শেয়ারবাজার-প্রণোদনার সুফল মিলবে কবে by ফারুক মঈনউদ্দীন
এটা বোধ হয় নিয়তির পরিহাস যে কিছু বাণিজ্যলোভী দ্রুত মুনাফালিপ্সু মানুষ সব সময় একশ্রেণীর শেয়ার ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় কিংবা প্রলোভনে সব নিয়মনীতিবিবর্জিত হয়ে দ্রুত বড়লোক হওয়ার বাসনায় ব্যবসায় নেমে সর্বস্বান্ত হওয়ার পর সরকারি প্রণোদনায় উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আমেরিকার সাব-প্রাইম সংকটের পরও মার্কিন সরকারকে করদাতা নাগরিকদের করের টাকায় এ রকম ‘বেইল আউট’ করতে হয়েছিল ব্যাংকগুলোকে।
শেয়ারবাজার শিল্পায়নের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটা মাধ্যম হলেও এই বাজারের কার্যক্রম কালক্রমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফাটকা বাজারে অর্থলগ্নির সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। শেয়ারবাজারকে স্বল্প মেয়াদে মুনাফা অর্জনের বাজার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল এই বাজার সৃষ্টির পর থেকেই। এমনকি শেয়ারবাজার কিংবা স্টক এক্সচেঞ্জ উদ্ভবের বহু আগে থেকেই মানুষ এ রকম ফাটকা ব্যবসায়ে নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কেবল সাধারণ মানুষ নয়, এমনকি বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মানুষও এই প্রয়াসে শামিল হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। খ্রিষ্টপূর্ব জমানার গ্রিক দার্শনিক থেলিস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬২৪-৫৪৭) সম্পর্কে বহু জনশ্রুতির মধ্যে একটি ছিল ফাটকা ব্যবসায় তথা পূর্বাভাসে তাঁর অসাধারণ ধীশক্তি। অ্যারিস্টটলের জবানি মোতাবেক জানা যায়, একবার থেলিস তাঁর পূর্বাভাস অনুযায়ী বুঝতে পেরেছিলেন যে আগামী মৌসুমে জলপাইয়ের ফলন হবে প্রচুর, আর তাই তিনি এলাকার সব জলপাই তেলের ঘানি কিনে রেখে দিয়েছিলেন, যাতে জলপাইয়ের তেল মাড়াইয়ের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতে হয় এবং বলাবাহুল্য, সে মৌসুমে তিনি প্রচুর মুনাফা লাভ করেছিলেন, কেবল পূর্বাভাসের সাফল্যের কারণে।
তার বহু শত বছর পর সপ্তদশ শতাব্দীতে হল্যান্ডে ঘটেছিল আরেকটি ফাটকা ব্যবসায়িক বিপর্যয়। স্মর্তব্য, তখনো শেয়ারবাজারের কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি, গঠিত হয়নি স্টক এক্সচেজ্ঞ। ইতিহাসে এ ঘটনাটি পরিচিত ‘টিউলিপ ম্যানিয়া’ হিসেবে। কারণ ফাটকা ব্যবসাটি সংঘটিত হয়েছিল টিউলিপ ফুলের কন্দ নিয়ে। আদিতে ইউরোপে টিউলিপ ফুল ছিল না, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করে ওলন্দাজেরা। রুচি ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের কারণে এর বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, আর শুরু হয় টিউলিপ-কন্দ নিয়ে ফাটকাবাজারি। ফাটকা ব্যবসায়ীরা শর্ট সেলের (হাতে শেয়ার না থাকলেও আগাম বিক্রি করে পরে বাজার থেকে কিনে দেওয়া) মাধ্যমে বায়বীয় বিক্রি থেকে তুলে নেয় প্রচুর মুনাফা। ফলে বাজার চড়তে চড়তে একসময় (১৬৩৭ সালে) ঘটে অবশ্যম্ভাবী পতন, তুঙ্গ থেকে ভূপাতিত হয় বাজার। এই ফাটকাবাজারি ব্যবসায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, দেশটির অর্থনীতিকে পরবর্তী বেশ কয়েক বছর টানতে হয়েছে এর জের।
বাংলাদেশের মতো একটা ছোট অর্থনীাতির অগভীর শেয়ারবাজারে মাত্র দেড় দশকের মধ্যে দুটো ধস অপ্রত্যাশিত না হলেও অনভিপ্রেত। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের ধসের পর ২০১০ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজার যখন আবার পাগলা ঘোড়ার মতো তেজি হয়ে ওঠে, তখন বাজার বিশ্লেষকেরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেও মানুষের উন্মাদনার কাছে সব আশঙ্কা পরাভব মানে। নব্বইয়ের ধস-পূর্ব বাজারের সঙ্গে এবারেরটির পার্থক্য ছিল এই যে, তখন মুনাফাপ্রত্যাশী বিনিয়োগকারীদের তৎপরতা ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকেন্দ্রিক; কিন্তু এবারের ধসের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও। কারণ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কল্যাণে তাদের দেশব্যাপী বিস্তৃত শাখার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরের মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল শেয়ার ব্যবসায়। শেয়ার ব্যবসা যে পেশাদার বিনিয়োগের খেলা এবং এটি যে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যম—এ কথাটি বিস্মৃত হয়েছিলেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। শেয়ারবাজারের প্রধানতম শর্তটিও সজ্ঞানে কিংবা অজান্তে উপেক্ষা করেছিলেন তাঁরা। সেটি হচ্ছে, কেবল উদ্বৃত্ত অর্থই শেয়ারবাজারে লগ্নি করা উচিত। কিন্তু এ নীতিটি কিংবা আরও যেসব অবশ্য পালনীয় পূর্বশর্ত থাকে, সেসবেরও তোয়াক্কা করেননি কেউ। কারণ তাঁদের প্রায় সবার সামনেই ছিল স্বল্পতম সময়ে ধনী হওয়ার হাতছানি। ফলে যা ঘটার ছিল ঘটেছে এবং সে ইতিহাস সবার জানা।
