মব জাস্টিস আতঙ্ক by শুভ্র দেব

সম্প্রতি দেশ জুড়ে মব জাস্টিস বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ঘটনা ঘটছে।

সুবিধাবঞ্চিত, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, জমানো ক্ষোভসহ নানা কারণে মব জাস্টিস হচ্ছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে। এসব বন্ধে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও এখনো তা পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে মব জাস্টিসের কারণে মানুষ হত্যা, গণপিটুনি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই চাকরিহারা ও পদহারা হয়েছেন। এতে করে মব জাস্টিস এখন রীতিমতো আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, ৫ই আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে থাকে। বিভিন্ন অভিযোগ তুলে গণপিটুনি, চাকরি থেকে অপসারণের দাবি, ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের জেরে আওয়ামী লীগ বানিয়ে মামলার আসামি, চাকরি থেকে অব্যাহতির মতো ঘটনা ঘটতে থাকে। এ ছাড়া বাসা বাড়িতে আক্রমণ, পুড়িয়ে দেয়া, মালামাল লুটের মতো ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশের অনুপস্থিতিতে এসব ঘটনা ঘটে।
সূত্রগুলো বলছে, মব জাস্টিসের কারণে অনেক সময় নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব ঘটনা ঘটায় সমাজে নেগেটিভ বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। সুযোগ সন্ধানী কিছু মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে পছন্দের জায়গায় বসানো, দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, অভিযোগ আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবিলা না করে নিজেই বিচার করতে চাচ্ছে। কখনো প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক তকমা, কখনো দুর্নীতির অভিযোগ, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থানের অভিযোগ আনা হচ্ছে। এভাবে কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে টার্গেট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রথমে নেগেটিভ অপপ্রচার চালিয়ে পরে আন্দোলনে নেমে প্রশাসনকে আল্টিমেটাম ও ভুক্তভোগীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কিন্তু  এসব ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। যাদের এসব নিয়ে কাজ করার কথা সেই পুলিশ সদস্যরাও এসব বিষয় দেখেও না দেখার ভান করছেন। ফলে যারা এসব কাজে জড়িত তারা আইনের আওতায় না আসার কারণে একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছে।  
পুলিশ ও গোয়েন্দাসূত্রগুলো বলছে, যারা মব জাস্টিসের সঙ্গে জড়িত তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করছে। এক গোষ্ঠী একসঙ্গে হয়ে যখন এসব কর্মকাণ্ড করে তখন অন্যরা নীরব ভূমিকা পালন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ এবং সমাজ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বিগত সময়ে রাজনৈতিক, কর্মজীবনসহ নানা ক্ষেত্রে মানুষ সুবিধা বঞ্চিত, বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এ নিয়ে মানুষের কষ্ট আছে, মনের মধ্যে ক্ষোভও আছে। একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের যাত্রা হলেও গণতন্ত্র বিভিন্ন সময় হোঁচট খেয়েছে। বিগত ১৫ বছরেও হোঁচট খেয়েছে। এসব কারণে কিছু মানুষ সংঘবদ্ধভাবে একত্রিত হয়ে যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তাকে তার পদ বা অবস্থান থেকে সরিয়ে দিতে এবং অপমান অপদস্থ করা আইনের শাসনের সঙ্গে পুরোপুরি বিপরীত একটা অবস্থান। একজন ক্ষতি করেছে বলে তাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে হবে এটি আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আইনি প্রক্রিয়ায় এগুলো সমাধান করা সকল পক্ষের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। কারণ কেউ যদি তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিচার সে নিজেই করতে চায় তখন সমাজে একটা অস্থিরতা বিরাজ করে। তখন স্বার্থান্বেষী মহল এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একটি বিশেষ অবস্থার মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে। তারা তাদের কাজের সঠিক জায়গায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে। এরমধ্যে দিয়ে কিছু লোক একত্রিত হয়ে কোথাও কোথাও আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করছে। এর ফলে আইন মানা ও আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হয়। এতে করে সমাজে স্বাভাবিক শৃঙ্খলার জায়গাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন, মব জাস্টিস বন্ধ করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো দরকার। এ সময়টাতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। তাদের আরও বেশি সাংগঠনিক ও সতর্কতা থাকা দরকার।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, সবসময়ই আমরা দেখেছি সরকার পরিবর্তন হলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দলবদ্ধভাবে স্বার্থান্বেষী মহল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বলপ্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করে। এটি কোনো ভাবে গ্রহণযোগ্য ও সমর্থনযোগ্য না। কিন্তু ক্রমাগতই এটি বাংলাদেশে হচ্ছে। তবে এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যেহেতু দেশে একটা অস্থির পরিবেশ বিরাজ করছে আর এই সুযোগটাই একটি মহল কাজে লাগাচ্ছে। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা বলার সুযোগ নাই।

No comments

Powered by Blogger.