বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-পরিবেশ ও ডায়াবেটিস by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
মানবদেহে ইনসুলিন নামক প্রয়োজনীয় হরমোনটির অপ্রতুল নিঃসরণের কারণে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়।
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, প্রতিরোধ করা যায় এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সনাতন সাধারণ লক্ষণ। যাঁদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাঁদের ওজন খুব বেশি, যাঁদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যাঁরা শরীরচর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, যাঁরা নিয়মিতভাবে সুষম খাবার পরিমিত পরিমাণে খান না, ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খেতে অভ্যস্ত তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনায়, মানসিক চাপে, দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায়, আঘাতে, সংক্রামক রোগে, অস্ত্রোপচারে, গর্ভাবস্থায় এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এ রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায় বলে অধুনা গবেষণায় প্রতিভাত হয়েছে।
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষায় 3D (Diet, Discipline and Drug) অর্থাৎ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমন কি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০০৯-১৩-তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উদ্যাপনে এবারের (২০১২) প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, 'সবার জন্য সঠিক পরিবেশ : ডায়াবেটিস থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করুন'। অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে।
এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রচার-প্রচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে আর এ চিকিৎসায় নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবারই শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তারকে থামানো, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে সীমিতকরণ। এবারের প্রচার-প্রচারণা মূল 3E (Education, Engage and Empower) বা তিনটি প্রতিপাদ্যে প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষার প্রসার, অধিকসংখ্যক রোগী-অরোগী-চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় সম্পৃক্তকরণ এবং ডায়াবেটিক রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ক্ষমতায়ন।
বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার সঙ্গে ডায়াবেটিসের বিস্তারের অন্তসম্পর্কটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাতাসে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পরিবেশগত সমস্যায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটার প্রমাণ এখনই মিলছে। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরো ভয়াবহ রূপে বাড়িয়ে পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি গ্যাস নিঃসরণ করলেও দরিদ্র দেশগুলো এর প্রতিক্রিয়া ভোগ করে বেশি। এ অবস্থার প্রতিকার না হলে প্রতি তিন বছরে জিডিপির ৫-২০ শতাংশ অর্থ ব্যয়িত হবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়। এর ফলে পুষ্টিহীনতা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার, দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। দ্রুত ও দুর্বল নগরায়নের ফলে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখন শহরে বাস করে। এখানে আছে যন্ত্রচালিত পরিবহন ব্যবস্থা, চলছে বস্তির বিস্তার, শরীরচর্চাবিহীন যাপিত জীবনে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধ জনসম্পদ, হচ্ছে বনজ প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়, প্রাণিজ ও সুষম খাদ্যের জায়গা দখল করছে কলকারখানায় প্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম অস্বাস্থ্যকর খাবার, পরিবর্তিত হচ্ছে আহার প্রক্রিয়া, বাড়ছে বিশ্বখাদ্য- কৃষির ব্যবসা ও বিপণনে প্রতিযোগিতা। ২০৩০ সালের মধ্যে আট বিলিয়ন বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ বিলিয়ন বাস করবে শহরে যাদের মধ্যে দুই বিলিয়নই বাস করবে বস্তিতে ফলে জীবনযাত্রায় জটিলতা বাড়তেই থাকবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নানা অনিয়মের ও ব্যবস্থাপনার কাছে নতি শিকার করতে বাধ্য হতে থাকবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৭ থেকে ৯ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়া ও আফ্রিকায়ই ঘটবে এর ব্যাপক বিস্তার। সার্বিকভাবে বিশ্বজনসংখ্যায় প্রবীণের প্রাধান্য পেলেও উন্নয়নশীল দেশে নবীনের পাল্লা হবে ভারি। জনমিতিতে এহেন অসম পরিবর্তন প্রবণতায় ইতিমধ্যে সম্পদের অপ্রতুলতায় পরিবেশ দূষণে, নানা রোগের প্রাদুর্ভাবে ও বিস্তারকে প্রভাবিত করছে। এ পটভূমিতে বর্তমানে বিশ্বে ৩৬৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ অর্ধ বিলিয়নে দাঁড়াবে। বছরে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মারা যায়। ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কর্মক্ষমতা হারানো, এ রোগের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাঁচজনের মধ্যে চারজন ডায়াবেটিস রোগী বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এ রোগ পরিবারকে অসচ্ছল করে, শ্রমশক্তি বিনষ্ট করে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে।
ডায়াবেটিসের বিস্তারের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত করা হয়েছে, কারণ ডায়াবেটিসের বিস্তার ও প্রতিরোধে পরিবেশের রয়েছে বিশেষ প্রভাবক ভূমিকা।
