উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(চার) by হুমায়ূন আহমেদ

দ্মকে নিয়ে রওনা হয়েছি। পদ্ম বলল, আমার স্যান্ডেল কেনার কোনো দরকার নেই, আপনার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা বলা দরকার।
আমি বললাম, বলো।
পদ্ম বলল, একগাদা মানুষের মধ্যে জরুরি কথা কীভাবে বলব! আপনার কাছে যদি টাকা থাকে, কোনো একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে যাই, চলুন।
আমার কাছে কুড়ি টাকার একটা নোট আছে। এই টাকা নিয়ে চায়নিজ রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায় না।
আপনার ভাইয়ার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসুন। আমার টম ইয়াম স্যুপ খেতে ইচ্ছে করছে।
ভাইয়ার কাছে টাকা থাকে না। রহিমার মায়ের কাছে ধার চেয়ে দেখতে পারি। মাঝে মাঝে সে আমাকে টাকা ধার দেয়।
রহিমার মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে না। চলুন, পার্কে যাই। আপনার ভাই যেমন আশ্চর্য মানুষ, আপনিও আশ্চর্য মানুষ।
আমরা রমনা পার্কে ঢুকে গেছি। সেখানে বাজারের চেয়েও ভিড় বেশি। মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গা পাওয়া গেল। কেয়াগাছের ঝাড়। সামনে ডাস্টবিন। ডাস্টবিন থেকে বিকট গন্ধ আসছে। এই কারণেই বোধহয় লোকজন এদিকে আসে না।
পদ্ম, কী বলবে বলো।
পদ্ম বলল, আপনার সম্বন্ধে আমার মায়ের কী ধারণা, জানতে চান?
আমি যে জানতে চাই, তা না, তুমি বলতে চাইলে বলো।
পদ্ম বলল, আমার মায়ের ধারণা, আপনি চালবাজ বেকুব।
এটাই কি তোমার জরুরি কথা?
পদ্ম বলল, না। জরুরি কথাটা হচ্ছে, ট্রাক ড্রাইভার সালামতের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। তার সঙ্গে ছয় দিন একসঙ্গে ছিলাম। আমি তার কাছে ফিরে যেতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
কথা শেষ করে পদ্ম ফিক করে হাসল। তাকে আনন্দিত ও উৎফুল্ল মনে হলো।
আমি বললাম, পদ্ম! কোনো ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়নি। এই গল্পটা তুমি বানিয়ে বলছ। তোমার মায়ের ধারণা হয়েছে, এ রকম একটা গল্প শুনলে আমি আর তোমার ধারেকাছে ঘেঁষব না। তুমি আমার কাছ থেকে নিরাপদ থাকবে। গল্পটা তোমার মা তোমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন।
পদ্ম হাসিমুখে বলল, তাই বুঝি?
আমি বললাম, উনি তোমাকে একা ছাড়ার মহিলা না, আমাকে তোমার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন, যাতে তুমি গল্পটা বলতে পারো।
পদ্ম বলল, কোন জায়গায় আপনি নিয়ে এসেছেন? বিশ্রী গন্ধ! চলুন, ভালো কোনো জায়গায় বসি। আইসক্রিম খাব। আইসক্রিমের টাকা আমি দেব। আমার কাছে টাকা আছে। সালামত সাহেব আমাকে প্রতি মাসে পনেরো শ টাকা হাতখরচ দেন। এ মাসেরটা অবশ্যি পাইনি।
পদ্মকে নিয়ে বাসায় ফিরছি। দুজন একই রিকশায়। পদ্মর হাতে কোন আইসক্রিম। সে আগ্রহ নিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে। পদ্ম বলল, আমি এই পর্যন্ত রিকশার সিট থেকে কতবার পড়েছি জানেন?
আমি বললাম, জানি না।
জানতে চান?
না। জেনে আমার লাভ কী?
লাভ আছে। আমাকে নিয়ে যখন রিকশায় উঠবেন তখন সাবধান থাকবেন। আমাকে ধরে রাখবেন। অন্যের রূপবতী স্ত্রীর হাত ধরে থাকার মধ্যে আনন্দ আছে।
তুমি রিকশার হুড শক্ত করে ধরে বসে থাকো। তাহলেই হয়।
পদ্ম বলল, ছোটবেলায় একবার রিকশায় হুড ধরে বসেছিলাম। হঠাৎ ধুম করে হুড পড়ে গেল। আঙুলে প্রচণ্ড ব্যথা পেলাম। একটা আঙুল ভেঙে গিয়েছিল। এর পর থেকে আমি রিকশার হুড ধরতে পারি না। রিকশায় উঠলেই ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে যায়।
তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তোমার ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
পদ্ম বলল, আপনি সঙ্গে আছেন, তাই ভয় পাচ্ছি না। যখন আমি পড়ে যাব তখন নিশ্চয় আপনি আমাকে ধরবেন। ধরবেন না?
পদ্ম কথা শেষ করার পরপরই রিকশা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল। প্রথমে পড়ল পাটাতনে, সেখান থেকে রাস্তায়। তার বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে রিকশার চাকা চলে গেল। আমি রাস্তা থেকে তাকে টেনে তুললাম। পদ্ম বলল, দেখুন, আইসক্রিম ঠিক আছে। আমি ভেবেছিলাম আইসক্রিম হাত থেকে ছিটকে পড়বে।
ব্যথা পেয়েছ?
পেয়েছি। পায়ের ওপর দিয়ে রিকশা চলে গেল, রিকশায় আপনি বসা, ব্যথা পাব না! তবে ব্যথার চেয়ে মজা বেশি পেয়েছি।
মজা পাওয়ার কী আছে?
মজা পাওয়ার কী আছে সেটা আরেক দিন আপনাকে বলব।
পদ্ম ব্যথা ভালোই পেয়েছে। সে ঘরে ঢুকল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পদ্মর মা আতঙ্কিত গলায় বলছেন, তোর কী হয়েছে?
পদ্ম বলল, ট্রাকড্রাইভারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, এটা ওনাকে বললাম। উনি রেগে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে রিকশা থেকে ফেলে দিলেন। মা, তুমি বলেছ না আলাদা আলাদা রিকশা নিতে? আমি একটা রিকশা নিলাম, উনি লাফ দিয়ে সেই রিকশায় উঠলেন। রাস্তায় তো আমি এই নিয়ে হইচই করতে পারি না।
পদ্মর মা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকিয়ে আছি পদ্মর দিকে। পদ্মর চেহারা স্বাভাবিক। এতই স্বাভাবিক যে একপর্যায়ে আমার মনে হলো, আমি হয়তো সত্যিই পদ্মকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলেছি।
তুমি আমার মেয়েকে রিকশা থেকে ফেলে দিয়েছ?
আমি বললাম, হুঁ।
তোমার এত বড় সাহস?
আমি বললাম, আমাদের দুজনের মধ্যে আরগুমেন্ট হচ্ছিল। পদ্ম বলছে, পৃথিবীতে ডিম আগে এসেছে। ডিম থেকে মুরগি। আমি বলছি, প্রথম এসেছে মুরগি, তারপর ডিম। তর্কের এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হলো। তারপর দুর্ঘটনা।
এসিড-মাতা মেয়ের দিকে তাকালেন। পদ্ম মুখ গম্ভীর করে বলল, তর্কে উনি হেরে গিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছেন। এই বিষয়ে তোমাকে কিছু করতে হবে না, মা। আমি শোধ নেব। আমার স্যান্ডেল এখনো কেনা হয়নি। একদিন স্যান্ডেল কিনতে ওনাকে নিয়ে যাব। তারপর ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেব।
এসিড-মাতা মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। তাদের ঘরের দরজা খোলা, সেখানে বারো-তেরো বছরের নির্বোধ চেহারার এক বালিকাকে ঝাঁটা হাতে দেখা যাচ্ছে।
বালিকার নাম মরি। মরিয়ম থেকে মরি। কাজের মেয়েদের দীর্ঘ নামে ডাকা সময়ের অপচয় বলেই মরিয়ম হয়েছে মরি।
মরি পদ্মদের বাড়িতে আগে কাজ করত, এখন আবার যুক্ত হয়েছে। পদ্মর মা তাঁর সংসার গুছিয়ে নিতে শুরু করেছেন। ভ্যানে করে একদিন একটা নতুন ফ্রিজ চলে এল। মিস্ত্রি এসে ফ্রিজ পদ্মদের শোবার ঘরে সেট করে দিল। পদ্ম আমাকে এসে বলল, আপনার ঠান্ডা পানি খেতে ইচ্ছা হলে আমাকে বলবেন। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি খেতে দেব।
আচ্ছা বলব।
আমি যে খুব ভালো রাঁধতে পারি তা জানেন?
না।
আমাদের নিজেদের রান্নাঘর হোক, আপনাকে রেঁধে খাওয়াব।
তোমাদের আলাদা রান্নাঘর হচ্ছে নাকি?
মা বলছে, হবে। যেদিন রান্নাঘর প্রথম চালু হবে, সেদিনই আপনাকে স্পেশাল একটা আইটেম খাওয়াব। আইটেমটার আমি নাম দিয়েছি ‘সালামত ডিলাইট’। ও এই আইটেম খুব পছন্দ করে বলে ওর নামে নাম। আপনিও যদি পছন্দ করেন তাহলে নাম বদলে দেব ‘মনজু সালামত ডাবল ডিলাইট’। নাম সুন্দর না?
হুঁ।
আমার লাগবে বাংলাদেশের মাশরুম। এই মাশরুম চাক চাক করে কেটে গোলমরিচ-লবণ দিয়ে বেসনে চুবিয়ে ডুবোতেলে ভাজা হবে।
পদ্ম মিটমিট করে তাকাচ্ছে। তার চোখের ভাষা পড়তে পারছি না। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে। পদ্মর চোখের ভাষা পড়াটা জরুরি কেন বুঝতে পারছি না।
বাবা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। পারিবারিক জরুরি মিটিং না বলে মনে হচ্ছে। পারিবারিক মিটিংয়ে ভাইয়া উপস্থিত থাকত। তাকে ডাকা হয়নি। এমনও হতে পারে যে বাবা তাকে পরিবার থেকে বের করে দিয়েছেন।
বাবা বললেন, পদ্মর মা একটা নতুন ফ্রিজ কিনেছেন বলে শুনলাম।
আমি বললাম, হুঁ। আট সিএফটির ফ্রিজ। লাল রং। স্যামসাং কোম্পানি।
এত বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছি না। অল্প কথায় মনের ভাব প্রকাশে অভ্যাস করো। হড়বড় করে দুনিয়ার কথা বলার কিছু নেই।
জি, আচ্ছা।
ওই মহিলা কি স্থায়ীভাবে থাকার পরিকল্পনা করছে?
জি। তাদের আলাদা কাজের মেয়ে চলে এসেছে। নাম মরি। মরিয়ম থেকে মরি। শুনেছি তাদের আলাদা রান্নাঘরও হবে।
তোমার কি মনে হয় না যে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন?
কী ব্যবস্থা?
ব্যবস্থা একটাই—ঘাড় ধরে মা-মেয়েকে বের করে দেওয়া। তবে আমরা সিভিল সোসাইটিতে বাস করি। ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব না।
আমি বললাম, সম্ভব হলেও করা ঠিক হবে না। পদ্মর মায়ের কাছে নীল রঙের বোতলে ভর্তি এসিড আছে। এসিড ছুড়ে একটা কাণ্ড করে বসতে পারেন।
এসিডভর্তি বোতল?
জি, বাবা।
বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তোমার ভাইয়াকে বলো একটা ব্যবস্থা করতে। যে কাঁটা বিঁধিয়েছে, তারই দায়িত্ব কাঁটা বের করা। তোমার ভাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলাম। সে যাচ্ছে না কেন?
অমাবস্যার জন্যে অপেক্ষা করছে। প্রথম অমাবস্যাতেই ঘর ছাড়বে। গৌতম বুদ্ধ পূর্ণিমাতে গৃহত্যাগ করেছিলেন, ভাইয়া করবে অমাবস্যায়। উনি নতুন এক ধর্ম প্রচার করবেন। ধর্মের নাম রগট ধর্ম। তিনটি মূলনীতির ওপর এই ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে। নীতিগুলো বলব, বাবা?
বাবা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাবার চোখের ভাষাও আমি পড়তে পারছি না। (চলবে)
=============================
উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(তিন)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(দুই)  উপন্যাস- আমরা কেউ বাসায় নেই-(এক)  গল্প- পৃথিবীর দীর্ঘতম হাত  কালা পানির অনশন  লেখক না হলে গোয়েন্দা হতাম  অভিবাসী মানুষদের উপন্যাস  আগুনের পরশমণি  প্রেমাংশুর রক্ত চাই  গল্প- কোথায় তুমি  কবিতা বাতাসে অক্সিজেন ছড়ায়  সত্যজিৎ আমার গুরু ছিলেন  গল্প- দৌড়  বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচার  যেভাবে মায়ের মন জয় করল বাবা  মানিক পীরের গান  গল্প- চুপি চুপি বাঁশি বাজে  গল্প- বিধুহীন  গল্প- অসমাপ্ত চুম্বনের ১৯ বছর পর...  গল্প- বসন্ত বিলাপ  খোয়াবের প্রতিলিপি  গল্প- জিঞ্জির ফেরা  দুর্লভ সময়ের হলফনামা  ইচ্ছা ছিল কবি হওয়ার  আমার গ্রন্থাগার  সোনার কমলার খোঁজে  রূপবান ঢাকার রক্তক্ষরণ  নারী জীবনের অচলায়তন  'ত্যাগের' মূল্যায়ন ও মুক্তকণ্ঠ তারুণ্য  মূল সংবিধান সংরক্ষণে সরকারের ইউটার্ন  তুরস্কে জেনারেলদের পদত্যাগ কেন?  ছোট দলগুলো ফুরফুরে মেজাজে!  কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা  গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  একাত্তরের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি  রশীদ করীমে'র সাক্ষাৎকার- 'মনে পড়ে বন্ধুদের'  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ  ফয়েজ আহমেদঃ স্মৃতিতে চিঠিতে  অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারঃ উপন্যাসের জগতের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই  ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা  গল্প- চাল ডাল লবণ ও তেল


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ


এই উপন্যাস'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.