শ্রদ্ধাঞ্জলি-জালাল আলমগীর আমার বন্ধু by আলী রীয়াজ

মেধাবী, মৃদুভাষী, সজ্জন এই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বর্ণনা করতে অতীতকাল ব্যবহার করতে হবে, এটা আমি এখনো বিশ্বাস করতে চাই না। জালালের মতো একজন প্রাণোচ্ছল, সম্ভাবনাময় তরুণ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করবে—এ কথা কে বিশ্বাস করবে? শনিবার সকালে এই খবরটার সঙ্গে জালালের হাসিমুখের ছবিটা না দেখলে আমি নিশ্চিত করেই বলতাম, কেউ কোথায় নাম, পদবি, পরিচয় ভুল করে ফেলেছে।


কিন্তু এখন আমাকে অনেক সূত্র থেকে বলেছে, সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়েছে, তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন বলেই কি আমাকে মেনে নিতে হবে? এখনো আমার কানে বাজছে জালালের কণ্ঠস্বর, ‘ডিসেম্বরে ঢাকায় দেখা না হলেও মার্চে টরন্টোতে দেখা হবে।’ ২৩ অক্টোবর সকালে উইসকনসিনের মেডিসন শহরে দক্ষিণ এশিয়া সম্মেলনের শেষ দিন সকালে কফির দোকান থেকে হোটেলে ফিরতে ফিরতে আমরা পরিকল্পনা করছিলাম পরবর্তী সাক্ষাতের। এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু ছিল না। গত পাঁচ বছরে আমাদের যতবার দেখা হয়েছে ততবারই আড্ডা, কফি বা খাবারদাবারের পর এভাবেই আমরা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। আসলে আমরা কখনোই বিদায় নিইনি। গত ৫ বছরে এমন কোনো মাস প্রায় নেই বললেই চলে, যখন জালালের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি—ই-মেইল, টেলিফোন, টেক্সট। তদুপরি এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া বা বাংলাদেশ নিয়ে উত্তর আমেরিকায় যেকোনো সম্মেলন হলে আমাদের যে দেখা হবেই, এটা আমরা জানি। জালালের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০০৭ সালের গোড়াতে বোস্টনে এশিয়ান স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে। পাঁচ বছর খুব দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু জালাল মানুষকে আপন করে নিতে এতটাই সিদ্ধহস্ত যে প্রথম পরিচয়ই মনে হয়েছে, আমরা অনেক দিনের পরিচিত। তারপর অনেক অনেক সময় আমাদের কেটেছে একত্রে।
জালাল আলমগীরের কাজের ব্যাপ্তি ও গভীরতার পরিচয় পেলাম যখন তার প্রথম প্রকাশিত বইটি পড়ার সুযোগ হলো ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। জালালের বইয়ের প্রকাশক রাটলেজ, আমার কয়েকটি বইয়ের প্রকাশকও। জালালের বইয়ের বিষয় ভারত। বইয়ের শিরোনাম ইনডিয়াস ওপেন ইকোনমি পলিসি: গ্লোবালইজম, রাইভেলারি, কনটিনিউটি। বিশ্বায়ন এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ওপর তার প্রভাব নিয়ে এমন অনুসন্ধানী ও গভীর আলোচনা খুব বেশি চোখে পড়েনি আমার। এই বইয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ এইখানে যে, যাঁরাই সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবর্তন ও রূপান্তর নিয়ে ভাবেন, তাঁরাই এই বই পড়ে লাভবান হবেন। একটা বই-ই শুধু নয়, জালালের অন্যান্য লেখাও তত দিনে ও আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, আমরা একই প্যানেলে অংশ নিচ্ছি এখানে-সেখানে।
২০০৯ সালে জালাল যখন পদোন্নতি ও স্থায়ীকরণের (টেনিউর ও প্রমোশন) জন্য আবেদন করল ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনুরোধে জালালের আবেদনপত্রটি মূল্যায়নকারীদের একজন ছিলাম আমি। তার গবেষণার তালিকা, প্রকাশনার কিছু কিছু উদাহরণের পাশাপাশি তার গোটা সিভি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ মিলল সেই সূত্রে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, প্রচারবিমুখ এই তরুণ গবেষক কত কম সময়ের ভেতরে নিজেকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক একজন গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০০০ সালে ব্রাউন বিশ্ববিদালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার পর জালাল কোনো না কোনোভাবে শীর্ষস্থানীয় গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে—ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট, ভারতের সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ। পরে জালাল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইনিসিয়েটিভের ফেলো হিসেবে যুক্ত ছিল। এ তালিকাটি আরও দীর্ঘ।
জালাল আলমগীর তার গবেষণাকে কেবল প্রচলিত একাডেমিক প্রকাশনার জগতে সীমিত রাখেনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, এশিয়ান স্টাডিজ ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক শীর্ষস্থানীয় গবেষণা জার্নালে জালাল যেসব প্রকাশ করেছে তার গবেষণার ফলাফল, তেমনি নিয়মিতভাবে লিখেছে হাফিংটন পোস্টে, ওপেন ডেমোক্রেসির মতো ইন্টারনেটভিত্তিক ম্যাগাজিনে। উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশ নিয়ে যারা গবেষণা ও শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত, তদের কাছে গত কয়েক বছরে জালাল আলমগীর একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছে। যাদের সৌভাগ্যে হয়েছে তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানার—তাদের কাছে জালাল আলমগীর প্রিয় ও পরিচিত নাম।
গবেষক হিসেবে জালাল যেমন নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষ ছিল, তেমনি মানুষ হিসেবে ছিল আকর্ষণীয়। জালাল আমার চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট, কিন্তু যতবার কথা বলেছি আমি তার উৎসাহ, আবেগ, কমিটমেন্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। ভিন্নমত সত্ত্বেও তার লেখা পড়ে মনে হয়েছে, এই বিশ্লেষণটার প্রয়োজন ছিল।
এ দুঃসংবাদটি শোনার পর টকেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ওম্যান স্টাডিজের ডিরেক্টর এবং বিশিষ্ট দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক আয়েশা জালালের সঙ্গে কথোপকথন হলো ই-মেইলে। আমাদের দুজনের কারও পক্ষেই সম্ভবত এ নিয়ে টেলিফোনে কথা বলা সম্ভব হতো না, জালালকে আয়েশা গভীরভাবে পছন্দ করত। আয়েশা লিখে পাঠিয়েছেন: ‘হি উইল বি ডিয়ারলি মিসড ইন দি ফিল্ড অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ।’ এর চেয়ে বেশি আমি আমার বন্ধু জালাল আলমগীরকে নিয়ে কী বলতে পারব?
পাদটীকা: বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে জালাল আলমগীরের মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়েছে পিতৃপরিচয়ের সূত্রে। তার এই পারিবারিক পরিচয়কে খাটো না করেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে: পিতৃপরিচয়ের সূত্র না থাকলে আমরা কি জানতেই পারতাম না বাংলাদেশবিষয়ক এই নিবেদিতপ্রাণ মেধাবী গবেষকের অকালমৃত্যুর খবর?
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.