রবীন্দ্রনাথ ও কারনাড by মাহবুব মোর্শেদ
গতকাল ফেসবুকে সহসা এক ভারতীয় বন্ধুর স্টেটাস নজর কেড়ে নিল। তিনি গিরিশ কারনাডকে একহাত নিয়েছেন। তিনি যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হলো, রবীন্দ্রনাথ দূরের কথা, গিরিশ কারনাড নাট্যকার হিসেবে আমাদের গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গেও তুলনীয় নন। তবে কি এবার রবীন্দ্রনাথ নিয়েই মন্তব্য করলেন কারনাড?
উত্তর পেতে বেশি সময় লাগল না। ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকায় নজর বুলিয়েই বুঝলাম, একেবারে বাঙালির আঁতে ঘা দিয়ে বসেছেন কারনাড। খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সমালোচনা করেছেন। তাও আবার আক্রমণাত্মক ভাষায়। কিছুদিন আগে ভিএস নাইপলকে একহাত নিয়ে সাহিত্যসেবীদের নজর কেড়েছিলেন কন্নড় ভাষার এই নাট্যকার ও অভিনেতা। গিরিশ কারনাড ভারতের জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোচিত নাট্যকার। বাংলা ভাষায় বাদল সরকার যে থার্ড থিয়েটার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তারই সমান্তরালে কারনাডও তার ভাষায় নাটকের রীতি পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। নাট্যকার হিসেবে তিনি ভারতখ্যাত। আমাদের দেশেও কিছু পরিচিতি আছে তার। এর মধ্যে ভারতের একটি করপোরেট সংস্থা ভিএস নাইপলকে সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিলে কারনাড নাইপল-বধে নামেন। বলাবাহুল্য, নাইপল বিশ্বখ্যাত ইসলামবিদ্বেষী, কিছুটা ভারতবিদ্বেষীও; যদিও পৈতৃক সূত্রে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শাসকদের ধ্বংসাত্মক ভূমিকা নিয়ে তিনি লিখেছেন। ভারতে এসে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে দহরম-মহরম করেছেন। নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানিও দিয়েছেন। এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরে কারনাড বলেন, ভারত সম্পর্কে, ভারতে মুসলিম শাসকদের অবদান সম্পর্কে নাইপলের কোনো ধারণা নেই। তিনি সময়ের প্রতিভাবান একজন সাহিত্যিক সন্দেহ নেই, কিন্তু আত্মীয়তার সূত্রে তাকে পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল। নাইপলকে নিয়ে এ মন্তব্যের পর ভারতজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারনাডকে অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন, আবার ধুয়ে দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই। ওই তর্ক এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই কারনাড বলে বসলেন, 'রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথ প্রভাবসঞ্চারী চিন্তক। কিন্তু তার নাটকগুলো মাঝারি মানের।' যুক্তি হিসেবে কারনাড বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে মেকি। আর সেগুলো তার সমকালে বা পরে মঞ্চায়িত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। কিছু ব্যতিক্রম বাদে রবীন্দ্র অনুরক্ত বাঙালি লেখক-পাঠকরা তা করেও থাকেন। অনেকেই বলেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস এখন আবেদন হারিয়েছে। কালের গ্রাসে চলে গেছে তার অনেক গদ্য রচনাও। কিন্তু তার গান এখনও বাঙালির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের নাটকের কী অবস্থা তা নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। যে উপন্যাস নিয়ে পাঠকের কিছুটা দ্বিধা সে উপন্যাসকেও তো আমরা চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে দেখছি। রাজা, রক্তকরবী, বিসর্জন, গান্ধারীর আবেদন তো অহরহই মঞ্চে আসছে। কেউ তো বাধ্য করছে না অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। দর্শকও দেখে আনন্দ পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তার নাটক অভিনীত হচ্ছে। তবে নাটক অভিনীত হচ্ছে না সে কথা জোর গলায় কীভাবে বলা যায়? সমকালে ঠাকুরবাড়ির প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাটক অভিনীত হয়েছে। কিন্তু একটা কথা তো বলতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ কখনোই মঞ্চ কাঁপানো নাট্যকার নন, বেস্টসেলিং ঔপন্যাসিকও নন। তার গুরুত্ব তার জায়গায়। আর যদি ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির কথায় আসি তবে তার নাটকগুলোর রূপক-সাংকেতিক আবহ কতটা ভাষার ভিন্নতা দাবি করে সে প্রশ্নও উঠবে। বরং ছোটগল্পগুলোতে চরিত্রগুলো কেন এক ভাষায় কথা বলে সে প্রশ্ন উঠতে পারে। রবীন্দ্রনাথের নাটক দৃশ্যমান জগতের অন্তরলোকের কথা বলেছে। তবে প্রযোজনার গুণে সে নাটকও ভিন্ন আবেদন তৈরি করতে পারে। বাদল সরকারের নির্দেশনায় রক্তকরবী কি বাজারে-মাঠে সহস্র দর্শককে আপ্লুত করেনি? তবু তর্ক চলতে পারে। কেউ যদি বলেন, রবীন্দ্রনাথের নাটকের আবেদন আর নেই তবে প্রতিবাদ করার কিছু নেই। তাই বলে দ্বিতীয় শ্রেণীর বা মাঝারি মানের সৃষ্টি বলা হবে? এটা কিন্তু আক্রমণই। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে আর যা-ই বলা হোক মাঝারি মানের বলা যায় না। সেগুলো রবীন্দ্রনাথের গুণেই একটি উচ্চতর মান অর্জন করেছে। তবে কথা বলে গিরিশ কারনাড একটা ধাক্কা দিয়েছেন। ধাক্কাটা খুব দরকার। চিন্তার জগতে এখন তো ধাক্কা দেওয়ার লোকও নেই তেমন। রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করায় ভারতের বাঙালিরা যেভাবে সোচ্চার হয়েছেন তাতে কিন্তু আশাও জাগে।
No comments