর্কতা ও পরবর্তী দুর্যোগ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণ ঠেকানো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপ্রতিহতভাবে হয়ে চলেছে। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে আমরা তার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারি। দুর্যোগের পর দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলতে পারি, ভাই, আমার এই হাত ধরে দাঁড়াও আবার।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
ঝড়ের তিন দিন আগেই আমেরিকা তাদের স্যাটেলাইট থেকে ঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেছিল পাকিস্তান আবহাওয়া দপ্তরকে। কিন্তু কেউ সতর্কবাণী প্রচার করেনি গুরুত্বসহকারে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তখন ব্যস্ত তাঁর চীন সফরে। তাঁকে ঝড়ের বার্তা জানানোর পর তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে কিছু রিলিফ পাঠিয়ে দিতে বলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনের হাওয়া তখন তুঙ্গে। বঙ্গবন্ধু, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, সবাই ব্যস্ত জনসংযোগে। সরকার আগাম দুর্যোগের কথা কাউকেই কিছু জানতে দেয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে তা নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা আগেভাগে টের পায়। নদীতে বিরল প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে, পাখিদের অস্থির আচরণ শুরু হয়, রাতের বেলা শিয়াল-কুকুর অস্থির ডাকাডাকি করে। সবই দেখা দিয়েছিল। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছিল। মুরবি্বরা ঝড়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু ঝড় যে এমন প্রলয়ঙ্করী হবে, তা কেউ আঁচ করেনি। তখন চরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা অত ভালো ছিল না। এমনকি ছিল না বনাঞ্চল। ছিল না দুর্যোগ ব্যবস্থা সামাল দেওয়ার মতো কোনো কিছু। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে খুলনার সুন্দরবন পর্যন্ত ছিল বিরাণ জনপদ। এত এত লাশ সমাহিত করার মতো অবস্থাও ছিল না, গণকবর দিতে হয়েছিল হাজার হাজার লাশ। এ যেন রুদ্রর সেই 'বাতাসে লাশের গন্ধ পাই।' নোয়াখালীর সদর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। হাতিয়া আর সন্দ্বীপে অসংখ্য মানুষ জলে ভেসে গেছে। বিদেশি পর্যটকদের ঢুকতে দেওয়া হলো না পূর্ব পাকিস্তানে। সজন হারানোর চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিল ক্ষুধার জ্বালা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন টের পেল, তারা কত অসহায়। দুই পাকিস্তান যে আসলে এক দেশ নয়, তা বুঝতে কারো বাকি রইল না। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে দাঁড়ালেন মানুষের পাশে। তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধু মত দিলেন, উপকূলাঞ্চল ছাড়া অন্য আসনে নির্বাচন করা যেতে পারে। ১৬৯ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু পেলেন ১৬৭ আসন। বাঙালি ভোট দিয়ে প্রমাণ করে দিল, তারা পূর্ববঙ্গে নিজেদের মানুষ চায়। আর এরই সূত্র ধরে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সূর্য দেখতে পেল।
মাত্র কিছু দিন আগে আমেরিকায় ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ঘূর্ণিঝড় 'স্যান্ডি' আক্রমণ করে। আগাম সতর্কতা ও পরবর্তী দুর্যোগ সামাল দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণ ঠেকানো মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপ্রতিহতভাবে হয়ে চলেছে। কিন্তু বুদ্ধি দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে আমরা তার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারি। দুর্যোগের পর দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলতে পারি, ভাই, আমার এই হাত ধরে দাঁড়াও আবার।
জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ
No comments