সময়ের প্রতিধ্বনি-সংকটে রাজনীতি এবং সক্রিয় দেশি-বিদেশি গোয়েন্দারা by মোস্তফা কামাল
রাজনীতি নিয়ে খোদ রাজনীতিকরাই শঙ্কিত। রাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে, তা কেউ বলতে পারছেন না। সবাই যেন অন্ধকারে আছেন। কেউ বলছেন, আবার ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। কেউ কেউ জরুরি অবস্থা জারির কথাও বলছেন। আসলে দেশের রাজনীতি কী রূপ নিতে যাচ্ছে?
প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য যদি সত্য হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে ঘোলাটে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি গত রবিবার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, যেকোনো মুহূর্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হতে পারে। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেও তাঁর বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। একটি রাজনৈতিক দলের নাশকতার চেষ্টা এবং দেশি ও বিদেশি গোয়েন্দাদের অতিমাত্রার তৎপরতা দেখে শঙ্কা জাগতেই পারে।
তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ আরো উত্তপ্ত করে তুলেছেন। বেগম জিয়া শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, 'এই প্রধানমন্ত্রী অবৈধ, তিনি প্যারোলে শপথ নিয়েছেন।' বেগম জিয়া এও বলেছেন, 'সরকার জামায়াতকে টানার চেষ্টা করছে।' এর জবাবে শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে বলেছেন, 'তিনি সর্প হয়ে দংশন করেন, ওঝা হয়ে ঝাড়েন।'
তাঁদের বক্তব্যের পর উভয় দলের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। নেতারা তো শুধু নেত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলা শুরু করলেই অন্যরা কোরাস গাইতে শুরু করেন। এ এক উদ্ভট দেশ! শুধু নেত্রীকে খুশি করার রাজনীতি এখানে খুব বেশি দেখা যায়। নবীনরা তো বটেই, প্রবীণ নেতারাও নেত্রীকে খুশি করতে ব্যস্ত। কার বিরুদ্ধে কী বললে নেত্রী খুশি হবেন, তা তাঁরা জানেন; সে অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ফলে রাজনীতিতে যে সমঝোতার কথা আমরা বলি, তা এখন দূর অস্ত। এক পক্ষ যেকোনো মূল্যে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। আরেক পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ব্যাপক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। দেশের সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম চাইলেও দুই নেত্রী সমঝোতার পথে নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এরই প্রেক্ষাপটে জামায়াত দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা নাশকতা সৃষ্টি করে দেশে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে বলে গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতাকে গ্রেপ্তারের টার্গেট করেছে। অভিযোগ আছে, জামায়াতকে পেছন থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আইএসআই গোয়েন্দাদের নিয়মিতই যোগাযোগ, বৈঠক হচ্ছে। আইএসআইয়ের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী জামায়াতের নাশকতা সৃষ্টিকারী দলগুলো রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আঁচ পেয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। গত সোমবার রাতে জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ারকে একটি বিশেষ দূতাবাসের কাছ থেকে আটক করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই দূতাবাসে একাধিক গোয়েন্দার সঙ্গে তিনি বৈঠক করছিলেন। দূতাবাস থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওত পেতে থাকা গোয়েন্দারা তাঁকে আটক করে।
সংকটাপন্ন রাজনীতির মাঠে শুধু আইএসআই নয়, বিদেশি বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এখন বেশ সক্রিয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও সজাগ দৃষ্টি রেখেছে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। বিদেশি কূটনীতিকরা সময়-সময় রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন। কখনো কখনো নিজেরাও বৈঠকে বসছেন তাঁদের করণীয় ঠিক করার জন্য। এর মধ্যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই' ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' নানা কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। রাজনীতিকদের নিয়ে তারা বেশ খেলাধুলা করছে।
একদিকে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির চক্রান্ত, অন্যদিকে রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পাশাপাশি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাজনীতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে। তবে এটা ঠিক যে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পরই দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
বিএনপি-জামায়াত দীর্ঘদিনের গাঁটছড়া ভাব কাটতে শুরু করেছে। এখন উভয় পক্ষই পরস্পরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। যেকোনো সময় বিএনপি-জামায়াত আলাদা হয়ে যেতে পারে এবং তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি আগের নিবন্ধেও লিখেছিলাম, বেগম জিয়ার ভারত সফরের পর জামায়াতকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বিএনপি। জামায়াতকে পরিত্যাগ করে একটি মডারেট দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারলে ভোটারদের একটা বড় অংশ বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেবে। বলাবাহুল্য, ভোটের রাজনীতিতে মডারেট অংশটিই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে।
