সেই সব দিনরাত্রি by রুমানা নাহীদ সোবহান
ভোর হয় ঢাকা শহরে। কাজী হাউসেও ভোর হয়। কাজী হাউস নামের গাছগাছালিতে ভরা হলুদ বাড়িতেও রোদ এসে পড়ে। পাখি কিচিরমিচির করে। সারা রাত জাগা ‘হুতু’ নামের কুকুরটা ক্লান্ত হয়ে গাড়িবারান্দায় কুণ্ডলী পাকায়। সাদা বিড়ালটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে কার্নিশে পায়চারি শুরু করে। স্বর্ণচাঁপা গাছে বুলবুলি পাখি এসে বসতে না-বসতেই কাজী হাউসের পুরোনো খড়খড়িঅলা কাঠের জানালাগুলো খুলে দেন একজন ৫০ বছরের একই নিয়ম ধরে। তাঁর পদশব্দ কাজী হাউসের ঘুম ভাঙানি গান হিসেবে কাজ করে। তাই অ্যালার্ম ক্লকের কোনো দরকার নেই কাজী হাউসের বাসিন্দাদের। সবাই তাঁর পদশব্দে বুঝে যায়, কয়টা বাজে।দরজা-জানালা খুলে ৫০ বছরের নিয়মে তিনি তাঁর নিজ ঘরে আসেন। এসে বিছানার পাশে রাখা করলার রস খেলেন। চিবোলেন রসুনের কোয়া, বহু পুরোনো অভ্যাস। সেই অভ্যাস তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। সকাল থেকেই আসতে থাকে ফোন। জজ সাহেব আছেন? সোবহান সাহেব আছেন? বিচারপতি সোবহানের সঙ্গে কথা বলতে পারি? এতক্ষণ বিচারপতি কে এম সোবহানের দিনের সূচনা বর্ণিত হচ্ছিল—ফোন আসতে থাকে বিচারপতি সোবহানের কাছে, বিভিন্ন দরকারি ফোন। কারোর কোনো আবেদন-অনুরোধই তিনি ফেলতে পারেন না। ৮৩ বছর বয়সেও ব্যস্ত তিনি এবং সকাল-সন্ধ্যা সদাই তাঁর ব্যস্ততা।পড়ার টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গে আনাগোনা শুরু হতো বিভিন্ন ধরনের মানুষের। পেশাজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ ফেরিওয়ালা। সবার সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন। শুধু তা-ই নয়, সারা দিনই অনেক পরিচিত-অপরিচিত লোকের আনাগোনা। নিজের হাতে দরজা খুলে দিতেন। পেশাজীবী-সুশীল-সুধী সমাজের সঙ্গে চলত নানা রকম আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।সকাল থেকে কাজের ফাঁকে ঘড়ির কাঁটা যখন ১১টা পার হয়, তখন তাঁর সাময়িক বিরতি। চলে যান খাওয়ার ঘরে। তাঁর জন্য প্রস্তুত ‘১১টার চা’ চলত এই দুই কাপ ধূমায়িত র-চা, শুকনো টোস্ট বিস্কুট, ঢাকাই পনির। মাঝেমধ্যে পাড়ার ছোট্ট চা-ছাপড়ার শিঙাড়া। চা-বিরতির পর লেখালেখি বা কোনো সভা-সমাবেশে বা জরুরি কোনো কাজে বাইরে যাওয়া। বেলা দুইটার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজন। মধ্যাহ্নভোজনের পর ছিল মিনিট ১৫-২০-এর ঘুম।অপরাহ্ন ছিল বিচারপতি সোবহানের একটি প্রিয় সময়। বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যেই তিনি তৈরি বৈকালিক ভ্রমণের জন্য। এটিও তাঁর অতি পুরোনো অভ্যাসের একটি। মালিবাগের কাজী হাউস থেকে রমনা পার্ক, তারপর রমনা পার্কের ভেতর সবুজ-শ্যামলে দ্রুত হাঁটাহাঁটি। বয়স তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি হাঁটাহাঁটিতে। নিয়মিত হাঁটতেন, যেন কোনো গন্তব্যে পৌঁছানো ছিল তাঁর লক্ষ্য। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আবার সন্ধ্যাকালীন স্নান। স্নানের পর পরেন কড়কড়ে ইস্ত্রি করা পায়জামা-পাঞ্জাবি। সারা বছরের সন্ধ্যাকালীন পোশাক। শীতে কেবল এরপর একটি শাল। স্নানের পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে চা-পান। চা-পানও নির্দিষ্ট। দুই কাপ চা। মুড়ি বা চিঁড়ার সঙ্গে মটরশুঁটি ও বাদাম। চা-পানের পর সাড়ে সাতটায় বিবিসির বাংলা সংবাদ শুনে আবার পড়ার টেবিল।রাতের খাবারের পর চলত লেখালেখি ও পড়াশোনার কাজ। শেষ হয়ে আসত তাঁর দিবানিশির কাব্য। পরিবারের সব সদস্য ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পুরোনো কাঠের ঢাউস দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে যেতেন। এ তো ছিল তাঁর এই সব দিনরাত্রির কাহিনি। এই সব দিনরাত্রির মধ্যেও তিনি নিয়ম করে মনে রাখতেন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের জন্মদিন, বিয়ের দিন।
নিজের জন্মদিন সযতনে এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু বন্ধু ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মদিনের কথা ভুলতেন না। ভুলতেন না ৬ সেপ্টেম্বর নিজের বিবাহবার্ষিকীর কথা। ৪৮ বছর ধরে নিজের স্ত্রীকে এই দিনে চমৎকার সব শাড়ি উপহার দিতেন। একটি বারের জন্যও ভুল হয়নি তাঁর। ঈদে-উৎসবে-আনন্দে এই সামাজিকতায় তিনি নিয়মিত শরিক হতেন। ঈদে পরিবার-আত্মীয়স্বজনকে কাপড় দিতেন। সম্ভাষণে, সম্বোধনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। প্রথমেই তিনি সালাম দিতেন, হোক সে বয়সে ছোট বা বড়। জীবনের শেষ দিনও সালামের উত্তরে কুশল বিনিময়ে বলেছেন, ‘খুব ভালো আছি।’ ফুল আর সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল এক ধরনের প্রচণ্ড আগ্রহ। যেখানেই যেতেন ফুল, ফল আর সবজির চারা নিয়ে আসতেন। বরিশাল থেকে নিয়ে এলেন ঝুমকোলতা। রাজশাহী গেলেন, নিয়ে এলেন আমের চারা। ফুল ফুটত তাঁর কাজী হাউসে নিয়ম করেই।ঘড়ির কাঁটা আর জীবন ছিল যুগলবন্দী সময়ের। কোনো দিন হেরফের হয়নি তাঁর। কোথাও কোনো দিন তাঁকে নির্ধারিত সময়ের পর পৌঁছাতে দেখিনি। কথিত আছে, যে রাস্তা ধরে তিনি প্রতি বিকেলে হাঁটতে যেতেন, সেই রাস্তার ধারের দোকান ও বাড়ির লোকজন নিজেদের ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নিতেন।জীবনের অক্ষরেখা ঘুরে যাচ্ছিল নিয়ম করেই। প্রতিদিনের মতো ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরও তাঁর দিন শুরু হয়েছিল একই নিয়মে, একই ছকে। একই সময়ে দিনান্তে হাঁটতে যাওয়ার আগে পড়ার টেবিলে বর্ষশেষের সব সংবাদপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন। বাড়িতেও সেদিন বর্ষশেষ উপলক্ষে অতিথি সমাগমের কথা ছিল, কিন্তু সেই দিনের সন্ধ্যাটা আর প্রতিদিনের মতো হলো না। সেদিন হাঁটতে যাওয়ার পর তাঁর ৮৩ বছরের জীবনের শেষটা হিসাবের খাতার বাইরে চলে গেল। ছক গেল পাল্টে, সময় গেল থমকে, নিয়ম হলো অনিয়ম। তাঁর আর ঘরে ফেরা হলো না। বাংলাদেশের গোধূলিলগ্ন তাঁকে নিয়ে গেল সন্ধ্যাকাশে হাজার তারার পাশে আরেকটি তারা হয়ে জ্বলতে। জানি না, সেতু পারাপারের সময় তিনি আলোকরেখাকে বলেছিলেন কি না, ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ কিংবা দেখেছিলেন কি না, ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার।’
নিজের জন্মদিন সযতনে এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু বন্ধু ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের ৯ ফেব্রুয়ারি জন্মদিনের কথা ভুলতেন না। ভুলতেন না ৬ সেপ্টেম্বর নিজের বিবাহবার্ষিকীর কথা। ৪৮ বছর ধরে নিজের স্ত্রীকে এই দিনে চমৎকার সব শাড়ি উপহার দিতেন। একটি বারের জন্যও ভুল হয়নি তাঁর। ঈদে-উৎসবে-আনন্দে এই সামাজিকতায় তিনি নিয়মিত শরিক হতেন। ঈদে পরিবার-আত্মীয়স্বজনকে কাপড় দিতেন। সম্ভাষণে, সম্বোধনে তিনি ছিলেন অগ্রণী। প্রথমেই তিনি সালাম দিতেন, হোক সে বয়সে ছোট বা বড়। জীবনের শেষ দিনও সালামের উত্তরে কুশল বিনিময়ে বলেছেন, ‘খুব ভালো আছি।’ ফুল আর সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল এক ধরনের প্রচণ্ড আগ্রহ। যেখানেই যেতেন ফুল, ফল আর সবজির চারা নিয়ে আসতেন। বরিশাল থেকে নিয়ে এলেন ঝুমকোলতা। রাজশাহী গেলেন, নিয়ে এলেন আমের চারা। ফুল ফুটত তাঁর কাজী হাউসে নিয়ম করেই।ঘড়ির কাঁটা আর জীবন ছিল যুগলবন্দী সময়ের। কোনো দিন হেরফের হয়নি তাঁর। কোথাও কোনো দিন তাঁকে নির্ধারিত সময়ের পর পৌঁছাতে দেখিনি। কথিত আছে, যে রাস্তা ধরে তিনি প্রতি বিকেলে হাঁটতে যেতেন, সেই রাস্তার ধারের দোকান ও বাড়ির লোকজন নিজেদের ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে নিতেন।জীবনের অক্ষরেখা ঘুরে যাচ্ছিল নিয়ম করেই। প্রতিদিনের মতো ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরও তাঁর দিন শুরু হয়েছিল একই নিয়মে, একই ছকে। একই সময়ে দিনান্তে হাঁটতে যাওয়ার আগে পড়ার টেবিলে বর্ষশেষের সব সংবাদপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন। বাড়িতেও সেদিন বর্ষশেষ উপলক্ষে অতিথি সমাগমের কথা ছিল, কিন্তু সেই দিনের সন্ধ্যাটা আর প্রতিদিনের মতো হলো না। সেদিন হাঁটতে যাওয়ার পর তাঁর ৮৩ বছরের জীবনের শেষটা হিসাবের খাতার বাইরে চলে গেল। ছক গেল পাল্টে, সময় গেল থমকে, নিয়ম হলো অনিয়ম। তাঁর আর ঘরে ফেরা হলো না। বাংলাদেশের গোধূলিলগ্ন তাঁকে নিয়ে গেল সন্ধ্যাকাশে হাজার তারার পাশে আরেকটি তারা হয়ে জ্বলতে। জানি না, সেতু পারাপারের সময় তিনি আলোকরেখাকে বলেছিলেন কি না, ‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’ কিংবা দেখেছিলেন কি না, ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার।’
No comments