সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-'জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা' by আবু সাঈদ খান
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ছোবলে যখন রামু-উখিয়া-পটিয়ার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হৃদয় বিদীর্ণ, তখন কিছু বর্ণাশ্রয়ী লোকের অমানবিক আচরণে জয়পুরহাটের আদিবাসী নর-নারীরা ক্ষোভে-অপমানে বিহ্বল। যারা আদিবাসীদের প্রতি বর্ণবাদী ও ঘৃণ্য আচরণ করেছে, তারা শিক্ষার আলোবঞ্চিত বা বখাটে শ্রেণীভুক্ত নন_ বরং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, ডিগ্রিধারী ব্যক্তি_ ওকালতির মতো জনগুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পেশায় নিয়োজিত।
গত ৬ অক্টোবর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের খবর এবং ৫ নভেম্বর সমকালে মানিক সরণের লেখায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী_ ৪ অক্টোবর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতৃত্বে কয়েকশ' আদিবাসী জনতা জয়পুরহাট শহরে তাদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন গঠন ও ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে মিছিল করে ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে যায়। দশ মাইল দূর থেকে হেঁটে আসা ২৫০ জন আদিবাসীর জন্য আইনজীবী সমিতির ক্যান্টিনে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তারা খাবারের প্যাকেট নিয়ে ক্যান্টিনের বাইরে আহার করে এবং ক্যান্টিনের গ্গ্নাসেই পানি পান করে। এ কথা শুনে তেড়ে আসেন আইনজীবী সমিতির কয়েকজন কর্মকর্তা ও সদস্য। আদিবাসীদের গ্গ্নাস ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য তারা ক্যান্টিন ম্যানেজারকে ধমকাতে থাকেন। বলেন, এ গ্গ্নাসগুলো অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। তারা এ গ্গ্নাসে আর পানি খাবেন না। এ পরিস্থিতিতে ক্যান্টিন ম্যানেজার আদিবাসী নেতা বাবুল রবিদাসকে তাদের ব্যবহৃত ২৬টি গ্গ্নাস কিনে নিতে বাধ্য করেন। বাবুল রবিদাস নিজেও উকিল এবং ওই আইনজীবী সমিতির সদস্য। ইতিপূর্বে বার সমিতির এই ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে তাকেও নাজেহাল হতে হয়েছে।
ঘটনাটির প্রতিবাদে ১৫ অক্টোবর জয়পুরহাটে মানববন্ধন হয়েছে। এতে আদিবাসী ও বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা যোগ দেন। অনুষ্ঠানে গণঐক্য নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ অনেকেই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। শুনেছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়ে জয়পুরহাট বার সমিতির সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
ভাবতে লজ্জা হয়, ন্যায়ের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত পেশার লোকেরা কী করে এমন বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় দিতে পারে? আরেকটি ঘটনা আমাদের লজ্জা বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ। ডেইলি স্টার ছাড়া অন্য কোনো কাগজে খবরটি চোখে পড়েনি। তবে কি স্থানীয় রিপোর্টাররা সংবাদটি পাঠাননি, নাকি সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট ডেস্ক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি? খবর নিয়ে জেনেছি, বার সমিতির প্রভাবশালী সদস্যদের অনুরোধে স্থানীয় রিপোর্টারদের দু'একজন ছাড়া প্রায় সবাই ঘটনাটি এবং এর প্রতিবাদে মানববন্ধনের সংবাদটিও উপেক্ষা করেছেন। সতীর্থ সাংবাদিক বন্ধুদের এ ভূমিকায় আমি কেবল তাদেরই ধিক্কার জানাব না, মনে হচ্ছে, সংবাদকর্মী হিসেবে ধিক্কার আমারও প্রাপ্য।
আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের দৃষ্টান্ত আরও রয়েছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারোকণায় একটি বাজারে স্থানীয় সাঁওতালদের একই রেস্তোরাঁয় খাওয়া নিয়ে একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। পরে আদিবাসী এক যুবক বাজারে একটি রেস্তোরাঁ দেয়। সেখানেই চলছে আদিবাসীদের চা-নাশতা খাওয়া-আড্ডা। এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের পৃথক করে রাখছে_ যা আমাদের জাতীয় সংহতির জন্য বড় বাধা।
রাজশাহী জেলার তানোর বাজারের রেস্তোরাঁ মালিকরা দুই ধরনের প্লেট-কাপ-পিরিচের ব্যবস্থা করেছে। এক সম্প্রদায়েরটা অন্য সম্প্রদায়কে দেওয়া হয় না। সিটি করপোরেশনের সুইপার (পরিচ্ছন্নতা কর্মী), যাদের মহাত্মা গান্ধী 'হরিজন' অর্থাৎ ঈশ্বরের পুত্র বলে সম্বোধন করে মর্যাদাবান করতে চেয়েছিলেন, তাদের কোনো কোনো শহরের রেস্তোরাঁয় আলাদা প্লেট ও কাপ নিয়ে ঢুকতে হয়। সেই প্লেটে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভাত-তরকারি কিংবা কাপে চা দেওয়া হয়। ওরা রেস্তোরাঁর বাইরে এসে খাবার খায়। কোথাও কোথাও সুইপারদের সেলুনে প্রবেশেও নিষেধ রয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের ঘটনা। আমি তখন ফরিদপুরে। আমরা কয়েক বন্ধু রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিচ্ছিলাম। দেখি, বেশ পরিপাটি চেহারার এক সুইপার যুবক নিজের আনা কাপে চা নিচ্ছে। ওকে টেনে এনে আমাদের পাশে বসিয়ে রেস্তোরাঁর কাপে চা খাওয়ালাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা রেস্তোরাঁগুলোতে সুইপারদের প্রবেশাধিকারের জন্য ক্যাম্পেইন শুরু করি। বেশ কাজও হয় এতে। তবে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা খানিকটা হীনমন্যতায় ভুগত। খবর নিয়ে জানলাম, ফরিদপুরে এখন আর রেস্তোরাঁগুলোতে জাতপাত বিচার
তেমনটা নেই।
স্বাধীনতার আগেও ফরিদপুরে কমিউনিস্ট কর্মী মোখলেছুর রহমান, মনোয়ার হোসেন সুইপার কলোনিতে গিয়ে নিয়মিত মোটিভিশন ক্লাস নিতেন এবং লেখাপড়াও শেখাতেন। সেই ধারাবাহিকতায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত সমকালের ব্যুরো প্রধান গৌতম দাস ও তার বন্ধুরা হরিজন ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন। শুধু তাই নয়, গৌতম সুইপার কলোনির মেয়ে দীপালিকে বিয়ে করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
আমাদের চোখের আড়ালে আদিবাসী-সুইপার-চর্মকাররা কতভাবে যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, তার কতটুকুই-বা আমরা খবর রাখি? সুইপারদের মধ্যে কাজ করেন_ এমন এক এনজিও কর্মীর কাছে শুনেছি, রাজধানীর উপকণ্ঠে গাবতলী এলাকায় একটি স্কুলের ঘটনা। ছেলেরা স্কুলে এসে দেখে বারান্দায় কেউ মল ত্যাগ করেছে। তখন তাদের সহপাঠী সুইপার পল্লীর এক ছেলেকে বলা হয়_ তুই পরিষ্কার কর, এটি তো তোদের কাজ। ছেলেটি তার এই অপমানের কথা শিক্ষকদের জানালে তারা এ নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। অপমানিত হয়ে ছেলেটি তারপর থেকে আর স্কুলে আসে না। এভাবেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের বর্ণাশ্রয়ী মানসিকতা।
আমরা যারা বর্ণাশ্রয়ী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি, তারা কারা? ইতিহাস বলে, এ অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় মানুষ বর্ণবাদের নির্মম শিকার হয়ে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান পেতেই একদা জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস বাণী গ্রহণ করেছিল। পরে ধর্ম প্রচারক সুফিদের উদার ও সাম্যবাদী নীতির কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আজ যদি কোনো টাইম মেশিনের সাহায্যে বড়জোর আট-নয়শ' বছর আগে ফিরে যাওয়া যেত, তবে হয়তো দেখতে পেতাম জয়পুরহাটের উকিল সাহেবদের, গাবতলীর শিক্ষকদের কিংবা আমাদের অনেকেরই পূর্বপ্রজন্ম বর্ণবাদের শিকার হয়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন।
ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের সূচনাপর্বেও হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পানাহারে বাছবিচার ছিল। তখন হিন্দু বাড়িতে মুসলমানের এবং মুসলিম বাড়িতে হিন্দুদের পানাহার চলত না। এমনকি শূদ্রের বাড়িতেও বর্ণহিন্দুদের খাওয়া-দাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। হিসাব মেলানো হতো, কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে কাদের জলচল আছে কিংবা কোনটার মধ্যে নেই। কথিত আছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ এক যুদ্ধের সময় কর্মকারদের অস্ত্র তৈরিতে সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, কী পুরস্কার চাও। কর্মকাররা বিনীতভাবে বলেছিল, জাঁহাপনা, সোনাদানা, মোহর, জমিজমা কিছুই চাই না। শুধু আমাদের জলচলের হুকুম জারি করে দিন। তাদের অনুরোধে নবাব ফরমান জারি করলেন, এখন থেকে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে কর্মকারের জলচল চালু হলো। কোনো বর্ণহিন্দু কামারের বাড়িতে খেতে আপত্তি করতে পারবে না। এরপর থেকে বর্ণহিন্দুরা কামারদের হাতের খাবার খেতে আপত্তি করে না।
পঞ্চাশের দশকেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একই হুঁকায় তামাক সেবন কিংবা একই গ্গ্নাসে পানি পান চলত না। নজরুলের কবিতায় তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই_ 'হুঁকার জল আর ভাতের হাঁড়ি/করলি এতেই জাতবিচার/ জাত সে শিকেয় তোলা রবে/কর্ম নিয়ে বিচার হবে'।
শুধু নজরুল নন, শৈশবে এক লোককবির গান শুনেছি। গানটি মনে করতে পারছি না। কিন্তু সেটির মর্মবাণী হচ্ছে_ মুসলমান, তুমি হিন্দু বাড়িতে খাও না, কিন্তু হিন্দু ময়রার মিষ্টি ছাড়া মিলাদ করতে পার না, আর হিন্দু তুমি মুসলমানদের খাবার স্পর্শ করো না, কিন্তু মুসলমান গেরস্তের পালা গাভীর দুধ ছাড়া তুমি পূজায় ভোগ দিতে পার না, এই তো তোমাদের শুচিতার বড়াই। বাউল-লোকশিল্পীরা বরাবরই জাতপাতের ঊধর্ে্বর মানুষ। পাকিস্তান আমলে মেজবানিতে কলাপাতায় খাওয়া হতো। হিন্দুরা কলাপাতার এক পিঠে এবং মুসলমানরা অন্য পিঠে খেত। এক বাউল আমাদের বাড়িতে এসে পাতা ঘুরিয়ে হিন্দুরীতি অনুসারে কলাপাতায় খাওয়া শুরু করলেন। বললেন, হিন্দু বাড়িতে গেলে তোমরা যে পিঠে খাও, সেই পিঠে রেখে খাবার খাব। এটা ছিল তার প্রতিবাদ।
শৈশবে দেখেছি_ বাবার হিন্দু বন্ধু ও তার ছাত্রসহ অনেকে গোপনে আমাদের বাড়িতে এসে মুরগি খেয়ে জাতের পিণ্ডি চটকাতেন। তখনও হিন্দু বাড়িতে মুরগি আর ডিম নিষিদ্ধ ছিল। লোকে বলাবলি করত, রশীদ মাস্টারও (আমার বাবা) নাকি হিন্দু বাড়িতে গিয়ে খানাপিনা করেন। '৬৪-৬৫ সালের ঘটনা। আমি যখন শহরতলির গ্রাম কোমরপুরে পড়ি, তখন দেখি সেখানে খাওয়া-দাওয়ায় বাছবিচার নেই। তখন থেকে বন্ধুরা মিলে প্রকাশ্যে হিন্দু বাড়িতে খেতাম এবং হিন্দু বন্ধুরাও আমাদের বাড়িতে এসে খেত। এটি নিয়ে এলাকার মোল্লারা কথা উঠিয়েছিল, কিন্তু তখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে তাদের কিছু করার থাকল না।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে মানবিক জাগৃতি ঘটে, তা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মুছে যেতে থাকে জাতপাতের বিভাজন।
বর্ণবাদ এখানকার সমাজের অতীত চিত্র_ যার শাস্ত্রীয় রূপও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, ঈশ্বরের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, হাত থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্র বা কর্মজীবীদের জন্ম। আসলে কর্মজীবীরাই সভ্যতার কারিগর। এ বিভাজনরেখা ঘোচাতেই নতুন করে ধর্মীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় মানুষ জেগেছে। ভিক্ষু-সুফি-বৈষ্ণবদের চেষ্টায় উদার মানবিক জমিন গড়ে উঠেছে। চণ্ডীদাস-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু করে রাধারমণ-জালাল খাঁ-শাহ আবদুল করিমসহ শত শত মানবতাবাদী দার্শনিক-শিল্পী মুঠো মুঠো আলো ছড়িয়ে অন্ধকার খানিকটা দূর করেছেন। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিক্ষার প্রসার ঘটছে, বিস্তৃত হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা। তারপরও সমাজদেহ থেকে সব কালিমা দূর হয়নি, তবে তা কেন এই সময়েও কোনো আধুনিক শিক্ষিত মানুষকে স্পর্শ করবে?
লালনের গানের কথায় আসতে চাই_ 'জাত গেল, জাত গেল/ বলে একি আজব কারখানা।/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তা না না না...।'
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
ঘটনাটির প্রতিবাদে ১৫ অক্টোবর জয়পুরহাটে মানববন্ধন হয়েছে। এতে আদিবাসী ও বাম সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা যোগ দেন। অনুষ্ঠানে গণঐক্য নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্যসহ অনেকেই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। শুনেছি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়ে জয়পুরহাট বার সমিতির সাধারণ সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
ভাবতে লজ্জা হয়, ন্যায়ের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত পেশার লোকেরা কী করে এমন বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় দিতে পারে? আরেকটি ঘটনা আমাদের লজ্জা বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ। ডেইলি স্টার ছাড়া অন্য কোনো কাগজে খবরটি চোখে পড়েনি। তবে কি স্থানীয় রিপোর্টাররা সংবাদটি পাঠাননি, নাকি সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট ডেস্ক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি? খবর নিয়ে জেনেছি, বার সমিতির প্রভাবশালী সদস্যদের অনুরোধে স্থানীয় রিপোর্টারদের দু'একজন ছাড়া প্রায় সবাই ঘটনাটি এবং এর প্রতিবাদে মানববন্ধনের সংবাদটিও উপেক্ষা করেছেন। সতীর্থ সাংবাদিক বন্ধুদের এ ভূমিকায় আমি কেবল তাদেরই ধিক্কার জানাব না, মনে হচ্ছে, সংবাদকর্মী হিসেবে ধিক্কার আমারও প্রাপ্য।
আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের দৃষ্টান্ত আরও রয়েছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারোকণায় একটি বাজারে স্থানীয় সাঁওতালদের একই রেস্তোরাঁয় খাওয়া নিয়ে একাধিক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। পরে আদিবাসী এক যুবক বাজারে একটি রেস্তোরাঁ দেয়। সেখানেই চলছে আদিবাসীদের চা-নাশতা খাওয়া-আড্ডা। এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী আদিবাসীদের পৃথক করে রাখছে_ যা আমাদের জাতীয় সংহতির জন্য বড় বাধা।
রাজশাহী জেলার তানোর বাজারের রেস্তোরাঁ মালিকরা দুই ধরনের প্লেট-কাপ-পিরিচের ব্যবস্থা করেছে। এক সম্প্রদায়েরটা অন্য সম্প্রদায়কে দেওয়া হয় না। সিটি করপোরেশনের সুইপার (পরিচ্ছন্নতা কর্মী), যাদের মহাত্মা গান্ধী 'হরিজন' অর্থাৎ ঈশ্বরের পুত্র বলে সম্বোধন করে মর্যাদাবান করতে চেয়েছিলেন, তাদের কোনো কোনো শহরের রেস্তোরাঁয় আলাদা প্লেট ও কাপ নিয়ে ঢুকতে হয়। সেই প্লেটে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ভাত-তরকারি কিংবা কাপে চা দেওয়া হয়। ওরা রেস্তোরাঁর বাইরে এসে খাবার খায়। কোথাও কোথাও সুইপারদের সেলুনে প্রবেশেও নিষেধ রয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের ঘটনা। আমি তখন ফরিদপুরে। আমরা কয়েক বন্ধু রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিচ্ছিলাম। দেখি, বেশ পরিপাটি চেহারার এক সুইপার যুবক নিজের আনা কাপে চা নিচ্ছে। ওকে টেনে এনে আমাদের পাশে বসিয়ে রেস্তোরাঁর কাপে চা খাওয়ালাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা রেস্তোরাঁগুলোতে সুইপারদের প্রবেশাধিকারের জন্য ক্যাম্পেইন শুরু করি। বেশ কাজও হয় এতে। তবে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা খানিকটা হীনমন্যতায় ভুগত। খবর নিয়ে জানলাম, ফরিদপুরে এখন আর রেস্তোরাঁগুলোতে জাতপাত বিচার
