চারদিক-অল্পে তুষ্ট মানুষেরা
পৌষের মিঠেকড়া রোদ। ঠান্ডা বাতাস পুড়ছে রোদে। গা গরম হচ্ছে, গাছপালা শিশিরভেজা পরত সরিয়ে চনমনে হচ্ছে। রোদ বাড়তেই ঠান্ডার জবুথবু ভাবটা উধাও। আমরা এ গাড়ি ও গাড়ি চড়ে পৌঁছে গেছি একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে একদল মানুষ অপেক্ষায়। গ্রামটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মধ্যজালালপুর (নেংটিকোনা)। জালালপুর গ্রামটি বেশ বড়।
মধ্যজালালপুর গ্রামের বাঁশ-বেত কারিগর সমবায় সমিতির সংগঠক রিসান আহমদের বাড়িতে তখন অনেক নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। এরা এসেছেন এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। সেই সকাল থেকে তাঁরা অপেক্ষা করছেন একদল অতিথির জন্য। যেন রাজার লোক আসছে, সঙ্গে উপঢৌকন! রাজার লোক না হোক, তবে উপঢৌকন বা দান, যা-ই বলা যাক, কিছু একটা যে তাঁদের দেওয়া হবে, এটা তাঁরা জানেন। কিন্তু কী পণ্য, কী সেটা, এটা তাঁদের কাছে স্পষ্ট না। আমরা (লেখক ও লোকগবেষক আহমদ সিরাজ, কমলগঞ্জ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিলকিস বেগম ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ) যখন সেখানে পৌঁছাই, তখনই বেশ বেলা হয়ে গেছে। মূল দলটি আরও পেছনে। তারা আসছে লোকাল বাসে করে। মৌলভীবাজার শহরের শমশেরনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে এই বাসটি যাবে জেলার সীমান্তবর্তী কুরমা অবধি। এরা স্থানটি চেনে না। এদের পথ চিনিয়ে নিতে ফিরে আসতে হলো আদমপুর বাজারে। এই দলটিতে আছেন প্রথম আলো বন্ধুসভা মৌলভীবাজারের বন্ধুরা। ১৫-২০ জনের দল। এরা এর আগে কখনো এমন করে কোনো কাজে বের হয়নি। আগে যেমন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন শীতার্ত, বন্যাকবলিত বা দুর্যোগপীড়িত মানুষের জন্য দলবেঁধে রাস্তায় বেরিয়েছে, ত্রাণ সংগ্রহ করেছে, তারপর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তা বিতরণ করেছে—সে রকম দৃশ্য এখন চোখে খুব কমই পড়ে। সবাই কেমন যেন আত্মমুখী! স্বার্থমুখী! বাণিজ্যমুখী!
বন্ধুসভার সদস্যরা মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়ি থেকে দরিদ্র মানুষের জন্য পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করেছেন। খুব কম মানুষই এই প্রাণচঞ্চল কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের বিমুখ করেছেন। কেউ তো খোঁজ করে পৌঁছে দিয়েছেন! বুঝতে অসুবিধা হয় না, জীবনকে শুধু সংগ্রামের পথে চেনানো হলেও সহযোগিতা, সহমর্মিতাও যে জীবনেরই অংশ, এটা এখনো অনেক মানুষের বোধে আছে। এই সংগৃহীত কাপড়চোপড়ই সেদিন (৬ জানুয়ারি ২০১২) বিতরণ করা হবে। বাস থেকে যখন এই কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর দল নামে, তাদের উচ্ছ্ব্াস এতটাই ঝলমলে, যেন জগতের মতো আনন্দময় আর কিছু নেই। পাকা রাস্তা ধরে তারা যখন নাড়ার মাঠের কোনাকুনি পথে হাঁটে, উচ্ছ্বাসটা আরও বেড়ে যায়। কেন জানি মনে হয়, এই মাটি, এই ধুলোপথ, ঘাস-নাড়ার মাঠ, এসবের সঙ্গে এখনো—উন্মূল শহরবাসের পরও—সবার নাড়ির বন্ধনটা ছিন্ন হয়ে যায়নি।
ততক্ষণে বেলা প্রায় দুপুরের কাছাকাছি। ভয় ছিল, বিলম্বে মানুষগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন না তো! যতটুকু জানি, তাঁরা নানা রকম প্রান্তিক পেশায় যুক্ত। কেউ বাঁশ-বেতের পণ্য তৈরি করেন, কেউ দিনমজুরি করেন। এখানে সেই কাজ ফেলে আসতে হয়েছে। বন্ধুসভার সম্পাদক অপূর্ব সোহাগ, বন্ধু আমিনা আইরিন তাঁদের উপলক্ষ করে বলেন, ‘আমরা যে শীতবস্ত্র বা অন্যান্য পোশাক নিয়ে এসেছি, তা আপনাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। আমরা শুধু এসেছি। এই দূরপ্রান্তে আপনারা থাকলেও এটা বোঝাতে যে, আপনারা একা নন। আপনাদের সাথে আমরাও আছি।’ রিসান আহমদ বাঁশ-বেতের কারিগরদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরই সহযোগিতায় এই বিতরণের ব্যবস্থা। তিনি যখন একেকটি পোশাক একেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছেন, নীরবে একেকজন তা নিয়ে নিচ্ছেন। কোনো হইচই নেই। কাড়াকাড়ি নেই। এত লোক সমবেত, কিন্তু চুপচাপ। আমার মনে হচ্ছিল, এই পোশাকটি হয়তো তাঁর (যাকে দেওয়া হচ্ছে) পরিবারের কোনো এক সদস্যের কাজে লাগতে পারে, না-ও লাগতে পারে। তবু এটা নয়, ওটা চাই—এ রকম বাড়তি কোনো কথা নেই। দিনটা মাটি করে তাঁরা যা পাচ্ছেন, তা যে তাঁদের হতাশ করার মতো, এটা বুঝতে সমস্যা হয় না। এ রকম একটা মুহূর্তেই একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা কিতা দিছইন (কী দিয়েছেন), এটা আমরার কাছে বড় নায়। আপনারা যে আমরার লাগি ভাবইন (ভাবেন)। এত দূর থাখি আইছইন (থেকে এসেছেন)। এটা বড় পাওয়া। আপনারারে আমরার সুখেদুঃখে খাছো ফাইলেই (কাছে পেলেই) আমরা খুশি।’
সবাই তখন বিস্মিত। এত সামান্য পেয়েও মানুষ এত তুষ্ট থাকতে পারে, অনেকের পক্ষে এটা ভাবাও কঠিন। যে দেশের মানুষ এত অল্পে তুষ্ট থাকে, সে দেশ কেন দরিদ্র হবে! কেউ কি তেমন করে ভাবছেন, জানি না। ফেরার আগে আরও বিস্ময়। সবার জন্য খিচুড়িভোজের ব্যবস্থা করেছেন রিসান আহমদ। এটা কেন—বলতেই শোনা গেল তাঁর কথা, ‘গরিব হতে পারি। তাই বলে মনটা মরে যায়নি। মনটা বড় আছে। আমাদের এখান থেকে কেউ খালি মুখে যেতে পারে না।’ চকিতে মাথায় খেলা করে, এই তো আমার দেশ! দেশের মানুষ। যে মানুষ যুগ যুগ ধরে একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে এগিয়ে চলছে!
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
বন্ধুসভার সদস্যরা মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়ি থেকে দরিদ্র মানুষের জন্য পুরোনো কাপড় সংগ্রহ করেছেন। খুব কম মানুষই এই প্রাণচঞ্চল কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের বিমুখ করেছেন। কেউ তো খোঁজ করে পৌঁছে দিয়েছেন! বুঝতে অসুবিধা হয় না, জীবনকে শুধু সংগ্রামের পথে চেনানো হলেও সহযোগিতা, সহমর্মিতাও যে জীবনেরই অংশ, এটা এখনো অনেক মানুষের বোধে আছে। এই সংগৃহীত কাপড়চোপড়ই সেদিন (৬ জানুয়ারি ২০১২) বিতরণ করা হবে। বাস থেকে যখন এই কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর দল নামে, তাদের উচ্ছ্ব্াস এতটাই ঝলমলে, যেন জগতের মতো আনন্দময় আর কিছু নেই। পাকা রাস্তা ধরে তারা যখন নাড়ার মাঠের কোনাকুনি পথে হাঁটে, উচ্ছ্বাসটা আরও বেড়ে যায়। কেন জানি মনে হয়, এই মাটি, এই ধুলোপথ, ঘাস-নাড়ার মাঠ, এসবের সঙ্গে এখনো—উন্মূল শহরবাসের পরও—সবার নাড়ির বন্ধনটা ছিন্ন হয়ে যায়নি।
ততক্ষণে বেলা প্রায় দুপুরের কাছাকাছি। ভয় ছিল, বিলম্বে মানুষগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন না তো! যতটুকু জানি, তাঁরা নানা রকম প্রান্তিক পেশায় যুক্ত। কেউ বাঁশ-বেতের পণ্য তৈরি করেন, কেউ দিনমজুরি করেন। এখানে সেই কাজ ফেলে আসতে হয়েছে। বন্ধুসভার সম্পাদক অপূর্ব সোহাগ, বন্ধু আমিনা আইরিন তাঁদের উপলক্ষ করে বলেন, ‘আমরা যে শীতবস্ত্র বা অন্যান্য পোশাক নিয়ে এসেছি, তা আপনাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। আমরা শুধু এসেছি। এই দূরপ্রান্তে আপনারা থাকলেও এটা বোঝাতে যে, আপনারা একা নন। আপনাদের সাথে আমরাও আছি।’ রিসান আহমদ বাঁশ-বেতের কারিগরদের সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরই সহযোগিতায় এই বিতরণের ব্যবস্থা। তিনি যখন একেকটি পোশাক একেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছেন, নীরবে একেকজন তা নিয়ে নিচ্ছেন। কোনো হইচই নেই। কাড়াকাড়ি নেই। এত লোক সমবেত, কিন্তু চুপচাপ। আমার মনে হচ্ছিল, এই পোশাকটি হয়তো তাঁর (যাকে দেওয়া হচ্ছে) পরিবারের কোনো এক সদস্যের কাজে লাগতে পারে, না-ও লাগতে পারে। তবু এটা নয়, ওটা চাই—এ রকম বাড়তি কোনো কথা নেই। দিনটা মাটি করে তাঁরা যা পাচ্ছেন, তা যে তাঁদের হতাশ করার মতো, এটা বুঝতে সমস্যা হয় না। এ রকম একটা মুহূর্তেই একজন বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনারা কিতা দিছইন (কী দিয়েছেন), এটা আমরার কাছে বড় নায়। আপনারা যে আমরার লাগি ভাবইন (ভাবেন)। এত দূর থাখি আইছইন (থেকে এসেছেন)। এটা বড় পাওয়া। আপনারারে আমরার সুখেদুঃখে খাছো ফাইলেই (কাছে পেলেই) আমরা খুশি।’
সবাই তখন বিস্মিত। এত সামান্য পেয়েও মানুষ এত তুষ্ট থাকতে পারে, অনেকের পক্ষে এটা ভাবাও কঠিন। যে দেশের মানুষ এত অল্পে তুষ্ট থাকে, সে দেশ কেন দরিদ্র হবে! কেউ কি তেমন করে ভাবছেন, জানি না। ফেরার আগে আরও বিস্ময়। সবার জন্য খিচুড়িভোজের ব্যবস্থা করেছেন রিসান আহমদ। এটা কেন—বলতেই শোনা গেল তাঁর কথা, ‘গরিব হতে পারি। তাই বলে মনটা মরে যায়নি। মনটা বড় আছে। আমাদের এখান থেকে কেউ খালি মুখে যেতে পারে না।’ চকিতে মাথায় খেলা করে, এই তো আমার দেশ! দেশের মানুষ। যে মানুষ যুগ যুগ ধরে একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে এভাবেই লোকচক্ষুর আড়ালে এগিয়ে চলছে!
আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
No comments