পানির দাম বাড়ানো কেন জরুরি by গোলাম মোস্তফা
ঢাকা ওয়াসা বোর্ড ঢাকাবাসীর জন্য সরবরাহকৃত পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত এই বৃদ্ধির হার যেহেতু বোর্ডের ক্ষমতাসীমার চেয়ে একটু বেশি, তাই তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ২০১১ সালের ৫ মার্চের দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদকীয় কলামে প্রস্তাবিত এই মূল্যবৃদ্ধির কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির আগে ওয়াসাকে তার সেবার মানোন্নয়নের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানির চাহিদা অনুপাতে সরবরাহের পরিমাণ ও গুণগত মান নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ড বাস্তবভিত্তিক সমালোচনা ও পরামর্শকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এ ধরনের সম্পাদকীয় গুরুত্ব বহন করে। এটা সবার জানা, মহানগরে পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। সেবাটি যেহেতু প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকা মহানগরের প্রত্যেক মানুষ এর মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবিত হন, তাই সেটাকে মাথায় রেখেই ঢাকা ওয়াসা এবারের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি তৈরি করেছে এবং সে সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোলটেবিল বৈঠকে যে বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো, ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সংগতি রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদানুযায়ী বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ঢাকা ওয়াসার করণীয় নির্ধারণ।
বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিং না থাকলে (যেমন শীতকালে) ঢাকা ওয়াসা ২২০ কোটি লিটার দৈনিক চাহিদার প্রায় পুরোটাই উৎপাদন করতে পারে। সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০১২ সালের মধ্যেই লোডশেডিং থেকে ঢাকাবাসী মুক্ত হবে। কিন্তু তখন সমস্যা দেখা দেবে ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতা নিয়ে। আর তা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রয়োজন ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা। বর্তমানে পানির গুণগত মান সম্পর্কে যেসব অভিযোগ আছে, তা থেকেও ২০১২ সালের মধ্যে বহুলাংশে মুক্ত হওয়া যাবে সায়েদাবাদ দ্বিতীয় ফেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বর্তমানে চালু থাকা এডিবির সাহায্যপুষ্ট ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অধীনে দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার পুরোনো পাইপলাইন পরিবর্তনের কাজ শেষ হলে। সে ক্ষেত্রে পানির সরবরাহ-ব্যবস্থায় ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে ঢাকা ওয়াসার প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে পরিকল্পিত পাগলা ও খিলক্ষেতে যথাক্রমে ৪৫ কোটি ও ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ।
বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী পাগলায় শোধনের জন্য পানি আসবে পদ্মা নদী থেকে আর খিলক্ষেতে আসবে মেঘনা নদী থেকে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে বর্তমান বাজারমূল্যেই খরচ পড়বে কমপক্ষে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসার বিবেচনায় রয়েছে সায়েদাবাদ ফেজ-৩ প্রকল্প, যার উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার। এই প্রকল্প বাস্তবায়নেও খরচ পড়বে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হবে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। প্রশ্ন হলো, এই বিশাল বিনিয়োগের অর্থ আসবে কোথা থেকে?
এ অবস্থায় ঢাকা ওয়াসাকে অবশ্যই বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। তা হলো, নিজস্ব সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদেশি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমানো। আর তা করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন বাণিজ্যিকভাবে লাভবান সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসাকে দাঁড় করানো। এই কাজটি করতে গেলে একদিকে যেমন প্রয়োজন দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনা রোধ করে সিস্টেম লস সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা; অন্যদিকে পানির উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা।
হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি হাজার লিটার পানির মূল্য একবারে নয় টাকা ৭৫ পয়সা করলেও ছয় সদস্যের একটি পরিবারে মাসের খরচ বাড়ে ১১৩ টাকা (ভ্যাটসহ)। অর্ধেক অর্ধেক করে দুবারে দাম বাড়ালে প্রতিবার মাসের খরচ বাড়বে মাত্র ৫৬ টাকা ৫০ পয়সা। একটি পরিবারের জন্য এই বৃদ্ধি বড় কিছু নয়। অথচ বাসায় এক দিন পানি না থাকাটা অনেক বেশি কষ্টদায়ক। একটি পরিবার যদি প্রতি মাসে পানি বাবদ ১১৩ টাকা বেশি খরচ করে, তাহলে যা ঘটবে তা হলো:
সরকার বা দাতা সংস্থার দিকে ওয়াসাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে না। অর্থাৎ, ঢাকাবাসীর চাহিদা পূরণে ওয়াসা নিজেই নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।
ঢাকা ওয়াসা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
ঢাকাবাসীর সারা বছরের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ঢাকা ওয়াসা পূরণ করতে পারবে।
অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে যে ময়লা বা দুর্গন্ধযুক্ত পানির অভিযোগ পাওয়া যায়, তা থেকে ঢাকাবাসী নিষ্কৃতি পাবে।
সবশেষে বলতে চাই, ঢাকা ওয়াসা যে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়নে জনসাধারণের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এ ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। শুধু সমালোচনা করলে চলবে না; সমস্যার কারণ ও গভীরতা বুঝতে হবে এবং তা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ঢাকা মহানগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা: চেয়ারম্যান, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড।
ঢাকা ওয়াসা বোর্ড বাস্তবভিত্তিক সমালোচনা ও পরামর্শকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এ ধরনের সম্পাদকীয় গুরুত্ব বহন করে। এটা সবার জানা, মহানগরে পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। সেবাটি যেহেতু প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঢাকা মহানগরের প্রত্যেক মানুষ এর মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাবিত হন, তাই সেটাকে মাথায় রেখেই ঢাকা ওয়াসা এবারের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবটি তৈরি করেছে এবং সে সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
গোলটেবিল বৈঠকে যে বিষয়টির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো, ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সংগতি রেখে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চাহিদানুযায়ী বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে ঢাকা ওয়াসার করণীয় নির্ধারণ।
বর্তমানে বিদ্যুতের লোডশেডিং না থাকলে (যেমন শীতকালে) ঢাকা ওয়াসা ২২০ কোটি লিটার দৈনিক চাহিদার প্রায় পুরোটাই উৎপাদন করতে পারে। সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০১২ সালের মধ্যেই লোডশেডিং থেকে ঢাকাবাসী মুক্ত হবে। কিন্তু তখন সমস্যা দেখা দেবে ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতা নিয়ে। আর তা থেকে উত্তরণের জন্য ঢাকা ওয়াসার প্রয়োজন ভূ-উপরিস্থ পানি শোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা। বর্তমানে পানির গুণগত মান সম্পর্কে যেসব অভিযোগ আছে, তা থেকেও ২০১২ সালের মধ্যে বহুলাংশে মুক্ত হওয়া যাবে সায়েদাবাদ দ্বিতীয় ফেজ প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বর্তমানে চালু থাকা এডিবির সাহায্যপুষ্ট ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অধীনে দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার পুরোনো পাইপলাইন পরিবর্তনের কাজ শেষ হলে। সে ক্ষেত্রে পানির সরবরাহ-ব্যবস্থায় ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে ঢাকা ওয়াসার প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে পরিকল্পিত পাগলা ও খিলক্ষেতে যথাক্রমে ৪৫ কোটি ও ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পানি শোধনাগার নির্মাণ।
বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী পাগলায় শোধনের জন্য পানি আসবে পদ্মা নদী থেকে আর খিলক্ষেতে আসবে মেঘনা নদী থেকে। প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে বর্তমান বাজারমূল্যেই খরচ পড়বে কমপক্ষে সাত হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসার বিবেচনায় রয়েছে সায়েদাবাদ ফেজ-৩ প্রকল্প, যার উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার। এই প্রকল্প বাস্তবায়নেও খরচ পড়বে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হবে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। প্রশ্ন হলো, এই বিশাল বিনিয়োগের অর্থ আসবে কোথা থেকে?
এ অবস্থায় ঢাকা ওয়াসাকে অবশ্যই বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। তা হলো, নিজস্ব সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিদেশি দাতা সংস্থার ওপর নির্ভরতা কমানো। আর তা করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন বাণিজ্যিকভাবে লাভবান সংস্থা হিসেবে ঢাকা ওয়াসাকে দাঁড় করানো। এই কাজটি করতে গেলে একদিকে যেমন প্রয়োজন দুর্নীতি, অপচয়, অব্যবস্থাপনা রোধ করে সিস্টেম লস সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসা; অন্যদিকে পানির উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা।
হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি হাজার লিটার পানির মূল্য একবারে নয় টাকা ৭৫ পয়সা করলেও ছয় সদস্যের একটি পরিবারে মাসের খরচ বাড়ে ১১৩ টাকা (ভ্যাটসহ)। অর্ধেক অর্ধেক করে দুবারে দাম বাড়ালে প্রতিবার মাসের খরচ বাড়বে মাত্র ৫৬ টাকা ৫০ পয়সা। একটি পরিবারের জন্য এই বৃদ্ধি বড় কিছু নয়। অথচ বাসায় এক দিন পানি না থাকাটা অনেক বেশি কষ্টদায়ক। একটি পরিবার যদি প্রতি মাসে পানি বাবদ ১১৩ টাকা বেশি খরচ করে, তাহলে যা ঘটবে তা হলো:
সরকার বা দাতা সংস্থার দিকে ওয়াসাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে না। অর্থাৎ, ঢাকাবাসীর চাহিদা পূরণে ওয়াসা নিজেই নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে।
ঢাকা ওয়াসা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
ঢাকাবাসীর সারা বছরের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ঢাকা ওয়াসা পূরণ করতে পারবে।
অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে যে ময়লা বা দুর্গন্ধযুক্ত পানির অভিযোগ পাওয়া যায়, তা থেকে ঢাকাবাসী নিষ্কৃতি পাবে।
সবশেষে বলতে চাই, ঢাকা ওয়াসা যে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বাস্তবায়নে জনসাধারণের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এ ক্ষেত্রে অনেক কিছু করার আছে। শুধু সমালোচনা করলে চলবে না; সমস্যার কারণ ও গভীরতা বুঝতে হবে এবং তা সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ঢাকা মহানগর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা: চেয়ারম্যান, ঢাকা ওয়াসা বোর্ড।
No comments