কাউয়াদীঘি হাওরে ‘শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে’
দেখতে দেখতে মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওরের পশ্চিম আকাশে সূর্য আরও লাল হয়ে উঠেছে। ‘ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ বাড়ি ফিরছে। রাখালের দল মেঠো পথে ধুলা উড়িয়ে হাওর থেকে গরু নিয়ে ছুটছে নিজেদের গ্রামের দিকে। কেউ ফিরছেন গবাদিপশুর জন্য ঘাস নিয়ে। সাদা বকের ঝাঁক রাত কাটাতে হাওরপারের কোনো বাড়ির আশ্রয়ের দিকে উড়ে চলছে। আর নির্জনতায় ডুবে আছে সবুজ ধানের দেশ, হাওরের দিলখোলা সবুজ হৃদয়।
মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা নিয়ে ছড়ানো কাউয়াদীঘি হাওরের বুক। সম্প্রতি বসন্তের এক বিকেলে কাউয়াদীঘি হাওরের দিকে যাওয়ার পথে অন্য রকম ভালো লাগা তৈরি হতে থাকে। সদর উপজেলার একাটুনা এলাকা পার হতেই দেখা মেলে ধানখেতের পাশে ঘাস, কচুরিপানা ভরা এক টুকরো পতিত জমিনে একঝাঁক শামুকখোল পাখির সঙ্গে। গ্রামের ভেতরেই পাখিগুলো ওখানে রাজকীয় পা ফেলছে, শরীর দুলিয়ে হাঁটছে, উড়ছে, খাদ্য খুঁটে খাচ্ছে। এতটাই নিশ্চিত তাদের উপস্থিতি, কোনো ভয়ভীতি নেই। পাশেই মানুষের ঘরবাড়ি। তবু কেউই তাদের বিরক্ত করছে না। শামুকখোলের দল আপনমনে ওখানে সময় পার করছে।
ওখান থেকে কিছুটা দূরে বিরাইমাবাদ এলাকায় অপেক্ষায় তখন শহর-নগরজীবনের বাইরে অন্য এক জগৎ। হয়তো ওই এলাকার মানুষের কাছে এ রকম প্রকৃতি নতুন কিছু নয়, দিনের শেষে ও রকম সময় প্রতিদিনই একবার ফিরে আসে তাদের কাছে। তারা দেখে, তারা একসময় ভুলেও যায়। ওই গ্রাম এলাকা হাওরপারের। গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে কাউয়াদীঘি হাওরের শুরু। হাওরের সবুজ হৃদয়ে তখন মৃদু নীরবতায় গোধূলি ধোঁয়া, ধীরে সন্ধ্যা নামছে। যত দূর চোখ যায়, তত দূর বিস্তৃত শুধু ধানের সবুজ, ঘাসের সবুজ। ওখানে তখন ‘সন্ধ্যা হয়ে আসে—সন্ধ্যা হয়ে আসে/ একা একা মাঠের বাতাসে/...।’
সন্ধ্যা যে হয়ে এসেছে, তা সূর্যই মনে করিয়ে দেয়। সূর্যের দিনের কড়া, চোখ রাঙানো মেজাজ তখন আর নেই। সূর্য তখন গোল থালার মতো পলাশ ফুলের রং মেখেছে সারা দেহে। পশ্চিমের আকাশে সূর্যটা তখন একটু একটু করে ঢলে পড়েছে, হালকা কুয়াশার মতো পর্দার আড়ালে ডুবতে বসেছে। আরও কিছু সময় শেষে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই রঙের ছোপ পড়েছে হাওরের প্রতিটি ঘাসে।
হাওর উচ্চারণমাত্রই মনে হতে পারে, ওখানে আর কিছু নেই। এ এক অথই জলের দেশ। শুধু জলের সাদা বুক, আঁচড়ে পড়া ঢেউ। ছোট-বড় নৌকা ভাসছে জলের বুকে। হাওরপারের গ্রামগুলোকে মনে হতে পারে গা ডুবিয়ে সাঁতার কাটছে জলে। এখন তার ঠিক উল্টো প্রকৃতি। এখন দু-একটি বিল ছাড়া আর কোথাও জলের দেখা মেলে না। চোখের সামনে শুধু সবুজের খোলা বুক, দিগন্তজোড়া সবুজের উন্মুক্ত হৃদয়, সৌন্দর্যের অন্য হাওর প্রকৃতি।
এদিকে সূর্য ডুবছে আর অন্যদিকে হাওরের কাজ শেষে ঘরে ফিরছেন মানুষ। পথে পথে দেখা হতে থাকে রাখালদের সঙ্গে। একটু পরপরই ১০-২০টি কিংবা তারও বেশি গরু নিয়ে ফিরছিলেন রাখালেরা। তাঁরা সেই সকালবেলা হাওরপারের গ্রাম থেকে পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে গরু নিয়ে হাওরে গিয়েছিলেন। ওখানে সারা দিন গরু চরিয়েছেন। কয়েকজন গৃহপালিত গবাদিপশুর জন্য হাওর থেকে ঘাস সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরছিলেন। তাঁরাও দিনের কোনো একটা সময় ঘাস সংগ্রহ করতে হাওরে এসেছিলেন।
শুধু কি মানুষই এমন সন্ধ্যায় নিজের গ্রামে, নিজের বাড়িতে ফিরে যায়? পাখিদেরও বাড়ি আছে, বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। পাখিরাও রাত কাটাতে একা, নয়তো ঝাঁকে ঝাঁকে হাওর থেকে হাওরপারের কোনো গ্রামে তাদের নিরাপদ ঠিকানা, কোনো আশ্রয়ের দিকে ফিরছে। এই দলে আছে সাদা বকপাখি, পানকৌড়ি, শালিক-ঘুঘুর দল। তারা উড়তে উড়তে কোনো না কোনো গ্রামের দিকে হারিয়ে যেতে থাকে। কোনো ঝাঁক হাওরপারের বাড়ির গাছে দলে দলে বসে থাকে। ওই গাছেই রাত কাটবে তাদের। সকাল হলেই এসব আশ্রয় ছেড়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে হাওরের বিভিন্ন দিকে। সারা দিন এখানে-ওখানে ওড়ে, ঘুরে তারা খাবার খুঁজে খায়।
ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। সূর্যের আর দেখা পাওয়া যায় না। শুধু আলোর কিছু রেশ আকাশের দিগন্তে ফুটে আছে, কিছু আলো মেঘের দেহে লেগে আছে। কিছু সময়ের মধ্যে তা–ও মুছে যায়। একটা সময় সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যায় হাওর, হাওরপারের গ্রাম। যে যেভাবেই দেখছে, এখানে এই হাওরের বুকে প্রকৃতই ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে’...। গোধূলি ম্লান হতে হতে সন্ধ্যাটা এখানে এমনই, নিজেকে রাঙিয়ে তবে ছুটি নেয়।
গোধূলিবেলায় হাওর থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছেন রাখাল। ছবি: প্রথম আলো |
No comments