রিও-২ খ্যাত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে এ বিষয়টি প্রতিভাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে স্বাস্থ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবেচনাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে 'স্বাস্থ্যই সকল সুখ বা উন্নয়নের হাতিয়ার।' সুতরাং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিধান এবং তার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো উন্নয়নই হবে টেকসই উন্নয়ন। ডায়াবেটিস যেহেতু মহামারি আকার ধারণ করে জনশক্তির, বিশেষ করে গণউৎপাদিকা শক্তির অপচয় এবং একই সঙ্গে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে বর্ধিত ব্যয় নির্বাহে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি ঘটায় সেহেতু ডায়াবেটিসকেই শনাক্ত করা হয় বিশ্ব অর্থনীতি এবং এর উন্নয়নের জন্য অন্যতম বাধা হিসেবে।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, চিফ কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ভাষায় 3D (Diet, Discipline and Drug) অর্থাৎ খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণমতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমন কি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে মহামারি আকারে ধেয়ে আসা অসংক্রামক রোগ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০০৯-১৩-তে ডায়াবেটিস রোগের বিস্তার রোধে উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ১৪ নভেম্বর সাড়ম্বরে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উদ্যাপনে এবারের (২০১২) প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে, 'সবার জন্য সঠিক পরিবেশ : ডায়াবেটিস থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করুন'। অর্থাৎ পরিবেশের প্রভাব থেকে ডায়াবেটিসের বিস্তার প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির বিষয়টি মুখ্য বিবেচনায় উঠে এসেছে।
এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রচার-প্রচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা আছে আর এ চিকিৎসায় নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবারই শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তারকে থামানো, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব প্রতিক্রিয়াকে সীমিতকরণ। এবারের প্রচার-প্রচারণা মূল 3E (Education, Engage and Empower) বা তিনটি প্রতিপাদ্যে প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষার প্রসার, অধিকসংখ্যক রোগী-অরোগী-চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় সম্পৃক্তকরণ এবং ডায়াবেটিক রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ক্ষমতায়ন।
বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার সঙ্গে ডায়াবেটিসের বিস্তারের অন্তসম্পর্কটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাতাসে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পরিবেশগত সমস্যায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটার প্রমাণ এখনই মিলছে। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরো ভয়াবহ রূপে বাড়িয়ে পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। ধনী দেশগুলো সবচেয়ে বেশি গ্যাস নিঃসরণ করলেও দরিদ্র দেশগুলো এর প্রতিক্রিয়া ভোগ করে বেশি। এ অবস্থার প্রতিকার না হলে প্রতি তিন বছরে জিডিপির ৫-২০ শতাংশ অর্থ ব্যয়িত হবে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়। এর ফলে পুষ্টিহীনতা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার, দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে।
অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। দ্রুত ও দুর্বল নগরায়নের ফলে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখন শহরে বাস করে। এখানে আছে যন্ত্রচালিত পরিবহন ব্যবস্থা, চলছে বস্তির বিস্তার, শরীরচর্চাবিহীন যাপিত জীবনে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধ জনসম্পদ, হচ্ছে বনজ প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়, প্রাণিজ ও সুষম খাদ্যের জায়গা দখল করছে কলকারখানায় প্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম অস্বাস্থ্যকর খাবার, পরিবর্তিত হচ্ছে আহার প্রক্রিয়া, বাড়ছে বিশ্বখাদ্য- কৃষির ব্যবসা ও বিপণনে প্রতিযোগিতা। ২০৩০ সালের মধ্যে আট বিলিয়ন বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ বিলিয়ন বাস করবে শহরে যাদের মধ্যে দুই বিলিয়নই বাস করবে বস্তিতে ফলে জীবনযাত্রায় জটিলতা বাড়তেই থাকবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নানা অনিয়মের ও ব্যবস্থাপনার কাছে নতি শিকার করতে বাধ্য হতে থাকবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৭ থেকে ৯ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়া ও আফ্রিকায়ই ঘটবে এর ব্যাপক বিস্তার। সার্বিকভাবে বিশ্বজনসংখ্যায় প্রবীণের প্রাধান্য পেলেও উন্নয়নশীল দেশে নবীনের পাল্লা হবে ভারি। জনমিতিতে এহেন অসম পরিবর্তন প্রবণতায় ইতিমধ্যে সম্পদের অপ্রতুলতায় পরিবেশ দূষণে, নানা রোগের প্রাদুর্ভাবে ও বিস্তারকে প্রভাবিত করছে। এ পটভূমিতে বর্তমানে বিশ্বে ৩৬৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ অর্ধ বিলিয়নে দাঁড়াবে। বছরে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মারা যায়। ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কর্মক্ষমতা হারানো, এ রোগের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাঁচজনের মধ্যে চারজন ডায়াবেটিস রোগী বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এ রোগ পরিবারকে অসচ্ছল করে, শ্রমশক্তি বিনষ্ট করে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে।
ডায়াবেটিসের বিস্তারের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি সম্পৃক্ত করা হয়েছে, কারণ ডায়াবেটিসের বিস্তার ও প্রতিরোধে পরিবেশের রয়েছে বিশেষ প্রভাবক ভূমিকা।
রিও-২ খ্যাত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন-সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনে এ বিষয়টি প্রতিভাত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে স্বাস্থ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবেচনাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে 'স্বাস্থ্যই সকল সুখ বা উন্নয়নের হাতিয়ার।' সুতরাং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন বিধান এবং তার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো উন্নয়নই হবে টেকসই উন্নয়ন। ডায়াবেটিস যেহেতু মহামারি আকার ধারণ করে জনশক্তির, বিশেষ করে গণউৎপাদিকা শক্তির অপচয় এবং একই সঙ্গে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে বর্ধিত ব্যয় নির্বাহে আর্থিক ব্যয় বৃদ্ধি ঘটায় সেহেতু ডায়াবেটিসকেই শনাক্ত করা হয় বিশ্ব অর্থনীতি এবং এর উন্নয়নের জন্য অন্যতম বাধা হিসেবে।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, চিফ কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
No comments