খাদ্যের জনসংখ্যা তত্ত্ব যখন বৈষম্য লুকায়
৬ অক্টোবর প্রথম আলোয় এ জেড এম আবদুল আলীর জনসংখ্যা ও খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষণটি পড়ে কিছু প্রসঙ্গ তুলে ধরা জরুরি মনে হয়েছে। লেখাটিতে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা খাদ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি—এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি তথাকথিত উচ্চফলনশীল গমের উদ্ভাবক, নোবেলজয়ী নরম্যান বোরল্যগের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তাঁর মতে, বোরল্যগের অবদানের কারণে পৃথিবীতে অনেক সময় দুর্ভিক্ষ আসেনি। তবে বোরল্যগের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি দাবি করেছেন, জনসংখ্যা যদি বাড়তে থাকে, তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা হাজারো প্রযুক্তি দিয়ে নিশ্চিত করা যাবে না। বোরল্যগের অবদান কিংবা আবদুল আলীর খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক আশঙ্কা, কোনোটি নিয়ে আমার সংশয় নেই। খাদ্য নিরাপত্তাকে তুলে ধরতে গিয়ে জনসংখ্যাকে যেভাবে সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে, তার ওপর আমার সংশয়। এমন সময়ে আবদুল আলী এটি লিখেছেন যখন বাজারে অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েই চলছে। এ লেখা পড়ে মনে হতে পারে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেই খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে আর এ কারণেই বাড়তি দাম। অথচ চিনির মজুদবিষয়ক সামপ্রতিক সংবাদগুলো কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। একই সঙ্গে চাল-ডালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও মজুদদারির সঙ্গে সম্পর্কিত।
খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষণে আবদুল আলীর জনসংখ্যা তত্ত্বের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পেতে অমর্ত্য সেনের কাজ আমাদের সহয়তা করতে পারে। অমর্ত্য সেন ও বোরল্যগের কাজের জায়গা ভিন্ন। কিন্তু তিনি খাদ্যের সংকটবিষয়ক যে তত্ত্ব দেন, তা আমাদের বুঝতে শেখায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা তৈরি হয় না বরং খাদ্য ব্যবস্থাপনাই খাদ্য নিরাপত্তার প্রধানতম বিষয়। খাদ্য অব্যবস্থাপনার কারণে যথেষ্ট জোগান থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে, যার উদাহরণ তিনি তাঁর দুর্ভিক্ষবিষয়ক বিশ্লেষণগুলোতে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ তার একটি উদাহরণ। খাদ্যের উত্পাদন ও এর মোট চাহিদা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উত্পাদিত শস্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করে শস্য জ্বালানি উত্পাদনে ব্যবহার করলে তো সংকট বাড়তেই পারে। ২০০৭ সালে খাদ্যসংকটের একটি বড় কারণ ছিল খাদ্যশস্যকে জ্বালানির কাজে ব্যবহার। তখন খাদ্য উত্পাদন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি ছিল। অথচ আবদুল আলীর লেখাতে কেবল জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণকেই তুলে ধরা হয়েছে। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের খাদ্যশস্য নিয়ে যথেচ্ছ ব্যবহারের কথা বলা হয়নি।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জনসংখ্যা তত্ত্ব সব ধরনের খাদ্য বাণিজ্য ও শোষণের বৈধতা দেয়। বোঝাতে চায়, জনগণ যে হারে বেড়েছে সে হারে খাবার বাড়েনি, এ কারণে সংকট। অথচ খাদ্যসংকট যখন দেখা দেয় তখন ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী একজন মানুষ আর বস্তিতে বসবাসকারী একজন রিকশাওয়ালার কি একই সংকট হয়? জনসংখ্যা বাড়ার কারণেই যদি খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তাহলে সব জনগণ সমান ভোগান্তিতে পড়ে না কেন? নাকি গরিবরাই কেবল জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং এ কারণেই ভোগান্তিটা তাদের? আসল কথা হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা। আমরা কী কাজ করি এবং সেই কাজ কীভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ায়, তা-ই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ধরন কী হবে। কেবল জনসংখ্যাকে দোষ দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা না করে, খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে দারিদ্র্য বিমোচন।
মুজীবুল আনাম লাবীব
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষণে আবদুল আলীর জনসংখ্যা তত্ত্বের সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পেতে অমর্ত্য সেনের কাজ আমাদের সহয়তা করতে পারে। অমর্ত্য সেন ও বোরল্যগের কাজের জায়গা ভিন্ন। কিন্তু তিনি খাদ্যের সংকটবিষয়ক যে তত্ত্ব দেন, তা আমাদের বুঝতে শেখায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা তৈরি হয় না বরং খাদ্য ব্যবস্থাপনাই খাদ্য নিরাপত্তার প্রধানতম বিষয়। খাদ্য অব্যবস্থাপনার কারণে যথেষ্ট জোগান থাকা সত্ত্বেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে, যার উদাহরণ তিনি তাঁর দুর্ভিক্ষবিষয়ক বিশ্লেষণগুলোতে তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী দুর্ভিক্ষ তার একটি উদাহরণ। খাদ্যের উত্পাদন ও এর মোট চাহিদা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উত্পাদিত শস্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহার না করে শস্য জ্বালানি উত্পাদনে ব্যবহার করলে তো সংকট বাড়তেই পারে। ২০০৭ সালে খাদ্যসংকটের একটি বড় কারণ ছিল খাদ্যশস্যকে জ্বালানির কাজে ব্যবহার। তখন খাদ্য উত্পাদন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি ছিল। অথচ আবদুল আলীর লেখাতে কেবল জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণকেই তুলে ধরা হয়েছে। তথাকথিত উন্নত বিশ্বের খাদ্যশস্য নিয়ে যথেচ্ছ ব্যবহারের কথা বলা হয়নি।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে জনসংখ্যা তত্ত্ব সব ধরনের খাদ্য বাণিজ্য ও শোষণের বৈধতা দেয়। বোঝাতে চায়, জনগণ যে হারে বেড়েছে সে হারে খাবার বাড়েনি, এ কারণে সংকট। অথচ খাদ্যসংকট যখন দেখা দেয় তখন ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী একজন মানুষ আর বস্তিতে বসবাসকারী একজন রিকশাওয়ালার কি একই সংকট হয়? জনসংখ্যা বাড়ার কারণেই যদি খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তাহলে সব জনগণ সমান ভোগান্তিতে পড়ে না কেন? নাকি গরিবরাই কেবল জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং এ কারণেই ভোগান্তিটা তাদের? আসল কথা হচ্ছে, ব্যবস্থাপনা। আমরা কী কাজ করি এবং সেই কাজ কীভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ায়, তা-ই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার ধরন কী হবে। কেবল জনসংখ্যাকে দোষ দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা না করে, খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে দারিদ্র্য বিমোচন।
মুজীবুল আনাম লাবীব
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments