টাকার খেলা
ক্রিকেট আর শুধুই খেলা নেই, টি-টোয়েন্টির রঙিন মোড়কে ঢাকা একটা ব্যবসাও। টাকার রসায়নে গলে যায় পুরোনো শত্রুতাও। লিখেছেন তারেক মাহমুদকিছু অন্ধ লোকের পাল্লায় পড়ে গেছে ক্রিকেট। তাদের কেউ ক্রিকেটকে ধরে বলছে, এটা সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। পেট কাটলেই এক লাফে কোটিপতি।
কেউ বলছে, আরে না, এ তো এক রঙ্গশালা! ক্রিকেট মানে নাচ, গান আর লাস্যময়ী চিয়ারলিডার। পার্টি, ফুর্তি। পেছন থেকে ডাক আসে, কে বলেছে ভাই? ক্রিকেট তো রকমারি পণ্য। কতভাবে যে এর সওদা হয়! এই ক্রিকেট...ক্রিকেট...লাগবে ক্রিকেট..?
বেচারা ক্রিকেটের দশা হয়ে গেল সেই হাতির মতো। নাকি হাতির চেয়েও খারাপ! হাতি তো কখনো কলাগাছ, কখনো কুলো হয়েছিল আসল অন্ধদের পাল্লায় পড়ে। সেই অন্ধদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু ক্রিকেট পড়েছে ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’দের চক্করে। এই ‘অন্ধ’রা দেখেও দেখে না, বুঝেও বোঝে না। তবে ভালো করেই জানে ক্রিকেট সবার আগে একটা খেলা।
সেই জানাটা তাঁরা ভুলে থাকতে চাইছেন। টক শো, সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বলছেন, ক্রিকেট মানে এখন অর্থনীতি। চাহিদা আর জোগানের নিক্তিতে ওঠানামা তার জনপ্রিয়তা, টিকে থাকা। চাহিদা যেটার, জোগান দাও সেটা। টি-টোয়েন্টির ঢেউয়ে ভাসিয়ে দাও ক্রিকেট। লাভের ওপর সোয়া সের তোলো। তাদের কাছে ক্রিকেট ব্যবসামাত্র এবং সেই ব্যবসায় সবচেয়ে লাভজনক পণ্য টি-টোয়েন্টি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়ে লাভ তুলে ওয়ানডে আর টেস্ট ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেন এত দিন এই খেলাগুলো মরে ছিল!
মজার ব্যাপার, ক্রিকেটে এই ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়ে। ২০০৭ সালে জিটিভির মালিক সুভাস চন্দ্র টিভি-স্বত্ব না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে ভারতে আইসিএল চালু করলেন। কপিল দেবের মতো গ্রেটকেও সঙ্গে পেলেন। ‘শুদ্ধবাদী’রা ওটাকে বিদ্রোহী ক্রিকেট বলে গাল দিলেন। আইসিএলে যিনি যান, আসল ক্রিকেট থেকে তাঁর নাম কাটা। এ নিয়ে কয়েকটা বছর সে কি হইচই! আইসিএলে খেলাদের পারলে মাটিতে পুঁতে ফেলে সবাই। আইসিএল যাঁরা খেলেন, যাঁরা খেলান, সবাই খারাপ। অচ্ছুত। বিসিসিআই যতভাবে পারে এর পথ আটকাল। পানিতে নেমে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ জেতে কেবল টারজান...সুভাস চন্দ্র-কপিল দেবরা না। কোনো রকমে দুই মৌসুম হয়ে আইসিএল বন্ধ।
সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে তত দিনে। বিসিসিআই আইসিএল মেনে নিতে পারেনি। তবে এর বিষটা নিল। আইসিএল বন্ধ, তাতে কি? টি-টোয়েন্টির ফ্যাশন ঠিকই আছে এবং সেটা এখন আইপিএলের গায়ে ঝকমক করছে।
ভারতে আইপিএলের দরজা খুলে দিয়েছিল আইসিএল। বাংলাদেশের নতুন লোলিত মোদিরা যে এখন বিপিএল-বিপিএল করে গলা ফাটাচ্ছেন, সেটার জন্মও তেমনি এক ‘সিএল’, মানে পিসিএল থেকে। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট পিসিএল (পোর্ট সিটি ক্রিকেট লিগ) জোয়ার উঠল। স্থানীয় ক্রিকেটকে জাগিয়ে তুলতেই নাকি ওই আয়োজন। বিসিবি কিছু বুঝতে না বুঝতেই প্রথম আসর শেষ। পরেরবার মাঠসংকটের অজুহাতে স্থানীয় ক্রিকেট চাঙ্গা করার টুর্নামেন্ট হয়ে গেল শারজা প্রবাসী। আহা! ক্রিকেট তো নয়, যেন প্রমোদবিহার! বিসিবি আর ক্রীড়াঙ্গনের কেউকেটারা পিসিএলের পয়সায় শারজায় গেলেন, থাকলেন, খেলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট টাকার গন্ধ পেল। চিয়ারলিডার দেখল। টি-টোয়েন্টির ‘উ লা লা...’ শুনল।
দুই-দুইটা পিসিএলের রমরমা আয়োজন চিন্তায় ফেলে দিল বিসিবিকে। শারজা ঘুরে এসে বোর্ড-কর্তাদের মনে হতে লাগল, কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো কিছু একটা চাই। পিসিএল-টিসিএল বাদ দিয়ে যেন সবাই সেটাতেই বুঁদ হয়। বিপিএলের জন্মও এভাবেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়ে। তবে বিসিবি চিন্তার বাস্তবায়নে যথারীতি একটু দেরি করল। পিসিএল ঠেকাতে বিপিএলের কথা বোর্ড কর্মকর্তাদের মুখে প্রথম শোনা গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। তা নিজেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতাটুকু থাকা খারাপ নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় জিততে গিয়ে শত্রু-মিত্রর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়াটা কি শোভন? আসলে প্রতিযোগিতা তো নয়, এই দ্রবীভূতকরণটা হচ্ছে টাকা নামক প্রভাবকের গুণে।
ভারতের আইসিএল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিপিএল পর্যন্ত আসতে আসতে ক্রিকেট টাকা-ডলারের অনেক গন্ধ শুঁকেছে। অনেক ভেদাভেদ ভুলে গেছে। বাংলাদেশের ১৪ খেলোয়াড় যখন আইসিএলে যাওয়ার ‘বিদ্রোহ’ করল, বিসিবি কর্মকর্তারা প্রতিদিনই মনে মনে এক বাঙালি ভারতীয়র কুশপুত্তলিকা দাহ করতেন। তাঁর নাম কৌস্তভ লাহিড়ী, কাস্টি লাহিড়ী নামেই বেশি পরিচিত। আইসিএলে বাংলাদেশের দল ঢাকা ওয়ারিয়র্সের ম্যানেজার ছিলেন, একই সঙ্গে খেলোয়াড়দের এজেন্টও। বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটার ‘ভাগিয়ে’ নেওয়ার কাজটা লাহিড়ীর, সেটা জানার পর সকাল-সন্ধ্যা তাঁর মুণ্ডুপাত করতেন বোর্ড কর্মকর্তারা। তখন অবশ্য এই বোর্ড ছিল না, ছিল তত্ত্বাবধায়ক বোর্ড। তবে এখনকার বিপিএলের একজন শীর্ষ কর্তা ওই বোর্ডেও ছিলেন।
কিন্তু ক্রিকেট যে বদলে গেছে! এটা এখন যত না ব্যাট-বলের, তার চেয়ে বেশি টাকার খেলা। এর স্লোগান ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ হওয়া উচিত। টাকা বদলে দেয় সব। কাস্টি লাহিড়ীকে জাতীয় শত্রুর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সেই বিসিবি কর্মকর্তারাই এখন সকাল-সন্ধ্যা পার্টি-মিটিং করছেন তাঁর সঙ্গে। না করে উপায় কি? লাহিড়ী বাবু যে এবার অন্য উপায়েও বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঢুকে গেছেন! বিপিএলের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ভারতের গেম অন স্পোর্টসের অন্যতম পরিচালক তিনি। বিপিএলের নিলামে তাঁকে দেখে এক আইকন খেলোয়াড় যতই বিস্মিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘এই লোক এখানে কেন’; ‘শত্রু’ থেকে ‘বন্ধু’ হয়ে তাঁরাই এখন ‘আলোর পথ’ দেখাচ্ছেন ক্রিকেটকে।
তা ‘শত্রু’র সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’টা কেমন উপভোগ্য? কয়েক দিন আগে এই প্রশ্নে বিব্রত হয়েছিলেন এক বোর্ড পরিচালক। তবে আশ্বস্ত করলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষতি হবে, এমন কিছু না করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছি আমরা তাদের কাছ থেকে।’ হাসি পেল। প্রতিশ্রুতি নেওয়ার ব্যাপারটাই তো আসে আস্থার সংকট থেকে!
ভালো কথা, এসব নিয়ে বিপিএলের নিলামের দিন লাহিড়ীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও লাভ হয়নি। পরিচয়পর্বের শুরুতে ভদ্রলোক বাংলাদেশে ক্রিকেট-বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে ছোট একটা বক্তৃতা শুরু করলেন। ইকোনমিকস, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং সবই তাতে থাকল। থাকল না কেবল ক্রিকেট! তাও ভালো, বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে সাংবাদিকমুক্ত করে নিয়ে গেলেন বিপিএল-প্রধান গাজী আশরাফ হোসেন।
কাস্টি লাহিড়ীদের দোষ নেই। তাঁরা ব্যবসায়ী। তাঁদের কাছে ‘ক্রিকেট ইজ আ বিজনেস’। ব্যবসা তাঁরা করবেনই। আইসিএলের খেলোয়াড় ‘ছিনতাই’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাময়িক ক্ষতি করলেও ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্যায় কিছু ছিল না। এবারও যে সেই ‘শত্রু’ই (বিসিবি তখন তাকে তাই ভাবত) বন্ধুবেশে বিপিএল-ব্যবসা করতে এলেন, তাতেও দোষ নেই। ক্রিকেট বেচে নিজেরা কামাবেন, বাংলাদেশকেও হয়তো কিছু দেবেন। ব্যবসা তো এমনই হয়। তাতে ক্রিকেটের বারোটা বাজলেও থোড়াই কেয়ার!
বেচারা ক্রিকেটের দশা হয়ে গেল সেই হাতির মতো। নাকি হাতির চেয়েও খারাপ! হাতি তো কখনো কলাগাছ, কখনো কুলো হয়েছিল আসল অন্ধদের পাল্লায় পড়ে। সেই অন্ধদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু ক্রিকেট পড়েছে ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’দের চক্করে। এই ‘অন্ধ’রা দেখেও দেখে না, বুঝেও বোঝে না। তবে ভালো করেই জানে ক্রিকেট সবার আগে একটা খেলা।
সেই জানাটা তাঁরা ভুলে থাকতে চাইছেন। টক শো, সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বলছেন, ক্রিকেট মানে এখন অর্থনীতি। চাহিদা আর জোগানের নিক্তিতে ওঠানামা তার জনপ্রিয়তা, টিকে থাকা। চাহিদা যেটার, জোগান দাও সেটা। টি-টোয়েন্টির ঢেউয়ে ভাসিয়ে দাও ক্রিকেট। লাভের ওপর সোয়া সের তোলো। তাদের কাছে ক্রিকেট ব্যবসামাত্র এবং সেই ব্যবসায় সবচেয়ে লাভজনক পণ্য টি-টোয়েন্টি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট দিয়ে লাভ তুলে ওয়ানডে আর টেস্ট ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যেন এত দিন এই খেলাগুলো মরে ছিল!
মজার ব্যাপার, ক্রিকেটে এই ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়ে। ২০০৭ সালে জিটিভির মালিক সুভাস চন্দ্র টিভি-স্বত্ব না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে ভারতে আইসিএল চালু করলেন। কপিল দেবের মতো গ্রেটকেও সঙ্গে পেলেন। ‘শুদ্ধবাদী’রা ওটাকে বিদ্রোহী ক্রিকেট বলে গাল দিলেন। আইসিএলে যিনি যান, আসল ক্রিকেট থেকে তাঁর নাম কাটা। এ নিয়ে কয়েকটা বছর সে কি হইচই! আইসিএলে খেলাদের পারলে মাটিতে পুঁতে ফেলে সবাই। আইসিএল যাঁরা খেলেন, যাঁরা খেলান, সবাই খারাপ। অচ্ছুত। বিসিসিআই যতভাবে পারে এর পথ আটকাল। পানিতে নেমে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ জেতে কেবল টারজান...সুভাস চন্দ্র-কপিল দেবরা না। কোনো রকমে দুই মৌসুম হয়ে আইসিএল বন্ধ।
সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে তত দিনে। বিসিসিআই আইসিএল মেনে নিতে পারেনি। তবে এর বিষটা নিল। আইসিএল বন্ধ, তাতে কি? টি-টোয়েন্টির ফ্যাশন ঠিকই আছে এবং সেটা এখন আইপিএলের গায়ে ঝকমক করছে।
ভারতে আইপিএলের দরজা খুলে দিয়েছিল আইসিএল। বাংলাদেশের নতুন লোলিত মোদিরা যে এখন বিপিএল-বিপিএল করে গলা ফাটাচ্ছেন, সেটার জন্মও তেমনি এক ‘সিএল’, মানে পিসিএল থেকে। ২০০৯ সালে চট্টগ্রামে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট পিসিএল (পোর্ট সিটি ক্রিকেট লিগ) জোয়ার উঠল। স্থানীয় ক্রিকেটকে জাগিয়ে তুলতেই নাকি ওই আয়োজন। বিসিবি কিছু বুঝতে না বুঝতেই প্রথম আসর শেষ। পরেরবার মাঠসংকটের অজুহাতে স্থানীয় ক্রিকেট চাঙ্গা করার টুর্নামেন্ট হয়ে গেল শারজা প্রবাসী। আহা! ক্রিকেট তো নয়, যেন প্রমোদবিহার! বিসিবি আর ক্রীড়াঙ্গনের কেউকেটারা পিসিএলের পয়সায় শারজায় গেলেন, থাকলেন, খেলেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট টাকার গন্ধ পেল। চিয়ারলিডার দেখল। টি-টোয়েন্টির ‘উ লা লা...’ শুনল।
দুই-দুইটা পিসিএলের রমরমা আয়োজন চিন্তায় ফেলে দিল বিসিবিকে। শারজা ঘুরে এসে বোর্ড-কর্তাদের মনে হতে লাগল, কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো কিছু একটা চাই। পিসিএল-টিসিএল বাদ দিয়ে যেন সবাই সেটাতেই বুঁদ হয়। বিপিএলের জন্মও এভাবেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে গিয়ে। তবে বিসিবি চিন্তার বাস্তবায়নে যথারীতি একটু দেরি করল। পিসিএল ঠেকাতে বিপিএলের কথা বোর্ড কর্মকর্তাদের মুখে প্রথম শোনা গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। তা নিজেদের মধ্যে এই প্রতিযোগিতাটুকু থাকা খারাপ নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় জিততে গিয়ে শত্রু-মিত্রর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়াটা কি শোভন? আসলে প্রতিযোগিতা তো নয়, এই দ্রবীভূতকরণটা হচ্ছে টাকা নামক প্রভাবকের গুণে।
ভারতের আইসিএল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিপিএল পর্যন্ত আসতে আসতে ক্রিকেট টাকা-ডলারের অনেক গন্ধ শুঁকেছে। অনেক ভেদাভেদ ভুলে গেছে। বাংলাদেশের ১৪ খেলোয়াড় যখন আইসিএলে যাওয়ার ‘বিদ্রোহ’ করল, বিসিবি কর্মকর্তারা প্রতিদিনই মনে মনে এক বাঙালি ভারতীয়র কুশপুত্তলিকা দাহ করতেন। তাঁর নাম কৌস্তভ লাহিড়ী, কাস্টি লাহিড়ী নামেই বেশি পরিচিত। আইসিএলে বাংলাদেশের দল ঢাকা ওয়ারিয়র্সের ম্যানেজার ছিলেন, একই সঙ্গে খেলোয়াড়দের এজেন্টও। বাংলাদেশ থেকে ক্রিকেটার ‘ভাগিয়ে’ নেওয়ার কাজটা লাহিড়ীর, সেটা জানার পর সকাল-সন্ধ্যা তাঁর মুণ্ডুপাত করতেন বোর্ড কর্মকর্তারা। তখন অবশ্য এই বোর্ড ছিল না, ছিল তত্ত্বাবধায়ক বোর্ড। তবে এখনকার বিপিএলের একজন শীর্ষ কর্তা ওই বোর্ডেও ছিলেন।
কিন্তু ক্রিকেট যে বদলে গেছে! এটা এখন যত না ব্যাট-বলের, তার চেয়ে বেশি টাকার খেলা। এর স্লোগান ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ হওয়া উচিত। টাকা বদলে দেয় সব। কাস্টি লাহিড়ীকে জাতীয় শত্রুর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সেই বিসিবি কর্মকর্তারাই এখন সকাল-সন্ধ্যা পার্টি-মিটিং করছেন তাঁর সঙ্গে। না করে উপায় কি? লাহিড়ী বাবু যে এবার অন্য উপায়েও বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঢুকে গেছেন! বিপিএলের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ভারতের গেম অন স্পোর্টসের অন্যতম পরিচালক তিনি। বিপিএলের নিলামে তাঁকে দেখে এক আইকন খেলোয়াড় যতই বিস্মিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘এই লোক এখানে কেন’; ‘শত্রু’ থেকে ‘বন্ধু’ হয়ে তাঁরাই এখন ‘আলোর পথ’ দেখাচ্ছেন ক্রিকেটকে।
তা ‘শত্রু’র সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’টা কেমন উপভোগ্য? কয়েক দিন আগে এই প্রশ্নে বিব্রত হয়েছিলেন এক বোর্ড পরিচালক। তবে আশ্বস্ত করলেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষতি হবে, এমন কিছু না করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছি আমরা তাদের কাছ থেকে।’ হাসি পেল। প্রতিশ্রুতি নেওয়ার ব্যাপারটাই তো আসে আস্থার সংকট থেকে!
ভালো কথা, এসব নিয়ে বিপিএলের নিলামের দিন লাহিড়ীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েও লাভ হয়নি। পরিচয়পর্বের শুরুতে ভদ্রলোক বাংলাদেশে ক্রিকেট-বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে ছোট একটা বক্তৃতা শুরু করলেন। ইকোনমিকস, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং সবই তাতে থাকল। থাকল না কেবল ক্রিকেট! তাও ভালো, বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে সাংবাদিকমুক্ত করে নিয়ে গেলেন বিপিএল-প্রধান গাজী আশরাফ হোসেন।
কাস্টি লাহিড়ীদের দোষ নেই। তাঁরা ব্যবসায়ী। তাঁদের কাছে ‘ক্রিকেট ইজ আ বিজনেস’। ব্যবসা তাঁরা করবেনই। আইসিএলের খেলোয়াড় ‘ছিনতাই’ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাময়িক ক্ষতি করলেও ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্যায় কিছু ছিল না। এবারও যে সেই ‘শত্রু’ই (বিসিবি তখন তাকে তাই ভাবত) বন্ধুবেশে বিপিএল-ব্যবসা করতে এলেন, তাতেও দোষ নেই। ক্রিকেট বেচে নিজেরা কামাবেন, বাংলাদেশকেও হয়তো কিছু দেবেন। ব্যবসা তো এমনই হয়। তাতে ক্রিকেটের বারোটা বাজলেও থোড়াই কেয়ার!
No comments