জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে করণীয় by ড. মিল্টন বিশ্বাস
চলতি বছরের শুরুতে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে কারাগারে পাঠানোর পর ১২ জানুয়ারি ঢাকা শহরে পুলিশের ওপর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির অতর্কিত হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করেছিল কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে, লুট করেছিল পিস্তল। (কালের কণ্ঠ, ১৩-১-২০১২) গত ৫ ও ৬ নভেম্বরে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল।
ওই দুই দিন দেশের ১৮টি জেলায় জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় পুলিশ সদস্যদের রক্তাক্ত ও নাজেহাল হতে হয়। গুচ্ছ এসএমএসের মাধ্যমে দ্রুত নির্দেশনা দিতে থাকে আর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে হামলা চালাতে থাকে জামায়াত-শিবির। ৫ নভেম্বর ঢাকায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে তারা আহত করেছে ২২ জনকে; মালিবাগে জামায়াতের অফিসের সামনেই আটজন আহত হয়। ঢাকা ছাড়াও রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, বরিশাল, সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও চট্টগ্রামে দুই দিনে পুলিশের ওপর হামলা ও পাল্টা প্রতিরোধে দেড়শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হন। সাধারণ জনতার বেশ ধরে পুলিশের ওপর হামলা চালানোতে পুলিশ তাদের পরিকল্পনা বুঝতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল আরোহীর বেশেও জামায়াত-শিবিরকর্মীরা পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে মাঠে থাকা নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছে; ঘটনাস্থল ঘুরে পুলিশের অবস্থান জানিয়েছে এভাবে। পুলিশের ওপর এ আক্রমণের পরিকল্পনা পূর্বনির্ধারিত বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে (বিডিনিউজ২৪, ৯/১১/২০১২)। বিগত দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে সব রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, তাদের কোনো কর্মসূচি মানেই পুলিশের ওপর হামলা, নৈরাজ্য সৃষ্টি করা।
এর আগে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইল এবং চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় তাদের হামলায় পুলিশবাহিনীর অনেক সদস্য আহত হয়েছেন। তখনকার ঘটনাবলিও প্রমাণ করে যে স্বাধীনতাবিরোধীরা সে সময় থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা ও কার্যক্রম আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত। ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের ওপর হামলা চালানোর পর ২৭ সেপ্টেম্বর চার দলের জনসভায় মঞ্চের সামনে স্লোগান দিয়ে শক্তি জানান দেয় তারা। ২০১১-এর ৩০ অক্টোবর একটি জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় এই শিরোনামে 'থেমে নেই কার্যক্রম : গোপনে সক্রিয় হচ্ছে শিবির'। ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের স্কুল-কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে নিজস্ব ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঘৃণা তীব্রতর হয়েছে; কিন্তু বিরোধী দল বিএনপি এসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু কেন? স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতায় নির্লিপ্ত কেন বিএনপি? দেশের মধ্যে জামায়াত-শিবির যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার বিবরণ কি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে?
জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; তাদের দলীয় নিবন্ধন বাতিলের জন্য অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন মহল দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনীতি করতে হলে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য থাকার বিধান থাকলেও তারা তা বর্জন করেই চলেছে। তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আল্লাহ ছাড়া কারো কর্তৃত্ব মানতে তারা রাজি নয়। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে যে জামায়াত-ই-তালেবার জন্ম হয় পরবর্তী সময় ১৯৫৫ সালে তা 'ইসলামী ছাত্র সংঘে' রূপ নেয়। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় 'আলবদর বাহিনী'। মুক্তিযুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে আলবদর বাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করলে এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে 'ইসলামী ছাত্র সংঘ' ১৯৭৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি 'ইসলামী ছাত্রশিবির' নামে আবির্ভূত হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত হয়। ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে দেশের মধ্যে যে জঙ্গিবাদের ভয়ংকর উত্থান ঘটে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে জামায়াত-শিবিরের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির কারণে বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হওয়ায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে সক্ষম হচ্ছে।
মূলত যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় সামনে রেখে জামায়াত-শিবির দেশে বড় ধরনের নাশকতার ছক কেটেছে বলে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। 'নাশকতার ছক আঁকছে জামায়াত ফ্রিডম পার্টি ও হিযবুত তাহরীর : চোরাগুপ্তা হামলার টার্গেট পুলিশ ও র্যাব' (ভোরের কাগজ : ১০/১১/২০১২) সংবাদ থেকে জানা গেছে, বিচার বাধাগ্রস্ত করতে ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ক্যাডাররা চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এতে টার্গেট করা হয়েছে পুলিশ ও র্যাবকে। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জামায়াত-শিবির, ফ্রিডম পার্টি, হিযবুত তাহরীর, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক চক্র ও জঙ্গিরা গোপন আঁতাতের চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা সূত্র মতে, জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ আট কারাবন্দি নেতার বিরুদ্ধে সরকার চূড়ান্ত অ্যাকশন নিলে ঢাকাকে অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে তারা। এ নিয়ে জামায়াতের হাইকমান্ড দফায় দফায় গোপন বৈঠক করেছে। 'মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি', পুরনো সেই স্লোগানকে তারা আবার সামনে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে তাদের মধ্যে চৌকস ও দক্ষ নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক লবিংয়েও তারা হোঁচট খেয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের রায় ঘোষণা করা হতে পারে। ওই বিচার বানচাল করতে তারা সারা দেশে তাদের অবস্থান জানান দিতে চায়। এ ছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্ত করার অজুহাত তুলে তারা রাজপথ দখলের পাঁয়তারা করছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যত কঠিন বাধাই আসুক, সেটাকে অতিক্রম করতে হবে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাদের বক্তব্যেও এ ধরনের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ও ই-মেইলেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সরকারি কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর ও বোমাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতার অভিযোগে সারা দেশে তিন হাজারের বেশি মামলা, ৮৬২টি চার্জশিট, ৯৭৫-এর বেশি তদন্ত চলছে। (যায়যায়দিন, ৬/১০/২০১০) ৫ ও ৬ নভেম্বরের নাশকতা ও হামলার জন্যও মামলা করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে দেশে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে- এ সন্দেহ থেকে তাদের ওপর নজরদারি বেড়েছে। আর সন্দেহের সত্যতা প্রমাণ করেছে তারা। নেতারা রয়েছেন অন্তরালে নাশকতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে। তাঁদের বেশির ভাগ গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করে নির্দেশনা দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা এবং পুলিশকে আক্রান্ত করার জন্য যেমন স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের কাছে ঘৃণ্য, তেমনি ছাত্রশিবিরের আস্তানায় পুলিশের অভিযানের কথা আগেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র; শর্ষের ভেতর ভূত থাকার কথা সত্যে পরিণত হচ্ছে- এ সম্পর্কে আমাদের অঙ্গুলি পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলাও সরকারকেই করতে হবে।
জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারভিত্তিক পলিটিঙ্কে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। কারণ নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার তার আদর্শে দৃঢ় থাকলে দেশের যেকোনো অঞ্চলে, যেকোনো পর্যায়ে কর্মীদের কাজ করতে সুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ কিংবা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমাদের জাতীয় চেতনার পক্ষে যেসব প্রোগ্রাম ফলপ্রসূ হবে সেসবের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কাজে নিয়োজিত হতে হবে। যেহেতু জামায়াত-শিবির গ্রাম-শহর চতুর্দিকে তাদের সমর্থক পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে; সেহেতু তাদের অতীত-বর্তমানের যাবতীয় কুকীর্তি ও অপকর্ম সবিস্তারে তুলে ধরা দরকার। তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সঙ্গে প্রগতিশীল ছাত্রদের সুসম্পর্কের ভিত্তিতে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। অনতিবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের চিহ্নিত করার জন্য ফিল্ম-শো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন পর্যায়ক্রমে পরিচালনা করা প্রয়োজন। জামায়াত-শিবিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবিধান করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। সে জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের নাশকতার বিরুদ্ধে সতর্ক ও কঠোর হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারলে এবং জামায়াত-শিবিরের দলীয় তৎপরতা বন্ধ করা গেলে বিদ্যাচর্চার সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। আমরা জানি, ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্র-শিক্ষকদের প্রাণচাঞ্চল্যের অভাবে স্থবির হয়ে পড়েছিল ক্যাম্পাসগুলো। জোটের কু-শরিক জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আলোকিত কর্মকাণ্ড নিমেষে বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের মূল ইন্ধনদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন একদল প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষক; যাঁরা সংকীর্ণ চেতনার অধিকারী। তাঁদের মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আত্মনিয়োগ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একমাত্র শক্তি। সেই চেতনা লালন, পালন ও বিস্তার দেশপ্রেমিক মানুষের কর্তব্য এবং দায়িত্ব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
এর আগে ২০১১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাকরাইল এবং চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় তাদের হামলায় পুলিশবাহিনীর অনেক সদস্য আহত হয়েছেন। তখনকার ঘটনাবলিও প্রমাণ করে যে স্বাধীনতাবিরোধীরা সে সময় থেকে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা ও কার্যক্রম আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত। ১৯ সেপ্টেম্বর পুলিশের ওপর হামলা চালানোর পর ২৭ সেপ্টেম্বর চার দলের জনসভায় মঞ্চের সামনে স্লোগান দিয়ে শক্তি জানান দেয় তারা। ২০১১-এর ৩০ অক্টোবর একটি জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় এই শিরোনামে 'থেমে নেই কার্যক্রম : গোপনে সক্রিয় হচ্ছে শিবির'। ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের স্কুল-কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে নিজস্ব ও বিভিন্ন সংগঠনের নামে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। ফলে তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঘৃণা তীব্রতর হয়েছে; কিন্তু বিরোধী দল বিএনপি এসব ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু কেন? স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতায় নির্লিপ্ত কেন বিএনপি? দেশের মধ্যে জামায়াত-শিবির যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার বিবরণ কি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে?
জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; তাদের দলীয় নিবন্ধন বাতিলের জন্য অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন মহল দাবি জানিয়ে আসছে। রাজনীতি করতে হলে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য থাকার বিধান থাকলেও তারা তা বর্জন করেই চলেছে। তাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আল্লাহ ছাড়া কারো কর্তৃত্ব মানতে তারা রাজি নয়। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও পুলিশের ওপর হামলার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে যে জামায়াত-ই-তালেবার জন্ম হয় পরবর্তী সময় ১৯৫৫ সালে তা 'ইসলামী ছাত্র সংঘে' রূপ নেয়। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় 'আলবদর বাহিনী'। মুক্তিযুদ্ধে দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে আলবদর বাহিনী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করলে এ ধরনের সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে 'ইসলামী ছাত্র সংঘ' ১৯৭৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি 'ইসলামী ছাত্রশিবির' নামে আবির্ভূত হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বার উন্মুক্ত হয়। ২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় এলে দেশের মধ্যে যে জঙ্গিবাদের ভয়ংকর উত্থান ঘটে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে জামায়াত-শিবিরের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির কারণে বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত হওয়ায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে সক্ষম হচ্ছে।
মূলত যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় সামনে রেখে জামায়াত-শিবির দেশে বড় ধরনের নাশকতার ছক কেটেছে বলে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। 'নাশকতার ছক আঁকছে জামায়াত ফ্রিডম পার্টি ও হিযবুত তাহরীর : চোরাগুপ্তা হামলার টার্গেট পুলিশ ও র্যাব' (ভোরের কাগজ : ১০/১১/২০১২) সংবাদ থেকে জানা গেছে, বিচার বাধাগ্রস্ত করতে ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ক্যাডাররা চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এতে টার্গেট করা হয়েছে পুলিশ ও র্যাবকে। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জামায়াত-শিবির, ফ্রিডম পার্টি, হিযবুত তাহরীর, বঙ্গবন্ধুর ঘাতক চক্র ও জঙ্গিরা গোপন আঁতাতের চেষ্টা করছে। গোয়েন্দা সূত্র মতে, জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ আট কারাবন্দি নেতার বিরুদ্ধে সরকার চূড়ান্ত অ্যাকশন নিলে ঢাকাকে অচল করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে তারা। এ নিয়ে জামায়াতের হাইকমান্ড দফায় দফায় গোপন বৈঠক করেছে। 'মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি', পুরনো সেই স্লোগানকে তারা আবার সামনে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে তাদের মধ্যে চৌকস ও দক্ষ নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক লবিংয়েও তারা হোঁচট খেয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিচারের রায় ঘোষণা করা হতে পারে। ওই বিচার বানচাল করতে তারা সারা দেশে তাদের অবস্থান জানান দিতে চায়। এ ছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্ত করার অজুহাত তুলে তারা রাজপথ দখলের পাঁয়তারা করছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যত কঠিন বাধাই আসুক, সেটাকে অতিক্রম করতে হবে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতাদের বক্তব্যেও এ ধরনের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার ও ই-মেইলেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
তবে আশার কথা, বর্তমান সরকার যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সরকারি কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর ও বোমাবাজিসহ বিভিন্ন নাশকতার অভিযোগে সারা দেশে তিন হাজারের বেশি মামলা, ৮৬২টি চার্জশিট, ৯৭৫-এর বেশি তদন্ত চলছে। (যায়যায়দিন, ৬/১০/২০১০) ৫ ও ৬ নভেম্বরের নাশকতা ও হামলার জন্যও মামলা করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে দেশে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে- এ সন্দেহ থেকে তাদের ওপর নজরদারি বেড়েছে। আর সন্দেহের সত্যতা প্রমাণ করেছে তারা। নেতারা রয়েছেন অন্তরালে নাশকতার পরিকল্পনাকারী হিসেবে। তাঁদের বেশির ভাগ গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করে নির্দেশনা দিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা এবং পুলিশকে আক্রান্ত করার জন্য যেমন স্বাধীনতাবিরোধীরা আমাদের কাছে ঘৃণ্য, তেমনি ছাত্রশিবিরের আস্তানায় পুলিশের অভিযানের কথা আগেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র; শর্ষের ভেতর ভূত থাকার কথা সত্যে পরিণত হচ্ছে- এ সম্পর্কে আমাদের অঙ্গুলি পুলিশ কর্মকর্তাদের দিকে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলাও সরকারকেই করতে হবে।
জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারভিত্তিক পলিটিঙ্কে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। কারণ নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার তার আদর্শে দৃঢ় থাকলে দেশের যেকোনো অঞ্চলে, যেকোনো পর্যায়ে কর্মীদের কাজ করতে সুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ কিংবা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমাদের জাতীয় চেতনার পক্ষে যেসব প্রোগ্রাম ফলপ্রসূ হবে সেসবের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার কাজে নিয়োজিত হতে হবে। যেহেতু জামায়াত-শিবির গ্রাম-শহর চতুর্দিকে তাদের সমর্থক পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে; সেহেতু তাদের অতীত-বর্তমানের যাবতীয় কুকীর্তি ও অপকর্ম সবিস্তারে তুলে ধরা দরকার। তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সঙ্গে প্রগতিশীল ছাত্রদের সুসম্পর্কের ভিত্তিতে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। অনতিবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের চিহ্নিত করার জন্য ফিল্ম-শো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন পর্যায়ক্রমে পরিচালনা করা প্রয়োজন। জামায়াত-শিবিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবিধান করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর থাকতে হবে। সে জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের নাশকতার বিরুদ্ধে সতর্ক ও কঠোর হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারলে এবং জামায়াত-শিবিরের দলীয় তৎপরতা বন্ধ করা গেলে বিদ্যাচর্চার সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। আমরা জানি, ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্র-শিক্ষকদের প্রাণচাঞ্চল্যের অভাবে স্থবির হয়ে পড়েছিল ক্যাম্পাসগুলো। জোটের কু-শরিক জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আলোকিত কর্মকাণ্ড নিমেষে বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের মূল ইন্ধনদাতা হিসেবে আবির্ভূত হন একদল প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষক; যাঁরা সংকীর্ণ চেতনার অধিকারী। তাঁদের মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আত্মনিয়োগ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা রোধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একমাত্র শক্তি। সেই চেতনা লালন, পালন ও বিস্তার দেশপ্রেমিক মানুষের কর্তব্য এবং দায়িত্ব।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
writermiltonbiswas@gmail.com
No comments