বাংলাদেশি রোগী নেই: কলকাতার হাসপাতালে ত্রাহি অবস্থা
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল ও অশান্তির জেরে এবং ভারতীয় ভিসার নিয়ন্ত্রণের জন্য চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা বাংলাদেশির সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে। চূড়ান্ত গুরুতর ও আপৎকালীন অসুস্থতা ছাড়া মেডিকেল ভিসাও ভারত সরকার ইস্যু করছে না। ফলে আগস্টের পরবর্তী দু’-তিন মাস পুরনো মেডিকেল ভিসায় কিছু রোগী এলেও নতুন করে মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রেও কড়াকড়ির কারণে এখন তাও বন্ধ। অনেকে নিরাপত্তাজনিত কারণেও আসছেন না।
ভাষাগত সাযুজ্য, সুবিধাজনক থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা খরচের স্বল্পতার জন্য লাখ লাখ বাংলাদেশির স্বাভাবিক পছন্দ ছিল কলকাতা। হার্টের অসুখ থেকে শুরু করে নিউরোসার্জারি, ক্যান্সার, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, ইউরোলজিক্যাল সমস্যা, অর্থোপেডিক রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি কিংবা বন্ধ্যত্ব, সবকিছুর চিকিৎসাতেই বাংলাদেশিরা ঢাকার চেয়ে কলকাতাকে ভরসা করতেন বেশি। ভারতে বিদেশ থেকে চিকিৎসা করাতে রোগীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশই এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। এর বেশির ভাগই বেছে নিয়েছিলেন কলকাতাকে।
কলকাতায় ১০-১২টি বেসরকারি হাসপাতালেই থাকতো বাংলাদেশি রোগীদের যাতায়াত। কলকাতায় মণিপাল গোষ্ঠীর অধীন চারটি হাসপাতালে গত সাত দিন ধরে বহির্বিভাগে নতুন বাংলাদেশি রোগী নেই বললেই চলে। সূত্রের খবর, আগে মাসে ২৩০০-২৪০০ রোগী বাংলাদেশ থেকে আসতেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশের কোনো রোগী নেই ইনডোর বিভাগেও। কর্তৃপক্ষ মনে করেন, এই অবস্থা আরও কিছুদিন চলবে। বাংলাদেশের রোগীরা মূলত নগদে চিকিৎসার খরচ মেটাতেন। ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে হাসপাতালকে।
রুবি জেনারেলের সিজিএম-অপারেশনস শুভাশিস দত্ত বলেন, আগে পড়শি দেশ থেকে দিনে ৩০-৩৫ জন রোগী আসতেন। গত ১ তারিখ থেকে নতুন রোগী ভর্তিও হননি। তার কথায়, আর্থিক ক্ষতি তো হচ্ছেই। আর এন টেগোর হাসপাতাল সূত্রের খবর, বহির্বিভাগে দিনে ১৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি রোগী আসতেন। সেখানে শেষ কয়েকদিনে তা কমে শূন্যে দাঁড়িয়েছে।
বড় বড় বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়াও বাংলাদেশি রোগীর অভাবে কলকাতা ও শহরতলির ছোট-মাঝারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা খুবই সংকটজনক। এই সব হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের ব্যবসার বড় অংশ আসতো বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসা থেকে। ফলে নগদের অভাবে ভুগছে তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিউরোসার্জন জানান, বাংলাদেশের রোগীরা মূলত চিকিৎসা করান নগদে। তাদের সংখ্যা কমতে কমতে শূন্যে নেমে আসায় প্রভাব পড়েছে চিকিৎসকদের উপরেও। অস্ত্রোপচারও বন্ধ। এখন ভরসা ভারতের রোগীরা।
পিয়ারলেস হাসপাতালের সিইও সুদীপ্ত মিত্রের মতে, বাংলাদেশের যে রোগীরা চিকিৎসা করাবেন বলে স্থির করেছিলেন, তারা আসবেনই। ফলে এটা লাভ-ক্ষতির বিষয় নয়। এখন হয়তো রোগী পাচ্ছি না। আগামী দিনে তা পাবো।
কয়েকটি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, তারা ইতিমধ্যেই চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করা বাংলাদেশি রোগীদের জন্য ই-চিকিৎসা ব্যবস্থা দিচ্ছেন।অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ‘চিকিৎসা পর্যটকদের’ সংখ্যা কমায় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে। কারণ, কলকাতার বিভিন্ন বড় হাসপাতাল থেকে হোটেল, রেস্তরাঁ ব্যবসা চিকিৎসার কারণে আসা বাংলাদেশিদের উপরে নির্ভরশীল। দিল্লির আর্থিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস’র সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের চিকিৎসা পর্যটন শিল্পে সব থেকে বড় অংশীদার বাংলাদেশ। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হওয়ার পরে ভারতের চিকিৎসা পর্যটন ক্ষেত্র ধাক্কা খেয়েছে। চিকিৎসা পর্যটক কমেছে। ফলে হাসপাতাল ও তার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। কারণ, এই সব অঞ্চলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা পর্যটক আসেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে দশটি দেশ থেকে সব থেকে বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসা করাতে আসেন, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। ২০২২ সালে যে ৪ লাখ ৭৪ হাজার বিদেশি ভারতে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন, তার ৬৮.৯ শতাংশ এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। এর বাইরে বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে সীমান্তবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়ে যান।
বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা কমাতে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তাতে অন্যান্য দেশ থেকেও চিকিৎসা পর্যটন টানতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
No comments