গল্প- আমার বাবার মাথা by ওকউইরি ওদুর
অনুবাদ : তানভীর আহসান।
ওকউইরি
ওদুর জন্ম কেনিয়ার নাইরোবিতে। তার উপন্যাসিকা দ্য ড্রিম চেজারস কমনওয়েলথ
বুক প্রাইজ ২০১২-তে খুব প্রশংসিত হয়েছে। তিনি সম্প্রতি উগান্ডার কাম্পালায়
রাইটিভিজম ফেস্টিভ্যাল পরিচালনা করেছেন। তিনি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তরুণ
লেখিকাদের ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর শিক্ষক এবং বর্তমানে তার পূর্ণদৈর্ঘ্য
উপন্যাসের কাজটি করছেন। >>>>>>
আমি বাবাকে ডেকেছিলাম ওর মাথাটা দেখতে কেমন হয়েছে সেটা দেখার জন্যই, কিন্তু এখন ও এখানেই রয়েছে আর আমি জানিও না যে, ওকে কী করে ফেরত পাঠাবো।
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল সেই বিষ্যুদবারে যেবার ফাদার ইগনাটিয়াস কিটগুমে মা মেরির নিষ্পাপ গর্ভ উৎসব থেকে ফেরত এলেন। বয়স্ক মহিলারা তাদের রবিবাসরিয় ফ্রক পরেছিল, আর বয়স্ক লোকগুলো বেড়া থেকে বাগানবিলাসের থোকা তুলে তাদের বুক পকেটে গুঁজে রেখেছিল। একজন বুড়ো তার শিকওয়ারুসিটা খুঁজে পাচ্ছিল না বলে ডরমিটরি থেকে আসতে চাইছিলো না। আমি পীড়াপীড়ি করলে সে তার চুলে চাপড় দিয়ে বলল, ‘খোদার কিরে, তুমি কী আমাকে সবসময় কেমন দেখায় তাই উগাণ্ডার পাদ্রীকে দেখাতে চাও?’
আমি সামনের উঠানে এভোকাডো গাছের তলায় চেয়ারগুলো সাজিয়ে রাখলাম, আর বুড়োবুড়িরা সেখানে বসে তাদের হাসিটা প্র্যাকটিস করে নিতে লাগলো। যে জনাকয়েক হোমে থাকতো না তারাও এলো, এই যেমন ঐ মহিলা যে উত্তর মাতাহারির স্টেজকোচ বাসে ক্যান্ডির হকারি করতো, সেই লোকটা যার একরুমের এপার্টমেন্টটা দিনের বেলায় কিন্ডারগার্টেন আর সন্ধ্যায় বেশ্যাবাড়ি হয়ে যায়, আর সেই মহিলা যার অবৈধ চোলাই খেয়ে গত জানুয়ারিতে পাঁচজন অন্ধ হয়ে গেছে।
ফাদার ইগনাটিয়াস একটা বোদাবোদার পিছনে চড়ে এলেন, আর সবাই তার টুপির ভিতরে একটা করে কয়েন ফেলার পর বোদাবোদার লোকটাকে পঞ্চাশ শিলিং দিলেন। বোদাবোদার লোকটা বলল, ‘ঈশ্বর মহান’, আর তারপর যে রাস্তায় এসেছিল সেই রাস্তায়ই আবার চলে গেল।
ফাদার ইগিনাটিয়াস কোটটা খুললেন আর তার জন্য, ‘ফাদার ইগনাটিয়াস ওকেলো, নতুন পাদ্রি,’ লিখে রাখা চেয়ারটাতে বসলেন, আর বুড়ো মানুষগুলো এতক্ষণ যে হাসিটা প্র্যাকটিস করছিলো সেই হাসিটাই তাকে দিল। হাসি যেটা ঘিয়ের মতন গলে গেল, যেটা তাদের ঠোঁটের কোণা ধরে পিচপিচ করে বেরিয়ে এলো আর তাদের কোলের উপর টুপটুপ করে পড়তে লাগলো, যতক্ষণ না যার জন্য এই হাসি সে বাতাসে টকে ওঠে।
ফাদার ইগনাটিয়াস বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন’—মানুষগুলোও বলে উঠলো, ‘আপনারও সহায় হোন’। তারপর তারা গান গাইলো আর চায়ে পাউরুটির টুকরো চুবিয়ে চুবিয়ে ভোজ খেল। যখন তাদের পশমী সোয়েটারের হাতায় ফোঁটা ফোঁটা চা পড়ল, তাদের ধূমায়িত, দারুচিনি জিহ্বা দিয়ে তা চুষেও নিল।
ফাদার ইগনাটিয়াসের সর্বপ্রথম ধর্মোপদেশ ছিল ভালোবাসা নিয়ে : ভালোবাসো তোমার প্রতিবেশিকে যেমন ভালোবাসো নিজেকে, এরকম সব আত্মোপলব্ধি মার্কা কথা। বুড়ো মানুষগুলোর ভালোবাসা নিয়ে কমই আগ্রহ ছিলো। ওরা আসলে কিটগুম জায়গাটা কেমন, আর বাগিসু লোকেরা সত্যি সত্যিই জংলি মানুষখেকো কিনা তাই শুনতেই উন্মুখ ছিল।
আমার জানার আগ্রহ হচ্ছিল যে, ফাদার ইগনাটিয়াস আসলে নিজেকে কী মনে করেন, অন্যদেরকে এমনভাবে ভালোবাসা বিলাতে বলেছেন, যেন ভালোবাসা পাল্লায় ওজন করে গ্লাসের জারে ভরে প্রতিবেশিদের ইচ্ছেমতো নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাকের উপর সাজিয়ে রাখা যায়। যেন কেউ একজন দেখে বলতে পারে, ‘দেখ : আমার সবমিলিয়ে দশখানা ভালোবাসা আছে। আচ্ছা, তিনখানা আমার দেশের জন্য রাখলাম আর বাকিসব আমার প্রতিবেশিদের দিয়ে দিলাম’।
মনে হয় যেমন করে ফাদার ইগনাটিয়াস তার মগটা ভরে নিতেন—যতক্ষণ না চা মগটার মেটে কানা উপচে টুলের পায়া ধরে গড়িয়ে তার ক্যানভাসের জুতোটা ভিজিয়ে দিচ্ছে—সেটাই আমার নিজের বাবার কথা ভাবিয়ে তুলেছিল। এই আমি আচোলি শৌর্যের গল্প শুনছি, আর তারপরই আমি আমার বাবার ছবিগুলোকে একসাথে গেঁথে চলেছি, তার হাত-পা নাড়াচ্ছি, তার মুখ দিয়ে কথা বলাচ্ছি। তাই শেষ পর্যন্ত—সে আমার হাতে একটা পুতুল, আর তার সাথে আমার স্মৃতিগুলো একটা নাটকের দৃশ্যের মতন হয়ে গেল।