যদিও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা ভিন্ন কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁরা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে বের করার কৌশল নিয়েছেন। ভোটের হিসাবে বিএনপি-জামায়াত জোট একসঙ্গে থাকলে জয়ের সম্ভাবনা থাকে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই তাঁরা জামায়াতকে আলাদা করতে চাইছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ভোটাররা যে জামায়াতকে পছন্দ করছে না সেটা তাঁদের মাথায় নেই।
জামায়াতও অবশ্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে একক নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ক্ষমতাসীনরা মনে করছে। সরকারের ভাবনা হচ্ছে, জামায়াতকে চাপে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে তাদের বের করে আনা। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের মতো হুমকিও রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট হয়তো হবে না। তবে এক ধরনের সমঝোতা হতে পারে। সেই সমঝোতার অংশ হিসেবেই বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করার কথা ভাবছে জামায়াত। আর এতে বিএনপির মডারেট অংশটি বেশ খুশি। তারা ভাবছে, জামায়াত বের হয়ে গেলে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তা হলে তারা আবার বিএনপিকে আগের মতো মডারেট দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। দেশের জনগণের একটা বড় অংশও সেটাই চাইছে। তবে বিএনপির কট্টরপন্থী অংশটি জামায়াতকে কিছুতেই আলাদা করতে রাজি নয়। তারা বলছে, ভোটের হিসাবে জোটের কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে জামায়াতই তাদের একমাত্র 'বিশ্বস্ত বন্ধু'।
জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির মধ্যে বিভাজনটা এখন বেশ স্পষ্ট। উভয় পক্ষই যার যার মতো করে বেগম জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। বিএনপির ভারতনীতি নিয়েও দুই পক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বেগম জিয়ার হাতে। তিনি কি বিএনপিকে আবার সেই মডারেট একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন, নাকি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ডানপন্থীদের প্রভাববলয়ে থাকবেন; সে সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, দেশি-বিদেশি কিছু গোয়েন্দা সংস্থা সরকার ও বিরোধী দলকে ফাঁদে ফেলে নতুন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছে। তার আদল কী হবে, কিভাবে সেই সরকার পরিচালিত হবে, সিভিল প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে, গণমাধ্যমের সমর্থন থাকবে কি না- এসব নিয়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংস্কারপন্থী নেতাদের ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।
সবকিছুই নির্ভর করছে দুই নেত্রীর ওপর। তাঁরা যদি সমঝোতায় পৌঁছতে পারেন তাহলে হয়তো গণতন্ত্র রক্ষা হবে এবং তৃতীয় কোনো শক্তির ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে। দুই নেত্রীকে অবশ্যই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা ফর্মুলা বের করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনের জন্য 'লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি করা দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। সমঝোতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। দুই নেত্রীর নিশ্চয়ই বোধোদয় হবে এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে তাঁরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন বলে আমাদের আশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ আরো উত্তপ্ত করে তুলেছেন। বেগম জিয়া শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, 'এই প্রধানমন্ত্রী অবৈধ, তিনি প্যারোলে শপথ নিয়েছেন।' বেগম জিয়া এও বলেছেন, 'সরকার জামায়াতকে টানার চেষ্টা করছে।' এর জবাবে শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে বলেছেন, 'তিনি সর্প হয়ে দংশন করেন, ওঝা হয়ে ঝাড়েন।'
তাঁদের বক্তব্যের পর উভয় দলের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। নেতারা তো শুধু নেত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলা শুরু করলেই অন্যরা কোরাস গাইতে শুরু করেন। এ এক উদ্ভট দেশ! শুধু নেত্রীকে খুশি করার রাজনীতি এখানে খুব বেশি দেখা যায়। নবীনরা তো বটেই, প্রবীণ নেতারাও নেত্রীকে খুশি করতে ব্যস্ত। কার বিরুদ্ধে কী বললে নেত্রী খুশি হবেন, তা তাঁরা জানেন; সে অনুযায়ী তাঁরা তাঁদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ফলে রাজনীতিতে যে সমঝোতার কথা আমরা বলি, তা এখন দূর অস্ত। এক পক্ষ যেকোনো মূল্যে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। আরেক পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য ব্যাপক আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। দেশের সাধারণ মানুষ, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম চাইলেও দুই নেত্রী সমঝোতার পথে নেই বলেই মনে হচ্ছে।
এরই প্রেক্ষাপটে জামায়াত দেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা নাশকতা সৃষ্টি করে দেশে একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইছে বলে গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতাকে গ্রেপ্তারের টার্গেট করেছে। অভিযোগ আছে, জামায়াতকে পেছন থেকে ইন্ধন জোগাচ্ছে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আইএসআই গোয়েন্দাদের নিয়মিতই যোগাযোগ, বৈঠক হচ্ছে। আইএসআইয়ের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী জামায়াতের নাশকতা সৃষ্টিকারী দলগুলো রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আঁচ পেয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। গত সোমবার রাতে জামায়াত নেতা গোলাম পরওয়ারকে একটি বিশেষ দূতাবাসের কাছ থেকে আটক করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই দূতাবাসে একাধিক গোয়েন্দার সঙ্গে তিনি বৈঠক করছিলেন। দূতাবাস থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওত পেতে থাকা গোয়েন্দারা তাঁকে আটক করে।
সংকটাপন্ন রাজনীতির মাঠে শুধু আইএসআই নয়, বিদেশি বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা এখন বেশ সক্রিয় রয়েছে। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও সজাগ দৃষ্টি রেখেছে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। বিদেশি কূটনীতিকরা সময়-সময় রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন। কখনো কখনো নিজেরাও বৈঠকে বসছেন তাঁদের করণীয় ঠিক করার জন্য। এর মধ্যে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা 'আইএসআই' ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা 'র' নানা কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। রাজনীতিকদের নিয়ে তারা বেশ খেলাধুলা করছে।
একদিকে আরেকটি ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টির চক্রান্ত, অন্যদিকে রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পাশাপাশি প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাজনীতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে। তবে এটা ঠিক যে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পরই দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে যেতে শুরু করেছে।
বিএনপি-জামায়াত দীর্ঘদিনের গাঁটছড়া ভাব কাটতে শুরু করেছে। এখন উভয় পক্ষই পরস্পরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। যেকোনো সময় বিএনপি-জামায়াত আলাদা হয়ে যেতে পারে এবং তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আমি আগের নিবন্ধেও লিখেছিলাম, বেগম জিয়ার ভারত সফরের পর জামায়াতকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বিএনপি। জামায়াতকে পরিত্যাগ করে একটি মডারেট দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারলে ভোটারদের একটা বড় অংশ বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেবে। বলাবাহুল্য, ভোটের রাজনীতিতে মডারেট অংশটিই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে।
যদিও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা ভিন্ন কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁরা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে বের করার কৌশল নিয়েছেন। ভোটের হিসাবে বিএনপি-জামায়াত জোট একসঙ্গে থাকলে জয়ের সম্ভাবনা থাকে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি অবিশ্বাস থেকেই তাঁরা জামায়াতকে আলাদা করতে চাইছেন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের ভোটাররা যে জামায়াতকে পছন্দ করছে না সেটা তাঁদের মাথায় নেই।
জামায়াতও অবশ্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে একক নির্বাচন করার পরিকল্পনা করছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ক্ষমতাসীনরা মনে করছে। সরকারের ভাবনা হচ্ছে, জামায়াতকে চাপে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে তাদের বের করে আনা। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের মতো হুমকিও রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট হয়তো হবে না। তবে এক ধরনের সমঝোতা হতে পারে। সেই সমঝোতার অংশ হিসেবেই বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করার কথা ভাবছে জামায়াত। আর এতে বিএনপির মডারেট অংশটি বেশ খুশি। তারা ভাবছে, জামায়াত বের হয়ে গেলে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তা হলে তারা আবার বিএনপিকে আগের মতো মডারেট দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। দেশের জনগণের একটা বড় অংশও সেটাই চাইছে। তবে বিএনপির কট্টরপন্থী অংশটি জামায়াতকে কিছুতেই আলাদা করতে রাজি নয়। তারা বলছে, ভোটের হিসাবে জোটের কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে জামায়াতই তাদের একমাত্র 'বিশ্বস্ত বন্ধু'।
জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির মধ্যে বিভাজনটা এখন বেশ স্পষ্ট। উভয় পক্ষই যার যার মতো করে বেগম জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। বিএনপির ভারতনীতি নিয়েও দুই পক্ষ পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বেগম জিয়ার হাতে। তিনি কি বিএনপিকে আবার সেই মডারেট একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন, নাকি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ডানপন্থীদের প্রভাববলয়ে থাকবেন; সে সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, দেশি-বিদেশি কিছু গোয়েন্দা সংস্থা সরকার ও বিরোধী দলকে ফাঁদে ফেলে নতুন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছে। তার আদল কী হবে, কিভাবে সেই সরকার পরিচালিত হবে, সিভিল প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে, গণমাধ্যমের সমর্থন থাকবে কি না- এসব নিয়ে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংস্কারপন্থী নেতাদের ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।
সবকিছুই নির্ভর করছে দুই নেত্রীর ওপর। তাঁরা যদি সমঝোতায় পৌঁছতে পারেন তাহলে হয়তো গণতন্ত্র রক্ষা হবে এবং তৃতীয় কোনো শক্তির ক্ষমতায় আসা কঠিন হবে। দুই নেত্রীকে অবশ্যই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা ফর্মুলা বের করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। নির্বাচনের জন্য 'লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি করা দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকারের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকেই এগিয়ে আসতে হবে। সমঝোতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। দুই নেত্রীর নিশ্চয়ই বোধোদয় হবে এবং বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে তাঁরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন বলে আমাদের আশা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments