আমাদের সবার মধ্যেই আছে জিনিয়াস -অরণ্যে রোদন by নিসুল হক
মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তারা আনন্দ করছে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে দেশের সেরা স্কুলের ছেলেমেয়েরা। পত্রিকায় আর টেলিভিশনের খবরে সেই মেধাবী ছেলেমেয়ের আনন্দ আর কৃতিত্বভরা মুখগুলো দেখতে কী ভালোই না লাগছে!
প্রথমেই আমরা অভিনন্দন জানাব এই বিজয়ীদের। মোটামুটি প্রতি নয়জনে একজন জিপিএ-৫ পেয়েছে এবার। তার মানে নয়জনে আটজনই পায়নি। কাজেই বাকি আটজনের সামনে যারা আছে তাদের তো অভিনন্দন জানাতেই হবে। তবে কার সামনে বা কার পেছনে গেলাম, এটা বড় কথা নয়। একটা পরীক্ষায় ভালো করলাম, ফল হিসেবে যেটা সবচেয়ে ভালো, সেটাতেই নিজের নাম লেখালাম, এর মধ্যে একটা গৌরব আছে।
এই জিপিএ পদ্ধতিটা আমার কাছে আমাদের সময়ের চেয়ে ভালো বলে মনে হয়। আমাদের সময়ে ছিল স্ট্যান্ড করা। এর বাইরে কে কটা লেটার মার্কস পেল, স্টার মার্কস আছে কি না; তারপর প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ—এই সব দিয়ে ফলাফলের ইতরবিশেষ করা হতো।
যারা মেধাতালিকায় স্থান পেত, বোর্ডের মধ্যে—একটা ছিল সম্মিলিত মেধাতালিকা, আর একটা ছিল বিজ্ঞান বা মানবিক বা বাণিজ্য শাখার মেধাতালিকা—তাদেরকে কৃতী ছাত্র হিসেবে গণ্য করা হতো। তাতে চার বোর্ড থেকে সাকল্যে দুই-আড়াই শ ছেলেমেয়েকে আলাদা করে নেওয়া হতো। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজারে। আমার একজন শিক্ষক অবশ্য তাতে খুবই গোস্বা। তিনি মনে করেন, এতে মুড়ি-মুড়কির এক দর হয়ে গেছে। প্রকৃত মেধা চেনা যাচ্ছে না। যে সবার সেরা, তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা ও স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। আমি তাঁর মতের সঙ্গে একেবারেই একমত নই। সবার সেরা, সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে কৃতী আবার কী! মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা খুব ভালো, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে-ই সবচেয়ে মেধাবী! আর জীবনের পরীক্ষায় সে-ই যে সবচেয়ে ভালো করবে এই রকম কোনো কথাও নেই। আসলে একটা গবেষণা হওয়া দরকার। সেই যে বোর্ডে যারা প্রথম থেকে বিশতম স্থান অধিকার করত আমাদের সময়ে, পরবর্তীকালে কে কী করেছে, কে কী হয়েছে? একটা বড় সমস্যা হলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আমাদের সময়ে আমাদের বোর্ডে যে ছেলেটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সে মেধাতালিকায় বিশের ঘরেও ছিল না। আবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখলাম, আমাদের সঙ্গে সিভিলে যে প্রথম হচ্ছে, মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তার ফল ছিল মামুলির চেয়ে মামুলি। এ রকমও দেখেছি, অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে সে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, তার সামনের যোগ্যতর কেউ ভর্তি হলে তার বুয়েটে জায়গাই হয় না, সেই ছেলে দিব্যি ফার্স্ট হচ্ছে তার বিভাগে। তারপর কী হলো? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে কত উজ্জ্বল মুখ এখন হয়তো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটা কম্পিউটার কোম্পানিকে দিন-রাত সেবা দিয়ে মরছে, আর মাঝারি ফল করে বুয়েট থেকে বেরিয়ে ঢাকায় সফটওয়্যার কোম্পানি দিয়ে সেই মাঝারি ছেলেটা এখন শত শত ছেলেমেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করেছে, দেশের জন্য আনছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, আর হয়তো আমাদের প্রথমোক্ত ভালো ছেলেটির নিয়োগকর্তার সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে ব্যবসায়িক কিংবা প্রযুক্তিগত লেনদেন করছে।
তাহলে আখেরে মেধাবী কে? দেশের জন্য বেশি উপকারী কে? পরীক্ষার ফল দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর বের করা যাবে না। এই জন্য যত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা উজ্জীবিত রাখতে পারি, উৎসাহিত রাখতে পারি, সমাজ-সভ্যতা ও মানুষের জন্য তত বেশি সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
প্রতিটি মানুষ একেকটা অনন্ত সম্ভাবনার নাম। প্রত্যেকের মধ্যে সলতে আছে, মোম আছে, শুধু অগ্নিসংযোগটা করে দেওয়ার অপেক্ষা।
আমার এই কথার সমর্থন পেলাম ডেভিড শেংকের কথায়। বিবিসি রেডিওর ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে এই লেখকের ইন্টারভিউ হচ্ছিল। তিনি সম্প্রতি একটা বই লিখেছেন, দি জিনিয়াস ইন অল অব আস। আমাদের সবার মধ্যেই আছে জিনিয়াস। তিনি বললেন, আমাদের যে কেউ আইনস্টাইন, বিটোফেন, মাইকেল জর্ডান হতে পারে। ওই বইটা এখন নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় আছে। তিনি বলছেন, আমরা কেউ ভালো করি, কেউ খারাপ করি, এটা আমাদের জিনে লেখা আছে বলে হয় না, আসলে আমাদের সবার জিনেই অনেক কিছুই আছে, এখন দরকার ওই জিনটাকে কার্যকর করে তোলা। সেটা হয় পরিবেশ, ক্রমাগত চেষ্টা, খাদ্য, হরমোন, মানসিক ও শারীরিক অনুশীলন আর অন্য জিনের ভূমিকার ওপরে। তিনি এন্ডারস এরিকসন নামের একজন মনোবিজ্ঞানীর একটা পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর বইয়ে। এই মনোবিদ একজন তরুণকে বেছে নিয়েছেন, যিনি সাত অঙ্কের বেশি সংখ্যা মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু ক্রমাগত অনুশীলন করে তীব্র মনোসংযোগ করে, শেষমেশ দেখা গেছে, ওই তরুণ আশি অঙ্কের বিশাল সংখ্যাও মনে রাখতে পারেন। তার মানে, এই যে বিশাল কোনো অঙ্ক মনে রাখার প্রতিভা, এটা ওই তরুণের ভেতরে ছিলই। পরিবেশের কারণে, চেষ্টাহীনতার কারণে তিনি তাঁর বিকাশ ঘটাতে পারেননি। ডেভিড শেংক বলছেন, যে কেউ জিনিয়াস হতে পারে, সে যদি তীব্রভাবে সেটা চায়, সেটা পাওয়ার জন্য প্রচণ্ড অনুশীলন করে। বেটোফেন তাঁর একটা পঙিক্ত রচনা করার জন্য ৬০-৭০ বার পর্যন্ত লিখেছেন, টেড উইলিয়ামস নামের আমেরিকার কিংবদন্তি বেসবল খেলোয়াড় প্রতিদিন এত অনুশীলন করতেন যে তাঁর আঙুল ফেটে রক্ত বেরোতে থাকত। আমরা জানি, এখনো শচীন টেন্ডুলকার রোজ নেটে খুবই শ্রম স্বীকার করে অনুশীলন করেন। এই অনুশীলন, এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই মনোসংযোগ তাঁর ভেতরের জিনটাকে সক্রিয় করে তোলে। এই জিন আমাদের সবার ভেতরেই আছে, আমরা সেই শ্রম স্বীকার করি না, সেই পরিবেশ পাই না।
কাজেই মেধাবীর সংখ্যা যত বেশি হবে, তাদের ভেতর থেকে জিনিয়াস বের করে আনার সম্ভাবনা তত বেশি।
কিন্তু আমরা কেবল কৃতকার্যদের নিয়ে কথা বলব না। আমাদের তাকাতে হবে অকৃতকার্যদের দিকেও। প্রায় দুই লাখ ছেলেমেয়ে পাস করতে পারেনি। ৮ বোর্ডে সাড়ে আট লাখ ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা ফল ভালো করতে পারেনি, তাদের প্রতি যেন অভিভাবকেরা সহানুভূতিহীন আচরণ না করেন। তোমরা যারা জিপিএ-৫ পাওনি, তোমরা একদম মন খারাপ করবে না।
আমার নিজের স্কুল-কলেজের দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে বিচার করার চেষ্টা করি আমি। পরীক্ষার ফল আর জীবনের ফল কি সব সময় এক থাকে? যে ছেলেটা এসএসসি পাস করেছিল দ্বিতীয় বিভাগে, সে কেমন আছে? আসলে আমাদের দেশে শিক্ষার একটাই উদ্দেশ্য, তা হলো, লেখাপড়া করে যেই জুড়িগাড়ি চড়ে সেই। আমরা কৃষকের সন্তান, লেখাপড়া করে কেরানি বাবু হব, বড়জোর জজ-ব্যারিস্টার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হব। এই হলো আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেটাও উপলক্ষ, আসল লক্ষ্য জুড়িগাড়ি চড়া। জীবনকে সুন্দর করা, নিজের ভেতরের দক্ষতা ও যোগ্যতার সীমাটাকে প্রসারিত করা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী ও সচেতন করে তোলা, মানবসভ্যতা আর মানবতার উপকারে লাগা, এই জাতীয় বিমূর্ত ধারণা আমাদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যেন যায়ই না।
আচ্ছা, এসো, আমরা বিবিসির জরিপে যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা প্রণীত হয়েছিল, সেটার দিকে তাকাই। সবার ওপরে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তালিকায় আরও যাঁরা আছেন—কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, তিতুমীর, বেগম রোকেয়া, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন—তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁদের বেশির ভাগেরই ভালো ছাত্র বলে সুনাম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলে যেতে চাননি, প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণই হননি। নজরুলের স্কুলের পড়া শেষ হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য ফল খুব ভালো ছিল। ফার্স্ট হতেন। নিশ্চয়ই অমর্ত্য সেনেরও পরীক্ষার ফল ভালো ছিল। ক্যামব্রিজে স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, তাঁর জীবনীতে দেখতে পাচ্ছি। তার মানে, পরীক্ষার ফল ভালো করলেও শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়, না করলেও হওয়া যায়। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাই বলেন, ‘আমি অনেক অভিভাবককে বলি, আপনারা তো পুত্রঘাতী রুস্তম। যে সন্তানের অ্যারিস্টোটল হওয়ার কথা ছিল, তাকে আপনারা একজন কম্পিউটার প্রগ্রামার বানিয়ে ভাবেন সেটাই সাফল্য।’
না, আমি তোমাদের লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে বলব না। চেষ্টা করো। আমাদের সবার মধ্যেই জিনিয়াস আছে, খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবেই। তবে শুধু লেখাপড়া বা পরীক্ষার ফল জীবনের সব কথা নয়, শেষ কথা তো নয়ই। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বাইরের বই পড়া, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পাঠ, সংগীত-চিত্রকলা-চলচ্চিত্রের আস্বাদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ইত্যাদি আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকেই কেবল জাগিয়ে তোলে না, আমাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ তৈরি করে। আমাদের দায়িত্ব নিতে শেখায়। ওই যে একটু বিবিসি জরিপের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নাম নিচ্ছিলাম, তাদের সবার পরীক্ষার ফল ভালো না হলেও একটা বিষয়ে সবার মধ্যে মিল পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেকেই প্রচুর পড়েছেন, এমনকি কাজী নজরুল ইসলামেরও দেশবিদেশের সাহিত্য পড়া ছিল গভীরভাবে।
যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে, তাদের মেধার আলোয় বাংলাদেশ আলোকিত হবে, এই স্বপ্ন তো আমরা দেখি। কিন্তু যারা জিপিএ-৫ পায়নি তাদের মধ্য থেকেও বেরিয়ে আসবেন আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, শেখ মুজিবুর রহমান, পাবলো পিকাসো, বিল গেটস, নয়তো কোনো দুনিয়া কাঁপানো শিল্পোদ্যোক্তা—সেই স্বপ্নও আমাদের আছে। শুধু স্বপ্ন নয়, বিশ্বাসও আছে। কাজেই আমাকে যদি পক্ষ নিতে বলা হয়, আমি বলব, আমি তাদের দলে, যারা জিপিএ-৫ পায়নি। সেই সাড়ে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এবার জিপিএ ফাইভ পায়নি, তারাও মানুষ হবে, কেবল নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে না, দেশ ও সমাজের কল্যাণে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, এ বিষয়ে আমার নিজের কোনও সন্দেহ নেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথমেই আমরা অভিনন্দন জানাব এই বিজয়ীদের। মোটামুটি প্রতি নয়জনে একজন জিপিএ-৫ পেয়েছে এবার। তার মানে নয়জনে আটজনই পায়নি। কাজেই বাকি আটজনের সামনে যারা আছে তাদের তো অভিনন্দন জানাতেই হবে। তবে কার সামনে বা কার পেছনে গেলাম, এটা বড় কথা নয়। একটা পরীক্ষায় ভালো করলাম, ফল হিসেবে যেটা সবচেয়ে ভালো, সেটাতেই নিজের নাম লেখালাম, এর মধ্যে একটা গৌরব আছে।
এই জিপিএ পদ্ধতিটা আমার কাছে আমাদের সময়ের চেয়ে ভালো বলে মনে হয়। আমাদের সময়ে ছিল স্ট্যান্ড করা। এর বাইরে কে কটা লেটার মার্কস পেল, স্টার মার্কস আছে কি না; তারপর প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ—এই সব দিয়ে ফলাফলের ইতরবিশেষ করা হতো।
যারা মেধাতালিকায় স্থান পেত, বোর্ডের মধ্যে—একটা ছিল সম্মিলিত মেধাতালিকা, আর একটা ছিল বিজ্ঞান বা মানবিক বা বাণিজ্য শাখার মেধাতালিকা—তাদেরকে কৃতী ছাত্র হিসেবে গণ্য করা হতো। তাতে চার বোর্ড থেকে সাকল্যে দুই-আড়াই শ ছেলেমেয়েকে আলাদা করে নেওয়া হতো। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজারে। আমার একজন শিক্ষক অবশ্য তাতে খুবই গোস্বা। তিনি মনে করেন, এতে মুড়ি-মুড়কির এক দর হয়ে গেছে। প্রকৃত মেধা চেনা যাচ্ছে না। যে সবার সেরা, তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা ও স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। আমি তাঁর মতের সঙ্গে একেবারেই একমত নই। সবার সেরা, সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে কৃতী আবার কী! মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করা খুব ভালো, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে-ই সবচেয়ে মেধাবী! আর জীবনের পরীক্ষায় সে-ই যে সবচেয়ে ভালো করবে এই রকম কোনো কথাও নেই। আসলে একটা গবেষণা হওয়া দরকার। সেই যে বোর্ডে যারা প্রথম থেকে বিশতম স্থান অধিকার করত আমাদের সময়ে, পরবর্তীকালে কে কী করেছে, কে কী হয়েছে? একটা বড় সমস্যা হলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। আমাদের সময়ে আমাদের বোর্ডে যে ছেলেটি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সে মেধাতালিকায় বিশের ঘরেও ছিল না। আবার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখলাম, আমাদের সঙ্গে সিভিলে যে প্রথম হচ্ছে, মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তার ফল ছিল মামুলির চেয়ে মামুলি। এ রকমও দেখেছি, অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে সে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে, তার সামনের যোগ্যতর কেউ ভর্তি হলে তার বুয়েটে জায়গাই হয় না, সেই ছেলে দিব্যি ফার্স্ট হচ্ছে তার বিভাগে। তারপর কী হলো? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে কত উজ্জ্বল মুখ এখন হয়তো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটা কম্পিউটার কোম্পানিকে দিন-রাত সেবা দিয়ে মরছে, আর মাঝারি ফল করে বুয়েট থেকে বেরিয়ে ঢাকায় সফটওয়্যার কোম্পানি দিয়ে সেই মাঝারি ছেলেটা এখন শত শত ছেলেমেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করেছে, দেশের জন্য আনছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, আর হয়তো আমাদের প্রথমোক্ত ভালো ছেলেটির নিয়োগকর্তার সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে ব্যবসায়িক কিংবা প্রযুক্তিগত লেনদেন করছে।
তাহলে আখেরে মেধাবী কে? দেশের জন্য বেশি উপকারী কে? পরীক্ষার ফল দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর বের করা যাবে না। এই জন্য যত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা উজ্জীবিত রাখতে পারি, উৎসাহিত রাখতে পারি, সমাজ-সভ্যতা ও মানুষের জন্য তত বেশি সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
প্রতিটি মানুষ একেকটা অনন্ত সম্ভাবনার নাম। প্রত্যেকের মধ্যে সলতে আছে, মোম আছে, শুধু অগ্নিসংযোগটা করে দেওয়ার অপেক্ষা।
আমার এই কথার সমর্থন পেলাম ডেভিড শেংকের কথায়। বিবিসি রেডিওর ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে এই লেখকের ইন্টারভিউ হচ্ছিল। তিনি সম্প্রতি একটা বই লিখেছেন, দি জিনিয়াস ইন অল অব আস। আমাদের সবার মধ্যেই আছে জিনিয়াস। তিনি বললেন, আমাদের যে কেউ আইনস্টাইন, বিটোফেন, মাইকেল জর্ডান হতে পারে। ওই বইটা এখন নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় আছে। তিনি বলছেন, আমরা কেউ ভালো করি, কেউ খারাপ করি, এটা আমাদের জিনে লেখা আছে বলে হয় না, আসলে আমাদের সবার জিনেই অনেক কিছুই আছে, এখন দরকার ওই জিনটাকে কার্যকর করে তোলা। সেটা হয় পরিবেশ, ক্রমাগত চেষ্টা, খাদ্য, হরমোন, মানসিক ও শারীরিক অনুশীলন আর অন্য জিনের ভূমিকার ওপরে। তিনি এন্ডারস এরিকসন নামের একজন মনোবিজ্ঞানীর একটা পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর বইয়ে। এই মনোবিদ একজন তরুণকে বেছে নিয়েছেন, যিনি সাত অঙ্কের বেশি সংখ্যা মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু ক্রমাগত অনুশীলন করে তীব্র মনোসংযোগ করে, শেষমেশ দেখা গেছে, ওই তরুণ আশি অঙ্কের বিশাল সংখ্যাও মনে রাখতে পারেন। তার মানে, এই যে বিশাল কোনো অঙ্ক মনে রাখার প্রতিভা, এটা ওই তরুণের ভেতরে ছিলই। পরিবেশের কারণে, চেষ্টাহীনতার কারণে তিনি তাঁর বিকাশ ঘটাতে পারেননি। ডেভিড শেংক বলছেন, যে কেউ জিনিয়াস হতে পারে, সে যদি তীব্রভাবে সেটা চায়, সেটা পাওয়ার জন্য প্রচণ্ড অনুশীলন করে। বেটোফেন তাঁর একটা পঙিক্ত রচনা করার জন্য ৬০-৭০ বার পর্যন্ত লিখেছেন, টেড উইলিয়ামস নামের আমেরিকার কিংবদন্তি বেসবল খেলোয়াড় প্রতিদিন এত অনুশীলন করতেন যে তাঁর আঙুল ফেটে রক্ত বেরোতে থাকত। আমরা জানি, এখনো শচীন টেন্ডুলকার রোজ নেটে খুবই শ্রম স্বীকার করে অনুশীলন করেন। এই অনুশীলন, এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এই মনোসংযোগ তাঁর ভেতরের জিনটাকে সক্রিয় করে তোলে। এই জিন আমাদের সবার ভেতরেই আছে, আমরা সেই শ্রম স্বীকার করি না, সেই পরিবেশ পাই না।
কাজেই মেধাবীর সংখ্যা যত বেশি হবে, তাদের ভেতর থেকে জিনিয়াস বের করে আনার সম্ভাবনা তত বেশি।
কিন্তু আমরা কেবল কৃতকার্যদের নিয়ে কথা বলব না। আমাদের তাকাতে হবে অকৃতকার্যদের দিকেও। প্রায় দুই লাখ ছেলেমেয়ে পাস করতে পারেনি। ৮ বোর্ডে সাড়ে আট লাখ ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পায়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা ফল ভালো করতে পারেনি, তাদের প্রতি যেন অভিভাবকেরা সহানুভূতিহীন আচরণ না করেন। তোমরা যারা জিপিএ-৫ পাওনি, তোমরা একদম মন খারাপ করবে না।
আমার নিজের স্কুল-কলেজের দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে বিচার করার চেষ্টা করি আমি। পরীক্ষার ফল আর জীবনের ফল কি সব সময় এক থাকে? যে ছেলেটা এসএসসি পাস করেছিল দ্বিতীয় বিভাগে, সে কেমন আছে? আসলে আমাদের দেশে শিক্ষার একটাই উদ্দেশ্য, তা হলো, লেখাপড়া করে যেই জুড়িগাড়ি চড়ে সেই। আমরা কৃষকের সন্তান, লেখাপড়া করে কেরানি বাবু হব, বড়জোর জজ-ব্যারিস্টার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হব। এই হলো আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেটাও উপলক্ষ, আসল লক্ষ্য জুড়িগাড়ি চড়া। জীবনকে সুন্দর করা, নিজের ভেতরের দক্ষতা ও যোগ্যতার সীমাটাকে প্রসারিত করা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কৌতূহলী ও সচেতন করে তোলা, মানবসভ্যতা আর মানবতার উপকারে লাগা, এই জাতীয় বিমূর্ত ধারণা আমাদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যেন যায়ই না।
আচ্ছা, এসো, আমরা বিবিসির জরিপে যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা প্রণীত হয়েছিল, সেটার দিকে তাকাই। সবার ওপরে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর পরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই তালিকায় আরও যাঁরা আছেন—কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, তিতুমীর, বেগম রোকেয়া, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন—তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁদের বেশির ভাগেরই ভালো ছাত্র বলে সুনাম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলে যেতে চাননি, প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণই হননি। নজরুলের স্কুলের পড়া শেষ হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য ফল খুব ভালো ছিল। ফার্স্ট হতেন। নিশ্চয়ই অমর্ত্য সেনেরও পরীক্ষার ফল ভালো ছিল। ক্যামব্রিজে স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, তাঁর জীবনীতে দেখতে পাচ্ছি। তার মানে, পরীক্ষার ফল ভালো করলেও শ্রেষ্ঠ হওয়া যায়, না করলেও হওয়া যায়। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাই বলেন, ‘আমি অনেক অভিভাবককে বলি, আপনারা তো পুত্রঘাতী রুস্তম। যে সন্তানের অ্যারিস্টোটল হওয়ার কথা ছিল, তাকে আপনারা একজন কম্পিউটার প্রগ্রামার বানিয়ে ভাবেন সেটাই সাফল্য।’
না, আমি তোমাদের লেখাপড়ায় ফাঁকি দিতে বলব না। চেষ্টা করো। আমাদের সবার মধ্যেই জিনিয়াস আছে, খুব মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবেই। তবে শুধু লেখাপড়া বা পরীক্ষার ফল জীবনের সব কথা নয়, শেষ কথা তো নয়ই। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে বাইরের বই পড়া, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পাঠ, সংগীত-চিত্রকলা-চলচ্চিত্রের আস্বাদন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ইত্যাদি আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকেই কেবল জাগিয়ে তোলে না, আমাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ তৈরি করে। আমাদের দায়িত্ব নিতে শেখায়। ওই যে একটু বিবিসি জরিপের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নাম নিচ্ছিলাম, তাদের সবার পরীক্ষার ফল ভালো না হলেও একটা বিষয়ে সবার মধ্যে মিল পাওয়া যাবে, তাদের প্রত্যেকেই প্রচুর পড়েছেন, এমনকি কাজী নজরুল ইসলামেরও দেশবিদেশের সাহিত্য পড়া ছিল গভীরভাবে।
যে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে, তাদের মেধার আলোয় বাংলাদেশ আলোকিত হবে, এই স্বপ্ন তো আমরা দেখি। কিন্তু যারা জিপিএ-৫ পায়নি তাদের মধ্য থেকেও বেরিয়ে আসবেন আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, শেখ মুজিবুর রহমান, পাবলো পিকাসো, বিল গেটস, নয়তো কোনো দুনিয়া কাঁপানো শিল্পোদ্যোক্তা—সেই স্বপ্নও আমাদের আছে। শুধু স্বপ্ন নয়, বিশ্বাসও আছে। কাজেই আমাকে যদি পক্ষ নিতে বলা হয়, আমি বলব, আমি তাদের দলে, যারা জিপিএ-৫ পায়নি। সেই সাড়ে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে এবার জিপিএ ফাইভ পায়নি, তারাও মানুষ হবে, কেবল নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে না, দেশ ও সমাজের কল্যাণে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, এ বিষয়ে আমার নিজের কোনও সন্দেহ নেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments