ভারতে বদল দরকার, সংঘাত নয় -কুলদীপ নায়ার
বর্তমান ব্যবস্থা নিয়ে অনেক ভারতীয়ই নাখোশ। ব্যাপক বৈষম্যের মধ্যে বিপুল মানুষের জীবন একেবারে কোণঠাসা। আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি এত প্রকাশ্য এবং বলতে বলতে ভোঁতা হয়ে গেলেও সত্য যে, অপরাধের রাজনৈতিকীকরণ ঘটেছে এবং রাজনীতি হয়েছে অপরাধময়।
কীভাবে এ ব্যবস্থা বদলানো যায়, তা নিয়ে জাতি ভাবিত। মাওবাদী ও তাদের সমর্থকেরা যেমনটা বিশ্বাস করে, বন্দুকের মাধ্যমে কি একে বদলানো সম্ভব? নাকি জনগণই ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত দেবে?
মাওবাদীদের অব্যাহত সহিংসতার মুখে প্রশ্নটি আরও সামনে চলে এসেছে। গত সপ্তাহে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদার গভীর অরণ্যে মাওবাদীদের হাতে ৭৬ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে যে মাওবাদীরা ক্ষমতা দখল করতে চায়। খারাপের খারাপ হলো, তারা পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও কেটে পড়তে পারছে। তার মানে, তাদের কৌশল ও অস্ত্রক্ষমতা অনেক বিকশিত হয়েছে। সরকারি সব প্রশিক্ষণেও পুলিশ তাদের সঙ্গে পারছে না। পুলিশের অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য ও সরঞ্জামাদিও তাদের জয়ী করতে পারছে না। একটি খবর জানাচ্ছে যে, অন্ধ্রপ্রদেশের চার মাওবাদী ক্যাডার পরিকল্পিতভাবে পুলিশ বাহিনীকে মৃত্যুফাঁদে আটকানোর নেতৃত্ব দিয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ সরাসরি মৃত্যুফাঁদের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল।
মাওবাদীদের এই হত্যাকাণ্ডই হলো সশস্ত্র বিপ্লব করার পন্থা। ভারত যখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম করছিল, তখন ব্রিটিশ পরাশক্তির বিরুদ্ধে একটা গুলিও ফোটাতে হয়নি। গান্ধী সেটা পেরেছিলেন, কারণ জনগণের শক্তি তাঁর পেছনে ছিল। গরিব, অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ জনগণ তাঁর পেছনে ছিল। এভাবে মহাত্মা জিতেছিলেন।
মাওবাদীরা যদি গরিব জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, তাহলে নির্বাচনেই তাদের সমর্থনের জোর প্রমাণ করা উচিত। জনগণের মন জয়ের জন্য দরকার লেগে থাকা, ধৈর্য ও যুক্তি। মাওবাদীদের বিশ্বাস, তাদের সেটা করার দরকার নেই, বন্দুকই ওই কাজ করে দেবে। এটাই তো সাম্রাজ্যবাদীদেরও ভাষা।
মাওবাদীরা বুঝতে পারছে না যে তাদের বন্দুককে নিস্তব্ধ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে। শাসকদের তারা পছন্দ করতে না পারে, কিন্তু তারা এসেছে ভোট অর্জনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। বন্দুক দিয়ে এই শাসকদের উচ্ছেদ করতে গেলে, বন্দুকের জোর অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি দিয়ে মাওবাদীদের দমন করা শাসকদের পক্ষে যুক্তিসংগত।
আজকের দুনিয়ায় সহিংসতার দিন শেষ। এমনকি সীমিত মাত্রার সন্ত্রাসও বিপজ্জনক। ভারতে যেহেতু ক্ষোভ-বিক্ষোভের অজস্র রন্ধ্র থেকে রক্ত ঝরছে, সেহেতু এখানে অস্ত্র ব্যবহার অনেক বিপজ্জনক।
ভগত সিংও বিপ্লবী ছিলেন। তিনিও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন। তার পরও তিনি সহিংসতাকে আদর্শ করেননি, তাঁর সংগঠন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টিও সহিংসতাকে উসকে দেয়নি। তাঁর কাছ থেকে মাওবাদীদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। ব্রিটিশরা ভগত সিংকে ফাঁসি দিয়েছিল তাঁর এই আদর্শের ভয়ে, তাঁকে ভয় পেয়ে নয়।
বিপ্লবীদের কাছে হত্যার কী তাৎপর্য? ভগত সিংয়ের ভাষায়: ‘আমরা মানবতার মহত্তকে ধারণ করি; আমরা মনে করি মানুষের জীবন পবিত্র। তাই কাউকে আহত করার বদলে আমরা আমাদের জীবনকেই মানবতার মুক্তির জন্য নিবেদন করি।’ এর মধ্যে কোনো প্রতিহিংসা, কোনো নৃশংসতা ও প্রতিশোধের ব্যাপার ছিল না। তিনি তাঁর ২১ বছর বয়সে ‘বোমার দর্শন’ নামক লেখায় বলেছিলেন, বিপ্লবীদের উচিত তাদের আদর্শ ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে জনগণের সমালোচনাকে আমলে নেওয়া; বরং এসবের সুযোগেই তাদের উচিত, তাদের নীতি ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করা ও বোঝানো।
সিং তাঁর বিচারের সময় পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সহিংসতা তাঁর আদর্শ নয়। তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে জাগিয়ে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-যুবদের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে। মাওবাদীদের বুঝতে হবে, তাদের সশস্ত্র বিপ্লব নির্বিকার সহিংসতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের সবকিছু আমার পছন্দ নয়। কিন্তু তিনি মাওবাদীদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদের অস্ত্রসমর্পণও করতে বলেননি; বরং বলেছিলেন সহিংসতা ত্যাগ করতে। তা করলেই কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি।
আর সে সময়টায় সরকার আদিবাসীদের এলাকা থেকে খনিজ আহরণ-প্রক্রিয়া বন্ধ করতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের বোঝাতে পারে। এসব সম্পদ ব্যবহারের সময় আদিবাসীদেরও যাতে উন্নতি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। মাওবাদীরা আদিবাসীদের বঞ্চনাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সশস্ত্র বিপ্লবকে জায়েজ করতে চায়। আদিবাসীরা যদি একবার বুঝতে পারে যে তাদের খনিজ সম্পদের ওপর মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তখনই তারা মাওবাদীদের সমর্থন করা বন্ধ করবে।
বিপ্লবের নামে মাওবাদীরা ‘সন্দেহজনক উৎস’ থেকে টাকা ও অস্ত্র-সহযোগিতা পাচ্ছে। সরকার যতই দুর্বল হোক, তারা ভারতীয় রাজনৈতিক সমাজকে পরাজিত করতে পারবে না। নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার বদল হতে পারে, কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতের যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা সারানোর অযোগ্য।
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক। সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার ও সাবেক রাজ্যসভা সদস্য।
কীভাবে এ ব্যবস্থা বদলানো যায়, তা নিয়ে জাতি ভাবিত। মাওবাদী ও তাদের সমর্থকেরা যেমনটা বিশ্বাস করে, বন্দুকের মাধ্যমে কি একে বদলানো সম্ভব? নাকি জনগণই ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত দেবে?
মাওবাদীদের অব্যাহত সহিংসতার মুখে প্রশ্নটি আরও সামনে চলে এসেছে। গত সপ্তাহে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াদার গভীর অরণ্যে মাওবাদীদের হাতে ৭৬ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে যে মাওবাদীরা ক্ষমতা দখল করতে চায়। খারাপের খারাপ হলো, তারা পুলিশের অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও কেটে পড়তে পারছে। তার মানে, তাদের কৌশল ও অস্ত্রক্ষমতা অনেক বিকশিত হয়েছে। সরকারি সব প্রশিক্ষণেও পুলিশ তাদের সঙ্গে পারছে না। পুলিশের অস্ত্র, গোয়েন্দা তথ্য ও সরঞ্জামাদিও তাদের জয়ী করতে পারছে না। একটি খবর জানাচ্ছে যে, অন্ধ্রপ্রদেশের চার মাওবাদী ক্যাডার পরিকল্পিতভাবে পুলিশ বাহিনীকে মৃত্যুফাঁদে আটকানোর নেতৃত্ব দিয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ সরাসরি মৃত্যুফাঁদের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল।
মাওবাদীদের এই হত্যাকাণ্ডই হলো সশস্ত্র বিপ্লব করার পন্থা। ভারত যখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম করছিল, তখন ব্রিটিশ পরাশক্তির বিরুদ্ধে একটা গুলিও ফোটাতে হয়নি। গান্ধী সেটা পেরেছিলেন, কারণ জনগণের শক্তি তাঁর পেছনে ছিল। গরিব, অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ জনগণ তাঁর পেছনে ছিল। এভাবে মহাত্মা জিতেছিলেন।
মাওবাদীরা যদি গরিব জনগণেরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, তাহলে নির্বাচনেই তাদের সমর্থনের জোর প্রমাণ করা উচিত। জনগণের মন জয়ের জন্য দরকার লেগে থাকা, ধৈর্য ও যুক্তি। মাওবাদীদের বিশ্বাস, তাদের সেটা করার দরকার নেই, বন্দুকই ওই কাজ করে দেবে। এটাই তো সাম্রাজ্যবাদীদেরও ভাষা।
মাওবাদীরা বুঝতে পারছে না যে তাদের বন্দুককে নিস্তব্ধ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাষ্ট্রের রয়েছে। শাসকদের তারা পছন্দ করতে না পারে, কিন্তু তারা এসেছে ভোট অর্জনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। বন্দুক দিয়ে এই শাসকদের উচ্ছেদ করতে গেলে, বন্দুকের জোর অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি দিয়ে মাওবাদীদের দমন করা শাসকদের পক্ষে যুক্তিসংগত।
আজকের দুনিয়ায় সহিংসতার দিন শেষ। এমনকি সীমিত মাত্রার সন্ত্রাসও বিপজ্জনক। ভারতে যেহেতু ক্ষোভ-বিক্ষোভের অজস্র রন্ধ্র থেকে রক্ত ঝরছে, সেহেতু এখানে অস্ত্র ব্যবহার অনেক বিপজ্জনক।
ভগত সিংও বিপ্লবী ছিলেন। তিনিও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন। তার পরও তিনি সহিংসতাকে আদর্শ করেননি, তাঁর সংগঠন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টিও সহিংসতাকে উসকে দেয়নি। তাঁর কাছ থেকে মাওবাদীদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। ব্রিটিশরা ভগত সিংকে ফাঁসি দিয়েছিল তাঁর এই আদর্শের ভয়ে, তাঁকে ভয় পেয়ে নয়।
বিপ্লবীদের কাছে হত্যার কী তাৎপর্য? ভগত সিংয়ের ভাষায়: ‘আমরা মানবতার মহত্তকে ধারণ করি; আমরা মনে করি মানুষের জীবন পবিত্র। তাই কাউকে আহত করার বদলে আমরা আমাদের জীবনকেই মানবতার মুক্তির জন্য নিবেদন করি।’ এর মধ্যে কোনো প্রতিহিংসা, কোনো নৃশংসতা ও প্রতিশোধের ব্যাপার ছিল না। তিনি তাঁর ২১ বছর বয়সে ‘বোমার দর্শন’ নামক লেখায় বলেছিলেন, বিপ্লবীদের উচিত তাদের আদর্শ ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে জনগণের সমালোচনাকে আমলে নেওয়া; বরং এসবের সুযোগেই তাদের উচিত, তাদের নীতি ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করা ও বোঝানো।
সিং তাঁর বিচারের সময় পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সহিংসতা তাঁর আদর্শ নয়। তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে জাগিয়ে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-যুবদের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে। মাওবাদীদের বুঝতে হবে, তাদের সশস্ত্র বিপ্লব নির্বিকার সহিংসতায় পর্যবসিত হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের সবকিছু আমার পছন্দ নয়। কিন্তু তিনি মাওবাদীদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদের অস্ত্রসমর্পণও করতে বলেননি; বরং বলেছিলেন সহিংসতা ত্যাগ করতে। তা করলেই কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি।
আর সে সময়টায় সরকার আদিবাসীদের এলাকা থেকে খনিজ আহরণ-প্রক্রিয়া বন্ধ করতে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের বোঝাতে পারে। এসব সম্পদ ব্যবহারের সময় আদিবাসীদেরও যাতে উন্নতি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। মাওবাদীরা আদিবাসীদের বঞ্চনাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সশস্ত্র বিপ্লবকে জায়েজ করতে চায়। আদিবাসীরা যদি একবার বুঝতে পারে যে তাদের খনিজ সম্পদের ওপর মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তখনই তারা মাওবাদীদের সমর্থন করা বন্ধ করবে।
বিপ্লবের নামে মাওবাদীরা ‘সন্দেহজনক উৎস’ থেকে টাকা ও অস্ত্র-সহযোগিতা পাচ্ছে। সরকার যতই দুর্বল হোক, তারা ভারতীয় রাজনৈতিক সমাজকে পরাজিত করতে পারবে না। নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার বদল হতে পারে, কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতের যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা সারানোর অযোগ্য।
গালফ নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক। সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার ও সাবেক রাজ্যসভা সদস্য।
No comments