বাজারের অবশ্যম্ভাবী পতনটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। বাজারসংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী বৃহৎ বিনিয়োগকারী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে বিষয়টি সরকারের জন্য কিছুটা বিব্রতকরও হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও বজায় রাখার স্বার্থে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হয় (আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রে এ রকমই ঘটে)। এর ফলে বহু বিচার-বিবেচনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত একটা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এই নতুন সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের মালিক-ব্যাংকপ্রদত্ত মূলধনের বাইরে ভিন্ন উৎস থেকে ৪৯ শতাংশ মূলধন সংগ্রহের অনুমতি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের অর্জিত লভ্যাংশ থেকে প্রচলিত হারে ১০ শতাংশ হারে আয়কর প্রত্যাহার, শেয়ারবাজারে বিনিয়োজিত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তোলা ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্যাংকসংক্রান্ত আরও কিছু প্রণোদনা ঘোষিত হয়। যেমন, শেয়ারবাজারে একক গ্রহীতার কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সীমা অতিরিক্ত ঋণসীমার মধ্যে নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০১২ সালের পরিবর্তে ২০১৩ সালের শেষদিন পর্যন্ত বর্ধিতকরণ, কোনো কোম্পানিতে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি মূলধন (ইক্যুইটি) বিনিয়োগ শেয়ারবাজারে সেই ব্যাংকের বিনিয়োগ কিংবা এক্সপোজার হিসেবে গণ্য না হওয়া, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ থেকে উদ্ভূত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন বা সংস্থিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে লাভ থেকে ক্ষতির পরিমাণ বাদ দিয়ে হিসাব করার বিধান প্রবর্তন করা এবং ব্যাংকের নিজস্ব সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের বিনিয়োজিত মূলধন পুঁজিবাজারে সেই ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য না হওয়া ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, শেষোক্ত বিধানটি প্রায় দেড় বছর আগেও প্রবর্তন করা হয়েছিল, ২০১০ সালের জুন মাসে, এটাকে আবার নতুন করে ঘোষিত প্রণোদনার অন্তর্ভুক্তির কারণ বোধগম্য নয়। ফলে এ নিয়মটি বাজারে নতুন করে কোনো প্রণোদনা সৃষ্টি করবে না। সরকারি প্রণোদনার তিনটি পর্যায় রয়েছে: স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা। স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা যে এখনো কাজ করা শুরু হয়নি, তা বাজারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তবে প্রণোদনা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তাৎক্ষণিক উল্লম্ফন ঘটবে, এটা কেউ ভেবে থাকলে ভুল হবে এবং সেটা সত্যিই ঘটেনি। এতে করে একটা বিষয় আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাজারের পতন কোনো অর্থনৈতিক বা মুদ্রানৈতিক কারণে ঘটেনি, সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোভ ও বিবেচনারহিত কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো বিশেষ মহল বাজারে তৈরি করা বুদ্বুদ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিশাল মুনাফা। আর সরকারকে মাঠে নামতে হয়েছে সেই কারসাজিকারীদের আড়াল করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণে। তা সরকার মাঠে নামতেই পারে, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিবেচনায়। ভর্তুকি এবং এজাতীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকারকে এ রকম পদক্ষেপ নিতেই হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাজারে সম্পৃক্ত করে তাদের ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। একসময় যখন ব্যাংকগুলো তাদের মূল কর্মপরিধি এবং আমানতকারীদের স্বার্থ-বিস্মৃত হয়ে একটা অসুস্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল, তখন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভ্রুকুঞ্চিত করে