যুদ্ধেই জন্ম শিশুর, যুদ্ধেই শহীদ
চলতি বসন্তে আফনান দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। এ সময় তাঁরা একটি দারিদ্র্যপীড়িত তাঁবুতে বাস করতেন। ১৫ মাস যুদ্ধের পর একটি নাজুক যুদ্ধবিরতি তাঁদের মনে কিছুটা প্রশান্তি এনেছিল।
কিন্তু গত মঙ্গলবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) নির্বিচার বিমান হামলায় তাঁদের তাঁবুটি মাটিতে মিশে যায়। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা আফনান আল-গানাম ও তাঁদের প্রথম সন্তান মোহাম্মদ দুজনই নিহত হয়েছে।
সেদিন সাহরির সময় অকস্মাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান এসে গাজায় বোমা ফেলতে শুরু করে। এতে চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে। জিম্মিদের ছেড়ে দিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে বাধ্য করতে গাজায় হামলা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
আফনানের স্বামী আলা আবু হেলাল বলেন, ‘তারা আমাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।’ দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিসে নাসের হাসপাতালে দাঁড়িয়ে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন কাপড় দিয়ে ঢাকা ছোট্ট মোহাম্মদের মরদেহ তাঁর কোলে।
ছোট্ট সন্তানের দিকে তাকিয়ে আবু হেলাল বলেন, যুদ্ধের এক কঠিন সময়ে সে জন্ম নিয়েছে, যুদ্ধেই শহীদ হয়েছে।
কথা বলার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল এই ফিলিস্তিনি তরুণের। তিনি বলেন, তাদের (ইসরায়েল) লক্ষ্যবস্তু নিষ্পাপেরা। তারা খুব কমই জীবন দেখেছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় পারিবারিক বসতি দেখতে গিয়েছিলেন আবু হেলাল। ঠিক তখনই মাওসিতে তাদের তাঁবুতে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। খান ইউনিসের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর তাঁবু এই মাওসি এলাকায় অবস্থিত।
যুদ্ধের সময় রাফায় আবু হেলালের ঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন সেখান থেকে কোনো কিছু লুট হয়েছে কি না; তা দেখতে যান তিনি। ২০ বছর বয়সী এই তরুণ বলেন, ‘আমাকে একা রেখে তারা সবাই চলে গেছে। অনাগত শিশুটিও নিহত হয়েছে।’
গেল বছরের মে মাসে আবু হেলালের পরিবারকে রাফা ছাড়তে বাধ্য করে ইসরায়েলি বাহিনী। তার কিছুদিন আগে জন্ম নেয় তাঁর প্রথম সন্তান মোহাম্মদ। যুদ্ধে রাফা অঞ্চলের বেশির ভাগ বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই ফিলিস্তিনি তরুণ বলেন, ‘পরিবার ও শিশুদের নিরাপদ রাখতে আপনি পালিয়ে গেলেন। কিন্তু তারপরও তারা নিহত হলো। তাদের সবাই নিহত।’
গাজা উপত্যকার নেতজারিম করিডরের একটি অংশ আবার দখলে নেওয়ার পর ভয়াবহ হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। গাজায় এমন তীব্র হামলা চালানো হবে ‘যা আগে কেউ কখনো দেখেনি’ বলেও হুমকি দিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার উত্তর ও দক্ষিণ গাজাকে বিভক্তকারী কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিতে সেনা মোতায়নের তথ্য নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল প্রশাসন। নেতজারিম করিডর ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।
করিডরটি দখলে নেওয়ার পর বুধবার এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি বাহিনী জানায়, জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ কার্যকর হলে এই অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তবে আবার সেখানে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে যুদ্ধে প্রায় ৪ মাইল (৬ কিলোমিটার) দীর্ঘ এই করিডরকে সামরিক অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার করেছে ইসরায়েল।
নৃশংস ইসরায়েলি হামলায় উত্তর গাজার অনেকেই পালিয়ে দক্ষিণ গাজায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৫ মাসের সংঘাত শেষে করিডর থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে গেলে অনেকেই উত্তর গাজায় ফিরেছিলেন।
নেতজারিম করিডর দখলের পর অঞ্চলটি থেকে সব ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ইসরায়েল কাৎজ। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, মঙ্গলবারের বিমান হামলা তো কেবল ইসরায়েলি পরিকল্পনার শুরু।
কাৎজ বলেন, হামাস জিম্মিদের মুক্তি না দিলে এমন ভয়াবহ হামলা চালানো হবে, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি।
![]() |
গাজার একটি হাসপাতালের বাইরে ছোট্ট শিশুসন্তান মোহাম্মদের মরদেহ হাতে আবু হেলাল। ছবি: এপির ভিডিও থেকে নেওয়া |
No comments