সমাজব্যবস্থা -শিক্ষা ও ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ বিষয়ে খানিকটা
না, কথাগুলো ঠিক শিক্ষানীতি নিয়ে নয়। বরং বলা যায় আলোচনাটা গোটা সমাজের রীতিনীতি তথা সমাজব্যবস্থা নিয়েই। ওয়েবসাইটে শিক্ষানীতি আসার পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে নানা মতামত পাওয়া যাচ্ছে। এবং আমরা দেখছি, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে শিক্ষা-দর্শন, সেক্যুলার শিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষা, প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বস্তরে একই পদ্ধতির শিক্ষা, শিক্ষার ব্যয়ভার মেটাতে রাষ্ট্রীয় দায়সহ আরও কতিপয় ক্ষেত্রে গুরুতর সব বৈপরীত্য রয়েছে বলে অনেকেই মত দিচ্ছে। ধরে নেওয়া গেল, সবার মতামত সমন্বয় করে শেষ পর্যন্ত একটা ‘চলনসই’ শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হলো। অবকাঠামো, লোকবল, প্রশাসনিক ও পদ্ধতিগত সংস্কার এবং অর্থের সমস্যার সমাধানও মেলানো গেল। কিন্তু তারপর কী হবে? শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জনে এককভাবে একটা ‘ভালো’ শিক্ষানীতির প্রভাব কতটা—এই প্রশ্ন কি সামনে চলে আসবে না?
‘খাপ খাওয়ানো’ বলে একটা কথা আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক পাঠদানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের যে আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হয়, সমাজের সামগ্রিক রীতিনীতি ও আচরণে সেই আদর্শের অনুশীলন বা প্রতিফলন না থাকলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবতার সঙ্গে তাদের শিক্ষাকে মেলাতে পারে না। বেখাপ্পা এই বাস্তবতায় শিক্ষার উদ্দেশ্যই শুধু ব্যাহত হয় না; মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এতে যুবসমাজের মধ্যে হতাশাসহ নানা ধরনের মনোবৈকল্য দেখা দিতে পারে। এবং যার শেষ পরিণতি হলো ব্যাধিগ্রস্ত একটা সমাজকে আরও বেশি ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলা। একটা উদাহরণের সাহায্য নিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা আছে, যেসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষ চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ‘চোরাকারবার’ নামক অপকর্মটি এসব অঞ্চলে একটা ‘স্বাভাবিক কর্ম’ হিসেবেই বিবেচিত হয়। শিক্ষার আদর্শ হিসেবে তাত্ত্বিকভাবে এই এলাকার শিশু-কিশোরদের চোরাচালানকে যতই অপকর্ম বলে শেখানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, সমাজের আদর্শে তা স্বাভাবিক কর্ম হওয়ায় তারা কিছুতেই এটাকে অপকর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে না। আমাদের সমাজে প্রায় সব অপকর্মই এখন স্বাভাবিক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বলা যায়, গোটা সমাজটাই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার ওপর পাঠ্যবইয়ে মুদ্রিত আদর্শের চেয়ে পরিবার ও সমাজে প্রচলিত আদর্শের প্রভাব অনেক বেশি। যা শিখি, সমাজের কাজকর্মের সঙ্গে তার কোনো মিল খুঁজে পাই না—খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এমন ধাক্কার বিষয়টিই বর্তমানে শিক্ষা প্রশ্নে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত বলে যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত কি না অথবা প্রশ্নটি এমনও হতে পারে যে, গোটা একটি সমাজ কি ব্যাধিগ্রস্ত হতে পারে? মনোবিজ্ঞানী বা আচরণবিজ্ঞানীরা ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ সম্পর্কে যা বলেন তার সারাত্সার হলো, সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যদি প্রচলিত আদর্শ বা কাম্য আদর্শের পরিপন্থী আচরণ করতে থাকে তবে সে সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ বলা যায়। পুরো সমাজটাই বিকল হয়ে পড়েছে, ইতিহাসে এমন নজিরও রয়েছে অনেক। এসব ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত আচরণবিধি ও রীতিনীতি সম্পূর্ণ অমানবিক ও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোটা জার্মান সমাজব্যবস্থা নািসবাদের প্রভাবে অস্বভাবী হয়ে পড়েছিল এবং বেশির ভাগ মানুষ চরম মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে নিয়োজিত হয়েছিল। রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী আদর্শহীনতা, অর্থনীতিতে চরম বৈষম্যের সুযোগ থাকা, নানা সামাজিক হিংস্রতা ও দুর্নীতি প্রভৃতি পুরো সমাজটাকেই একসময় গ্রাস করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমরা সমাজে যে আদর্শ স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা কেবল দ্রুত মিলিয়েই যায়নি; চরম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা সমাজের তলানিতে যেটুকু ভালো আদর্শ অবশিষ্ট ছিল, তাকেও ধুয়েমুছে দিয়েছে। সমাজের জন্য প্রণিধানযোগ্য আদর্শগুলোর বর্তমান সুরতহাল বিবেচনায় নিলেই এ কথার প্রমাণ মিলবে।
‘সততা’ কথাটি যেকোনো সমাজে গ্রহণযোগ্য আদর্শগুলোর মধ্যে পয়লা নম্বরে পড়ে। নৈতিকতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যসূচিতে ঘুরেফিরে নানাভাবে সততা ও নৈতিকতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সততা ও নৈতিকতার মাপকাঠি ঠিক কী—এ ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও আমাদের প্রচলিত শিক্ষাসূচিতে এটা বারবার উচ্চারিত হতে দেখা যাচ্ছে। আমরা যদি ধরে নেই, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে সততা ও নৈতিকতার মাপকাঠি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে—তাহলেই বা কী লাভ হবে? যে শিশুকে ছাপার হরফে সত্ হতে পরামর্শ দেওয়া হবে সে শিশু সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখবে যে, অসত্ ব্যক্তিরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং এসব ব্যক্তিকে সমাজ মোটেই ঘৃণার চোখে দেখছে না, বরং উল্টো তাদেরই ‘আইকন’ হিসেবে গ্রহণ করছে।
আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারও শিক্ষার অন্তর্নিহিত অন্যতম আদর্শ। আইনের শাসন বিষয়ে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন’ এমন কথা পুঁথিগতভাবে আমাদের যতই শেখানো হোক, বাস্তবতা হলো আইন প্রকারান্তরে শিষ্টকেই দমন করছে এবং দুষ্টকে করছে পালন। আইনের আশ্রয় নিতে গেলে সাধারণ মানুষকে আজ হুমকি-ধমকির শিকার হওয়া থেকে শুরু করে, ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ এমনকি প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হচ্ছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন এবং জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করার ঘটনার সময় থেকেই আমরা দেখে আসছি, রাষ্ট্র কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে এসেছে। আজও ‘ক্রসফায়ারের’ নাম করে চলছে নির্লজ্জ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এবং মনে হচ্ছে সমাজ একে সাধারণভাবেই গ্রহণ করেছে। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’—বহুল প্রচলিত এ কথাটির মধ্যে আক্ষেপ থাকলেও সমাজ এর বিরুদ্ধে খুব একটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেনি।
‘আত্মনির্ভরতা’ এবং ‘ঐক্যই শক্তি’ কথা দুটিও শিক্ষার নীতিবাক্য। কিন্তু যে সমাজের ওপরতলা অন্যের অর্জনকে ব্যবহার এবং অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত, সে সমাজের মানুষ শুধু পাঠ্যবইয়ের তত্ত্বকথায় আত্মনির্ভর হবে কীভাবে? একইভাবে সমাজে ধনী-গরিবে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে এবং নারী-পুরুষে ভেদাভেদ জিইয়ে রেখে ঐক্যের জ্ঞানদানই বা কীভাবে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে? শিক্ষার আদর্শ আর সমাজের আদর্শের মধ্যে বৈপরীত্যের তালিকা আর দীর্ঘ করার প্রয়োজন পড়ে না এ কারণে যে, সমাজের মানুষ প্রায় সবাই আজ এই বৈপরীত্যের অংশীদার।
শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষকে খাপ খাইয়ে চলতে শেখানো। তবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি হতে হবে মানুষের জন্য মঙ্গলমুখী। কিন্তু আমাদের সমাজের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে বিপরীতমুখী, যার সঙ্গে মানুষের মঙ্গলের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। বরং চরম অকল্যাণের অশনিসংকেত প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে এমন ধাঁচের পরিবর্তনের মাধ্যমে। আসলে শিক্ষার আদর্শগুলো তো কিছু কাগুজে কথা মাত্র। কাগুজে এই আদর্শগুলো সমাজের আদর্শের সঙ্গে না মিললে শিক্ষার উদ্দেশ্যই শুধু ব্যাহত হবে না, শিক্ষার্থীরাও মানসিক বৈকল্যের শিকার হবে।
একটা মঙ্গলমুখী ভালো শিক্ষানীতি কখনোই শুধু ‘শিক্ষার আওতার’ মধ্যে দৃষ্টি আটকে রেখে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে বৈষম্যহীন মাঙ্গলিক আদর্শের ভিত্তি স্থাপন করা না গেলে সে নীতি জগাখিচুড়ি হতে বাধ্য। আবার সব ক্ষেত্রে শুভমুখী আদর্শ স্থাপন করা গেলেও ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের সঙ্গে সেই আদর্শকে মেলানো কঠিন। একদিকে আমাদের সংবিধানে রয়েছে একটা এককেন্দ্রিক বা একমুখী আদর্শের সংকট, অন্যদিকে রয়েছে একটা প্রায় ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ। এই উভয়মুখী সংকট মোকাবিলা না করে শিক্ষানীতি এককভাবে এগিয়ে যাবে কী করে? প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা থাকবে কি? আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
‘খাপ খাওয়ানো’ বলে একটা কথা আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাত্ত্বিক পাঠদানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের যে আদর্শ শিক্ষা দেওয়া হয়, সমাজের সামগ্রিক রীতিনীতি ও আচরণে সেই আদর্শের অনুশীলন বা প্রতিফলন না থাকলে শিক্ষার্থীরা বাস্তবতার সঙ্গে তাদের শিক্ষাকে মেলাতে পারে না। বেখাপ্পা এই বাস্তবতায় শিক্ষার উদ্দেশ্যই শুধু ব্যাহত হয় না; মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এতে যুবসমাজের মধ্যে হতাশাসহ নানা ধরনের মনোবৈকল্য দেখা দিতে পারে। এবং যার শেষ পরিণতি হলো ব্যাধিগ্রস্ত একটা সমাজকে আরও বেশি ব্যাধিগ্রস্ত করে তোলা। একটা উদাহরণের সাহায্য নিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। সীমান্তবর্তী অনেক এলাকা আছে, যেসব এলাকার বেশির ভাগ মানুষ চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ‘চোরাকারবার’ নামক অপকর্মটি এসব অঞ্চলে একটা ‘স্বাভাবিক কর্ম’ হিসেবেই বিবেচিত হয়। শিক্ষার আদর্শ হিসেবে তাত্ত্বিকভাবে এই এলাকার শিশু-কিশোরদের চোরাচালানকে যতই অপকর্ম বলে শেখানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, সমাজের আদর্শে তা স্বাভাবিক কর্ম হওয়ায় তারা কিছুতেই এটাকে অপকর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে না। আমাদের সমাজে প্রায় সব অপকর্মই এখন স্বাভাবিক কর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বলা যায়, গোটা সমাজটাই ব্যাধিগ্রস্ত সমাজে পরিণত হয়েছে।
শিক্ষার ওপর পাঠ্যবইয়ে মুদ্রিত আদর্শের চেয়ে পরিবার ও সমাজে প্রচলিত আদর্শের প্রভাব অনেক বেশি। যা শিখি, সমাজের কাজকর্মের সঙ্গে তার কোনো মিল খুঁজে পাই না—খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে এমন ধাক্কার বিষয়টিই বর্তমানে শিক্ষা প্রশ্নে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত বলে যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত কি না অথবা প্রশ্নটি এমনও হতে পারে যে, গোটা একটি সমাজ কি ব্যাধিগ্রস্ত হতে পারে? মনোবিজ্ঞানী বা আচরণবিজ্ঞানীরা ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ সম্পর্কে যা বলেন তার সারাত্সার হলো, সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যদি প্রচলিত আদর্শ বা কাম্য আদর্শের পরিপন্থী আচরণ করতে থাকে তবে সে সমাজকে ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ বলা যায়। পুরো সমাজটাই বিকল হয়ে পড়েছে, ইতিহাসে এমন নজিরও রয়েছে অনেক। এসব ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত আচরণবিধি ও রীতিনীতি সম্পূর্ণ অমানবিক ও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোটা জার্মান সমাজব্যবস্থা নািসবাদের প্রভাবে অস্বভাবী হয়ে পড়েছিল এবং বেশির ভাগ মানুষ চরম মানবতাবিরোধী কার্যকলাপে নিয়োজিত হয়েছিল। রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী আদর্শহীনতা, অর্থনীতিতে চরম বৈষম্যের সুযোগ থাকা, নানা সামাজিক হিংস্রতা ও দুর্নীতি প্রভৃতি পুরো সমাজটাকেই একসময় গ্রাস করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমরা সমাজে যে আদর্শ স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা কেবল দ্রুত মিলিয়েই যায়নি; চরম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা সমাজের তলানিতে যেটুকু ভালো আদর্শ অবশিষ্ট ছিল, তাকেও ধুয়েমুছে দিয়েছে। সমাজের জন্য প্রণিধানযোগ্য আদর্শগুলোর বর্তমান সুরতহাল বিবেচনায় নিলেই এ কথার প্রমাণ মিলবে।
‘সততা’ কথাটি যেকোনো সমাজে গ্রহণযোগ্য আদর্শগুলোর মধ্যে পয়লা নম্বরে পড়ে। নৈতিকতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যসূচিতে ঘুরেফিরে নানাভাবে সততা ও নৈতিকতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সততা ও নৈতিকতার মাপকাঠি ঠিক কী—এ ব্যাপারে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও আমাদের প্রচলিত শিক্ষাসূচিতে এটা বারবার উচ্চারিত হতে দেখা যাচ্ছে। আমরা যদি ধরে নেই, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে সততা ও নৈতিকতার মাপকাঠি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে—তাহলেই বা কী লাভ হবে? যে শিশুকে ছাপার হরফে সত্ হতে পরামর্শ দেওয়া হবে সে শিশু সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখবে যে, অসত্ ব্যক্তিরাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত এবং এসব ব্যক্তিকে সমাজ মোটেই ঘৃণার চোখে দেখছে না, বরং উল্টো তাদেরই ‘আইকন’ হিসেবে গ্রহণ করছে।
আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারও শিক্ষার অন্তর্নিহিত অন্যতম আদর্শ। আইনের শাসন বিষয়ে ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন’ এমন কথা পুঁথিগতভাবে আমাদের যতই শেখানো হোক, বাস্তবতা হলো আইন প্রকারান্তরে শিষ্টকেই দমন করছে এবং দুষ্টকে করছে পালন। আইনের আশ্রয় নিতে গেলে সাধারণ মানুষকে আজ হুমকি-ধমকির শিকার হওয়া থেকে শুরু করে, ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ এমনকি প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হচ্ছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন এবং জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করার ঘটনার সময় থেকেই আমরা দেখে আসছি, রাষ্ট্র কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে এসেছে। আজও ‘ক্রসফায়ারের’ নাম করে চলছে নির্লজ্জ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এবং মনে হচ্ছে সমাজ একে সাধারণভাবেই গ্রহণ করেছে। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’—বহুল প্রচলিত এ কথাটির মধ্যে আক্ষেপ থাকলেও সমাজ এর বিরুদ্ধে খুব একটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেনি।
‘আত্মনির্ভরতা’ এবং ‘ঐক্যই শক্তি’ কথা দুটিও শিক্ষার নীতিবাক্য। কিন্তু যে সমাজের ওপরতলা অন্যের অর্জনকে ব্যবহার এবং অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন-প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত, সে সমাজের মানুষ শুধু পাঠ্যবইয়ের তত্ত্বকথায় আত্মনির্ভর হবে কীভাবে? একইভাবে সমাজে ধনী-গরিবে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে এবং নারী-পুরুষে ভেদাভেদ জিইয়ে রেখে ঐক্যের জ্ঞানদানই বা কীভাবে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে? শিক্ষার আদর্শ আর সমাজের আদর্শের মধ্যে বৈপরীত্যের তালিকা আর দীর্ঘ করার প্রয়োজন পড়ে না এ কারণে যে, সমাজের মানুষ প্রায় সবাই আজ এই বৈপরীত্যের অংশীদার।
শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষকে খাপ খাইয়ে চলতে শেখানো। তবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি হতে হবে মানুষের জন্য মঙ্গলমুখী। কিন্তু আমাদের সমাজের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে বিপরীতমুখী, যার সঙ্গে মানুষের মঙ্গলের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। বরং চরম অকল্যাণের অশনিসংকেত প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে এমন ধাঁচের পরিবর্তনের মাধ্যমে। আসলে শিক্ষার আদর্শগুলো তো কিছু কাগুজে কথা মাত্র। কাগুজে এই আদর্শগুলো সমাজের আদর্শের সঙ্গে না মিললে শিক্ষার উদ্দেশ্যই শুধু ব্যাহত হবে না, শিক্ষার্থীরাও মানসিক বৈকল্যের শিকার হবে।
একটা মঙ্গলমুখী ভালো শিক্ষানীতি কখনোই শুধু ‘শিক্ষার আওতার’ মধ্যে দৃষ্টি আটকে রেখে প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতিতে বৈষম্যহীন মাঙ্গলিক আদর্শের ভিত্তি স্থাপন করা না গেলে সে নীতি জগাখিচুড়ি হতে বাধ্য। আবার সব ক্ষেত্রে শুভমুখী আদর্শ স্থাপন করা গেলেও ব্যাধিগ্রস্ত সমাজের সঙ্গে সেই আদর্শকে মেলানো কঠিন। একদিকে আমাদের সংবিধানে রয়েছে একটা এককেন্দ্রিক বা একমুখী আদর্শের সংকট, অন্যদিকে রয়েছে একটা প্রায় ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ। এই উভয়মুখী সংকট মোকাবিলা না করে শিক্ষানীতি এককভাবে এগিয়ে যাবে কী করে? প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে এ বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা থাকবে কি? আমরা অপেক্ষায় রইলাম।
মলয় ভৌমিক: শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
No comments