গল্প- আত্ম+সুখ+হনন by চাণক্য বাড়ৈ
সেলুন
থেকে বেরোনোর পর মেজাজের সলতেটায় আরেক দফা আগুন ধরে ওঠে বশিরের। শালার
হাটুরেদেরও ট্রেনিং নেওয়া দরকার। বশির হাঁটছিল খুব সাবধানে; চিপা গলির মধ্য
দিয়ে, প্রয়োজনমতো ডানে-বাঁয়ে কাৎ হয়ে ব্যস্ত, বেয়াক্কেল আর উদাসী
মানুষগুলোর ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। এরই মধ্যে এক বেকুব আচমকা
কোথা থেকে এসে কচুর ডগার ঘষা দিয়ে গেল বশিরের অফিসিয়াল একমাত্র সাদা
শার্টটিতে। ধ্যাৎ! জামার আস্তিন হয়ে মাজার সামনের দিকটায় এক লহমায় এমন এক
বাড়ি লাগল, ডগার মাথায় চুঁইয়ে থাকা সবটুকু কষ যেন মেখে গেল। ওর ইচ্ছা ছিল
কিছু পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ কিনে বাসায় ফিরবে। তা আর হলো না। বাসার সামনে
থেকে দু-টাকা দামের একটা মিনিপ্যাক শ্যাম্পু আর তিন টাকা দামের ডিটারজেন্ট
কিনে বাসার মেইন গেট পার হলো। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে নিচের ফ্লোরে বহু
দিনের পুরোনো কপাটের ফাঁক দিয়ে প্রোফাইল ভিউতে যে মেয়েটিকে বই পড়তে অথবা
ব্যাক ভিউতে চুল বাঁধতে অথবা ফ্রন্ট ভিউতে নখ কাটতে অথবা শুয়ে থাকলে পায়ের
একটি পাতার ওপর আরেকটি পাতার নাচানাচি দেখা যেত, তাকে গত এগারো দিনের মতো
আজও দেখা গেল না। সারা মাস কুরিয়ারের চিঠি বিলি করে ওর বাবা যে বেতন পায়,
তা দিয়ে বোধ হয় বাড়তি ভাড়া টানা সম্ভব নয়। এ সমস্যা বশিরেরও আছে। এ মাসে
বাসা ভাড়া বাবদ ওকে আরও পাঁচশ টাকা বেশি গুনতে হবে।
দরজা খুলতেই ছোট্ট রুমে আটকে থাকা যে বোঁটকা গন্ধটা প্রতিদিন তাকে সম্ভাষণ জানায়, আজ তার উপস্থিতি আর টের পেল না বশির। এবার ঘেন্নায় তার গা আরও গুলিয়ে গেল। চুল কাটা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু কেনো যে বলতে গেল—‘দাঁড়িটাও কামায়ে দে’। এইসব পাতি নাপিতের সেলুনে দাঁড়ি কামানো যে অস্বাস্থ্যকর, তা সে ভালো করে জানত। তার উপর পশ্চিম দিকের গলি দিয়ে পনেরো-বিশ মিনিট হাঁটলে যে নিষিদ্ধপল্লিটা, তার নিয়মিত খদ্দেরগুলো ওই সেলুনে নিয়মিত চুল-দাড়ি কাটায়। এক টাকা বাঁচাতে গিয়ে নাপিত ব্যাটা পুরোনো ব্লেড টানা শুরু করে দিল। ভাগ্যিস কাটেনি। নইলে এইচআইভি, হেপাটাইটিস এ-বি-সি, এসটিডি—কিছু একটা নির্ঘাত হয়ে যেতে পারত। রাজ্যের মানুষের মুখে ঘষা ফিটকিরি, ঘামে জবজবে পাউডারের প্যাড, আঠায় আটকে থাকা ব্রিসলের ব্রাশ আর ব্যবহারে জর্জর স্পঞ্জ তার নাকে-মুখে ঘষে দিল আর দুর্গন্ধযুক্ত নষ্ট পাউডার মাখিয়ে দিল নাপিতটা। সবমিলিয়ে তার চারপাশে এমন একটা অচেনা গন্ধের আবহ, রুমের চেনা গন্ধটাও তার ধারে-কাছে আসতে পারল না। অসহায়ের মতো খাটের উপর ধপাস করে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয় সে।
টেবিল ফ্যানটা দেখে খুব পুরাতন মনে হয় না। সেটি ঘুরল সুইচ টেপার পাঁচ-সাত মিনিট পর। ততক্ষণে জামাকাপড় ছাড়ে বশির। টেবিলের নিচে আলু, দুটি পেয়াঁজ আর চিমসে কয়েকটি কাঁচামরিচ দেখে স্বস্তি পায়। বারান্দার গ্যাসের চুলোয় পরিমাণমতো চাল, একটা ডিম, কয়েকটি আলু আর কয়েকটি মরিচ চড়িয়ে দিয়ে স্নানে যায় সে। শেয়ারের চুলো হলেও এ সময়ে সেটি ফাঁকা থাকে। তার বাথরুমটা অ্যাটাচড। চুল ছোট থাকলে একবারে মিনিপ্যাকের অর্ধেক শ্যাম্পু হলেই তার চলে। চুলগুলো ধোয়া হলে, নাকে-মুখে সাবান ঘষা হলে সেলুনের বোঁটকা গন্ধটা গা থেকে উধাও হয়ে যায়। মাথায় মগের পর মগ জল ঢালতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু চুলোর জ্বলন্ত ভাতের হাঁড়ির দুশ্চিন্তায় ইচ্ছাপূরণের আগেই স্নানঘর থেকে বের হতে হয় তাকে।
খেতে বসে সে আরও নিশ্চিন্ত হয়। কোথাও কাটেনি, এটা ভেবে একধরনের তৃপ্তি আসে মনে। কোথাও সামান্য ছাল উঠে গেলেও স্নানের সময় টের পেত। জল লাগার সঙ্গে সঙ্গে ছ্যাঁৎ করে উঠত। তা হয়নি। এই যুক্তিতে জীবাণুর সংক্রমণ না হওয়ার নিশ্চয়তা আরও বদ্ধমূল হয়। খাওয়া শেষে বশিরের চোখজুড়ে ঘুমের পাতলা একটা পর্দা নেমে আসতে থাকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমায় সে। বেশ অনেক্ষণ পরে তার ঝিমুনিটা কাটে ট্রেনের শব্দে। দিনের বেলা হলে মাথাটা ঘোরালেই সে দেখতে পেত। জানালার কারণে ট্রেনটা অবশ্য দেখা যায় না। ছাদের উপরের মানুষগুলোকে শুধু দেখা যায়। এটাই বরং ভালো। মনে হয় জাদুর মাদুরে উড়ে যাচ্ছে মানুষগুলো। আর শোনা যায় ঝমঝম শব্দ আর তীব্র হুইসেল। বশির ভাবে, মাত্র কয়েক মিনিটের ঝিমুনিতে ধরেছিল তাকে। কিন্তু না। টেবিলের অ্যালার্ম ঘড়িতে চেয়ে দেখে পোনে দু’টা বাজে। ট্রেনের শব্দটা নিঃশেষিত হতে বেশ সময় লাগে। সম্ভবত মাল-ট্রেন হবে। মনে হয় জরাগ্রস্ত সাপের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে মালভর্তি প্রায় অর্ধশত ভারী ওয়াগন। কিছু ভেবে উঠতে পারে না বশির। কী এক ভোঁতা ঘোরগ্রস্ততায় উঠে বালতিতে ডিটারজেন্ট গুলে কচুর কষ লাগা জামাটা এবং একটি স্যান্ডো গেঞ্জি ভেজায়। জামার যে জায়গাটায় কচুর দাগ লেগে আছে, সেখানে এক চিমটি গুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করে। ভালো ফল না পেয়ে জলে চুবিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে আগের মতোই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। টের পায়, ঘুমের ঝোঁকটা এখন আর অবশিষ্ট নেই। সে নিচের তলার মেয়েবিষয়ক একটা ভাবনার পুকুর তৈরি করে খানিকক্ষণের জন্য তাতে ডুব দেয়। এই ডুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পিঠের ত্বকের একটা বিন্দু আলপিনের মতো মস্তিষ্কে ভীষণ জোরে একটা খোঁচা মারে। খুব দ্রুত ঘুরে, যা অনুমান করে, তা-ই দেখতে পায়, প্রায় কচ্ছপাকৃতির একটি ছারপোকা, তার পিঠ সরিয়ে নেওয়ায় দেয়ালে হঠাৎ আলো এসে পড়ায়—হতবিহব্বলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। বশির সেটাকে মারতে উদ্যত হয়; পারে না। দেয়ালে ময়দার আঠায় সাঁটা পুরোনো পত্রিকার নিচে ছারপোকাটি আত্মগোপন করে। আঙুল ঢুকিয়ে পত্রিকার কিছু অংশ আলগা করতেই সেটির দেখা মেলে। আবারও ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয় বশির। আরও কিছু অংশ ছিঁড়ে শেষমেশ সে নিজেকে একটি হত্যার অপরাধে জড়াতে সক্ষম হয়।
ততক্ষণে পত্রিকার খানিকটা অংশ ঝুলে পড়েছে। পত্রিকার উল্টো দিকে দুটি নগ্ন পায়ের ছবি। হাই হিলের চাপে পায়ের টসটসে গোড়ালি দেখে উপরের অংশ দেখার লোভ সামলাতে পারে না বশির। আরও কিছু অংশ সে টেনে ছিঁড়ে বের করে। দীপিকা পাড়ুকোন। বেগুনি রঙের বক্ষবন্ধনীর নিচে অদ্ভুত ক্ষীণ ফর্সা দেহকাণ্ড। মাঝখানে নাভীর মোহময় কূপ, যার চারপাশে নির্মেদ কমলালেবুর মতো ত্বক, আর তার নিচে ফিনেফিনে ছোট স্কার্ট ঊরুর মাঝামাঝি এসে থেমেছে। ডান হাতে কিছু একটা ধরে থাকলেও থ্যাবড়ানো আঠার কারণে তা দেখা সম্ভব হয় না। বশিরের দৃষ্টি পায়ের গোড়ালি থেকে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠতে গিয়ে স্কার্টের প্রান্তে এসে সহসা চলৎশক্তি হারায়। সে ভাবে, হঠাৎ যদি একটা ঊর্ধ্বমুখী দমকা হাওয়া আসে আর স্কার্টটা...
দ্রুত বিছানার নিচ থেকে মলাটবিহীন একটা বই নিয়ে বশির পাতা ওল্টাতে থাকে। নতুন কিছুই নেই। মলাটটা থাকলে সেটা বদলে যেকোনো জায়গা থেকে দশ টাকার বিনিময়ে নতুন আরেকটা বই আনতে পারত সে। অফিসের কলিগদের নজর এড়াতে গিয়ে মলাট ছিঁড়ে ফেলায় সে সুযোগ এখন হাতছাড়া। নতুন কিছু কিনতে গেলে পকেট থেকে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা খসে যাবে। পুরোনো পছন্দের গল্পটাই শুরু করে বশির, ‘পুজোর ছুটিতে মেজ মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়াছিলাম। সেবার মামার ছোট শালার ছোট মেয়ে সবিতাও কলিকাতা থেকে বেড়াতে আসল। সবিতা কলিকাতার স্মার্ট মেয়ে। কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে, বয়স কেবল ষোল। দুপুরে মামার বাড়িতে কেউ থাকে না...’ গল্পটা খুব অল্প সময়ে শেষ করে বইয়ের ভেতরকার গ্লোসি পেপারের ছবিগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয় কয়েক মুহূর্ত। তারপর অর্ধব্যয়িত শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক নিয়ে একদৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।
এবার বরং কিছুটা ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। সবিতার কল্পিত চেহারার সাথে সে দীপিকার মুখ বসিয়ে দিতে গিয়ে এই ঝামেলা তৈরি করে। কেউই যেন শেষমেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে চায় না। না সবিতা, না দীপিকা। শ্যাম্পুসৃষ্ট পিচ্ছিল মুষ্ঠিবদ্ধ বাঁ হাতটি ততক্ষণে একটু একটু আসা-যাওয়া করতে থাকে। তারও পরে একসময় গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে দীপিকা পাড়ুকোনের যখন অনেক কাছে চলে আসে, বশির দীপিকার হাই হিল পরা পায়ের গোড়ালি থেকে দৃষ্টি ওপরের দিকে ওঠাতে থাকে। তার ব্যস্ত হাতটি আরও ব্যস্ত হয় আর ফ্রি ডান হাতটি কোন ফাঁকে যেন ফিনফিনে স্কার্টটি ওপরে তুলে ধরে। এ সময় দীপিকার ধবধবে দুটি ঊরু একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে তার বাঁ হাতটি, যেন সিরাপের বোতল ঝাঁকাচ্ছে, এমন গতিশীল হয়। তার দাদার মৃত্যুর আগে তাকে প্রায়ই এভাবে সালসার বোতল ঝাঁকিয়ে দিতে হতো। এই পর্যায়ের পর একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে পেয়ে বসে এবং তার সবকিছু শিথিল হয়ে আসে। কপাল, গলার নিচে, বগল আর কুঁচকি ঘামে ভিজে যায়। সেই অবস্থায় বালতির ভেজানো জামা আর গেঞ্জি ধুয়ে দিয়ে তা ঘরের কোনায় ঝোলানো দড়িতে মেলে দেয়। এবং বেশ ব্যস্ততার সাথে আরও একবার স্নান করে আসে।
এবার শিডিউল অনুযায়ী সে তার বাকি কাজটা শেষ করার প্রস্তুতি নেয়। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে মোবাইলফোনে একটি এসএমএস লেখে— Rasel vi, ofis er lokar er upre amar droyar er cabi ache. maf korben, boshir. মেসেজটা সেন্ট হয়; কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও ডেলিভারি রিপোর্ট না এলে তার মনে পড়ে, রাসেল ভাই মোবাইলফোন অফ করে ঘুমান। এবার বশিরও মোবাইলফোনটা বন্ধ করে টেবিলটা রুমের মাঝবরাবর এনে গামছাটা নিয়ে তার ওপরে দাঁড়ায়। বহু দিনের অব্যবহৃত সিলিং ফ্যানের মরিচা-জর্জর আংটায় গামছাটা বেঁধে এদিক-ওদিক টান দিয়ে পরখ করে নেয়। তারপর একটা ফাঁস বানিয়ে নিচে নেমে টেবিলটা আগের জায়গায় সরিয়ে আনে। টেবিলফ্যানের সুইসটাও অফ করে দেয় এবার।
দুই রাকাত নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়ালে বশিরের কাছে খাট আর জীবনের কিনার সমার্থক হয়ে যায়। ফাঁসের মধ্যে মাথাটা গলিয়ে ঝুলে পড়লে প্রথমে গভীর রাতে বনের মধ্য থেকে ভেসে আসা বাদুড়ের কান্না বা গোঙানির মতো শব্দ হয় এবং একসাথে তিন-চারটা বাদুড়ের উড়ে যাওয়ার শব্দ শেষ হয়ে এলে রুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
সকাল সোয়া সাতটার দিকে টেবিলঘড়ির অ্যালার্ম বেজে বেজে এক সময় নিজে থেকে থেমে যায়। এর পরের দিনও ঠিক এমনটিই হয়। তৃতীয় দিন আর ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে না।
দরজা খুলতেই ছোট্ট রুমে আটকে থাকা যে বোঁটকা গন্ধটা প্রতিদিন তাকে সম্ভাষণ জানায়, আজ তার উপস্থিতি আর টের পেল না বশির। এবার ঘেন্নায় তার গা আরও গুলিয়ে গেল। চুল কাটা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু কেনো যে বলতে গেল—‘দাঁড়িটাও কামায়ে দে’। এইসব পাতি নাপিতের সেলুনে দাঁড়ি কামানো যে অস্বাস্থ্যকর, তা সে ভালো করে জানত। তার উপর পশ্চিম দিকের গলি দিয়ে পনেরো-বিশ মিনিট হাঁটলে যে নিষিদ্ধপল্লিটা, তার নিয়মিত খদ্দেরগুলো ওই সেলুনে নিয়মিত চুল-দাড়ি কাটায়। এক টাকা বাঁচাতে গিয়ে নাপিত ব্যাটা পুরোনো ব্লেড টানা শুরু করে দিল। ভাগ্যিস কাটেনি। নইলে এইচআইভি, হেপাটাইটিস এ-বি-সি, এসটিডি—কিছু একটা নির্ঘাত হয়ে যেতে পারত। রাজ্যের মানুষের মুখে ঘষা ফিটকিরি, ঘামে জবজবে পাউডারের প্যাড, আঠায় আটকে থাকা ব্রিসলের ব্রাশ আর ব্যবহারে জর্জর স্পঞ্জ তার নাকে-মুখে ঘষে দিল আর দুর্গন্ধযুক্ত নষ্ট পাউডার মাখিয়ে দিল নাপিতটা। সবমিলিয়ে তার চারপাশে এমন একটা অচেনা গন্ধের আবহ, রুমের চেনা গন্ধটাও তার ধারে-কাছে আসতে পারল না। অসহায়ের মতো খাটের উপর ধপাস করে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয় সে।
টেবিল ফ্যানটা দেখে খুব পুরাতন মনে হয় না। সেটি ঘুরল সুইচ টেপার পাঁচ-সাত মিনিট পর। ততক্ষণে জামাকাপড় ছাড়ে বশির। টেবিলের নিচে আলু, দুটি পেয়াঁজ আর চিমসে কয়েকটি কাঁচামরিচ দেখে স্বস্তি পায়। বারান্দার গ্যাসের চুলোয় পরিমাণমতো চাল, একটা ডিম, কয়েকটি আলু আর কয়েকটি মরিচ চড়িয়ে দিয়ে স্নানে যায় সে। শেয়ারের চুলো হলেও এ সময়ে সেটি ফাঁকা থাকে। তার বাথরুমটা অ্যাটাচড। চুল ছোট থাকলে একবারে মিনিপ্যাকের অর্ধেক শ্যাম্পু হলেই তার চলে। চুলগুলো ধোয়া হলে, নাকে-মুখে সাবান ঘষা হলে সেলুনের বোঁটকা গন্ধটা গা থেকে উধাও হয়ে যায়। মাথায় মগের পর মগ জল ঢালতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু চুলোর জ্বলন্ত ভাতের হাঁড়ির দুশ্চিন্তায় ইচ্ছাপূরণের আগেই স্নানঘর থেকে বের হতে হয় তাকে।
খেতে বসে সে আরও নিশ্চিন্ত হয়। কোথাও কাটেনি, এটা ভেবে একধরনের তৃপ্তি আসে মনে। কোথাও সামান্য ছাল উঠে গেলেও স্নানের সময় টের পেত। জল লাগার সঙ্গে সঙ্গে ছ্যাঁৎ করে উঠত। তা হয়নি। এই যুক্তিতে জীবাণুর সংক্রমণ না হওয়ার নিশ্চয়তা আরও বদ্ধমূল হয়। খাওয়া শেষে বশিরের চোখজুড়ে ঘুমের পাতলা একটা পর্দা নেমে আসতে থাকে। দেয়ালে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমায় সে। বেশ অনেক্ষণ পরে তার ঝিমুনিটা কাটে ট্রেনের শব্দে। দিনের বেলা হলে মাথাটা ঘোরালেই সে দেখতে পেত। জানালার কারণে ট্রেনটা অবশ্য দেখা যায় না। ছাদের উপরের মানুষগুলোকে শুধু দেখা যায়। এটাই বরং ভালো। মনে হয় জাদুর মাদুরে উড়ে যাচ্ছে মানুষগুলো। আর শোনা যায় ঝমঝম শব্দ আর তীব্র হুইসেল। বশির ভাবে, মাত্র কয়েক মিনিটের ঝিমুনিতে ধরেছিল তাকে। কিন্তু না। টেবিলের অ্যালার্ম ঘড়িতে চেয়ে দেখে পোনে দু’টা বাজে। ট্রেনের শব্দটা নিঃশেষিত হতে বেশ সময় লাগে। সম্ভবত মাল-ট্রেন হবে। মনে হয় জরাগ্রস্ত সাপের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে মালভর্তি প্রায় অর্ধশত ভারী ওয়াগন। কিছু ভেবে উঠতে পারে না বশির। কী এক ভোঁতা ঘোরগ্রস্ততায় উঠে বালতিতে ডিটারজেন্ট গুলে কচুর কষ লাগা জামাটা এবং একটি স্যান্ডো গেঞ্জি ভেজায়। জামার যে জায়গাটায় কচুর দাগ লেগে আছে, সেখানে এক চিমটি গুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করে। ভালো ফল না পেয়ে জলে চুবিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে আগের মতোই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। টের পায়, ঘুমের ঝোঁকটা এখন আর অবশিষ্ট নেই। সে নিচের তলার মেয়েবিষয়ক একটা ভাবনার পুকুর তৈরি করে খানিকক্ষণের জন্য তাতে ডুব দেয়। এই ডুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। পিঠের ত্বকের একটা বিন্দু আলপিনের মতো মস্তিষ্কে ভীষণ জোরে একটা খোঁচা মারে। খুব দ্রুত ঘুরে, যা অনুমান করে, তা-ই দেখতে পায়, প্রায় কচ্ছপাকৃতির একটি ছারপোকা, তার পিঠ সরিয়ে নেওয়ায় দেয়ালে হঠাৎ আলো এসে পড়ায়—হতবিহব্বলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। বশির সেটাকে মারতে উদ্যত হয়; পারে না। দেয়ালে ময়দার আঠায় সাঁটা পুরোনো পত্রিকার নিচে ছারপোকাটি আত্মগোপন করে। আঙুল ঢুকিয়ে পত্রিকার কিছু অংশ আলগা করতেই সেটির দেখা মেলে। আবারও ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয় বশির। আরও কিছু অংশ ছিঁড়ে শেষমেশ সে নিজেকে একটি হত্যার অপরাধে জড়াতে সক্ষম হয়।
ততক্ষণে পত্রিকার খানিকটা অংশ ঝুলে পড়েছে। পত্রিকার উল্টো দিকে দুটি নগ্ন পায়ের ছবি। হাই হিলের চাপে পায়ের টসটসে গোড়ালি দেখে উপরের অংশ দেখার লোভ সামলাতে পারে না বশির। আরও কিছু অংশ সে টেনে ছিঁড়ে বের করে। দীপিকা পাড়ুকোন। বেগুনি রঙের বক্ষবন্ধনীর নিচে অদ্ভুত ক্ষীণ ফর্সা দেহকাণ্ড। মাঝখানে নাভীর মোহময় কূপ, যার চারপাশে নির্মেদ কমলালেবুর মতো ত্বক, আর তার নিচে ফিনেফিনে ছোট স্কার্ট ঊরুর মাঝামাঝি এসে থেমেছে। ডান হাতে কিছু একটা ধরে থাকলেও থ্যাবড়ানো আঠার কারণে তা দেখা সম্ভব হয় না। বশিরের দৃষ্টি পায়ের গোড়ালি থেকে একটু একটু করে উপরের দিকে উঠতে গিয়ে স্কার্টের প্রান্তে এসে সহসা চলৎশক্তি হারায়। সে ভাবে, হঠাৎ যদি একটা ঊর্ধ্বমুখী দমকা হাওয়া আসে আর স্কার্টটা...
দ্রুত বিছানার নিচ থেকে মলাটবিহীন একটা বই নিয়ে বশির পাতা ওল্টাতে থাকে। নতুন কিছুই নেই। মলাটটা থাকলে সেটা বদলে যেকোনো জায়গা থেকে দশ টাকার বিনিময়ে নতুন আরেকটা বই আনতে পারত সে। অফিসের কলিগদের নজর এড়াতে গিয়ে মলাট ছিঁড়ে ফেলায় সে সুযোগ এখন হাতছাড়া। নতুন কিছু কিনতে গেলে পকেট থেকে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা খসে যাবে। পুরোনো পছন্দের গল্পটাই শুরু করে বশির, ‘পুজোর ছুটিতে মেজ মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়াছিলাম। সেবার মামার ছোট শালার ছোট মেয়ে সবিতাও কলিকাতা থেকে বেড়াতে আসল। সবিতা কলিকাতার স্মার্ট মেয়ে। কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে, বয়স কেবল ষোল। দুপুরে মামার বাড়িতে কেউ থাকে না...’ গল্পটা খুব অল্প সময়ে শেষ করে বইয়ের ভেতরকার গ্লোসি পেপারের ছবিগুলোতে চোখ বুলিয়ে নেয় কয়েক মুহূর্ত। তারপর অর্ধব্যয়িত শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক নিয়ে একদৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে।
এবার বরং কিছুটা ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। সবিতার কল্পিত চেহারার সাথে সে দীপিকার মুখ বসিয়ে দিতে গিয়ে এই ঝামেলা তৈরি করে। কেউই যেন শেষমেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে চায় না। না সবিতা, না দীপিকা। শ্যাম্পুসৃষ্ট পিচ্ছিল মুষ্ঠিবদ্ধ বাঁ হাতটি ততক্ষণে একটু একটু আসা-যাওয়া করতে থাকে। তারও পরে একসময় গাঢ় কুয়াশা ভেদ করে দীপিকা পাড়ুকোনের যখন অনেক কাছে চলে আসে, বশির দীপিকার হাই হিল পরা পায়ের গোড়ালি থেকে দৃষ্টি ওপরের দিকে ওঠাতে থাকে। তার ব্যস্ত হাতটি আরও ব্যস্ত হয় আর ফ্রি ডান হাতটি কোন ফাঁকে যেন ফিনফিনে স্কার্টটি ওপরে তুলে ধরে। এ সময় দীপিকার ধবধবে দুটি ঊরু একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেলে তার বাঁ হাতটি, যেন সিরাপের বোতল ঝাঁকাচ্ছে, এমন গতিশীল হয়। তার দাদার মৃত্যুর আগে তাকে প্রায়ই এভাবে সালসার বোতল ঝাঁকিয়ে দিতে হতো। এই পর্যায়ের পর একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে পেয়ে বসে এবং তার সবকিছু শিথিল হয়ে আসে। কপাল, গলার নিচে, বগল আর কুঁচকি ঘামে ভিজে যায়। সেই অবস্থায় বালতির ভেজানো জামা আর গেঞ্জি ধুয়ে দিয়ে তা ঘরের কোনায় ঝোলানো দড়িতে মেলে দেয়। এবং বেশ ব্যস্ততার সাথে আরও একবার স্নান করে আসে।
এবার শিডিউল অনুযায়ী সে তার বাকি কাজটা শেষ করার প্রস্তুতি নেয়। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে মোবাইলফোনে একটি এসএমএস লেখে— Rasel vi, ofis er lokar er upre amar droyar er cabi ache. maf korben, boshir. মেসেজটা সেন্ট হয়; কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও ডেলিভারি রিপোর্ট না এলে তার মনে পড়ে, রাসেল ভাই মোবাইলফোন অফ করে ঘুমান। এবার বশিরও মোবাইলফোনটা বন্ধ করে টেবিলটা রুমের মাঝবরাবর এনে গামছাটা নিয়ে তার ওপরে দাঁড়ায়। বহু দিনের অব্যবহৃত সিলিং ফ্যানের মরিচা-জর্জর আংটায় গামছাটা বেঁধে এদিক-ওদিক টান দিয়ে পরখ করে নেয়। তারপর একটা ফাঁস বানিয়ে নিচে নেমে টেবিলটা আগের জায়গায় সরিয়ে আনে। টেবিলফ্যানের সুইসটাও অফ করে দেয় এবার।
দুই রাকাত নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়ালে বশিরের কাছে খাট আর জীবনের কিনার সমার্থক হয়ে যায়। ফাঁসের মধ্যে মাথাটা গলিয়ে ঝুলে পড়লে প্রথমে গভীর রাতে বনের মধ্য থেকে ভেসে আসা বাদুড়ের কান্না বা গোঙানির মতো শব্দ হয় এবং একসাথে তিন-চারটা বাদুড়ের উড়ে যাওয়ার শব্দ শেষ হয়ে এলে রুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
সকাল সোয়া সাতটার দিকে টেবিলঘড়ির অ্যালার্ম বেজে বেজে এক সময় নিজে থেকে থেমে যায়। এর পরের দিনও ঠিক এমনটিই হয়। তৃতীয় দিন আর ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে না।
No comments