চারদিক-এমন রঙিন পাখা
টিক টিক করে এগিয়ে চলেছে ঘড়ির কাঁটা। সেই সঙ্গে ঘুরছে আমাদের গাড়ির চাকাও। গন্তব্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্দেশ্য এখানকার প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রজাপতি মেলা দর্শন। চারপাশের সবুজ শ্যামলিমা ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে গন্তব্যের দিকে। সকালের সূর্যটা তখন সবেমাত্র তাপ ছড়াতে শুরু করেছে।
গাছগাছালির পাতা ও ঘাসের ওপর তখনো ঝলমল করছে শিশিরবিন্দু। ঘড়িতে ঠিক আটটা বাজতেই আমাদের গাড়ি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে নামতেই ছোটখাটো একটা ভিড় চোখে পড়ল। কিন্তু এত সকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানুষের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু আজ লোকসমাগম বেশ ভালোই। কারণ এখানে বসেছে প্রজাপতির মেলা। হরেক রঙে রাঙা শাড়ি, পাঞ্জাবি পরে এসেছেন সবাই। কারও কারও গায়ে শীতের শাল। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে ঠিক যেন মনুষ্য প্রজাপতি, শুধু ডানাটাই নেই। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারপাশের পরিবেশ। নানা রঙের বেলুন ও প্ল্যাকার্ডে ফুটে উঠেছে প্রজাপতির জীবনচক্র। গত বছর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ নিয়মিত আয়োজন করে আসছে এ প্রজাপতি মেলার। ২ ডিসেম্বর জাবি ক্যাম্পাসে বসেছিল এ মেলার দ্বিতীয় আসর। প্রজাপতি মেলা দেখতে এসেছেন নানা বয়সের মানুষ। এমনকি এ তালিকা থেকে বাদ পড়েনি শিশুরাও। ‘আমি না এর আগে কখনো এত্ত প্রজাপতি একসাথে দেখিনি। আজকেই একসাথে এত্তগুলা প্রজাপতি দেখলাম। আমি অনেকগুলো প্রজাপতির নামও শিখেছি—শীতলপাটি, ঊর্মিমালা, মৃন্ময়ী, তালডিঙ্গি, শঙ্খমালা, শকুন্তলা, মেঘকুমারীসহ আরও কত সুন্দর সুন্দর নাম। প্রজাপতিগুলো দেখতেও না নামের চাইতে আরও অনেক সুন্দর।’ প্রজাপতি মেলায় এসে নিজের ভালো লাগার কথা এভাবেই বলছিল সাভার রেডিও কলোনি বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর খুদে শিক্ষার্থী ইমা ফাতিম। শুধু সে একাই নয়, বড়দের পাশাপাশি তার মতো আরও অনেক শিশুই এসেছিল এ মেলায়। কেউবা এসেছিল বাবা-মায়ের কোলে চড়ে। আর অনেকের জন্যই এটি ছিল প্রথম প্রজাপতি-দর্শন। কেউ কেউ প্রজাপতি বাসায় নিয়ে যাওয়ার বায়নাও ধরেছিল। বাবা-মা বুঝিয়ে বলার পরও তারা মানতে নারাজ। কে শোনে কার কথা। প্রজাপতি তাদের চাই-ই চাই। অনেক বুঝিয়ে শান্ত করতে হলো তাদের। আবার এদের ব্যতিক্রমও ছিল কেউ কেউ। তাদের মধ্যে একজন মাইশা তাবাসসুম। সে বড় ভাইকে নিয়ে এসেছে হরেক রঙের প্রজাপতি দেখতে। বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে সে বলল, ‘প্রজাপতিরা মুক্ত থাকলেই দেখতে ভালো লাগে। আমি বইতে পড়েছি প্রজাপতি না থাকলে ফুলের পরাগায়ন ব্যাহত হবে। আর ফুলের পরাগায়ন না হলে তখন আমরা খাব কী? তাই প্রজাপতিরা যাতে ঠিকভাবে বাঁচতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।’ ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ স্লোগানে দিনব্যাপী এ মেলার সকালের পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক ড. মাহমুদুল আমীনকে মরণোত্তর সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে প্রজাপতিবিষয়ক একটি প্রবন্ধ ও প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে গবেষণার জন্য দেওয়া হয় এ পদক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন, স্থপতি রবিউল হুসাইনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ৪০টি প্রজাপতির বাংলা নামকরণ, প্রজাপতিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ঘুড়ি-উৎসব, বারোয়ারি বিতর্ক ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা এবং প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজনে সারা দিন উৎসবমুখর ছিল এ মেলা। প্রজাপতি-দর্শনের মতো জীবনে প্রথমবার ঘুড়ি উড়ালেন কেউ কেউ। ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেনে ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল বেশ লম্বা একটা লাইন। সামনে এগোতেই লক্ষ করলাম প্রজাপতির হাটে ঢোকার লাইন এটি। মশারির জাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম এ প্রজাপতির হাট। আর এতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৭০ প্রজাতির প্রায় ৪০০ জীবন্ত প্রজাপতি। এ হাটই ছিল এবারের প্রজাপতি মেলার মূল আকর্ষণ। হাটের এক দিক দিয়ে প্রবেশ করে আরেক দিক দিয়ে বের হচ্ছিলেন সবাই। এখানে প্রজাপতিদের খুব কাছে আসতে পেরেছেন সবাই। এমনকি প্রজাপতি ছুঁয়েও দেখেছেন অনেকে। কিন্তু মানুষ বেশি হওয়ার কারণে প্রজাপতি-দর্শনে সময় কম পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন অনেকে। রাজধানীর উত্তরা থেকে আসা সাদিয়া শাহরীন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই প্রজাপতির প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। বইয়ের পাতা আর টেলিভিশন ছাড়া প্রজাপতির সান্নিধ্য খুব একটা পেতাম না। কিন্তু এখানে প্রজাপতি মেলা হবে শুনে বেশ উৎসাহী হয়েই চলে এসেছি। এবারই প্রথম আমি প্রজাপতি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম।’ প্রাণিবিদেরা বলে থাকেন প্রজাপতির নাকি দুপক্ষ। একটি কনেপক্ষ, আরেকটি বরপক্ষ। কিন্তু যাঁরা প্রজাপতি দেখতে এ মেলায় এসেছেন তাঁদের মধ্যে ছিল না কোনো পক্ষ। তাঁরা সবাই প্রজাপতিপ্রেমী। প্রজাপতিদের ভালোবাসা নিয়ে দিনশেষে প্রজাপতিপ্রেমীরা যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন সূর্যটা তখন হেলে পড়ছিল পশ্চিম আকাশে। কিন্তু প্রজাপতিপ্রেমী এসব মানুষের ঠিকই মনে মনে বাজছিল একটি গান ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা...’
জিয়াউর রহমান চৌধুরী
জিয়াউর রহমান চৌধুরী
No comments