তাদের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করে উন্মত্ত বিনিয়োগকারীদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। শুধু ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজার কর্মকাণ্ডের তৎপরতা বৃদ্ধি নয়, সবগুলো ব্যাংকের সমন্বয়ে একটা বিশাল ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়াও ব্যাংকমালিকদের সংগঠনের মাধ্যমে চালানো হয়েছে, যা কিছু বিচক্ষণ ব্যাংকারের ভূমিকার কারণে এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তা ছাড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য সমস্যার কারণে যেখানে তারা প্রকৃত ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ঠিকভাবে ঋণ সুবিধা দিতে পারছে না, সেখানে শেয়ারবাজার চাঙা করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠন করতে তাদের অর্থলগ্নি করার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং কেউ যদি মনে করেন যে এই সুযোগে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে টেনে এনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে আবারও বাজার থেকে মুনাফা তুলে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটা তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে—সেটাকে উপেক্ষা করা যায় না।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত সুযোগ-সুবিধা ও বিধানগুলোর প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে কেনার চাপ তৈরি করে সূচককে আবার ওপরে ওঠানো, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ বাজারকে কৃত্রিমভাবে আবার চাঙা করতে হবে। তাহলে যেসব প্রতিষ্ঠানের মৌলিক সূচকসমূহ ভালো নয়, অথচ ধসের আগ পর্যন্ত যেগুলোর শেয়ার অনাবশ্যকভাবে চড়া দামে কিনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেগুলোর দাম আবার ফাঁপিয়ে তোলার জন্যই এত সব প্রণোদনা? এতে বাজারে সুশাসনের বিষয়টি কি উপেক্ষিত হবে না? বাজার পড়ে গেছে এটা যেমন সত্য, যে অবস্থা তথা সূচক থেকে পতন শুরু হয়েছিল, সেটিও তেমন ফাঁপা ও কৃত্রিম। কৃত্রিম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশা যদি কারও থাকে, তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রণোদনা প্যাকেজের তিন মেয়াদি কার্যক্রমের প্রায় সব কটিই প্রণীত হয়েছে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যসূচক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, অথচ বাজারের আচরণ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা প্যাকেজের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ ক্রিয়াশীল হবে না।
অতএব শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আরও অপেক্ষা করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ একটা ধসের ধাক্কা সামলাতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। সেই দীর্ঘ সময়ে উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও শেয়ারবাজার একটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যম, স্বল্পতম সময়ে আচমকা মুনাফা করার সুযোগ দৈবাৎ ঘটতে পারে, কিন্তু সেটা বাজারের কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
তার বহু শত বছর পর সপ্তদশ শতাব্দীতে হল্যান্ডে ঘটেছিল আরেকটি ফাটকা ব্যবসায়িক বিপর্যয়। স্মর্তব্য, তখনো শেয়ারবাজারের কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি, গঠিত হয়নি স্টক এক্সচেজ্ঞ। ইতিহাসে এ ঘটনাটি পরিচিত ‘টিউলিপ ম্যানিয়া’ হিসেবে। কারণ ফাটকা ব্যবসাটি সংঘটিত হয়েছিল টিউলিপ ফুলের কন্দ নিয়ে। আদিতে ইউরোপে টিউলিপ ফুল ছিল না, তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এটি আমদানি করে ওলন্দাজেরা। রুচি ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জনের কারণে এর বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, আর শুরু হয় টিউলিপ-কন্দ নিয়ে ফাটকাবাজারি। ফাটকা ব্যবসায়ীরা শর্ট সেলের (হাতে শেয়ার না থাকলেও আগাম বিক্রি করে পরে বাজার থেকে কিনে দেওয়া) মাধ্যমে বায়বীয় বিক্রি থেকে তুলে নেয় প্রচুর মুনাফা। ফলে বাজার চড়তে চড়তে একসময় (১৬৩৭ সালে) ঘটে অবশ্যম্ভাবী পতন, তুঙ্গ থেকে ভূপাতিত হয় বাজার। এই ফাটকাবাজারি ব্যবসায় বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, দেশটির অর্থনীতিকে পরবর্তী বেশ কয়েক বছর টানতে হয়েছে এর জের।
বাংলাদেশের মতো একটা ছোট অর্থনীাতির অগভীর শেয়ারবাজারে মাত্র দেড় দশকের মধ্যে দুটো ধস অপ্রত্যাশিত না হলেও অনভিপ্রেত। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের ধসের পর ২০১০ সালের শেষদিকে শেয়ারবাজার যখন আবার পাগলা ঘোড়ার মতো তেজি হয়ে ওঠে, তখন বাজার বিশ্লেষকেরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেও মানুষের উন্মাদনার কাছে সব আশঙ্কা পরাভব মানে। নব্বইয়ের ধস-পূর্ব বাজারের সঙ্গে এবারেরটির পার্থক্য ছিল এই যে, তখন মুনাফাপ্রত্যাশী বিনিয়োগকারীদের তৎপরতা ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকেন্দ্রিক; কিন্তু এবারের ধসের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও। কারণ, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর কল্যাণে তাদের দেশব্যাপী বিস্তৃত শাখার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন শহরের মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল শেয়ার ব্যবসায়। শেয়ার ব্যবসা যে পেশাদার বিনিয়োগের খেলা এবং এটি যে একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যম—এ কথাটি বিস্মৃত হয়েছিলেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। শেয়ারবাজারের প্রধানতম শর্তটিও সজ্ঞানে কিংবা অজান্তে উপেক্ষা করেছিলেন তাঁরা। সেটি হচ্ছে, কেবল উদ্বৃত্ত অর্থই শেয়ারবাজারে লগ্নি করা উচিত। কিন্তু এ নীতিটি কিংবা আরও যেসব অবশ্য পালনীয় পূর্বশর্ত থাকে, সেসবেরও তোয়াক্কা করেননি কেউ। কারণ তাঁদের প্রায় সবার সামনেই ছিল স্বল্পতম সময়ে ধনী হওয়ার হাতছানি। ফলে যা ঘটার ছিল ঘটেছে এবং সে ইতিহাস সবার জানা।
বাজারের অবশ্যম্ভাবী পতনটি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। বাজারসংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী বৃহৎ বিনিয়োগকারী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে বিষয়টি সরকারের জন্য কিছুটা বিব্রতকরও হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও বজায় রাখার স্বার্থে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হয় (আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রে এ রকমই ঘটে)। এর ফলে বহু বিচার-বিবেচনার পর ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশিত একটা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এই নতুন সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা, মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে তাদের মালিক-ব্যাংকপ্রদত্ত মূলধনের বাইরে ভিন্ন উৎস থেকে ৪৯ শতাংশ মূলধন সংগ্রহের অনুমতি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য শেয়ারবাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের অর্জিত লভ্যাংশ থেকে প্রচলিত হারে ১০ শতাংশ হারে আয়কর প্রত্যাহার, শেয়ারবাজারে বিনিয়োজিত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তোলা ইত্যাদি। এ ছাড়া ব্যাংকসংক্রান্ত আরও কিছু প্রণোদনা ঘোষিত হয়। যেমন, শেয়ারবাজারে একক গ্রহীতার কাছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সীমা অতিরিক্ত ঋণসীমার মধ্যে নামিয়ে আনার সময়সীমা ২০১২ সালের পরিবর্তে ২০১৩ সালের শেষদিন পর্যন্ত বর্ধিতকরণ, কোনো কোম্পানিতে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি মূলধন (ইক্যুইটি) বিনিয়োগ শেয়ারবাজারে সেই ব্যাংকের বিনিয়োগ কিংবা এক্সপোজার হিসেবে গণ্য না হওয়া, পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ থেকে উদ্ভূত ক্ষতির বিপরীতে প্রভিশন বা সংস্থিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে লাভ থেকে ক্ষতির পরিমাণ বাদ দিয়ে হিসাব করার বিধান প্রবর্তন করা এবং ব্যাংকের নিজস্ব সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের বিনিয়োজিত মূলধন পুঁজিবাজারে সেই ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য না হওয়া ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, শেষোক্ত বিধানটি প্রায় দেড় বছর আগেও প্রবর্তন করা হয়েছিল, ২০১০ সালের জুন মাসে, এটাকে আবার নতুন করে ঘোষিত প্রণোদনার অন্তর্ভুক্তির কারণ বোধগম্য নয়। ফলে এ নিয়মটি বাজারে নতুন করে কোনো প্রণোদনা সৃষ্টি করবে না। সরকারি প্রণোদনার তিনটি পর্যায় রয়েছে: স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা। স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা যে এখনো কাজ করা শুরু হয়নি, তা বাজারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তবে প্রণোদনা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে তাৎক্ষণিক উল্লম্ফন ঘটবে, এটা কেউ ভেবে থাকলে ভুল হবে এবং সেটা সত্যিই ঘটেনি। এতে করে একটা