তেমনটা নেই।
স্বাধীনতার আগেও ফরিদপুরে কমিউনিস্ট কর্মী মোখলেছুর রহমান, মনোয়ার হোসেন সুইপার কলোনিতে গিয়ে নিয়মিত মোটিভিশন ক্লাস নিতেন এবং লেখাপড়াও শেখাতেন। সেই ধারাবাহিকতায় দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত সমকালের ব্যুরো প্রধান গৌতম দাস ও তার বন্ধুরা হরিজন ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন। শুধু তাই নয়, গৌতম সুইপার কলোনির মেয়ে দীপালিকে বিয়ে করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
আমাদের চোখের আড়ালে আদিবাসী-সুইপার-চর্মকাররা কতভাবে যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে, তার কতটুকুই-বা আমরা খবর রাখি? সুইপারদের মধ্যে কাজ করেন_ এমন এক এনজিও কর্মীর কাছে শুনেছি, রাজধানীর উপকণ্ঠে গাবতলী এলাকায় একটি স্কুলের ঘটনা। ছেলেরা স্কুলে এসে দেখে বারান্দায় কেউ মল ত্যাগ করেছে। তখন তাদের সহপাঠী সুইপার পল্লীর এক ছেলেকে বলা হয়_ তুই পরিষ্কার কর, এটি তো তোদের কাজ। ছেলেটি তার এই অপমানের কথা শিক্ষকদের জানালে তারা এ নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। অপমানিত হয়ে ছেলেটি তারপর থেকে আর স্কুলে আসে না। এভাবেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের বর্ণাশ্রয়ী মানসিকতা।
আমরা যারা বর্ণাশ্রয়ী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছি, তারা কারা? ইতিহাস বলে, এ অঞ্চলের নিম্নবর্গীয় মানুষ বর্ণবাদের নির্মম শিকার হয়ে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান পেতেই একদা জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের অহিংস বাণী গ্রহণ করেছিল। পরে ধর্ম প্রচারক সুফিদের উদার ও সাম্যবাদী নীতির কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আজ যদি কোনো টাইম মেশিনের সাহায্যে বড়জোর আট-নয়শ' বছর আগে ফিরে যাওয়া যেত, তবে হয়তো দেখতে পেতাম জয়পুরহাটের উকিল সাহেবদের, গাবতলীর শিক্ষকদের কিংবা আমাদের অনেকেরই পূর্বপ্রজন্ম বর্ণবাদের শিকার হয়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন।
ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের সূচনাপর্বেও হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে পানাহারে বাছবিচার ছিল। তখন হিন্দু বাড়িতে মুসলমানের এবং মুসলিম বাড়িতে হিন্দুদের পানাহার চলত না। এমনকি শূদ্রের বাড়িতেও বর্ণহিন্দুদের খাওয়া-দাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। হিসাব মেলানো হতো, কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে কাদের জলচল আছে কিংবা কোনটার মধ্যে নেই। কথিত আছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ এক যুদ্ধের সময় কর্মকারদের অস্ত্র তৈরিতে সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিলেন, কী পুরস্কার চাও। কর্মকাররা বিনীতভাবে বলেছিল, জাঁহাপনা, সোনাদানা, মোহর, জমিজমা কিছুই চাই না। শুধু আমাদের জলচলের হুকুম জারি করে দিন। তাদের অনুরোধে নবাব ফরমান জারি করলেন, এখন থেকে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে কর্মকারের জলচল চালু হলো। কোনো বর্ণহিন্দু কামারের বাড়িতে খেতে আপত্তি করতে পারবে না। এরপর থেকে বর্ণহিন্দুরা কামারদের হাতের খাবার খেতে আপত্তি করে না।
