বিবিসি প্রধানের পদত্যাগ-গণমাধ্যম ও দায়িত্বশীলতা by সুভাষ সাহা
সেপ্টেম্বরে দায়িত্ব নিয়ে মাত্র দুই মাস পদে থাকার পর বিবিসির মহাপরিচালক ও প্রধান সম্পাদক জর্জ এনটুইসেল পদত্যাগ করলেন। বিবিসির নিউজনাইট অনুষ্ঠানে ব্রিটেনের এক সাবেক টোরি রাজনীতিবিদকে শিশু যৌন হয়রানির ঘটনায় ভুলক্রমে অভিযুক্ত করার দায় নিয়ে তার এ পদত্যাগ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কর্মনিষ্ঠা, সততা ও বিশ্বস্ততার গুরুত্বকে তুলে ধরে।
এটা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতারও নজির বটে। তবে, এভাবে কিছু বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কী করে বিবিসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে পারল, সে বিষয়টি খোদ বিবিসি এবং তাবৎ দুনিয়ার গণমাধ্যমের গভীর গবেষণার বিষয় হবে। সঙ্গত কারণেই এ অনুষ্ঠানের জন্য রিপোর্টটি যারা প্রস্তুত করেছিলেন সেই প্রতিবেদক, প্রযোজক, সহকারী ও অনুষ্ঠান সম্পাদনার দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না। আর যার বিরুদ্ধে ভুয়া শিশু নির্যাতনের কল্পকাহিনী ফাঁদা হলো তিনি কি চুপ করে বসে থাকবেন? নিশ্চয়ই না। ইতিমধ্যেই তিনি বিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। তদুপরি এটা তার ন্যায়সঙ্গত অধিকারও বটে। কারণ এ অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হওয়ার কারণে তার পারিবারিক শান্তি, ব্যক্তিগত সুনাম ও সামাজিক সম্মানের ক্ষতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানসিকভাবে এ ধরনের তথ্য যে কাউকে মারাত্মক বিপর্যস্ত করতে পারে এবং টোরি রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। এতে বিবিসির সুনামেও কিছুকাল আঁচড়ের দাগ লেপ্টে থাকবে। এমনিতেই প্রয়াত বিবিসি তারকা জিমি সেভিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন নিউজনাইটে সম্প্রচার না করা নিয়ে বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার পেছনে বিবিসির সম্প্রতি ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইকে দায়ী করেছেন। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই ছাড়াই এবং কখনও কখনও নিউজের বা তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের স্বীকৃত পর্যবেক্ষণ নিয়মনীতিও মানা হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। তাছাড়া বিবিসি কর্মী দলের মধ্যেও অনিশ্চয়তাজনিত এক ধরনের 'কেলাসনেস' জন্ম নিয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় রিচার্ড ওসলে ও সুসি মিসুরির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২ নভেম্বর অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগে এনটুইসেলের কাছে অনুষ্ঠানটিতে একজন রাজনীতিবিদের শিশু যৌন হয়রানির তথ্য রয়েছে মর্মে টুইট এলেও তিনি সে টুইট মেসেজটি তখন পড়েননি। অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের পরের দিন তিনি এটি পড়েছিলেন। এখানে বিবিসি প্রধানের অসতর্কতা রয়েছে বোঝাই যায়। তদুপরি প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের পর এটি যেহেতু স্পর্শকাতর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা_ তাহলে এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও সম্পাদনার সিস্টেম কাজ করেনি কেন সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থাকবে। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্টগুলো সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সম্পাদনার গোটা প্রক্রিয়াটিই যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তাই এসব নিয়েও প্রতিষ্ঠানটিতে চিন্তাভাবনা আসবেই। বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া বিবিসির এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়া দেখে নিজেদের সামলে ও সমঝে চলার ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে। আসলে মিডিয়ার সম্বল হলো পাঠক, শ্রোতা, দর্শকদের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। এটি হারিয়ে গেলে নির্দিষ্ট মিডিয়ার পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। তাই মিডিয়া বাজারের সঙ্গে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও গ্রহণযোগ্য অনুষ্ঠান প্রকাশ এবং সম্প্রচারের প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। তবে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষত যুদ্ধের সময় এমবেডেড সাংবাদিকতার নামে শক্তিমান দেশগুলোর বানানো সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য করার নজিরও কম নেই। বিগত ইরাক যুদ্ধের সময়েই এটি ব্যাপকভাবে ধরা পড়ে। সে কারণে অনেক বাঘা বাঘা গণমাধ্যম আজ বিতর্কিত এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও অনেক কমে গেছে। আমরা চাই না, বিবিসির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটুক। কারণ বিবিসির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অনেক আস্থা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাকিস্তানপন্থি নীতি সত্ত্বেও বিবিসি পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল। তাই বাংলাদেশি মাত্রই বিবিসির ব্যাপারে এক ধরনের আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক।
তবে বিবিসিতে যারা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের নিউজনাইট অনুষ্ঠানের রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছেন ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সঙ্গত কারণেই। যেমন রিপোর্টটির সঙ্গে যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে টোরি দলের সাবেক নেতা লর্ড ম্যাকআলপাইনের ঘটনা সংশ্লিষ্ট কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজ নেই কেন এর উত্তর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দেবেন কী করে! তারা কেবল অভিযোগকারীর মুখের অভিযোগের ভিত্তিতেই রিপোর্টটি তৈরি করে ফেললেন। অভিযোগকারী মিসহাম শুক্রবার নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তার অভিযোগটি সত্য নয় এবং তিনি ভুল করেছেন। এত বড় একটি ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট প্রস্তুত করার পর সেটা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা সর্বোচ্চ পর্যায়কে যথাযথভাবে অবহিত করলেন না কেন? এখানেই নিউজ বা অনুষ্ঠান তৈরি করা ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নামে এক ধরনের আনাড়িপনা নজরে আসে।
শুধু মহাপরিচালক ও প্রধান সম্পাদক জর্জ এনটুইসেলের পদত্যাগের মাধ্যমে বিবিসি তার নাজুক অবস্থা পুরোপুরি সামাল দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এমনকি অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগে পুরোপুরি আস্থা নাও ফিরতে পারে। কারণ, প্রয়াত বিবিসি তারকা জিমি সেভিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন নিউজনাইটে সম্প্রচার করা হবে কি-না এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনও ঝুলে রয়েছে। এটি বিবিসি কর্তৃপক্ষকেই সুরাহা করতে হবে।
তবে, এটা ঠিক যে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো, মিডিয়াকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবে সেটা অবশ্যই পাঠক-শ্রোতা তথা জনতার আদালত।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এ ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার পেছনে বিবিসির সম্প্রতি ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইকে দায়ী করেছেন। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই ছাড়াই এবং কখনও কখনও নিউজের বা তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের স্বীকৃত পর্যবেক্ষণ নিয়মনীতিও মানা হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। তাছাড়া বিবিসি কর্মী দলের মধ্যেও অনিশ্চয়তাজনিত এক ধরনের 'কেলাসনেস' জন্ম নিয়ে থাকতে পারে। যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় রিচার্ড ওসলে ও সুসি মিসুরির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ২ নভেম্বর অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগে এনটুইসেলের কাছে অনুষ্ঠানটিতে একজন রাজনীতিবিদের শিশু যৌন হয়রানির তথ্য রয়েছে মর্মে টুইট এলেও তিনি সে টুইট মেসেজটি তখন পড়েননি। অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের পরের দিন তিনি এটি পড়েছিলেন। এখানে বিবিসি প্রধানের অসতর্কতা রয়েছে বোঝাই যায়। তদুপরি প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের পর এটি যেহেতু স্পর্শকাতর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা_ তাহলে এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ ও সম্পাদনার সিস্টেম কাজ করেনি কেন সে ব্যাপারেও প্রশ্ন থাকবে। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যানুসন্ধানী রিপোর্টগুলো সম্পাদনার ক্ষেত্রে বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠানকে আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সম্পাদনার গোটা প্রক্রিয়াটিই যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তাই এসব নিয়েও প্রতিষ্ঠানটিতে চিন্তাভাবনা আসবেই। বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া বিবিসির এহেন নাজুক পরিস্থিতিতে পড়া দেখে নিজেদের সামলে ও সমঝে চলার ব্যাপারে আরও সতর্ক হবে। আসলে মিডিয়ার সম্বল হলো পাঠক, শ্রোতা, দর্শকদের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। এটি হারিয়ে গেলে নির্দিষ্ট মিডিয়ার পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। তাই মিডিয়া বাজারের সঙ্গে সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও গ্রহণযোগ্য অনুষ্ঠান প্রকাশ এবং সম্প্রচারের প্রশ্নটি জড়িয়ে আছে। তবে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষত যুদ্ধের সময় এমবেডেড সাংবাদিকতার নামে শক্তিমান দেশগুলোর বানানো সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য করার নজিরও কম নেই। বিগত ইরাক যুদ্ধের সময়েই এটি ব্যাপকভাবে ধরা পড়ে। সে কারণে অনেক বাঘা বাঘা গণমাধ্যম আজ বিতর্কিত এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও অনেক কমে গেছে। আমরা চাই না, বিবিসির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটুক। কারণ বিবিসির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের অনেক আস্থা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাকিস্তানপন্থি নীতি সত্ত্বেও বিবিসি পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল। তাই বাংলাদেশি মাত্রই বিবিসির ব্যাপারে এক ধরনের আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক।
তবে বিবিসিতে যারা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের নিউজনাইট অনুষ্ঠানের রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছেন ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সঙ্গত কারণেই। যেমন রিপোর্টটির সঙ্গে যৌন নির্যাতনকারী হিসেবে টোরি দলের সাবেক নেতা লর্ড ম্যাকআলপাইনের ঘটনা সংশ্লিষ্ট কোনো ছবি বা ভিডিও ফুটেজ নেই কেন এর উত্তর অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দেবেন কী করে! তারা কেবল অভিযোগকারীর মুখের অভিযোগের ভিত্তিতেই রিপোর্টটি তৈরি করে ফেললেন। অভিযোগকারী মিসহাম শুক্রবার নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তার অভিযোগটি সত্য নয় এবং তিনি ভুল করেছেন। এত বড় একটি ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট প্রস্তুত করার পর সেটা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা সর্বোচ্চ পর্যায়কে যথাযথভাবে অবহিত করলেন না কেন? এখানেই নিউজ বা অনুষ্ঠান তৈরি করা ও সম্প্রচারের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নামে এক ধরনের আনাড়িপনা নজরে আসে।
শুধু মহাপরিচালক ও প্রধান সম্পাদক জর্জ এনটুইসেলের পদত্যাগের মাধ্যমে বিবিসি তার নাজুক অবস্থা পুরোপুরি সামাল দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এমনকি অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগে পুরোপুরি আস্থা নাও ফিরতে পারে। কারণ, প্রয়াত বিবিসি তারকা জিমি সেভিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন নিউজনাইটে সম্প্রচার করা হবে কি-না এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনও ঝুলে রয়েছে। এটি বিবিসি কর্তৃপক্ষকেই সুরাহা করতে হবে।
তবে, এটা ঠিক যে, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণ হলো, মিডিয়াকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, তবে সেটা অবশ্যই পাঠক-শ্রোতা তথা জনতার আদালত।
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments