সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী by সৈয়দ শামীম শিরাজী
১৮৯৯
সালের কোনো একদিন। সিরাজগঞ্জ শহরতলির বড়ইতলা মাঠে (বর্তমানে পদ্ম পুকুরের
পাশে) সভা চলছে। সভার প্রধান আকর্ষণ তৎকালীন মুসলিম বাংলার জনপ্রিয় নেতা,
প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহ। খ্রিষ্টান মিশনারিদের
সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে তিনি তখন মর্দে মুজাহিদের
মর্যাদা লাভ করেছেন। এ সময় বাংলাদেশের সহজ সরল দরিদ্র শ্রেণির মুসলমানদের
সামনে নানা প্রলোভনের ফাঁদ পেতে খ্রিষ্টান পাদ্রিরা তাদের ধর্মান্তরিত
করছিল। সেদিন মুসলমানদের ধর্মান্তর রোধ করতে বাংলাদেশের কোনো জমিদার, নেতা
কেউই এগিয়ে আসেননি- এলেন যশোরের দড়াটানার একজন অতি সাধারণ মানুষ- দর্জি
মুন্সী মেহেরুল্লাহ। তার জ্ঞানগর্ভ ও বুদ্ধিমত্তার বলে প্রতিরোধের মুখে
খ্রিষ্টান মিশনারিদের সে অপতৎপরতা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। তিনি তাদের কাছে
এক মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন। একের পর এক বাহাসে তার কাছে পরাজিত হয়ে মুখ
কালি করে নিজেদের মিশনে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে বাঘা বাঘা পাদ্রি। এ সাহসী
ভূমিকার কারণে সারা বাংলাদেশেই অত্যন্ত মশহুর হয়ে ওঠেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ।
অক্লান্ত এ মানুষটি যেখান থেকে ডাক আসে, সেখানেই ছুটে যান। শোনান ধর্মের
কথা। ইসলামের মূল আদর্শের কথা। তার যুক্তিপূর্ণ জ্ঞানগর্ভের কথা শুনে
মুসলমানরা বিপর্যয়ের মধ্যে আশার আলো দেখতে পায়, ঈমানি জজবায় নতুন করে
বলীয়ান হয়ে ওঠে। সেই ত্যাগী মুন্সী মেহেরুল্লাহ আসছেন বড়ইতলার ধর্মসভায়Ñ এ
কথা শুনে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, বগুড়াসহ নানা স্থান থেকে মানুষ এসে
হাজির হয়েছে। মুন্সী মেহেরউল্লাহর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনবে তারা।
স্থানীয় বক্তাদের বক্তৃতা শেষ পর্যায়ে। এর পরই মুন্সী মেহেরউল্লাহ জ্বালাময়ী বক্তৃতা করবেন। এমন সময় সভার আয়োজকদের মধ্যে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি মুন্সী সাহেবের কাছে এসে বললেন, হুজুর একটি ছেলে সভায় কিছু কথা বলতে চায়। একটি কবিতা সে পাঠ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে এ সভায়। আমরা তাকে চিনি। এ শহরেরই ছেলে, খুব শরিফ ঘরের। যেমন তেজস্বী তেমনি ভালো বক্তা। আপনি যদি মেহেরবানি পূর্বক অনুমতি দেন তাহলে ছেলেটি দু-চার কথা বলতে পারে। উদার হৃদয়ের খাঁটি মানুষ মুন্সী মেহেরউল্লাহ সাহেব সহজেই অনুমতি দিলেন। ছেলেমানুষ বলুক দু-চার কথা। সভা-সমিতিতে কথা বলতে পারে এমন ছেলের দেখা-সাক্ষাৎ মুসলমান সমাজে বেশি মেলে না। এ ছেলেটি যখন আগ্রহ করে সভায় কথা বলতে দুঃসাহস করছে, তাকে সুযোগ দিয়ে দেখা যাক না কী বলে।
সুঠাম দেহের তরুণ যুবক বক্তৃতা শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর মুন্সী মেহেরউল্লাহর মনোযোগের পুরোটাই কেড়ে নেয় সেই তরুণ। ততক্ষণে তার কণ্ঠে মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনের আভাস ধ্বনিত হতে শুরু করেছে। মুন্সী সাহেব অবাক দৃষ্টিতে এই প্রথম যুবকের দিকে তাকালেন। ছেলে ঠিক নয়- মাঝারি উচ্চতার কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের সদ্য কৈশোর পেরোনো এক উচ্ছল তরুণ। কোরআন, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানদের বর্তমান দুরবস্থা সবই তার কথায় উঠে আসছে। আশ্চর্য! এত বড় সভা, হাজার হাজার লোক। মাইক নেই; কিন্তু বিনা মাইকেই তার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর সভাস্থলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে। কিছুক্ষণ পরই শেষ করল সে। সবার কাছে সবিনয়ে অনুমতি চাইল একটি জাতীয় কবিতা পাঠের। অতি সহজেই তা মিলে গেল। জানাল, কবিতাটি তার নিজেরই লেখা। যা হোক, কবিতা পাঠ শুরু করল সে। কবিতাটির নাম ‘অনল প্রবাহ’- বিশাল অগ্নিঝরা কবিতা।
আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া
ওঠরে মুসলিম ওঠরে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।
বিস্ময়, আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠলেন মুন্সী মেহেরউল্লাহ। সুদীর্ঘ সে বক্তৃতার পুরোটাই শুনলেন তিনি মুগ্ধ হয়ে। কবিতা নয়- যেন আগুন ঝরছে লেখকের কণ্ঠে। তার বক্তব্যে মুসলমানরা ঘুমিয়ে আছে। তারা বেখেয়াল। তারা সব জায়গায় মার খাচ্ছে। ইংরেজরা এদেশের শাসক। হিন্দুরা তাদের সহযোগিতা করে কত উন্নতি লাভ করছে। আর বাদশাহর জাতি মুসলমান আজ সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তাদের অবস্থা যেন মৃতপ্রায়। একদিন সারা বিশ্বে যে মুসলমানরা সভ্যতার আলো ছড়িয়েছিল, তারা আজ চরম দুর্দশায়; কিন্তু আর নয়। ওঠ, মুসলমানরা জাগো। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দাও, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করো। ব্রিটিশদের অধীনে আর গোলাম থাকা নয়। স্বাধীনতা লাভ করতে হবে। মুসলমানরা, সিংহের বিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়াও। আল্লাহর নাম স্মরণ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়। তোমরা বিশ্বের সেরা জাতি ছিলে। আবার সেরা জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর দেরি নয়, ওঠো মুসলমান জেগে ওঠো।
মুন্সী মেহেরউল্লাহ নিজেই নিজেকে বললেন, এ যেন আমারই উত্তরসূরি। বাংলাদেশে এত মুসলমান, দু-চারজন লেখকের দেখাও এখন মিলছে। কিন্তু এ রকম বজ্রনিনাদ, মুসলমানদের জেগে ওঠার এমন বলিষ্ঠ আহ্বান তো আর কারও কণ্ঠে শোনা যায়নি। কিংবা কারও লেখায়ও দেখা যায়নি। এ রকম সাহস তো আর কারও মধ্যে দেখিনি। মহাশক্তিমান ব্রিটিশ সরকারকেও পরোয়া করে না- কে এই তরুণ!
তরতাজা এ তরুণকে মুন্সী সাহেব কাছে ডেকে নিলেন। কত আর বয়স, আঠারো-উনিশ হবে বোধ হয়। বুকে জড়িয়ে ধরে যেন সান্ত¡না খুঁজে পেলেন। ভাবলেন ভবিষ্যতে আমার দলের কান্ডারি হবে। উৎসাহ দিলেন আরও লেখার জন্য। এ রকম আগুনঝরা লেখাই তো এখন চাই। মোক্ষম সময়ই তুমি লিখেছ। বাংলার ঘুমন্ত মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে তাদের বজ্রের গর্জন শোনাতে হবে, সেতারের সুললিত ঝংকার নয়, এখানেই থেমে থাকলেন না বাংলার মর্দে মুজাহিদ মুন্সী মেহেরউল্লাহ। কিছুদিনের মধ্যে টাকা-পয়সা জোগাড় করে তার সেই কাব্য পুস্তকটি প্রকাশ করলেন যশোর থেকে। বাংলার মুসলমান বিশেষ করে যুব তরুণ সমাজের কাছে পৌঁছে গেল জ্বালাময়ী কাব্য ‘অনল প্রবাহ’। সেই তরুণের নাম সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে অনল প্রবাহ কাব্য সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই বছর সশ্রম কারাদ- দেয়। মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীই প্রথম যিনি কবিতা লেখার অভিযোগে কারাদ- ভোগ করেন। সে সময় মহকুমা ম্যাজিস্ট্র্রেট লয়েড অনল প্রবাহ বাজেয়াপ্ত করতে এসে সিরাজী সাহেবের ফ্যামিলি লাইব্রেরির গ্রন্থগুলো আগ্রহ সহকারে দেখে মন্তব্য করেন, "সিরাজী শুধু একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নহেন, তিনি একজন বিরাট পন্ডিত ব্যক্তি)।" মুন্সী মেহেরউল্লাহর বদৌলতে সিরাজী গ্রন্থখানা ছাপা হওয়ায় এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে জেল দেওয়ায় সিরাজীর নাম সর্বত্র আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উৎসাহ-উদ্দীপনায় সিরাজী আরও ক্ষুরধার অস্ত্রে পরিণত হয়ে উঠল। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, যার সারকথা ‘রচনাশৈলীর ভেতরেই মানুষটির যথার্থ পরিচয়।’ সিরাজী সাহেবের রচনাভঙ্গি তার বৈশিষ্ট্য সূচিত করে। সে অগ্নি তার কবিতা, সংগীত, কাব্য, বাগ্মিতা ও কর্মপ্রচেষ্টায় ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতির জীবনে তা নিষ্ফল হয়নি। মানুষের প্রতি, জাতির প্রতি, কওমের প্রতি কোনো অন্যায় জুলুম তিনি সহ্য করেননি। জাতির মানমর্যাদা রক্ষার্থে আজীবন আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। জাতির কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ এবং মুসলমান সমাজভুক্ত মানুষের কল্যাণ তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। ধর্মের অনুসারীদের তিনি সব ভয়-ভীতি, দুঃখ-দৈন্যের, ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও অগ্রসর হওয়ার আহ্বান শুনিয়েছেন। শিক্ষায়, সাহিত্যে, জীবনে তিনি বিজাতীয় অন্ধ অনুকরণের তীব্র প্রতিবাদ যেমন করেছিলেন, তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করার জন্য প্রবল উৎসাহ সঞ্চার করাও তার জীবনের ব্রত ছিল। দেশের স্বাধীনতার অর্থে এ দেশের কোটি কোটি শ্রমক্লিষ্ট, কৃষক-মজুরের জীবন বিকাশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাই বুঝিয়েছেন।
সর্বগুণে গুণান্বিত মুন্সী সাহেব একাই একাধিক দায়িত্ব পালন করে সফলকাম হয়েছেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন অতুলনীয় বাগ্মী। বাগ্মিতায় সে সময় মুসলমানদের মধ্যে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। ধর্ম-সমাজ, স্বাধীনতা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তা, মুসলমানদের জাগরণের কথা, সব বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা ছিল তার। তার সেই তেজস্বী কণ্ঠের বক্তৃতা লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। মানুষকে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রভাবিত করার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল তার। একইভাবে গাজী সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীও পরবর্তীকালে বাংলার অদ্বিতীয় বাগ্মী, বক্তৃতার জাদুকর, বাংলার এডমন্ড বার্ক ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত হয়েছিলেন। এজন্যই বলা যায়Ñ যখন এক ধাপ এগিয়ে যায় তখনই তো আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়। মুন্সী মেহেরুল্লাহর সান্নিধ্য, সংস্পর্শ পেয়ে তেমনি বেগবান হয়ে উঠেছিল সিরাজী। সেই সঙ্গে মুন্সী সাহেবের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে সিরাজী বিদ্রোহী কবি নজরুলকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করেছিলেন। নজরুলের ভাষায়Ñ “আমি তখন প্রথম ভয়ে ভয়ে কাব্য-কাননে পা টিপে টিপে প্রবেশ করেছি- ফিঙ্গে বায়স বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মতো কণ্ঠ ছেড়ে গাইবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। নখচক্ষুর আঘাতও যে না খেয়েছি এমন নয়- এমনি ভীতির দুর্দিনে মানি অর্ডারে আমার নামে দশটা টাকা এসে হাজির। একপাশে সিরাজী সাহেবের হাতের লেখা, ‘তোমার লেখা পড়িয়া সুখী হইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।’ চোখের জলে স্নেহ-সুধাসিক্ত ওই কয় পঙ্্ক্তি লেখা বারে বারে পড়লাম। টাকা দশটা লয়ে মাথায় ঠেকালাম। তখনও আমি তাকে দেখিনি। কাঙ্গাল ভক্তের মত দূর হতেই তার লেখা পড়েছি। মুখস্থ করেছি। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি।”
সে সময়ে সিরাজীর দশটি টাকা কবি নজরুলকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল নজরুলের উপর্যুক্ত অভিমতে তা স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, কায়কোবাদ যখন মহাশ্মশান লিখে অর্ধশিক্ষিত মুসলমানদের চাপের মুখে পড়লেন। ঠিক তখনি সিরাজী তাকে সোনার দোয়াত-কলম উপঢৌকন দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাকে সে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। একইভাবে পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনকে সিরাজী উৎসাহিত করেছিলেন। আবার সিরাজীর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র তূর্যনাদের অমর কবি সৈয়দ আসাদুদ্দৌলা সিরাজী কবি নজরুল ইসলামকে সিরাজগঞ্জে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী কবি তখন বাণীকুঞ্চে এসে সিরাজীর মাজারে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এ যেন হজ্ব করতে এসে কাবা শরিফ না দেখে ফিরে যাওয়া।’
স্থানীয় বক্তাদের বক্তৃতা শেষ পর্যায়ে। এর পরই মুন্সী মেহেরউল্লাহ জ্বালাময়ী বক্তৃতা করবেন। এমন সময় সভার আয়োজকদের মধ্যে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি মুন্সী সাহেবের কাছে এসে বললেন, হুজুর একটি ছেলে সভায় কিছু কথা বলতে চায়। একটি কবিতা সে পাঠ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে এ সভায়। আমরা তাকে চিনি। এ শহরেরই ছেলে, খুব শরিফ ঘরের। যেমন তেজস্বী তেমনি ভালো বক্তা। আপনি যদি মেহেরবানি পূর্বক অনুমতি দেন তাহলে ছেলেটি দু-চার কথা বলতে পারে। উদার হৃদয়ের খাঁটি মানুষ মুন্সী মেহেরউল্লাহ সাহেব সহজেই অনুমতি দিলেন। ছেলেমানুষ বলুক দু-চার কথা। সভা-সমিতিতে কথা বলতে পারে এমন ছেলের দেখা-সাক্ষাৎ মুসলমান সমাজে বেশি মেলে না। এ ছেলেটি যখন আগ্রহ করে সভায় কথা বলতে দুঃসাহস করছে, তাকে সুযোগ দিয়ে দেখা যাক না কী বলে।
সুঠাম দেহের তরুণ যুবক বক্তৃতা শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর মুন্সী মেহেরউল্লাহর মনোযোগের পুরোটাই কেড়ে নেয় সেই তরুণ। ততক্ষণে তার কণ্ঠে মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনের আভাস ধ্বনিত হতে শুরু করেছে। মুন্সী সাহেব অবাক দৃষ্টিতে এই প্রথম যুবকের দিকে তাকালেন। ছেলে ঠিক নয়- মাঝারি উচ্চতার কিন্তু বলিষ্ঠ দেহের সদ্য কৈশোর পেরোনো এক উচ্ছল তরুণ। কোরআন, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস, মুসলমানদের বর্তমান দুরবস্থা সবই তার কথায় উঠে আসছে। আশ্চর্য! এত বড় সভা, হাজার হাজার লোক। মাইক নেই; কিন্তু বিনা মাইকেই তার বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর সভাস্থলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসে। কিছুক্ষণ পরই শেষ করল সে। সবার কাছে সবিনয়ে অনুমতি চাইল একটি জাতীয় কবিতা পাঠের। অতি সহজেই তা মিলে গেল। জানাল, কবিতাটি তার নিজেরই লেখা। যা হোক, কবিতা পাঠ শুরু করল সে। কবিতাটির নাম ‘অনল প্রবাহ’- বিশাল অগ্নিঝরা কবিতা।
আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া
ওঠরে মুসলিম ওঠরে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।
বিস্ময়, আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠলেন মুন্সী মেহেরউল্লাহ। সুদীর্ঘ সে বক্তৃতার পুরোটাই শুনলেন তিনি মুগ্ধ হয়ে। কবিতা নয়- যেন আগুন ঝরছে লেখকের কণ্ঠে। তার বক্তব্যে মুসলমানরা ঘুমিয়ে আছে। তারা বেখেয়াল। তারা সব জায়গায় মার খাচ্ছে। ইংরেজরা এদেশের শাসক। হিন্দুরা তাদের সহযোগিতা করে কত উন্নতি লাভ করছে। আর বাদশাহর জাতি মুসলমান আজ সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তাদের অবস্থা যেন মৃতপ্রায়। একদিন সারা বিশ্বে যে মুসলমানরা সভ্যতার আলো ছড়িয়েছিল, তারা আজ চরম দুর্দশায়; কিন্তু আর নয়। ওঠ, মুসলমানরা জাগো। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দাও, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করো। ব্রিটিশদের অধীনে আর গোলাম থাকা নয়। স্বাধীনতা লাভ করতে হবে। মুসলমানরা, সিংহের বিক্রমে মাথা তুলে দাঁড়াও। আল্লাহর নাম স্মরণ করে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়। তোমরা বিশ্বের সেরা জাতি ছিলে। আবার সেরা জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর দেরি নয়, ওঠো মুসলমান জেগে ওঠো।
মুন্সী মেহেরউল্লাহ নিজেই নিজেকে বললেন, এ যেন আমারই উত্তরসূরি। বাংলাদেশে এত মুসলমান, দু-চারজন লেখকের দেখাও এখন মিলছে। কিন্তু এ রকম বজ্রনিনাদ, মুসলমানদের জেগে ওঠার এমন বলিষ্ঠ আহ্বান তো আর কারও কণ্ঠে শোনা যায়নি। কিংবা কারও লেখায়ও দেখা যায়নি। এ রকম সাহস তো আর কারও মধ্যে দেখিনি। মহাশক্তিমান ব্রিটিশ সরকারকেও পরোয়া করে না- কে এই তরুণ!
তরতাজা এ তরুণকে মুন্সী সাহেব কাছে ডেকে নিলেন। কত আর বয়স, আঠারো-উনিশ হবে বোধ হয়। বুকে জড়িয়ে ধরে যেন সান্ত¡না খুঁজে পেলেন। ভাবলেন ভবিষ্যতে আমার দলের কান্ডারি হবে। উৎসাহ দিলেন আরও লেখার জন্য। এ রকম আগুনঝরা লেখাই তো এখন চাই। মোক্ষম সময়ই তুমি লিখেছ। বাংলার ঘুমন্ত মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে তাদের বজ্রের গর্জন শোনাতে হবে, সেতারের সুললিত ঝংকার নয়, এখানেই থেমে থাকলেন না বাংলার মর্দে মুজাহিদ মুন্সী মেহেরউল্লাহ। কিছুদিনের মধ্যে টাকা-পয়সা জোগাড় করে তার সেই কাব্য পুস্তকটি প্রকাশ করলেন যশোর থেকে। বাংলার মুসলমান বিশেষ করে যুব তরুণ সমাজের কাছে পৌঁছে গেল জ্বালাময়ী কাব্য ‘অনল প্রবাহ’। সেই তরুণের নাম সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন শিরাজী। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে অনল প্রবাহ কাব্য সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে দুই বছর সশ্রম কারাদ- দেয়। মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীই প্রথম যিনি কবিতা লেখার অভিযোগে কারাদ- ভোগ করেন। সে সময় মহকুমা ম্যাজিস্ট্র্রেট লয়েড অনল প্রবাহ বাজেয়াপ্ত করতে এসে সিরাজী সাহেবের ফ্যামিলি লাইব্রেরির গ্রন্থগুলো আগ্রহ সহকারে দেখে মন্তব্য করেন, "সিরাজী শুধু একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নহেন, তিনি একজন বিরাট পন্ডিত ব্যক্তি)।" মুন্সী মেহেরউল্লাহর বদৌলতে সিরাজী গ্রন্থখানা ছাপা হওয়ায় এবং ব্রিটিশ সরকার তাকে জেল দেওয়ায় সিরাজীর নাম সর্বত্র আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উৎসাহ-উদ্দীপনায় সিরাজী আরও ক্ষুরধার অস্ত্রে পরিণত হয়ে উঠল। ইংরেজীতে একটি কথা আছে, যার সারকথা ‘রচনাশৈলীর ভেতরেই মানুষটির যথার্থ পরিচয়।’ সিরাজী সাহেবের রচনাভঙ্গি তার বৈশিষ্ট্য সূচিত করে। সে অগ্নি তার কবিতা, সংগীত, কাব্য, বাগ্মিতা ও কর্মপ্রচেষ্টায় ছড়িয়ে পড়েছিল। জাতির জীবনে তা নিষ্ফল হয়নি। মানুষের প্রতি, জাতির প্রতি, কওমের প্রতি কোনো অন্যায় জুলুম তিনি সহ্য করেননি। জাতির মানমর্যাদা রক্ষার্থে আজীবন আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। জাতির কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ এবং মুসলমান সমাজভুক্ত মানুষের কল্যাণ তার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল। ধর্মের অনুসারীদের তিনি সব ভয়-ভীতি, দুঃখ-দৈন্যের, ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও অগ্রসর হওয়ার আহ্বান শুনিয়েছেন। শিক্ষায়, সাহিত্যে, জীবনে তিনি বিজাতীয় অন্ধ অনুকরণের তীব্র প্রতিবাদ যেমন করেছিলেন, তেমনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করার জন্য প্রবল উৎসাহ সঞ্চার করাও তার জীবনের ব্রত ছিল। দেশের স্বাধীনতার অর্থে এ দেশের কোটি কোটি শ্রমক্লিষ্ট, কৃষক-মজুরের জীবন বিকাশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাই বুঝিয়েছেন।
সর্বগুণে গুণান্বিত মুন্সী সাহেব একাই একাধিক দায়িত্ব পালন করে সফলকাম হয়েছেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন অতুলনীয় বাগ্মী। বাগ্মিতায় সে সময় মুসলমানদের মধ্যে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। ধর্ম-সমাজ, স্বাধীনতা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনীয়তা, মুসলমানদের জাগরণের কথা, সব বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা ছিল তার। তার সেই তেজস্বী কণ্ঠের বক্তৃতা লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। মানুষকে বক্তৃতার মাধ্যমে প্রভাবিত করার ঈর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল তার। একইভাবে গাজী সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীও পরবর্তীকালে বাংলার অদ্বিতীয় বাগ্মী, বক্তৃতার জাদুকর, বাংলার এডমন্ড বার্ক ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত হয়েছিলেন। এজন্যই বলা যায়Ñ যখন এক ধাপ এগিয়ে যায় তখনই তো আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়। মুন্সী মেহেরুল্লাহর সান্নিধ্য, সংস্পর্শ পেয়ে তেমনি বেগবান হয়ে উঠেছিল সিরাজী। সেই সঙ্গে মুন্সী সাহেবের আদর্শকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে সিরাজী বিদ্রোহী কবি নজরুলকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করেছিলেন। নজরুলের ভাষায়Ñ “আমি তখন প্রথম ভয়ে ভয়ে কাব্য-কাননে পা টিপে টিপে প্রবেশ করেছি- ফিঙ্গে বায়স বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মতো কণ্ঠ ছেড়ে গাইবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। নখচক্ষুর আঘাতও যে না খেয়েছি এমন নয়- এমনি ভীতির দুর্দিনে মানি অর্ডারে আমার নামে দশটা টাকা এসে হাজির। একপাশে সিরাজী সাহেবের হাতের লেখা, ‘তোমার লেখা পড়িয়া সুখী হইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।’ চোখের জলে স্নেহ-সুধাসিক্ত ওই কয় পঙ্্ক্তি লেখা বারে বারে পড়লাম। টাকা দশটা লয়ে মাথায় ঠেকালাম। তখনও আমি তাকে দেখিনি। কাঙ্গাল ভক্তের মত দূর হতেই তার লেখা পড়েছি। মুখস্থ করেছি। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি।”
সে সময়ে সিরাজীর দশটি টাকা কবি নজরুলকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল নজরুলের উপর্যুক্ত অভিমতে তা স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, কায়কোবাদ যখন মহাশ্মশান লিখে অর্ধশিক্ষিত মুসলমানদের চাপের মুখে পড়লেন। ঠিক তখনি সিরাজী তাকে সোনার দোয়াত-কলম উপঢৌকন দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাকে সে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। একইভাবে পল্লীকবি জসীমউদ্্দীনকে সিরাজী উৎসাহিত করেছিলেন। আবার সিরাজীর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র তূর্যনাদের অমর কবি সৈয়দ আসাদুদ্দৌলা সিরাজী কবি নজরুল ইসলামকে সিরাজগঞ্জে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। বিদ্রোহী কবি তখন বাণীকুঞ্চে এসে সিরাজীর মাজারে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘এ যেন হজ্ব করতে এসে কাবা শরিফ না দেখে ফিরে যাওয়া।’
No comments