বিষয় আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাজারের পতন কোনো অর্থনৈতিক বা মুদ্রানৈতিক কারণে ঘটেনি, সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোভ ও বিবেচনারহিত কর্মকাণ্ডের কারণে কোনো বিশেষ মহল বাজারে তৈরি করা বুদ্বুদ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিশাল মুনাফা। আর সরকারকে মাঠে নামতে হয়েছে সেই কারসাজিকারীদের আড়াল করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণে। তা সরকার মাঠে নামতেই পারে, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বিবেচনায়। ভর্তুকি এবং এজাতীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকারকে এ রকম পদক্ষেপ নিতেই হয়। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাজারে সম্পৃক্ত করে তাদের ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। একসময় যখন ব্যাংকগুলো তাদের মূল কর্মপরিধি এবং আমানতকারীদের স্বার্থ-বিস্মৃত হয়ে একটা অসুস্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে দ্রুত মুনাফা তুলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল, তখন নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভ্রুকুঞ্চিত করে তাদের কর্মকাণ্ডে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করে উন্মত্ত বিনিয়োগকারীদের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। শুধু ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজার কর্মকাণ্ডের তৎপরতা বৃদ্ধি নয়, সবগুলো ব্যাংকের সমন্বয়ে একটা বিশাল ফান্ড গঠনের প্রক্রিয়াও ব্যাংকমালিকদের সংগঠনের মাধ্যমে চালানো হয়েছে, যা কিছু বিচক্ষণ ব্যাংকারের ভূমিকার কারণে এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তা ছাড়া ব্যাংকগুলোর তারল্য সমস্যার কারণে যেখানে তারা প্রকৃত ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ঠিকভাবে ঋণ সুবিধা দিতে পারছে না, সেখানে শেয়ারবাজার চাঙা করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠন করতে তাদের অর্থলগ্নি করার কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না; বরং কেউ যদি মনে করেন যে এই সুযোগে ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে টেনে এনে মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে আবারও বাজার থেকে মুনাফা তুলে বের হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটা তহবিল গঠনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে—সেটাকে উপেক্ষা করা যায় না।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত সুযোগ-সুবিধা ও বিধানগুলোর প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে কেনার চাপ তৈরি করে সূচককে আবার ওপরে ওঠানো, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ বাজারকে কৃত্রিমভাবে আবার চাঙা করতে হবে। তাহলে যেসব প্রতিষ্ঠানের মৌলিক সূচকসমূহ ভালো নয়, অথচ ধসের আগ পর্যন্ত যেগুলোর শেয়ার অনাবশ্যকভাবে চড়া দামে কিনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেগুলোর দাম আবার ফাঁপিয়ে তোলার জন্যই এত সব প্রণোদনা? এতে বাজারে সুশাসনের বিষয়টি কি উপেক্ষিত হবে না? বাজার পড়ে গেছে এটা যেমন সত্য, যে অবস্থা তথা সূচক থেকে পতন শুরু হয়েছিল, সেটিও তেমন ফাঁপা ও কৃত্রিম। কৃত্রিম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আবার সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার আশা যদি কারও থাকে, তা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। প্রণোদনা প্যাকেজের তিন মেয়াদি কার্যক্রমের প্রায় সব কটিই প্রণীত হয়েছে বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যসূচক বাড়ানোর উদ্দেশ্যে, অথচ বাজারের আচরণ বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনা প্যাকেজের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপসমূহ ক্রিয়াশীল হবে না।
অতএব শেয়ারবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আরও অপেক্ষা করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ একটা ধসের ধাক্কা সামলাতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। সেই দীর্ঘ সময়ে উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলেও শেয়ারবাজার একটা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের মাধ্যম, স্বল্পতম সময়ে আচমকা মুনাফা করার সুযোগ দৈবাৎ ঘটতে পারে, কিন্তু সেটা বাজারের কোনো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম নয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com
No comments