পঞ্চাশের দশকেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একই হুঁকায় তামাক সেবন কিংবা একই গ্গ্নাসে পানি পান চলত না। নজরুলের কবিতায় তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই_ 'হুঁকার জল আর ভাতের হাঁড়ি/করলি এতেই জাতবিচার/ জাত সে শিকেয় তোলা রবে/কর্ম নিয়ে বিচার হবে'।
শুধু নজরুল নন, শৈশবে এক লোককবির গান শুনেছি। গানটি মনে করতে পারছি না। কিন্তু সেটির মর্মবাণী হচ্ছে_ মুসলমান, তুমি হিন্দু বাড়িতে খাও না, কিন্তু হিন্দু ময়রার মিষ্টি ছাড়া মিলাদ করতে পার না, আর হিন্দু তুমি মুসলমানদের খাবার স্পর্শ করো না, কিন্তু মুসলমান গেরস্তের পালা গাভীর দুধ ছাড়া তুমি পূজায় ভোগ দিতে পার না, এই তো তোমাদের শুচিতার বড়াই। বাউল-লোকশিল্পীরা বরাবরই জাতপাতের ঊধর্ে্বর মানুষ। পাকিস্তান আমলে মেজবানিতে কলাপাতায় খাওয়া হতো। হিন্দুরা কলাপাতার এক পিঠে এবং মুসলমানরা অন্য পিঠে খেত। এক বাউল আমাদের বাড়িতে এসে পাতা ঘুরিয়ে হিন্দুরীতি অনুসারে কলাপাতায় খাওয়া শুরু করলেন। বললেন, হিন্দু বাড়িতে গেলে তোমরা যে পিঠে খাও, সেই পিঠে রেখে খাবার খাব। এটা ছিল তার প্রতিবাদ।
শৈশবে দেখেছি_ বাবার হিন্দু বন্ধু ও তার ছাত্রসহ অনেকে গোপনে আমাদের বাড়িতে এসে মুরগি খেয়ে জাতের পিণ্ডি চটকাতেন। তখনও হিন্দু বাড়িতে মুরগি আর ডিম নিষিদ্ধ ছিল। লোকে বলাবলি করত, রশীদ মাস্টারও (আমার বাবা) নাকি হিন্দু বাড়িতে গিয়ে খানাপিনা করেন। '৬৪-৬৫ সালের ঘটনা। আমি যখন শহরতলির গ্রাম কোমরপুরে পড়ি, তখন দেখি সেখানে খাওয়া-দাওয়ায় বাছবিচার নেই। তখন থেকে বন্ধুরা মিলে প্রকাশ্যে হিন্দু বাড়িতে খেতাম এবং হিন্দু বন্ধুরাও আমাদের বাড়িতে এসে খেত। এটি নিয়ে এলাকার মোল্লারা কথা উঠিয়েছিল, কিন্তু তখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে তাদের কিছু করার থাকল না।
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে মানবিক জাগৃতি ঘটে, তা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে মুছে যেতে থাকে জাতপাতের বিভাজন।
বর্ণবাদ এখানকার সমাজের অতীত চিত্র_ যার শাস্ত্রীয় রূপও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, ঈশ্বরের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, হাত থেকে ক্ষত্রিয়, ঊরু থেকে বৈশ্য এবং পা থেকে শূদ্র বা কর্মজীবীদের জন্ম। আসলে কর্মজীবীরাই সভ্যতার কারিগর। এ বিভাজনরেখা ঘোচাতেই নতুন করে ধর্মীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনায় মানুষ জেগেছে। ভিক্ষু-সুফি-বৈষ্ণবদের চেষ্টায় উদার মানবিক জমিন গড়ে উঠেছে। চণ্ডীদাস-লালন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু করে রাধারমণ-জালাল খাঁ-শাহ আবদুল করিমসহ শত শত মানবতাবাদী দার্শনিক-শিল্পী মুঠো মুঠো আলো ছড়িয়ে অন্ধকার খানিকটা দূর করেছেন। ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। শিক্ষার প্রসার ঘটছে, বিস্তৃত হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা। তারপরও সমাজদেহ থেকে সব কালিমা দূর হয়নি, তবে তা কেন এই সময়েও কোনো আধুনিক শিক্ষিত মানুষকে স্পর্শ করবে?
লালনের গানের কথায় আসতে চাই_ 'জাত গেল, জাত গেল/ বলে একি আজব কারখানা।/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তা না না না...।'
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments