সম্পর্ক জটিল হবে by এম হাফিজউদ্দিন খান
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নির্ধারণ করতে উচ্চ আদালত যে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে জেলা জজের অবস্থান সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানের ওপরে বলে ঠিক করা হয়েছে।
এখানে এ বিষয়ে দুটি মতামত প্রকাশকরা হলো।
সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট সম্পূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগের আওতাভুক্ত বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য রায় দিয়েছেন। এই রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ক্রমিকে জেলা জজ ও সমপর্যায়ভুক্ত জজদের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করেছেন। তাঁদের সরকারের সচিব এবং তিন বাহিনীর প্রধানের ওপর স্থান দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ রায়ের ফলে প্রশাসনে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হতে পারে, তা তুলে ধরা দোষের হবে না বলে মনে করি।
প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বলবত্ জেলা জজ ও সমপর্যায়ভুক্ত জজদের যে পদমর্যাদা রয়েছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। তাঁরা বর্তমানে উপসচিবের পদমর্যাদা ভোগ করেন। বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হলো জেলা জজ। সুতরাং তাঁদের উপসচিব পদমর্যাদা প্রদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের অন্যান্য ক্যাডারের (প্রশাসনিক ক্যাডার ব্যতীত) সর্বোচ্চ পদ সরকারি বেতনক্রমের দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত বা অতিরিক্ত সচিবের সমপর্যায়ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত বিভাগ, কৃষি বিভাগ, মত্স্য বিভাগ, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদি বিভাগের সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত সচিবের পর্যায়ভুক্ত। তবে সেসব বিভাগের দ্বিতীয় গ্রেডের ১০ শতাংশ পদকে প্রথম গ্রেড অর্থাত্ সচিবের সমপর্যায়ের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। বেতনক্রমও সচিবদের সমান অর্থাত্ বেতনক্রমের প্রথম গ্রেডভুক্ত। সুতরাং সে বিচারে জেলা জজকে এত দিন যে পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা অসন্তোষজনক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে হাইকোর্টের রায়ে তাঁদের যে পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে, তা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং আন্তক্যাডার জ্যেষ্ঠতা ও পদমর্যাদায় অনেক সমস্যা স্পষ্ট করবে বলে প্রতীয়মান হয়। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদ বিসিএস জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের দ্বারা পূরণযোগ্য। জেলা জজরা ওই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। অতঃপর পদোন্নতি পেয়ে ক্রমান্বয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় অনুসারে, জেলা জজরা সচিবের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করবেন। তাহলে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো কাদের দ্বারা পূরণ করা হবে, সে প্রশ্ন রয়ে গেল। যদি জেলা জজদের এসব পদে নিয়োগ করা হয়, তাহলে তাঁদের পদাবনতি হয়ে যাবে। এটা কী করে সম্ভব?
আমার মনে হয়, জেলা জজদের বর্তমান সমস্যার সর্বোচ্চ সমাধান হতো যদি বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারকে হাইকোর্টের বিচারকদের ফিডার পদ হিসেবে নির্ধারণ করা হতো এবং তত্সহ হাইকোর্টের বিচারকের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পদ ওই ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত থাকত। তাহলে জেলা জজদের উচ্চতর আদালতে যাওয়ার পথ সুগম হতো এবং এতে তাঁদের বর্তমান পদমর্যাদা নিয়ে যে অসন্তোষ বিরাজমান, তা কিছুটা উপশম হতো। এর ফলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে জেলা জজরা উচ্চতর আদালতে আসতে পারতেন এবং উচ্চতর আদালতের গুণগত মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতেন। উচ্চতর আদালতে বিচারক নিয়োগে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনা প্রবলভাবে বিদ্যমান, তা দূর করার একটি সুযোগ পাওয়া যেত।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুসারে, উচ্চতর আদালতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারের যেকোনো কর্মকর্তা ১০ বছর চাকরি করলেই যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, উচ্চ আদালতে অধিকাংশ বিচারক নিযুক্ত হন আইনজীবীদের মধ্য থেকে। কালেভদ্রে দুই-একজন জেলা জজ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। সম্প্রতি হাইকোর্টে বিরাটসংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা হয়। সেখানে মাত্র দুজন এসেছেন জেলা জজ থেকে।
পত্রিকান্তরে দেখতে পেলাম, সরকার এ বিষয়টি নিয়ে আপিল বিভাগে যাবে। কারণ, মনে হয় রায়ের ফলে প্রশাসনে যে অস্থিতিশীল অবস্থা ও আন্তক্যাডার অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, তার নিরসন হওয়া দরকার। এমনিতেই আমাদের জন্য প্রশাসনে বহুবিদ জটিলতা রয়ে গেছে। প্রশাসন সার্বিকভাবে অদক্ষ ও স্থবির। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে সার্বিক পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এবং প্রশাসনের অদক্ষতা ও স্থবিরতা আরও বেড়ে যাবে বলে অনুমিত হচ্ছে।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
এখানে এ বিষয়ে দুটি মতামত প্রকাশকরা হলো।
সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্ট সম্পূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগের আওতাভুক্ত বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য রায় দিয়েছেন। এই রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ক্রমিকে জেলা জজ ও সমপর্যায়ভুক্ত জজদের অবস্থান পুনর্নির্ধারণ করেছেন। তাঁদের সরকারের সচিব এবং তিন বাহিনীর প্রধানের ওপর স্থান দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ রায়ের ফলে প্রশাসনে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হতে পারে, তা তুলে ধরা দোষের হবে না বলে মনে করি।
প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বলবত্ জেলা জজ ও সমপর্যায়ভুক্ত জজদের যে পদমর্যাদা রয়েছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। তাঁরা বর্তমানে উপসচিবের পদমর্যাদা ভোগ করেন। বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হলো জেলা জজ। সুতরাং তাঁদের উপসচিব পদমর্যাদা প্রদান গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশের অন্যান্য ক্যাডারের (প্রশাসনিক ক্যাডার ব্যতীত) সর্বোচ্চ পদ সরকারি বেতনক্রমের দ্বিতীয় গ্রেডভুক্ত বা অতিরিক্ত সচিবের সমপর্যায়ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে সড়ক ও জনপথ, গণপূর্ত বিভাগ, কৃষি বিভাগ, মত্স্য বিভাগ, নিরীক্ষা ও হিসাব ইত্যাদি বিভাগের সর্বোচ্চ পদ অতিরিক্ত সচিবের পর্যায়ভুক্ত। তবে সেসব বিভাগের দ্বিতীয় গ্রেডের ১০ শতাংশ পদকে প্রথম গ্রেড অর্থাত্ সচিবের সমপর্যায়ের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। বেতনক্রমও সচিবদের সমান অর্থাত্ বেতনক্রমের প্রথম গ্রেডভুক্ত। সুতরাং সে বিচারে জেলা জজকে এত দিন যে পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা অসন্তোষজনক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে হাইকোর্টের রায়ে তাঁদের যে পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে, তা অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এবং আন্তক্যাডার জ্যেষ্ঠতা ও পদমর্যাদায় অনেক সমস্যা স্পষ্ট করবে বলে প্রতীয়মান হয়। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত সব পদ বিসিএস জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের দ্বারা পূরণযোগ্য। জেলা জজরা ওই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। অতঃপর পদোন্নতি পেয়ে ক্রমান্বয়ে যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হিসেবে নিযুক্ত হন। এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় অনুসারে, জেলা জজরা সচিবের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করবেন। তাহলে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো কাদের দ্বারা পূরণ করা হবে, সে প্রশ্ন রয়ে গেল। যদি জেলা জজদের এসব পদে নিয়োগ করা হয়, তাহলে তাঁদের পদাবনতি হয়ে যাবে। এটা কী করে সম্ভব?
আমার মনে হয়, জেলা জজদের বর্তমান সমস্যার সর্বোচ্চ সমাধান হতো যদি বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারকে হাইকোর্টের বিচারকদের ফিডার পদ হিসেবে নির্ধারণ করা হতো এবং তত্সহ হাইকোর্টের বিচারকের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ পদ ওই ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত থাকত। তাহলে জেলা জজদের উচ্চতর আদালতে যাওয়ার পথ সুগম হতো এবং এতে তাঁদের বর্তমান পদমর্যাদা নিয়ে যে অসন্তোষ বিরাজমান, তা কিছুটা উপশম হতো। এর ফলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে জেলা জজরা উচ্চতর আদালতে আসতে পারতেন এবং উচ্চতর আদালতের গুণগত মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারতেন। উচ্চতর আদালতে বিচারক নিয়োগে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও দলীয় বিবেচনা প্রবলভাবে বিদ্যমান, তা দূর করার একটি সুযোগ পাওয়া যেত।
সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুসারে, উচ্চতর আদালতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডারের যেকোনো কর্মকর্তা ১০ বছর চাকরি করলেই যোগ্যতা অর্জন করেন। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, উচ্চ আদালতে অধিকাংশ বিচারক নিযুক্ত হন আইনজীবীদের মধ্য থেকে। কালেভদ্রে দুই-একজন জেলা জজ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। সম্প্রতি হাইকোর্টে বিরাটসংখ্যক বিচারক নিয়োগ করা হয়। সেখানে মাত্র দুজন এসেছেন জেলা জজ থেকে।
পত্রিকান্তরে দেখতে পেলাম, সরকার এ বিষয়টি নিয়ে আপিল বিভাগে যাবে। কারণ, মনে হয় রায়ের ফলে প্রশাসনে যে অস্থিতিশীল অবস্থা ও আন্তক্যাডার অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, তার নিরসন হওয়া দরকার। এমনিতেই আমাদের জন্য প্রশাসনে বহুবিদ জটিলতা রয়ে গেছে। প্রশাসন সার্বিকভাবে অদক্ষ ও স্থবির। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে সার্বিক পরিস্থিতি আরও জটিল হবে এবং প্রশাসনের অদক্ষতা ও স্থবিরতা আরও বেড়ে যাবে বলে অনুমিত হচ্ছে।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments