প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে ভাবনা by দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা আনন্দিত যে, সর্বসাধারণের জন্য এ খসড়া নীতির ওপর সুপারিশের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি যেকোনো সরকারের জন্যই একটি বড় প্রাপ্তি। জনগণকে নিয়ে জনগণেরই কল্যাণে নীতিমালা তৈরি করাটাই তো গণতন্ত্রের মূল কথা। বাংলাদেশ সে আদর্শ পথে চলতে শুরু করছে।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের, বিশেষত শিক্ষা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এই নিবন্ধ লেখার উদ্যোগ সেটারই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। আমরা খেয়াল করে দেখেছি, শিক্ষানীতি ২০০৯ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হলেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে এ নীতিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, এর বিশ্লেষণ পত্রপত্রিকায় খুব একটা আসেনি। ফলে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে শিক্ষানীতিতে কী আছে, বা যা আছে তা কতটা বাস্তবসম্মত, বা আদৌ উপযুক্ত কি না, সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। আমরা যাঁরা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি, তাঁদেরই কাজটি করতে হবে বলে আমাদের এই প্রয়াস।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়া প্রতিবেদনটিতে ‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা’ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, খসড়া নীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ২৩ নম্বর লক্ষ্যটি হলো ‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা’, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। বলা বাহুল্য, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’, অর্থাত্ এটি আইনের মাধ্যমে সিদ্ধ একটি অধিকার। শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত, কীভাবে এ আইনসিদ্ধ অধিকার অর্জন করতে তাদের সহায়তা করা যাবে। এখানে আমাদের প্রস্তাব হলো—‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সমান অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং শিখনের জন্য উপযোগী অবকাঠামো উপকরণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।’
অনেকে মনে করেন, সব প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হয়তো বিশেষ বা পৃথক স্কুলে লেখাপড়া করবে। কিন্তু ‘একীভূত শিক্ষা’ ধারণা থেকে আমরা বুঝি যে, মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার সব প্রতিবন্ধী শিশু/শিক্ষার্থী সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। প্রয়োজন শুধু পাঠ্যক্রমে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। তবে এটা অনস্বীকার্য, গুরুতর মাত্রায় প্রতিবন্ধিতার ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘বিশেষ স্কুল’ থাকতে হবে। ‘প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা’ অধ্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অংশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের (যারা সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে সক্ষম হবে) জন্য পৃথকভাবে কৌশল নির্ধারণ করা রয়েছে। এ অধ্যায়ে ‘প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা’ অংশে একটি নতুন কৌশল সংযোজনের সুপারিশ করছি। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি বড় অংশ শিক্ষার মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে, যদি সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বলা হয়েছে, ‘৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে।’ এ শিক্ষাস্তরে যদি তাদের প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত ও চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করা হয়, তবে অতি শৈশবেই তার প্রতিবন্ধিতা নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তাই একটি নতুন কৌশল হতে পারে, ‘প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের ভর্তির সময়ই বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা।’ এতে যদি কোনো শিশুর প্রতিবন্ধিতার লক্ষণ পাওয়া যায়, তবে দ্রুত তাকে প্রাথমিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে ওই শিশুকে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পাওয়া যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কীভাবে এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চালাবেন। এখানে বলা যায়, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ অধ্যায়ের অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো, ‘...প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের বিশেষ শিখন চাহিদা অনুসারে শিখনসেবা দেওয়ার কলাকৌশল অর্জনে সহায়তা করা’ অর্থাত্ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ওই প্রশিক্ষণে শনাক্তকরণ বিষয়টি যুক্ত করলেই তাঁরা কাজটি করতে সমর্থ হবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অংশে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির বয়স ৬+ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় বিবেচনা করা জরুরি। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিবন্ধিতার মাত্রা অনুযায়ী তাদের বিকাশে বিলম্ব হতে পারে। ফলে দেখা যায়, কোনো কোনো শিশু হয়তো আট বছর বা সাত বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে সক্ষম হবে। আমাদের সুপারিশ হলো, প্রাথমিক স্তরে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তির বয়সটা প্রয়োজনবোধে নমনীয় হওয়া উচিত। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধ্যায়গুলোতেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কৌশলের উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বিশেষত, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের (দৃষ্টি, শ্রবণ, শারীরিক) ভর্তির প্রক্রিয়ায় তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে কিছু নমনীয়তা রাখার সুপারিশ করছি।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সাধারণ/একীভূত শিক্ষায় লেখাপড়া করবে, তাদের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন-ব্যবস্থায় বিশেষ বিবেচনা করা উচিত। এখানে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। দৃষ্টি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এ পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারে। দৃষ্টিগত সমস্যার কারণে তারা অনেক প্রশ্নের উত্তর (যেমন জ্যামিতিবিষয়ক প্রশ্ন) করতে পারবে না। তাদের ক্ষেত্রে পরিপূরক কী ব্যবস্থা রাখা হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য মাধ্যমিক স্তরের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ পদ্ধতিতে যেখানে চিত্রসংবলিত প্রশ্ন বা যে প্রশ্নের উত্তর করার জন্য কোনো ডায়াগ্রাম বা মডেল প্রশ্নে দেওয়া থাকে, সে প্রশ্নের উত্তর তারা করতে পারে না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এখানে আমাদের প্রস্তাব হলো, পাবলিক পরীক্ষায় কতজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে, এর একটি রেকর্ড বোর্ডের কাছে থাকতে হবে এবং সে সংখ্যা অনুযায়ী বোর্ড প্রশ্নপত্রে ওই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর জন্য বিকল্প প্রশ্ন রাখবে।
অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যায় ১৮-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অধ্যায় ১৮-তে রয়েছে—‘বিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, স্কাউট ও গার্ল গাইড এবং ব্রতচারী’। এ অধ্যায়টি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ‘বিশেষ শিক্ষা’ শিরোনামে আসতে হবে। কারণ, বিশেষ শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শিক্ষাপদ্ধতি। এটা কখনোই অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আসতে পারে না। এখানে তারাই অংশ নেবে, যারা গুরুতর প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণ বিদ্যালয়ে অংশ নিতে পারছে না। এদের শিক্ষাব্যবস্থাটি হবে একই সঙ্গে আধুনিক ও প্রায়োগিক। ফলে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায় হিসেবে এটিকে বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশে একীভূত শিক্ষার প্রচলন হয়েছে। সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা ও শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বের সঙ্গে একীভূত শিক্ষাকে বিবেচনা করছে। ফলে বিশেষ শিক্ষার সঙ্গে একীভূত শিক্ষাকে সমন্বয় করেও ১৮ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হতে পারে ‘একীভূত শিক্ষা ও বিশেষ শিক্ষা’।
এ অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী প্রয়োজন। এখানে অনেকবার ‘মানসিক সমস্যা’ কথাটি ব্যবহূত হয়েছে। ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক সমস্যা’ কখনোই এক কথা নয়। এ কারণে ‘মানসিক সমস্যা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া এ অধ্যায়ে ‘সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু’ করার কথা বলা হয়েছে; এর বদলে ‘একীভূত শিক্ষা’ শব্দগুলো ব্যবহার করাই শ্রেয়। ৫ নম্বর কৌশলে ‘বচন ও মানসিক প্রতিবন্ধী’ বলা হয়েছে; এর পরিবর্তে ‘ভাব প্রকাশ বা যোগাযোগ অক্ষমতা ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ব্যবহারের প্রস্তাব করছি।
আমরা আশা করি, শিক্ষানীতির খসড়াটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার আগে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার-বিষয়ক সনদ ২০০৬ (ইউএনসিআরপিডি) অন্যতম দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার: শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের, বিশেষত শিক্ষা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। এই নিবন্ধ লেখার উদ্যোগ সেটারই ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। আমরা খেয়াল করে দেখেছি, শিক্ষানীতি ২০০৯ নিয়ে নানামুখী আলোচনা হলেও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে এ নীতিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে, এর বিশ্লেষণ পত্রপত্রিকায় খুব একটা আসেনি। ফলে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা নিয়ে শিক্ষানীতিতে কী আছে, বা যা আছে তা কতটা বাস্তবসম্মত, বা আদৌ উপযুক্ত কি না, সেটার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। আমরা যাঁরা প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছি, তাঁদেরই কাজটি করতে হবে বলে আমাদের এই প্রয়াস।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর খসড়া প্রতিবেদনটিতে ‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা’ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, খসড়া নীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ২৩ নম্বর লক্ষ্যটি হলো ‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা’, যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। বলা বাহুল্য, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’, অর্থাত্ এটি আইনের মাধ্যমে সিদ্ধ একটি অধিকার। শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত, কীভাবে এ আইনসিদ্ধ অধিকার অর্জন করতে তাদের সহায়তা করা যাবে। এখানে আমাদের প্রস্তাব হলো—‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সমান অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং শিখনের জন্য উপযোগী অবকাঠামো উপকরণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।’
অনেকে মনে করেন, সব প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী হয়তো বিশেষ বা পৃথক স্কুলে লেখাপড়া করবে। কিন্তু ‘একীভূত শিক্ষা’ ধারণা থেকে আমরা বুঝি যে, মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার সব প্রতিবন্ধী শিশু/শিক্ষার্থী সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। প্রয়োজন শুধু পাঠ্যক্রমে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন। তবে এটা অনস্বীকার্য, গুরুতর মাত্রায় প্রতিবন্ধিতার ক্ষেত্রে অবশ্যই ‘বিশেষ স্কুল’ থাকতে হবে। ‘প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা’ অধ্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অংশে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের (যারা সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে সক্ষম হবে) জন্য পৃথকভাবে কৌশল নির্ধারণ করা রয়েছে। এ অধ্যায়ে ‘প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা’ অংশে একটি নতুন কৌশল সংযোজনের সুপারিশ করছি। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিবন্ধী শিশুদের একটি বড় অংশ শিক্ষার মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে, যদি সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বলা হয়েছে, ‘৫+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে।’ এ শিক্ষাস্তরে যদি তাদের প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত ও চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করা হয়, তবে অতি শৈশবেই তার প্রতিবন্ধিতা নির্ণয় করা সম্ভব হবে। তাই একটি নতুন কৌশল হতে পারে, ‘প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের ভর্তির সময়ই বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা।’ এতে যদি কোনো শিশুর প্রতিবন্ধিতার লক্ষণ পাওয়া যায়, তবে দ্রুত তাকে প্রাথমিক প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে এবং এর মাধ্যমে ওই শিশুকে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পাওয়া যাবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কীভাবে এই শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া চালাবেন। এখানে বলা যায়, ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ অধ্যায়ের অন্যতম একটি লক্ষ্য হলো, ‘...প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের বিশেষ শিখন চাহিদা অনুসারে শিখনসেবা দেওয়ার কলাকৌশল অর্জনে সহায়তা করা’ অর্থাত্ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ওই প্রশিক্ষণে শনাক্তকরণ বিষয়টি যুক্ত করলেই তাঁরা কাজটি করতে সমর্থ হবেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অংশে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির বয়স ৬+ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় বিবেচনা করা জরুরি। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিবন্ধিতার মাত্রা অনুযায়ী তাদের বিকাশে বিলম্ব হতে পারে। ফলে দেখা যায়, কোনো কোনো শিশু হয়তো আট বছর বা সাত বছর বয়সে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে সক্ষম হবে। আমাদের সুপারিশ হলো, প্রাথমিক স্তরে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তির বয়সটা প্রয়োজনবোধে নমনীয় হওয়া উচিত। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধ্যায়গুলোতেও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কৌশলের উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। বিশেষত, প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের (দৃষ্টি, শ্রবণ, শারীরিক) ভর্তির প্রক্রিয়ায় তাদের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনা করে কিছু নমনীয়তা রাখার সুপারিশ করছি।
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সাধারণ/একীভূত শিক্ষায় লেখাপড়া করবে, তাদের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন-ব্যবস্থায় বিশেষ বিবেচনা করা উচিত। এখানে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। দৃষ্টি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়ছে, তারা এ পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়তে পারে। দৃষ্টিগত সমস্যার কারণে তারা অনেক প্রশ্নের উত্তর (যেমন জ্যামিতিবিষয়ক প্রশ্ন) করতে পারবে না। তাদের ক্ষেত্রে পরিপূরক কী ব্যবস্থা রাখা হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একই কথা প্রযোজ্য মাধ্যমিক স্তরের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও। বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু ‘সৃজনশীল প্রশ্ন’ পদ্ধতিতে যেখানে চিত্রসংবলিত প্রশ্ন বা যে প্রশ্নের উত্তর করার জন্য কোনো ডায়াগ্রাম বা মডেল প্রশ্নে দেওয়া থাকে, সে প্রশ্নের উত্তর তারা করতে পারে না। বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। এখানে আমাদের প্রস্তাব হলো, পাবলিক পরীক্ষায় কতজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে, এর একটি রেকর্ড বোর্ডের কাছে থাকতে হবে এবং সে সংখ্যা অনুযায়ী বোর্ড প্রশ্নপত্রে ওই নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর জন্য বিকল্প প্রশ্ন রাখবে।
অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যায় ১৮-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অধ্যায় ১৮-তে রয়েছে—‘বিশেষ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, স্কাউট ও গার্ল গাইড এবং ব্রতচারী’। এ অধ্যায়টি সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ‘বিশেষ শিক্ষা’ শিরোনামে আসতে হবে। কারণ, বিশেষ শিক্ষা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শিক্ষাপদ্ধতি। এটা কখনোই অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আসতে পারে না। এখানে তারাই অংশ নেবে, যারা গুরুতর প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণ বিদ্যালয়ে অংশ নিতে পারছে না। এদের শিক্ষাব্যবস্থাটি হবে একই সঙ্গে আধুনিক ও প্রায়োগিক। ফলে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায় হিসেবে এটিকে বিবেচনা করাই যুক্তিযুক্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশে একীভূত শিক্ষার প্রচলন হয়েছে। সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা ও শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বের সঙ্গে একীভূত শিক্ষাকে বিবেচনা করছে। ফলে বিশেষ শিক্ষার সঙ্গে একীভূত শিক্ষাকে সমন্বয় করেও ১৮ নম্বর অধ্যায়ের শিরোনাম হতে পারে ‘একীভূত শিক্ষা ও বিশেষ শিক্ষা’।
এ অধ্যায়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী প্রয়োজন। এখানে অনেকবার ‘মানসিক সমস্যা’ কথাটি ব্যবহূত হয়েছে। ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ও ‘মানসিক সমস্যা’ কখনোই এক কথা নয়। এ কারণে ‘মানসিক সমস্যা’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া এ অধ্যায়ে ‘সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু’ করার কথা বলা হয়েছে; এর বদলে ‘একীভূত শিক্ষা’ শব্দগুলো ব্যবহার করাই শ্রেয়। ৫ নম্বর কৌশলে ‘বচন ও মানসিক প্রতিবন্ধী’ বলা হয়েছে; এর পরিবর্তে ‘ভাব প্রকাশ বা যোগাযোগ অক্ষমতা ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা’ ব্যবহারের প্রস্তাব করছি।
আমরা আশা করি, শিক্ষানীতির খসড়াটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার আগে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার-বিষয়ক সনদ ২০০৬ (ইউএনসিআরপিডি) অন্যতম দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
দিবা হোসেন ও শাহরিয়ার হায়দার: শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments