বিরোধের নেপথ্যে কি মেয়র নির্বাচন -নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম by বিশ্বজিত্ চৌধুরী
একদিক থেকে দেখলে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন নিরুত্তাপ থাকার কথা। কারণ বিরোধী দল বিএনপি রাজপথে নামার মতো স্থানীয় কোনো ইস্যু তৈরি করতে পারেনি। ইস্যু তৈরি হলেও যে নামতে পারবে এমন সম্ভাবনা বা শঙ্কা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। কেননা নির্বাচনে বড় ধরনের বিপর্যয়ের পর তারা যেমন মনোবল হারিয়েছে, তেমনি অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণেও হয়ে পড়েছে হীনবল। অন্য দিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে না পড়ে নিরুদ্বিগ্ন থাকলেও নিজেরাই নিজেদের জন্য তৈরি করছে গর্ত, কে কাকে সেখানে ঠেলে ফেলতে পারে চলছে তার জোর প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটা এত দূর গড়িয়েছে যে দলীয় নেতার কুশপুত্তলিকা পোড়ানোর জন্য বাইরের কারও দায়িত্ব নিতে হয়নি, নেতাদের প্ররোচনায় সেটা করেছেন দলেরই একাংশের কর্মীরা।
আসলে গত সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগে নানা ধরনের বিভক্তি ও কোন্দল চলে আসছিল। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরের গুরুত্বপূর্ণ কোতোয়ালি আসনে নুরুল ইসলামের মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি। তাঁর নানা কর্মকাণ্ডে সেই মনোভাব প্রকাশিত হলেও নুরুল ইসলাম সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এতে দলীয় কর্মীদের ওপর মেয়রের প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। নগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে যাঁরা নানা কারণে বিরক্ত ছিলেন, মেয়রের ওপর তাঁরা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের ক্ষোভ-দুঃখের কথাও বলতে শুরু করেছেন এ সময় থেকে।
একসময়কার ঘনিষ্ঠ সতীর্থ মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে মেয়রের মতান্তর ঘটেছে আরও আগে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাভোগের পর বেরিয়ে এসেই তিনি বিষোদ্গার করতে থাকেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনরত মঞ্জুরুল আলমের ওপর।
নানাভাবে মেয়রের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মঞ্জুরুল আলম দল ও নেতার (মহিউদ্দিন চৌধুরীর) ওপর থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করেন। এভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিঃসঙ্গ হতে শুরু করেন মহিউদ্দিন। এখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে মন্ত্রী আফসারুল আমীন ও সীতাকুণ্ডের সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টার ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তাঁকে সমর্থন করার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে।
এর মধ্যে মেয়রের বাড়িতে বিএনপির দলীয় সাংসদ ও নানা কারণে বিতর্কিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সদলবলে আতিথ্য গ্রহণ এবং গৃহকর্তার আন্তরিক মেহমানদারি উপদলীয় উত্তাপে আরও কিছুটা ঘি ঢেলেছে।
এ অবস্থায় পশ্চিম পটিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে নতুন করে বিরোধে জড়িয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর ফলে নতুন এক মেরুকরণ হয়েছে। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’—এ নীতিতে নুরুল ইসলাম ও তাঁর সমমনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর। সদ্য প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা এম এ মান্নানের শোকসভা ও মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে পৃথকভাবে। পরস্পরের অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন দুপক্ষের নেতা-কর্মীরা। এমনকি রাজপথেও পরস্পরের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, আখতারুজামান-মহিউদ্দিন বিরোধ এককালে এ অঞ্চলে বহুল আলোচিত একটি বিষয় ছিল। বহু সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এ বিরোধকে ঘিরে। পরবর্তীকালে হুমায়ুন জহির হত্যা মামলা ও ইউসিবিএল ব্যাংক দখলের ঘটনায় জড়িয়ে বেকায়দায় পড়েন আখতারুজ্জামান। সে সময় একদিকে সংসদ নির্বাচনে তাঁর পরাজয় ও অন্যদিকে বিরোধী দলে থেকেও মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিনের বিরাট জয় তাঁকে প্রায় দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো আখতারুজ্জামানের সেনাপতি বলে কথিত আ জ ম নাসির দুর্দিনে তাঁকে ছেড়ে গেলে, বলা চলে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সমঝোতার পথ ধরেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। লালদিঘির মাঠের জনসভায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী মহিউদ্দিনকে তাঁর নেতা ঘোষণা করে দৃশ্যত বিরোধের অবসান ঘটান এবং কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলেন।
সময় বদলেছে। গত সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আবার রাজনীতির মাঠে জায়গা করে নিয়েছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। ইতিমধ্যে মেয়র মহিউদ্দিনের সঙ্গে এখানকার অন্যান্য নেতার দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করার সুযোগও তৈরি হয়েছে তাঁর জন্য।
এখন এই এত বছর পর আবার এই দুই নেতার কর্মকাণ্ড কর্মী-সমর্থক, এমনকি এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনেও তৈরি করেছে শঙ্কা। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিছুদিন আগে এক জনসভায় পশ্চিম পটিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিতে গেলে আখতারুজ্জামানের সমর্থকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন মেয়র। সভাস্থলে চেয়ার ছুড়ে, স্লোগান দিয়ে মেয়রের এ উদ্যোগকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন আখতারুজ্জামানের সমর্থকেরা। এর জের ধরে পক্ষে-বিপক্ষে সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মিছিল-মিটিং ইত্যাদি এখন চলছে প্রায় প্রতিদিনই।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য, মূল শহর থেকে মাত্র একটি নদীর দূরত্বে (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় সমাপ্তির পথে) থাকা একটি অঞ্চল এতটা অনুন্নত থাকতে পারে না। পশ্চিম পটিয়ায় এখন অনেক শিল্প-কারখানা হয়েছে। এসব অঞ্চল সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলে এর দ্রুত উন্নয়ন হবে। এতে এলাকাবাসীর জীবনের মান যেমন বাড়বে তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এ এলাকাকে উপজেলা করা। হঠাত্ করে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা চমক সৃষ্টির চেষ্টা ও হটকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ছাড়া মহিউদ্দিনের এই উদ্যোগ আইনি জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন পেছানোর একটি চক্রান্ত বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি দলের দুই নেতার টানাপোড়েনে এলাকাবাসীর এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তবে কর্মী-সমর্থকদের বাইরে সাধারণভাবে এ অঞ্চলের মানুষের ধারণা, সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলে এসব এলাকার উন্নয়ন হবে। করপোরেশনের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর উন্নয়নের উদ্যোগ ও সাফল্য বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের এক ধরনের আস্থা আছে বলেই মনে হয়। পক্ষান্তরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী এলাকার উন্নয়নে কখনো জোরালো ভূমিকা রেখেছেন—এমন দৃষ্টান্ত তাঁদের সামনে নেই।
আসলে এসব বিরোধ-বিতর্কের আড়ালে আছে অন্য এক রাজনীতি। মাত্র আট মাস পরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা। মহিউদ্দিন চৌধুরী চান তাঁর প্রভাবের পরিধি বাড়াতে। অন্যদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরীরও আছে রাজনৈতিক অভিলাষ। তাঁর ছেলে, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী মেয়র পদে দলের মনোনয়ন চান। মূল বিরোধটা এখানেই বলে মনে করেন অনেকে।
এ কথা আমরা বারবার বলি, মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাঁর আমলে হয়েছে, ইতিপূর্বে কখনোই তা হয়নি। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোই এখন যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিভিন্ন মাতৃসদন) কার্যক্রম হতাশাব্যঞ্জক, রাস্তাঘাটের অবস্থা করুণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সাফল্য দেখাতে পারছে না করপোরেশন। নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির চেষ্টার বদলে করপোরেশনের আয়-বৃদ্ধির ব্যাপারেই (যেমন—বহুতল ভবন নির্মাণ ও ফ্ল্যাট বিক্রি, জমি কিনে প্লট তৈরি করে বিক্রি, বিপণিকেন্দ্র তৈরি ইত্যাদি) তাঁর মনোযোগ বেশি নিবদ্ধ বলে মনে হয়। এ কথা সত্যি, সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, ক্রমবর্ধমান এ নগরের চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। এ জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল তৈরির প্রয়োজন আছে। কিন্তু করপোরেশনের আয় বাড়াতে গিয়ে তাকে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রূপ দেওয়া, উত্তরোত্তর মুনাফা অর্জনের চেষ্টায় সেবামূলক কার্যক্রমকে ব্যাহত করা এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হতে পারে না। তৃতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মহিউদ্দিনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও একগুঁয়ে মনোভাব তাঁকে ক্রমেই দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এখন ‘একলা চলো নীতিতে’ তিনি কতটা এগোতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
Email : bishwa_chy@yahoo.com
আসলে গত সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগে নানা ধরনের বিভক্তি ও কোন্দল চলে আসছিল। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরের গুরুত্বপূর্ণ কোতোয়ালি আসনে নুরুল ইসলামের মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি। তাঁর নানা কর্মকাণ্ডে সেই মনোভাব প্রকাশিত হলেও নুরুল ইসলাম সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। এতে দলীয় কর্মীদের ওপর মেয়রের প্রভাব কিছুটা হলেও কমেছে। নগর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে যাঁরা নানা কারণে বিরক্ত ছিলেন, মেয়রের ওপর তাঁরা প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের ক্ষোভ-দুঃখের কথাও বলতে শুরু করেছেন এ সময় থেকে।
একসময়কার ঘনিষ্ঠ সতীর্থ মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে মেয়রের মতান্তর ঘটেছে আরও আগে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাভোগের পর বেরিয়ে এসেই তিনি বিষোদ্গার করতে থাকেন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালনরত মঞ্জুরুল আলমের ওপর।
নানাভাবে মেয়রের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মঞ্জুরুল আলম দল ও নেতার (মহিউদ্দিন চৌধুরীর) ওপর থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করেন। এভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিঃসঙ্গ হতে শুরু করেন মহিউদ্দিন। এখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে মন্ত্রী আফসারুল আমীন ও সীতাকুণ্ডের সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টার ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তাঁকে সমর্থন করার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে।
এর মধ্যে মেয়রের বাড়িতে বিএনপির দলীয় সাংসদ ও নানা কারণে বিতর্কিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সদলবলে আতিথ্য গ্রহণ এবং গৃহকর্তার আন্তরিক মেহমানদারি উপদলীয় উত্তাপে আরও কিছুটা ঘি ঢেলেছে।
এ অবস্থায় পশ্চিম পটিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে নতুন করে বিরোধে জড়িয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর ফলে নতুন এক মেরুকরণ হয়েছে। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’—এ নীতিতে নুরুল ইসলাম ও তাঁর সমমনাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর। সদ্য প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতা এম এ মান্নানের শোকসভা ও মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে পৃথকভাবে। পরস্পরের অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন দুপক্ষের নেতা-কর্মীরা। এমনকি রাজপথেও পরস্পরের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা দরকার, আখতারুজামান-মহিউদ্দিন বিরোধ এককালে এ অঞ্চলে বহুল আলোচিত একটি বিষয় ছিল। বহু সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে এ বিরোধকে ঘিরে। পরবর্তীকালে হুমায়ুন জহির হত্যা মামলা ও ইউসিবিএল ব্যাংক দখলের ঘটনায় জড়িয়ে বেকায়দায় পড়েন আখতারুজ্জামান। সে সময় একদিকে সংসদ নির্বাচনে তাঁর পরাজয় ও অন্যদিকে বিরোধী দলে থেকেও মেয়র নির্বাচনে মহিউদ্দিনের বিরাট জয় তাঁকে প্রায় দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়। ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো আখতারুজ্জামানের সেনাপতি বলে কথিত আ জ ম নাসির দুর্দিনে তাঁকে ছেড়ে গেলে, বলা চলে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে সমঝোতার পথ ধরেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। লালদিঘির মাঠের জনসভায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী মহিউদ্দিনকে তাঁর নেতা ঘোষণা করে দৃশ্যত বিরোধের অবসান ঘটান এবং কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে তোলেন।
সময় বদলেছে। গত সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আবার রাজনীতির মাঠে জায়গা করে নিয়েছেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। ইতিমধ্যে মেয়র মহিউদ্দিনের সঙ্গে এখানকার অন্যান্য নেতার দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করার সুযোগও তৈরি হয়েছে তাঁর জন্য।
এখন এই এত বছর পর আবার এই দুই নেতার কর্মকাণ্ড কর্মী-সমর্থক, এমনকি এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনেও তৈরি করেছে শঙ্কা। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিছুদিন আগে এক জনসভায় পশ্চিম পটিয়ার পাঁচটি ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিতে গেলে আখতারুজ্জামানের সমর্থকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন মেয়র। সভাস্থলে চেয়ার ছুড়ে, স্লোগান দিয়ে মেয়রের এ উদ্যোগকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেন আখতারুজ্জামানের সমর্থকেরা। এর জের ধরে পক্ষে-বিপক্ষে সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, মিছিল-মিটিং ইত্যাদি এখন চলছে প্রায় প্রতিদিনই।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য, মূল শহর থেকে মাত্র একটি নদীর দূরত্বে (তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় সমাপ্তির পথে) থাকা একটি অঞ্চল এতটা অনুন্নত থাকতে পারে না। পশ্চিম পটিয়ায় এখন অনেক শিল্প-কারখানা হয়েছে। এসব অঞ্চল সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলে এর দ্রুত উন্নয়ন হবে। এতে এলাকাবাসীর জীবনের মান যেমন বাড়বে তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্য, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল এ এলাকাকে উপজেলা করা। হঠাত্ করে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা চমক সৃষ্টির চেষ্টা ও হটকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তা ছাড়া মহিউদ্দিনের এই উদ্যোগ আইনি জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন পেছানোর একটি চক্রান্ত বলে মনে করেন তিনি।
সরকারি দলের দুই নেতার টানাপোড়েনে এলাকাবাসীর এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। তবে কর্মী-সমর্থকদের বাইরে সাধারণভাবে এ অঞ্চলের মানুষের ধারণা, সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলে এসব এলাকার উন্নয়ন হবে। করপোরেশনের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর উন্নয়নের উদ্যোগ ও সাফল্য বিষয়ে এ অঞ্চলের মানুষের এক ধরনের আস্থা আছে বলেই মনে হয়। পক্ষান্তরে আখতারুজ্জামান চৌধুরী এলাকার উন্নয়নে কখনো জোরালো ভূমিকা রেখেছেন—এমন দৃষ্টান্ত তাঁদের সামনে নেই।
আসলে এসব বিরোধ-বিতর্কের আড়ালে আছে অন্য এক রাজনীতি। মাত্র আট মাস পরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হওয়ার কথা। মহিউদ্দিন চৌধুরী চান তাঁর প্রভাবের পরিধি বাড়াতে। অন্যদিকে আখতারুজ্জামান চৌধুরীরও আছে রাজনৈতিক অভিলাষ। তাঁর ছেলে, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী মেয়র পদে দলের মনোনয়ন চান। মূল বিরোধটা এখানেই বলে মনে করেন অনেকে।
এ কথা আমরা বারবার বলি, মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যেভাবে সোচ্চার ছিলেন, যত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাঁর আমলে হয়েছে, ইতিপূর্বে কখনোই তা হয়নি। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে প্রশংসিত কর্মকাণ্ডের অনেকগুলোই এখন যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিভিন্ন মাতৃসদন) কার্যক্রম হতাশাব্যঞ্জক, রাস্তাঘাটের অবস্থা করুণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও সাফল্য দেখাতে পারছে না করপোরেশন। নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির চেষ্টার বদলে করপোরেশনের আয়-বৃদ্ধির ব্যাপারেই (যেমন—বহুতল ভবন নির্মাণ ও ফ্ল্যাট বিক্রি, জমি কিনে প্লট তৈরি করে বিক্রি, বিপণিকেন্দ্র তৈরি ইত্যাদি) তাঁর মনোযোগ বেশি নিবদ্ধ বলে মনে হয়। এ কথা সত্যি, সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, ক্রমবর্ধমান এ নগরের চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। এ জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল তৈরির প্রয়োজন আছে। কিন্তু করপোরেশনের আয় বাড়াতে গিয়ে তাকে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের রূপ দেওয়া, উত্তরোত্তর মুনাফা অর্জনের চেষ্টায় সেবামূলক কার্যক্রমকে ব্যাহত করা এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হতে পারে না। তৃতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মহিউদ্দিনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও একগুঁয়ে মনোভাব তাঁকে ক্রমেই দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এখন ‘একলা চলো নীতিতে’ তিনি কতটা এগোতে পারেন, সেটাই দেখার বিষয়।
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
Email : bishwa_chy@yahoo.com
No comments