কমালা না ট্রাম্প? by মোহাম্মদ আবুল হোসেন

 যুক্তরাষ্ট্রে কমালা হ্যারিস প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট! এ ফয়সালার ক্ষণ গণনা শুরু। দুই প্রার্থীই ম্যাজিক সংখ্যা ২৭০ এর খোঁজে। এ নিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বে এক উন্মাদনা। নতুন করে বিশ্ব জুড়ে অধীর প্রতীক্ষা। এই ম্যাজিক সংখ্যা স্পর্শ করতে অক্লান্ত পরিশ্রম ডেমোক্রেট-রিপাবলিকানদের। এর সমাধান দিতে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে রায় জানিয়ে এসেছেন। তবে কে এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন- কমালা হ্যারিস নাকি ডনাল্ড ট্রাম্প! এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে যখন আজ বুধবার সকাল তখন যুক্তরাষ্ট্রে মঙ্গলবার দিনের শেষভাগ। এরই মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। এতক্ষণে গণনা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। তাতে ৫৩৮ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে কে পান ২৭০, তা জানতে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। আট বছর আগে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন পারেননি। কমালা হ্যারিস কি পারবেন! সেই একই প্রতিদ্বন্দ্বী ডনাল্ড ট্রাম্প। কমালা হ্যারিস যদি পারেন ২৭০-এ পৌঁছে যেতে তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় রচিত হবে। তিনি হবেন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যদি ট্রাম্প নির্বাচিত হন তাহলে তিনি হবেন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর আবার নির্বাচনে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। একই সঙ্গে তিনি হবেন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ প্রান্তে এসে তারা দু’জনেই জয়ের ব্যাপারে বড় আশা প্রকাশ করেছেন। তবে এবারের নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গার মতো কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে এ জন্য কমপক্ষে ১৯টি রাজ্যে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যেসব স্থানে ভোট গণনাকেন্দ্রে সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার চারপাশে বিশেষ নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। কখন জানা যাবে এই ভোটের ফল সে সম্পর্কে অনলাইন বিবিসি বলছে- বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সময়ে ভোট গ্রহণ শেষ হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বুধবার রাত ১১টার মধ্যে সব রাজ্যের সব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে, যা গ্রিনিচ মান সময় বুধবার দিবাগত রাত ভোর ৪টা পর্যন্ত। সেই হিসেবে বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় শেষ হবে ভোট। শুধু হাওয়াই এবং আলাস্কায় আরও পরে ভোটগ্রহণ বন্ধ হবে। ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থানীয় সময় বুধবার রাত ১১টায় ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর পরই কে জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তা জানতে উত্তেজনা দেখা দেয় চারদিকে। কিন্তু কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, এবার দ্রুততার সঙ্গে এ প্রশ্নের সমাধান মিলবে না। কে জয়ী হচ্ছেন তা জানতে কয়েক ঘণ্টার পরিবর্তে কয়েক দিন লেগে যাবে বলে অনেকে মনে করেন। এক্ষেত্রে ভোটের আগে যেসব জরিপ করা হয়েছে তাও উল্টে যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে একই সঙ্গে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদেরও ভোট হচ্ছে।
গতকাল ৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়। তার মধ্যে মধ্য রাতের পরপরই প্রথম নিউ হ্যাম্পশায়ারের ডিক্সভিল নচে ভোট দেন ৬ জন ভোটার। তার মধ্যে ৩ জন ভোট দেন কমালা হ্যারিসকে এবং ৩ জন ভোট দেন ট্রাম্পকে। সেখানে বিবিসি’র সাংবাদিক কথা বলেছেন এর একজন ভোটার লেস ওটেনের সঙ্গে। তিনি রিপাবলিকান। তবে এবারই প্রথম তিনি ডেমোক্রেট প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, হ্যারিস ভোটারদের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল। তাই তাকে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে ভোটারদের কাছ থেকে আনুগত্য চান ট্রাম্প। এ জন্য তিনি ট্রাম্পকে ভোট দেননি। যখন এই লেখা পাঠকের হাতে তখন ভোট গণনা চলছে। সামান্য দু’চারটি স্থান থেকে ফল আসতে শুরু করেছে হয়তো। কিন্তু কে হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্তও কোনো আভাস পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে কঠিন ও হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচন। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জনমত জরিপে সামান্য এক পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন কমালা হ্যারিস। তাকে সমর্থন করছিলেন শতকরা ৪৯ ভাগ ভোটার। অন্যদিকে ট্রাম্পকে সমর্থন করছিলেন শতকরা ৪৮ ভাগ। সার্বিক পরিস্থিতি এমন হলেও গুরুত্বপূর্ণ ৭ সুইং স্টেটের মধ্যে জনসমর্থনে সামান্য এগিয়ে ছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। কমালা এগিয়ে ছিলেন মাত্র দু’টিতে। নির্বাচনের আগের দিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যদিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন দুই প্রার্থী ট্রাম্প ও কমালা। সুইং স্টেট বিশেষ করে পেনসিলভ্যানিয়া ও মিশিগানে তাদেরকে বেশি ব্যস্ত দেখা গেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। অন্যদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস তার সমর্থকদের অধিক উন্নত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সবাইকে নিয়ে সেই ভবিষ্যৎ গড়তে চান তিনি। স্লোগানরত প্রার্থীদের বলেছেন- আমরা আর পেছনে ধাবিত হবো না। ৫ই নভেম্বর ভোট শুরুর আগেই প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। তবে তার ফল জানা সম্ভব হয়নি। কারণ, সেসব ভোট গণনা করা হবে গতকাল অনুষ্ঠিত ভোটের সঙ্গে। এমন অবস্থায় সাত সুইং স্টেটের ওপর নির্বাচনের ভোরে জরিপ চালিয়েছে দ্য হিল, নিউ ইয়র্ক টাইমস সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। তাতে দেখা গেছে, অন্য যেকোনো সুইং স্টেটের তুলনায় অ্যারিজোনায় অধিক শক্তিশালী অবস্থানে আছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। এই রাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে মোট ১১টি। ভোগ গ্রহণ শেষ হওয়ার কথা স্থানীয় সময় রাত ৯টায়। সেখানে দ্য হিল/ডিডিএইচকিউ-এর গড় জরিপে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন ২.৫ পয়েন্টে। অন্যদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের জরিপের গড়ে তিনি তিন পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। ২০২০ সালে খুব সামান্য ভোটে এই রাজ্যে জয় পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার ইলেকশন ল্যাবের সর্বশেষ হিসাবে এই রাজ্যে রিপাবলিকানরা শতকরা ৪১ ভাগ ভোট দেবেন ট্রাম্পকে। ডেমোক্রেটরা ৩৩ ভাগ ভোট দেবেন কমালাকে। অন্যদিকে জর্জিয়ায় আছে ১৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট। এখানে ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায়। ২০২০ সালে এই রাজ্যে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন বাইডেন। এবার যদি এই রাজ্যে জয় না পান তাহলে তা ট্রাম্পের জন্য একটি বড় আঘাত হতে পারে। দ্য হিল/ডিডিএইচকিউ-এর গড় হিসাবে এখানে ১.৮ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। ফাইভ থার্টি এইট এবং ন্যাট সিলভারের সিলভার বুলেটিনের জরিপে এই ব্যবধান আরও অনেক কম। এখানে জয়ের স্বপ্ন দেখছেন কমালা হ্যারিস। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং সিয়েনা কলেজের জরিপে কমালা এক পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। মিশিগানে মোট ১৫টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে। সেখানে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৯টায় ভোটকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। জরিপে সেখানে খুব সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন কমালা। ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার হিসাবে এই রাজ্যে মোট আগাম যেসব ভোটার ভোট দিয়েছেন তার মধ্যে শতকরা ৫৫ ভাগই নারী। এটা কমালাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে।  নেভাদায় ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ৬টি। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কথা স্থানীয় সময় রাত ১০টায়। এটি সাতটি ব্যাটলগ্রাউন্ডের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাজ্য। সেখানে জরিপে ১.৩ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। নর্থ ক্যারোলাইনাতে মোট ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট ১৬টি। এখানে ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে। এটিই ফলাফল নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব রাজ্য তার অন্যতম। কারণ, এখানে কে জয়ী হবেন তা স্থির নয়। কোনো কোনো জরিপে এখানে ট্রাম্প এগিয়ে। আবার কোনো জরিপে কমালা এগিয়ে ৩ পয়েন্টে। সবচেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে পেনসিলভ্যানিয়ায়। এখানে ভোটগ্রহণ শেষ হবে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৮টায়। নির্বাচনের আগে এখানেই দুই প্রার্থী তাদের প্রচারণার ইতি টেনেছেন। এখানেই তারা টিভি বিজ্ঞাপনে শত শত মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। এখানে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে। এ ছাড়া উইসকনসিনে ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট আছে ১০টি। ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার কথা স্থানীয় সময় রাত ৯টায়। এটি কমালা হ্যারিসের শক্তিশালী ব্যাটলগ্রাউন্ড। পেনসিলভ্যানিয়া, মিশিগানের সঙ্গে এটাকে ব্লু ওয়াল বা ডেমোক্রেটপন্থি রাজ্য হিসেবে মনে করা হচ্ছে। যদি এই তিনটি রাজ্যে কমালা জয়ী হতে পারেন তাহলে তার জয় সম্ভবত সুনিশ্চিত।  
নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিন সোমবার এবং মঙ্গলবারের শুরুর দিকে ট্রাম্প নর্থ ক্যারোলাইনা ও পেনসিলভ্যানিয়াতে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিপদের ইস্যু ভোটারদের সামনে তুলে ধরেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মধ্যরাতে মিটিং করেছেন মিশিগানে। অন্যদিকে তুলনামূলক আশার বাণী শুনিয়েছেন কমালা হ্যারিস। তিনি পেনসিলভ্যানিয়ার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত প্রচারণা চালিয়েছেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সেলিব্রেটি অপরাহ উইনফ্রের মতো তারকারা। মধ্যরাতে ফিলাডেলফিয়ায় র‌্যালি করার আগে তিনি স্ক্রান্টন, অ্যালেনটাউন এবং পিটার্সবুর্গে যাত্রাবিরতি করেন। তিনি এ সময় সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গর্ভপাতের অধিকার ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, মার্কিনিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা গত দশকের রাজনীতি থেকে সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। এখান থেকে প্রায় ৩০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে পেনসিলভ্যানিয়ার রিডিংয়ে বক্তব্য রাখেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি জোর দিয়ে অবৈধ অভিবাসী ইস্যু তুলে ধরেন। মানসিকভাবে অসুস্থ অপরাধীর ইস্যু তুলে ধরেন। অপরাধীদেরকে তিনি বর্বর এবং পশু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

No comments

Powered by Blogger.