এমনকি যখন আমি ফাদার ইগনাটিয়াসকে তার ঘর দেখিয়ে দিলাম, টেবিল পরিষ্কার করে চেয়ারগুলো ভেতরে নিয়ে গেলাম, আমার পার্সটা নিলাম আর নিজেকে টেনে উহিরু পর্যন্ত একটা মাতাতু ধরার জন্য ওডেনে নিয়ে গেলাম—আমি আমার বাবার চোখের ভুট্টারঙা ছুলির কথা ভাবলাম, আর তার কোটের পকেটের সেই পঞ্চাশ সেন্টের কয়েন, যার কথা সে সবসময় ভুলে যেত, আর যেরকম করে শনিবার সকালে লোকেরা এসে আমাদের দরজায় ঘা দিত আর বলত, ‘জনসন, এখন তো বাইরে আসা লাগে; পানির পাইপটা ফেটে গেছে আর আমাদের গ্লাসে গু ভরছি’, আর ‘জনসন, কাপড় পরার সময় নেইরে ভাই; যেরম আছো ওরমই বেরিয়ে এসো। মাতারিটা রাতেই বিইয়েছে আর বাচ্চাকে পায়খানায় ফ্ল্যাশ করে দিয়েছে’।
প্রত্যেকদিন কাজের পরে, আমি রাস্তা থেকে একটা পোড়ানো ভুট্টা কিনে ওটার একটা একটা দানা চিবাতাম, আর যখন বাড়িতে পৌঁছতাম, আমার মসলিনের পোশাকটা থেকে মুচড়ে বেরিয়ে একটা ডাংগেরি পরতাম আর এককাপ মসলা-চা খেতাম। তারপর আমি বাবার যন্ত্রপাতির বাক্সটা বাথরুমে নিয়ে যেতাম। আমি ভাঙা টাইলসগুলো ছেনি দিয়ে দেয়াল থেকে খুলে নিতাম, আর ওগুলো আমার বুটের উপর পড়তো আর ধুলো উড়তো, রঙিন কাচের ফাটলের ভিতর দিয়ে লাফিয়ে আসা আগুনের লকলকে জিহ্বার উপর বিস্ফোরিত হতো।
এইবার, যখন আমি এইসব করছি, আমি সেই দিনটার কথা ভাবলাম—যেদিন আমি বাবার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। সে মুঠোভর্তি চিনাবাদাম তুলে নিয়ে দু’হাতের তালুতে ঘষলো, এরপর সেগুলোকে চিবালো, তারপর মুখ থেকে নিয়ে আমাকে সেটা খাওয়ালো। ওই বয়সে আমি কৌতূহলীই ছিলাম; নিজের দাঁতে চিবানোর মতো বড় হয়ে গেছি, তারপরও ঐ উষ্ণ, চর্বিত ভালোবাসার লোভ করার মতো ছোট রয়ে গেছি, ভালোবাসা হিতোপদেশমূলক কিংবা কফ সিরাপের কাপে মাপার মতো নয়।
যে বিষ্যুদবারে ফাদার ইগনাটিয়াস কিটগুম থেকে এলেন, আমি বসার ঘরে পুরোটা রাত পেটের উপর শুয়ে আমার বাবার ছবি আঁকলাম। মনে মনে আমি তার চোখ দেখতে পেলাম, মুখের চারপাশের বলিরেখা দেখতে পেলাম, দেখতে পেলাম তার চোখের মনিতে ছোট্ট আলোর বিন্দুটা, যেখানটাতে কান তার মাথার সাথে জুড়েছে সেখানকার ভাঁজও দেখতে পেলাম। এমনকি আমি তার শার্টের কলারে তেল আর ঘামের মোটা দাগটাও দেখতে পেলাম—ছোট ছোট বাদামী শিরা যেগুলো ময়লার মূলস্রোত ভেঙে বেরিয়ে নিজেরাই নেমে এসেছিল।
এইসব আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, তারপরও আমি যাই করি না কেনো, তার মাথাটা কাগজের সীমানার ভিতরে কিছুতেই আসতে রাজি হচ্ছিলো না। আমি তার পা থেকে শুরু করলাম আর ক্রমশ উপরের দিকে আঁকতে থাকলাম আর শেষে আমার বাবার মাথাটা কাগজের প্রান্তে, ঘষা তিসির তেল, প্লাস্টিকের গাঁদাফুল আর ভেঁজা বাথরুম চপ্পলের উপরে টুপ করে ভেসে উঠলো।
আমি বউইবোকে কয়েকটা ড্রয়িং দেখালাম। বউইবো বুড়ো মানুষগুলোর হোমের রাঁধুনি ছিল। ওর সাথে আমি একটা সহজ আস্থার সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলাম।
‘ঈশ্বর!’ বউইবো ওগুলো দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল, ‘সিমবি, এতো অস্বাভাবিক’।
‘অস্বাভাবিক’ শব্দটা ঝুরঝুরে হয়ে বেরিয়ে এলো, আর এটা টেবিলের তীক্ষ্ণ কানায় লেগে ভেঙে গেল এবং মেঝের প্লাস্টিক কভারের উপর একটা আঠালো দলা হয়ে রইলো। বউইবো হাতের তালুতে ওর মাথাটা রাখলো, আর ওর ক্রিমরঙা কাফতানের ঘটি হাতাটা এমন ফুলে উঠলো যেন ওগুলোর ভিতরে কুমড়ো ঠাসা রয়েছে।
আমি যেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম সেটা ওকে বললাম, যে খুব সম্ভবত আমার বাবার একটা মুখ থাকলেও তার কোনও মাথা ছিল না। আর যদি আমার বাবার মাথাটা থেকেও থাকে, আমি তা দেখিনি : মানুষের মাথাটা এমন কিছু না যেটা কেউ দেখে। কেউ একজনের দিকে তাকায়, আর যা দেখে সেটা হলো তার মুখ : একটি সাধারণ মুখের আদলের মুখ, যেটা একটি সাধারণ মাথার আদলের মাথাকে ঢেকে রাখে। মুখটা মনে রাখার মতো হলে কেউ দুবার তাকায়। কিন্তু, একজনের চোখকে আরেকজনের মাথার গতানুগতিকতায় আঁকার মধ্যে আসলে কী আছে? বেশিরভাগ সময়ই যখন কেউ কারোর দিকে তাকায়, ওখানে তাদের মাথাটা দেখতেই পায় না।
বউইবো কোমর উঁচু জিকোটার সামনে দাঁড়ালো, আর একটি পাত্রে ফুটন্ত পানির মধ্যে কাসাভা ময়দা ঢাললো আর একটা রান্নার হাতা দিয়ে ওটা নাড়তে শুরু করলো। ‘বাছা,’ সে বললো, ‘তুমি কি করে বুঝেছো যে ঐসব ড্রয়িংয়ের লোকটা তোমার বাবা? ওরতো কোনো মাথাই নেই, কোনো মুখ নেই’।
‘আমি ওর পোশাক চিনেছি। ওই লাল কর্ডুরয়টা, যেটা সে সবসময় হলুদ শার্টটার সাথে মিলিয়ে পরতো’।
বউইবো মাথা নাড়লো। ‘শুধু একটা হালকা ঝুড়ি দিয়েই যে কেউ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে’।
দিনের এই সময়টায় বুড়ো মানুষগুলো তাদের কাঠের পুঁতির ছড়ায় হাত বুলাতো আর মন্ত্রপাঠের মধ্যে মধ্যে ঘুম তাড়াতে নাক দিয়ে বিকট শব্দ করতো। আমি তাদেরকে একটি ছোট, অপ্রতিভ ঝিমুনি দিতে দিতাম, ততটুকুই যতক্ষণে তারা বিশ্বাস করত যে, পুরো জপটাই তারা শেষ করেছে। তারপর আমি দড়ি ধরে টানলে দুপুরের খাবারের ঘণ্টা টুংটাং বেজে উঠত। বুড়ো মানুষগুলো প্রতি টেবিলে আটজন করে বসত, আর উগালি, টক ডাল আর ঢেঁড়সের স্যুপে তাদের মুখ ভর্তি করে বলে উঠত, ‘কাদিমা’র দোকান থেকে চাপাতি কিনো না—কাদিমা’র বউ ময়ানের উপর বসে আর ওর পাছা দিয়ে ওটা তুকতাক করে’ অথবা, ‘তোমায় কি ওয়ামবুয়ার কথা বলেছি, ওই যে, যার গরুটা একটা বাচ্চাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল, বাচ্চাটা কান্না থামাচ্ছিল না তাই’।
বিকেলে আমি বেডপ্যানগুলো খালি করে দিতাম আর বুড়ো মানুষগুলোর পা উষ্ণ জল আর বেকিং সোডায় ভিজিয়ে দিতাম, আর যখন তারা দলবেঁধে প্রার্থনায় রওনা দিত, আমি আমার পার্সটা নিতাম আর বাড়ি যেতাম।
আখের ট্র্যাক্টর আমার বাবাকে মেরে ফেলার আগের বড়দিনে, সে প্লেট থেকে চা খেয়েছিল, কফি জারের ঢাকনার উপর ডিম ভেজেছিল আর ঘরের পেছনের আবছায়া, টিকটিকি ভরা কোণা থেকে তার ইয়ামাহা ড্রাম সেটটা এনে বারান্দায় বসে যতক্ষণ না তার আঙুল ফেটে রক্ত বেরোয় ততক্ষণ বাজিয়েছিল ।
একদিন সে তার টুল আর হাত রেডিওটা নিয়ে বারান্দায় গেল, আমি তার পায়ের কাছে বসে রইলাম, তার জুতোর ফিতে খুলে দিলাম আর পা থেকে চটচটে মোজাটা ছাড়িয়ে নিলাম। সে খানিক্ষণ তার আঙুল নাড়ালো। ওগুলোয় খানিকটা পচা গন্ধ ছিল, টক ছানার মতো।
আমার বাবা ধূমপান করত আর আফ্রিকার শিংয়ের আরও ভেতরে যে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে তার বর্ণনা শুনতো, আর ঘড়িতে আটটা বাজলে নব ঘুরিয়ে মৃত্যুর খবরগুলো শুনতো। তার চেনা কারোর নাম তার কানে লাগতে সময় নিতো না। সে বিষম খেতো আর ধোঁয়া তার গলায় আটকে যেত।
আমার বাবা বলতো, ‘শুনলে ওটা? সোপস্টার চলে গেল! সোপস্টার, মিকাহ’র ছেলে, মিরেকে মাধ্যমিকে যে কৃষি পড়াতো। ঈশ্বর, আমি বলছি, সবাই চলে যাচ্ছে। এমনকি আমিও, আমার নামও খুব শিগগিরই মৃত্যুর খবরে শুনবে’।
আমি তাকে বিকেলের চা নিয়ে এসে দিলাম। বারান্দায় সে তার সিগারেটটা পিষে দিল, তারপর ধীরে ধীরে কাপটা তার ঠোঁটের কাছে তুললো। কাপটা তার পছন্দ মতোই ভরা ছিল, এতটাই যে, একটু ঝাঁকুনিতেই তার আঙুল আর কোল ভেসে যাবে।
আমার বাবা চায়ে একটা চুমুক দিত আর বলত, ‘সোপস্টার আমার ভাইয়ের মতো ছিল। ওর মরার খবর কেন আমায় এমন করে জানতে হবে, এরকম রেডিওতে?’
তারপর আমার বাবা ভাঁজ করা সোফাটায় শুতো, আমি টুলে বসে তাকে দেখতাম, ভয় পেতাম, যদি আমি নজর ফেরাই তাহলে সেও চলে যাবে। সেবারই প্রথম আমি তার মৃত্যু কল্পনা করি, প্রথম আমি শোক করি।
আর তারপরও আমি আসলে আমার বাবার জন্য শোক করছিলাম না, বাবার মৃত্যুর অসম্ভব বার্তাবরণের মাঝে আমার আমির জন্য শোক করছিলাম। আমি কল্পনা করছিলাম এটা কেমন লাগবে : মৃত্যু সংবাদটা জানাবে যে, আমার বাবা একটা নরককুণ্ডের ভিতর ডুবে গেছে, আর মানুষ এমনভাবে আমার দিকে তাকাবে যেন, আমি রাস্তার ম্যানহোলে আটকে পড়া একটা গুঁইসাপ। আমি কল্পনা করলাম যে, যখন আমি খবরটা পাব তখন আমার পরনে একটা সবুজ পোশাক থাকবে—যেটার জমিনে লাল গন্ধরাজ বোনা থাকবে—মানুষ আসবে, আমার কাঁধে চাপড় দেবে আর প্লাস্টিকের কাপে উষ্ণ কোকাকোলা আমার হাতে দিয়ে বলবে, ‘খবরটা পাওয়ার সাথে সাথেই আমি আমার সব শোক একটা ঝুড়িতে ভরে এখানে চলে চলে এসেছি। আর কীভাবে তোমার বাবার আত্মা জানবে যে, তার মৃত্যুতে আমার কোনো দোষ নেই’।
আমার বাবার মাথাটা আমি কেনো স্মরণ করতে পারছিলাম না, তা নিয়ে বউইবোর একটা ব্যাখ্যা ছিল।
ও বলল, ‘যদিও সবার মাথাই তাদের মুখের পেছনে থাকে, কেউ কেউ সহজেই তাদেরটা দেখিয়ে দেয়; যখন তারা তোমার দিকে পেছন ফেরে আর তাদের মাথাটাই শুধু তুমি দেখতে পাও। তোমার বাবা ভালো মানুষ ছিল আর ভালো মানুষেরা কখনও তাদের মাথা দেখায় না; তারা তোমাকে তাদের মুখ দেখায়’।
হয়তো ও ঠিকই বলছিলো। এমনকি যেদিন আমার বাবার সাথের লোকেরা ফোন করে বলছিলো যে শিবালে যাওয়ার পথে একটা আখের ট্র্যাক্টর তাকে রাস্তার সাথে পিষে ফেলেছে, কেউই তার মাথা দেখার কথা কিছু বলেনি। মাপা সূক্ষ্মতায় তারা বাকি শরীরটার বর্ণনা দিচ্ছিল : কীভাবে তার পা রাস্তায় টাটকা পিচে চটচটে আর চকচকে হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, কীভাবে তখনও তার একটা পা টায়ারের স্যান্ডেলের মধ্যে থেকে বাইসাইকেলের প্যাডেল মেরেই চলেছে, কীভাবে আখের রসে তার মুখ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল আর তার পলিয়েস্টার শার্টের কলার ভিজিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে তখনও তার মুখে একটা ধৈর্যশীল প্রশান্তি লেপ্টে ছিল, এমনকি তার চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে বৃষ্টি জলে গড়াচ্ছিল।
যখন তারা আমাকে এইসব বলছিল, সেসব শুনেই কাঁদার বদলে আমি ভাবছিলাম, আমার বাবা কী সত্যিই ওবাওয়ামিদের দীর্ঘ ধারা থেকে এসেছিল আর তার লোকেরা তাকে গলায় রাজকীয় কড়ির একটা মালা ঝুলিয়ে বসা অবস্থায় কবর দেবে কিনা।
‘যাই হোক’ বউইবো বলে চলল, ‘তোমার বাবাকে নিয়ে আর চিন্তা করে কী হবে, হ্যাঁ? ও দুধ বহু আগেই উপচে গেছে আর মাটিতে মিশেও গেছে’।
দিনটা আমি ডরমিটরিতে কাটালাম, বিছানা তুললাম, তোষক রোদে দিলাম, পিভিসি ম্যাট্রেস ঘষে পরিষ্কার করলাম। একটা বুড়ো লোক আমার সাথেই থাকলো। সে শোনালো কিভাবে সে তার জীবনের অস্তগামী বছরগুলো কাটানোর জন্যে এই হোমে এসেছিলো—১৯৯৮ সালের আগস্টে সে মোম্বাসায় তার বাড়িতে ফেরার জন্য বিকেলের ট্রেনে উঠতে স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমেরিকান দূতাবাসে বোমা ফাটলে পুলিশ সারা শহরে চিরুনি চালালো আরব বংশোদ্ভূত সব লোককেই হাজত করলো। যেহেতু সে বাহাত্তুরে বুড়ো ছিল আর খুব দ্রুতই ভীমরতির লক্ষণ দেখাচ্ছিল, তাই ওরা তাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে যায়, আর তখন থেকে সে এখানেই আছে।
‘তোমার লোকেরা তোমাকে কখনও নিতে আসেনি?’ হতভম্ব হয়ে আমি জানতে চাইলাম।
বুড়োটা নাক টানলো। ‘আমার লোকেরা?’
‘সবারই তো নিজের নিজের লোকেরা আছে’
বুড়োটা হেসে ফেললো। ‘যে খাবারটা তুমি খেয়ে ফেলেছো কেবল সেটাই তোমার নিজের, বাছা’
পরে বুড়ো মানুষগুলো ঝুলঝুলে গোছা হয়ে উঠানে বসলো। বউইবো আর আমি রান্নাঘরের পেছনের সিঁড়ি থেকে তাই দেখলাম। ঘাসের মধ্যে পিঁপড়েরা একটি শুয়োপোকা সাবাড় করছে। কুকুরটা ঘষা গোলাপি রঙের উপর সবুজ শিরার আঁকিবুঁকি করা নাকটা কুঁচকাচ্ছে। কাঠচাঁপা গাছটার ওপরে পাখিগুলো একটি আরেকটির সাথে পাল্লা দিচ্ছে। ওদের একটি বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেল আর শ্যাওলা-ঢাকা বিদ্যুতের খুঁটিটায় মাথাটা থেতলে ফেলল।
বোলতারা ঘাসের ওপর নিচুতে উড়ছে। শ্যাওলায় দম আটকে ধরা একটি গাছের গুড়ির উপর একটি টিকিটিকি বেয়ে উঠলো। কুকুরটা নিজের পায়ের ভেতর দিকটা চেটে নিল। রাজকীয় নৃত্যশিল্পী প্রজাপতির একটা দল লিলির সারির উপর ভেসে এল, ওদের বর্ণিল নাচের ঘাগরা অশ্রুত বাতাসের দাপটে কাঁপছিল। কুকুরটা ঘাসের উপর পাশ ফিরে শুয়ে নিঃশেষিত শুয়োপোকা আর সেটাকে চিবিয়ে চলা পিঁপড়েদের দলাই-মলাই করছিল। কুকুরটার লোমশ পেট থেকে বেরিয়ে থাকা স্তনের বোঁটাগুলো থুতু লেগে থাকা ছাগলের লাদির মতো লাগছিল।
বউইবো বলল, ‘আমি তোমার বাবার মাথা মনে করতে তোমায় সাহায্য করতে পারি’।
আমি বললাম, ‘কী সব ফ্যালদা কথা শুরু করলে তুমি এখন?’
বউইবো তার তর্জনিটা চাটলো আর পরমবিশ্বাসে তুলে ধরল। ‘লাল বাইবেলের কসম! আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, আর আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি’।
তোমায় বলি : একদিন তুমি তোমার নির্বাসন অস্বীকার করবে, তুমি বাড়ি ফিরে যাবে, আর তোমার মা সবচেয়ে সুন্দর চিনামাটির বাসনগুলো বের করবে, আর তোমার বাবা তোমার জন্য একটি তেজি মোরগ জবাই করবে, আর তোমার বোন তার নেভি ব্লু পি. ই. র্যাপারটা পরবে, আর তোমার ভাই আঙুলের ফাঁক দিয়ে হড়কে যাওয়া ভাত আর সুরুয়া চটকানোর বদলে চামচ দিয়ে খাবে।
আর তুমি তাদের সেই জায়গার গল্প বলবে যেগুলো এখানের না, আর সেইসব লোকদের গল্প : যারা জিক ব্লিচে টেবিল ন্যাপকিন ভেজায় আর লন্ডন নিয়ে এমনভাবে কথা বলে যেন লন্ডন এমন একটা জায়গা যে লাফ দিয়ে একটা বাসে উঠে নাকুরু, আর কিসুমু। এবং কাকামেগার ভিতর দিয়ে গিয়েই ওরা সেখানে পৌঁছে যায়।
তুমি সেইসব লোকেদের গল্প বলবে, যারা তরমুজ ফালি ফালি করে কাটে না বরং তরমুজটাকে দুই ভাগ করে প্রতিটি ভাগ থেকেই চামচ দিয়ে খায় এবং সেইসব মহিলাদের গল্প করবে যারা হাত ধরাধরি করে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের চারিধারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়, ধূসর মাদার ইউনিয়নরঙা ঘটি অন্তর্বাসের ছিটেফোঁটা দেখিয়ে ফেলে এই গানটা গাইতে গাইতে :
কিজেমবে নি কিকালি, পারাম-পারাম
কিলিকাতা মওয়ালিমু, পারাম-পারাম
তুমি মনে কর যে, তোমার লোকেরা আসলে তোমার, সবসময়ই তাদের মনে আর দিলে তোমার জন্যে একটা জায়গা রাখা আছে। তুমি মনে কর যে, তোমার লোকেরা সবসময় তোমার ফেরার পথ চেয়ে থাকে।
হয়তো তুমি যেদিন ঘরে তোমার লোকদের কাছে ফিরে যাবে, বারান্দায় বেতের একটা চেয়ারে তুমি একা বসতে পারবে, একা তামাক টানতে পারবে কারণ তোমার লোকেরা তোমায় ফেরত চাইলেও কেউই আসলে চায়নি যে তুমি থেকে যাও।
আমার বাবা বারান্দায় বেতের চেয়ারটার উপর ঝুলে ছিল, পুরাতন দিনগুলোর মতোই তামাক তানছিল আর হাতরেডিওটা দেখছিল। রেডিও থেকে মৃত্যুসংবাদটা উঠে এলো, আর নিচুতে ভাসতে ভাসতে, বসার ঘরের জানালার শীতল কাঁচে লেপ্টে থাকা ধোঁয়াশা হয়ে গেল।
আমার বাবার জামা বাতাসে ঝাঁপটালো, আর ধোঁয়ার সরু শুড়গুলো তার মুখের সামনে ফট করে ভেঙে গেল। সে আপনমনে শিস দিয়ে উঠলো। প্রথমে সুরটার মুখায়বয়ব ছিল না, যাচ্ছেতাই জিনিস, যেন কেউ পথের উপর একটি বোতল পেয়েছে আর লাথি দিতে দিতে ওটা বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তারপর সুরটা নিজের ভিতর অন্য সুরের খণ্ডগুলি ধরতে পেল, আর তখন নিজের মনখোলা ওঠা-নামাটা হারিয়ে ফেলল।
আমার বাবার একটা মাথা ছিল। এখন যখন আমি এটার দিকে তাকাতে মনস্থির করলাম আমি এটা দেখতে পেলাম। তার মাথাটা একটি চালকুমড়োর মতো দেখতে ছিল। সম্ভবত সে কারণেই আমি এটার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম; এটা ভয়াবহ, মাথা আউলা করে দেওয়ার মতো দেখতে।
আমার বাবা কলের মিস্ত্রি ছিল। সে যে নর্দমার পাইপগুলো সে নাড়াচাড়া করতো তার নখে তখনোও সেগুলোর গায়ের রঙ লাগানো, আর তার বুটে তখনোও যতসব অবর্ণনীয় কিচেনসিংকগুলোর চিটচিটে ময়লায় ছিবড়ানো। তাকে দেখে আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ল যেদিন সে কারোর বর্জ্যের আঁশে একটা সোনার হার পেঁচানো দেখতে পেয়েছিল, আর সে তার কর্ডুরয়ে ময়লাটা মুছে হারটা নাগিনপত্নীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল, আর সেই সন্ধ্যায় কাঁধে করে লাল গ্রেটওয়েল টেলিভিশনটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। বসার ঘরের এক কোণায় সে ওটা বসালো আর বলল, ‘দেখতো জিনিসটা কেমন ঝকঝক করছে, যেন এটার ভিতর কোন গু-ই পোরা নেই’।
আর প্রতিদিনই আমি একগোছা লবঙ্গফুল তুলে নিয়ে আসতাম আর ওদের ডাঁটাগুলি তেরছা করে ভেঙে একটা কাঁচের বাটিতে করে টেলিভিশনের উপরে রাখতাম যাতে করে আমার বাবা সন্ধ্যার খবর দেখতে দেখতে গুয়ের কথা না ভাবে।
আমি বউইবোকে বললাম, ‘আমাদের ওকে ফেরত পাঠাতে হবে’
বউইবো বলল, ‘সেই কলিজাটাই তো চাইলে যেটা তুমি খাও’
‘কিন্তু আমি ঠিক তাকে ফেরত চাইনি, আমি শুধু তার মাথাটা দেখতে চেয়েছিলাম’
বউইবো বলল, ‘শেষতক সে তো তোমার কাছে ফিরেই এলো আর এরও তো কিছু একটা ব্যাপার আছে, তাই না?’
সম্ভবত আমার বাবার ফিরে আসায় আর কোনো ব্যাপার নেই, শুধুমাত্র সারাবাড়িটা তার গন্ধ গন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া—পোড়া ডাল, গলন্ত নখ আর তেতো কুইনিনের বাকল আর ভাঙা সিগারেটের টুকরায় ভেজা নেকড়ার অম্লতা।
আমার বাবার দিকে আমি জিনিসপত্র ছুঁড়ে দিয়েছিলাম; রসুন, আগর, লবণ, শুকরের মাংস, আর যখন কোনোকিছুই তাকে ফেরাতে পারলো না, আমি বাড়িটার শান্তি-সস্ত্যয়ন করে দেওয়ার জন্য ফাদার ইগনাটিয়াসকে অনুরোধ করলাম। উনি এক শিশি পবিত্র জল নিয়ে এলেন, আর সব ঘরে ছিটিয়ে দিলেন, আমার বাবার উপরেও ছিটালেন। ফাদার ইগনাটিয়াস বললেন, আমার আরোও সুরক্ষা দরকার, তার আগে তাকে আমার একটি চেক লিখে দিতে হবে।
একদিন যখন আমি রাস্তার কোণা থেকে পোড়ানো ভুট্টা কিনছিলাম, দোকানদারটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সবজির দোকানি যা বলছে, এটা কি সত্যি নাকি যে, তুমি শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসার মানুষটা খুঁজে পেয়েছো কিন্তু তাকে দরজা দিয়ে ঢুকতেই দিচ্ছ না?’
সেই সন্ধ্যায় আমি আমার বাবাকে ভিতরে ডেকে নিলাম। আমরা ভাঁজ করা সোফাটায় পাশাপাশি বসলাম, আর একটা মাছিকে জানালার কাঁচ আর গ্রিলের মাঝের স্ক্রিনটায় বেয়ে উঠতে দেখলাম। বেয়ে উঠতে উঠতে ওটা একটু ভনভনালো। ছাদের পাখাটা ক্যাঁচকোঁচ করলো আর ওটা করিডোরের মেঝেতে ছায়া বিছালো। ছায়াটা উঁচুতে লাফ দিলো আর দরজায় চড়ে বসলো আর দেয়ালের ঘুলঘুলিতে উঁকি দিল।
বাতাস একটি কাপ উল্টে ফেলল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাপটা জানলার কার্নিশে কাত হয়ে রইলো। তারপর এটি একপাশে গড়িয়ে পড়লো আর মেঝের উপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে গেল। আমি ছিটকিনিটা তুলে জানালাটা আটকে দিলাম। কাঁচের গায়ে বাতাস-ভেজা ঠোঁট বুলিয়ে দিল। ধুলো আর লালার একটি দাগ রেখে গেলো, আর গ্লাসের কানা ধরে লালাটা ধীরে গড়িয়ে নেমে গেল। বাতাসের মুখটা লালাভর্তি ছিলো। শিগগিরিই লালায় সারা জানালা ঢেকে গেলো, ততক্ষণ ধরে ছড়াতে লাগলো যতক্ষণে জানালার বাইরের রোজমেরি ব্রাশউডের ঝোপটা ঝাপসা হয়ে যায়। বাইরে জাকারান্ডা নিচু হয়ে ছাদে আঁচল কেটে গেলো। পাশের ঘরে দরজা জানালা দমদম বাড়ি খেলো।
আমি আমার বাবার দিকে তাকালাম। তাকে একইসাথে অচেনা আর চেনা লাগছিলো, একই সাথে দারুণ আর ভীতিকর—সে ঝুরঝুরে ছিলো, চিনামাটির চিড়ধরা হাতলের মতো, আর সে ছিলো পেঁচার শীতল পীতবর্ণ দৃষ্টির মতো।
আমার বাবা আমার হাত ছুঁলো—এতো হাল্কা, এতো নরম করে যেন, ভয় পাচ্ছিলো আমি শিউরে উঠবো আর হাত সরিয়ে নেব। আমি চোখ তোলার সাহস করলাম না, কিন্তু সে আমার চিবুক ছুঁলো আর উপরে তুললো যাতে করে তার দিকে তাকানো ছাড়া আমার আর উপায় রইলো না।
আমার মনে পড়লো সেই সময়ের কথা যখন আমি ছোট ছিলাম, যখন আমি প্রায় এরকমভাবেই আমার বাবার চোখের দিকে তাকাতাম। ওখানে আমি দেখতাম বিভিন্ন আকৃতি; বৃত্ত, ত্রিভুজ আর চতুর্ভুজের একটি মাতাল, বুদ্ধিহীন পিণ্ড। আমি বিস্মিত হতাম আমার বাবার চোখের ভিতরে ওগুলো ঢুকলো কীভাবে। আমি কল্পনা করতাম সে টেবিলে বসে, রঙিন বই থেকে চকচকে স্মৃতিগুলো কেটে নিয়েছে, আর আঠা দিয়ে মেখে ওগুলো চোখের ভিতর দিকে সেটে দিয়েছে যাতে তার মণির ভিতরে একটা উদ্ভট এলোমেলো কোলাজ তৈরি হয়।
আমার বাবা বলল, ‘একটু চা হবে, সিমবি?’
আমি নিয়ে এলাম, আর সে জানতে চাইলো তার পুরনো বন্ধু পাইয়াস ওবোতে এখনো শনিবারগুলোতে বাড়িতে আসে কি না, এখনোও বাদাম সাবান আর কুমড়ো পাতা আর পোস্ট অফিস থেকে আসার পথে তোলা চিঠির গাদা হাতে হাজির হয় কিনা।
আমি বললাম, ‘পাইয়াস ওবোতে চার বছর হলো মারা গেছে’
আমার বাবা তার কাপটা ঠেলে সরিয়ে দিলো। সে বলল, ‘যদি চাও যে তোমার চা না খাই, বললেই পারো, তোমার মুখ দিয়ে লোক মারা-মারা খেলো না’
আমার বাবা খানিকক্ষণ চুপ রইলেন, এই পাইয়াস ওবোতে লোকটার জন্য দুঃখ করলেন, যে আমাকে সবসময় হাঁটুতে হাঁটুতে বাড়ি খাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। পাইয়াস ওবোতে খুব চোখ পিটপিট করতো, পকেটের মধ্যে বলপেনের জন্য হাতড়াতো আর হাতে উঠে আসতো একটা মুরগির হাড়, তখনো লালা, তখনো রসালো।
আমার বাবা আমাকে বলল, ‘তোমার সাথে দেখা হলো। তুমি চা খাওয়ালে। এখন আমি যাব’।
‘কোথায় যাবে?’
‘এখান থেকে দূরে কোনো শহরে কাজ খুঁজে নেব। হয়তো এলদোরেতে। ওখানে একসময় আমার লোকেরা ছিল।‘
আমি বললাম, ‘তুমি এখানে আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে, বাবা’।
আমি বাবাকে ডেকেছিলাম ওর মাথাটা দেখতে কেমন হয়েছে সেটা দেখার জন্যই, কিন্তু এখন ও এখানেই রয়েছে আর আমি জানিও না যে, ওকে কী করে ফেরত পাঠাবো।
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল সেই বিষ্যুদবারে যেবার ফাদার ইগনাটিয়াস কিটগুমে মা মেরির নিষ্পাপ গর্ভ উৎসব থেকে ফেরত এলেন। বয়স্ক মহিলারা তাদের রবিবাসরিয় ফ্রক পরেছিল, আর বয়স্ক লোকগুলো বেড়া থেকে বাগানবিলাসের থোকা তুলে তাদের বুক পকেটে গুঁজে রেখেছিল। একজন বুড়ো তার শিকওয়ারুসিটা খুঁজে পাচ্ছিল না বলে ডরমিটরি থেকে আসতে চাইছিলো না। আমি পীড়াপীড়ি করলে সে তার চুলে চাপড় দিয়ে বলল, ‘খোদার কিরে, তুমি কী আমাকে সবসময় কেমন দেখায় তাই উগাণ্ডার পাদ্রীকে দেখাতে চাও?’
আমি সামনের উঠানে এভোকাডো গাছের তলায় চেয়ারগুলো সাজিয়ে রাখলাম, আর বুড়োবুড়িরা সেখানে বসে তাদের হাসিটা প্র্যাকটিস করে নিতে লাগলো। যে জনাকয়েক হোমে থাকতো না তারাও এলো, এই যেমন ঐ মহিলা যে উত্তর মাতাহারির স্টেজকোচ বাসে ক্যান্ডির হকারি করতো, সেই লোকটা যার একরুমের এপার্টমেন্টটা দিনের বেলায় কিন্ডারগার্টেন আর সন্ধ্যায় বেশ্যাবাড়ি হয়ে যায়, আর সেই মহিলা যার অবৈধ চোলাই খেয়ে গত জানুয়ারিতে পাঁচজন অন্ধ হয়ে গেছে।
ফাদার ইগনাটিয়াস একটা বোদাবোদার পিছনে চড়ে এলেন, আর সবাই তার টুপির ভিতরে একটা করে কয়েন ফেলার পর বোদাবোদার লোকটাকে পঞ্চাশ শিলিং দিলেন। বোদাবোদার লোকটা বলল, ‘ঈশ্বর মহান’, আর তারপর যে রাস্তায় এসেছিল সেই রাস্তায়ই আবার চলে গেল।
ফাদার ইগিনাটিয়াস কোটটা খুললেন আর তার জন্য, ‘ফাদার ইগনাটিয়াস ওকেলো, নতুন পাদ্রি,’ লিখে রাখা চেয়ারটাতে বসলেন, আর বুড়ো মানুষগুলো এতক্ষণ যে হাসিটা প্র্যাকটিস করছিলো সেই হাসিটাই তাকে দিল। হাসি যেটা ঘিয়ের মতন গলে গেল, যেটা তাদের ঠোঁটের কোণা ধরে পিচপিচ করে বেরিয়ে এলো আর তাদের কোলের উপর টুপটুপ করে পড়তে লাগলো, যতক্ষণ না যার জন্য এই হাসি সে বাতাসে টকে ওঠে।
ফাদার ইগনাটিয়াস বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন’—মানুষগুলোও বলে উঠলো, ‘আপনারও সহায় হোন’। তারপর তারা গান গাইলো আর চায়ে পাউরুটির টুকরো চুবিয়ে চুবিয়ে ভোজ খেল। যখন তাদের পশমী সোয়েটারের হাতায় ফোঁটা ফোঁটা চা পড়ল, তাদের ধূমায়িত, দারুচিনি জিহ্বা দিয়ে তা চুষেও নিল।
ফাদার ইগনাটিয়াসের সর্বপ্রথম ধর্মোপদেশ ছিল ভালোবাসা নিয়ে : ভালোবাসো তোমার প্রতিবেশিকে যেমন ভালোবাসো নিজেকে, এরকম সব আত্মোপলব্ধি মার্কা কথা। বুড়ো মানুষগুলোর ভালোবাসা নিয়ে কমই আগ্রহ ছিলো। ওরা আসলে কিটগুম জায়গাটা কেমন, আর বাগিসু লোকেরা সত্যি সত্যিই জংলি মানুষখেকো কিনা তাই শুনতেই উন্মুখ ছিল।
আমার জানার আগ্রহ হচ্ছিল যে, ফাদার ইগনাটিয়াস আসলে নিজেকে কী মনে করেন, অন্যদেরকে এমনভাবে ভালোবাসা বিলাতে বলেছেন, যেন ভালোবাসা পাল্লায় ওজন করে গ্লাসের জারে ভরে প্রতিবেশিদের ইচ্ছেমতো নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাকের উপর সাজিয়ে রাখা যায়। যেন কেউ একজন দেখে বলতে পারে, ‘দেখ : আমার সবমিলিয়ে দশখানা ভালোবাসা আছে। আচ্ছা, তিনখানা আমার দেশের জন্য রাখলাম আর বাকিসব আমার প্রতিবেশিদের দিয়ে দিলাম’।
মনে হয় যেমন করে ফাদার ইগনাটিয়াস তার মগটা ভরে নিতেন—যতক্ষণ না চা মগটার মেটে কানা উপচে টুলের পায়া ধরে গড়িয়ে তার ক্যানভাসের জুতোটা ভিজিয়ে দিচ্ছে—সেটাই আমার নিজের বাবার কথা ভাবিয়ে তুলেছিল। এই আমি আচোলি শৌর্যের গল্প শুনছি, আর তারপরই আমি আমার বাবার ছবিগুলোকে একসাথে গেঁথে চলেছি, তার হাত-পা নাড়াচ্ছি, তার মুখ দিয়ে কথা বলাচ্ছি। তাই শেষ পর্যন্ত—সে আমার হাতে একটা পুতুল, আর তার সাথে আমার স্মৃতিগুলো একটা নাটকের দৃশ্যের মতন হয়ে গেল।
এমনকি যখন আমি ফাদার ইগনাটিয়াসকে তার ঘর দেখিয়ে দিলাম, টেবিল পরিষ্কার করে চেয়ারগুলো ভেতরে নিয়ে গেলাম, আমার পার্সটা নিলাম আর নিজেকে টেনে উহিরু পর্যন্ত একটা মাতাতু ধরার জন্য ওডেনে নিয়ে গেলাম—আমি আমার বাবার চোখের ভুট্টারঙা ছুলির কথা ভাবলাম, আর তার কোটের পকেটের সেই পঞ্চাশ সেন্টের কয়েন, যার কথা সে সবসময় ভুলে যেত, আর যেরকম করে শনিবার সকালে লোকেরা এসে আমাদের দরজায় ঘা দিত আর বলত, ‘জনসন, এখন তো বাইরে আসা লাগে; পানির পাইপটা ফেটে গেছে আর আমাদের গ্লাসে গু ভরছি’, আর ‘জনসন, কাপড় পরার সময় নেইরে ভাই; যেরম আছো ওরমই বেরিয়ে এসো। মাতারিটা রাতেই বিইয়েছে আর বাচ্চাকে পায়খানায় ফ্ল্যাশ করে দিয়েছে’।
প্রত্যেকদিন কাজের পরে, আমি রাস্তা থেকে একটা পোড়ানো ভুট্টা কিনে ওটার একটা একটা দানা চিবাতাম, আর যখন বাড়িতে পৌঁছতাম, আমার মসলিনের পোশাকটা থেকে মুচড়ে বেরিয়ে একটা ডাংগেরি পরতাম আর এককাপ মসলা-চা খেতাম। তারপর আমি বাবার যন্ত্রপাতির বাক্সটা বাথরুমে নিয়ে যেতাম। আমি ভাঙা টাইলসগুলো ছেনি দিয়ে দেয়াল থেকে খুলে নিতাম, আর ওগুলো আমার বুটের উপর পড়তো আর ধুলো উড়তো, রঙিন কাচের ফাটলের ভিতর দিয়ে লাফিয়ে আসা আগুনের লকলকে জিহ্বার উপর বিস্ফোরিত হতো।
এইবার, যখন আমি এইসব করছি, আমি সেই দিনটার কথা ভাবলাম—যেদিন আমি বাবার পায়ের কাছে বসে ছিলাম। সে মুঠোভর্তি চিনাবাদাম তুলে নিয়ে দু’হাতের তালুতে ঘষলো, এরপর সেগুলোকে চিবালো, তারপর মুখ থেকে নিয়ে আমাকে সেটা খাওয়ালো। ওই বয়সে আমি কৌতূহলীই ছিলাম; নিজের দাঁতে চিবানোর মতো বড় হয়ে গেছি, তারপরও ঐ উষ্ণ, চর্বিত ভালোবাসার লোভ করার মতো ছোট রয়ে গেছি, ভালোবাসা হিতোপদেশমূলক কিংবা কফ সিরাপের কাপে মাপার মতো নয়।
যে বিষ্যুদবারে ফাদার ইগনাটিয়াস কিটগুম থেকে এলেন, আমি বসার ঘরে পুরোটা রাত পেটের উপর শুয়ে আমার বাবার ছবি আঁকলাম। মনে মনে আমি তার চোখ দেখতে পেলাম, মুখের চারপাশের বলিরেখা দেখতে পেলাম, দেখতে পেলাম তার চোখের মনিতে ছোট্ট আলোর বিন্দুটা, যেখানটাতে কান তার মাথার সাথে জুড়েছে সেখানকার ভাঁজও দেখতে পেলাম। এমনকি আমি তার শার্টের কলারে তেল আর ঘামের মোটা দাগটাও দেখতে পেলাম—ছোট ছোট বাদামী শিরা যেগুলো ময়লার মূলস্রোত ভেঙে বেরিয়ে নিজেরাই নেমে এসেছিল।
এইসব আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, তারপরও আমি যাই করি না কেনো, তার মাথাটা কাগজের সীমানার ভিতরে কিছুতেই আসতে রাজি হচ্ছিলো না। আমি তার পা থেকে শুরু করলাম আর ক্রমশ উপরের দিকে আঁকতে থাকলাম আর শেষে আমার বাবার মাথাটা কাগজের প্রান্তে, ঘষা তিসির তেল, প্লাস্টিকের গাঁদাফুল আর ভেঁজা বাথরুম চপ্পলের উপরে টুপ করে ভেসে উঠলো।
আমি বউইবোকে কয়েকটা ড্রয়িং দেখালাম। বউইবো বুড়ো মানুষগুলোর হোমের রাঁধুনি ছিল। ওর সাথে আমি একটা সহজ আস্থার সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলাম।
‘ঈশ্বর!’ বউইবো ওগুলো দেখতে দেখতে বিড়বিড় করে বলল, ‘সিমবি, এতো অস্বাভাবিক’।
‘অস্বাভাবিক’ শব্দটা ঝুরঝুরে হয়ে বেরিয়ে এলো, আর এটা টেবিলের তীক্ষ্ণ কানায় লেগে ভেঙে গেল এবং মেঝের প্লাস্টিক কভারের উপর একটা আঠালো দলা হয়ে রইলো। বউইবো হাতের তালুতে ওর মাথাটা রাখলো, আর ওর ক্রিমরঙা কাফতানের ঘটি হাতাটা এমন ফুলে উঠলো যেন ওগুলোর ভিতরে কুমড়ো ঠাসা রয়েছে।
আমি যেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম সেটা ওকে বললাম, যে খুব সম্ভবত আমার বাবার একটা মুখ থাকলেও তার কোনও মাথা ছিল না। আর যদি আমার বাবার মাথাটা থেকেও থাকে, আমি তা দেখিনি : মানুষের মাথাটা এমন কিছু না যেটা কেউ দেখে। কেউ একজনের দিকে তাকায়, আর যা দেখে সেটা হলো তার মুখ : একটি সাধারণ মুখের আদলের মুখ, যেটা একটি সাধারণ মাথার আদলের মাথাকে ঢেকে রাখে। মুখটা মনে রাখার মতো হলে কেউ দুবার তাকায়। কিন্তু, একজনের চোখকে আরেকজনের মাথার গতানুগতিকতায় আঁকার মধ্যে আসলে কী আছে? বেশিরভাগ সময়ই যখন কেউ কারোর দিকে তাকায়, ওখানে তাদের মাথাটা দেখতেই পায় না।
বউইবো কোমর উঁচু জিকোটার সামনে দাঁড়ালো, আর একটি পাত্রে ফুটন্ত পানির মধ্যে কাসাভা ময়দা ঢাললো আর একটা রান্নার হাতা দিয়ে ওটা নাড়তে শুরু করলো। ‘বাছা,’ সে বললো, ‘তুমি কি করে বুঝেছো যে ঐসব ড্রয়িংয়ের লোকটা তোমার বাবা? ওরতো কোনো মাথাই নেই, কোনো মুখ নেই’।
‘আমি ওর পোশাক চিনেছি। ওই লাল কর্ডুরয়টা, যেটা সে সবসময় হলুদ শার্টটার সাথে মিলিয়ে পরতো’।
বউইবো মাথা নাড়লো। ‘শুধু একটা হালকা ঝুড়ি দিয়েই যে কেউ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে’।
দিনের এই সময়টায় বুড়ো মানুষগুলো তাদের কাঠের পুঁতির ছড়ায় হাত বুলাতো আর মন্ত্রপাঠের মধ্যে মধ্যে ঘুম তাড়াতে নাক দিয়ে বিকট শব্দ করতো। আমি তাদেরকে একটি ছোট, অপ্রতিভ ঝিমুনি দিতে দিতাম, ততটুকুই যতক্ষণে তারা বিশ্বাস করত যে, পুরো জপটাই তারা শেষ করেছে। তারপর আমি দড়ি ধরে টানলে দুপুরের খাবারের ঘণ্টা টুংটাং বেজে উঠত। বুড়ো মানুষগুলো প্রতি টেবিলে আটজন করে বসত, আর উগালি, টক ডাল আর ঢেঁড়সের স্যুপে তাদের মুখ ভর্তি করে বলে উঠত, ‘কাদিমা’র দোকান থেকে চাপাতি কিনো না—কাদিমা’র বউ ময়ানের উপর বসে আর ওর পাছা দিয়ে ওটা তুকতাক করে’ অথবা, ‘তোমায় কি ওয়ামবুয়ার কথা বলেছি, ওই যে, যার গরুটা একটা বাচ্চাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলল, বাচ্চাটা কান্না থামাচ্ছিল না তাই’।
বিকেলে আমি বেডপ্যানগুলো খালি করে দিতাম আর বুড়ো মানুষগুলোর পা উষ্ণ জল আর বেকিং সোডায় ভিজিয়ে দিতাম, আর যখন তারা দলবেঁধে প্রার্থনায় রওনা দিত, আমি আমার পার্সটা নিতাম আর বাড়ি যেতাম।
আখের ট্র্যাক্টর আমার বাবাকে মেরে ফেলার আগের বড়দিনে, সে প্লেট থেকে চা খেয়েছিল, কফি জারের ঢাকনার উপর ডিম ভেজেছিল আর ঘরের পেছনের আবছায়া, টিকটিকি ভরা কোণা থেকে তার ইয়ামাহা ড্রাম সেটটা এনে বারান্দায় বসে যতক্ষণ না তার আঙুল ফেটে রক্ত বেরোয় ততক্ষণ বাজিয়েছিল ।
একদিন সে তার টুল আর হাত রেডিওটা নিয়ে বারান্দায় গেল, আমি তার পায়ের কাছে বসে রইলাম, তার জুতোর ফিতে খুলে দিলাম আর পা থেকে চটচটে মোজাটা ছাড়িয়ে নিলাম। সে খানিক্ষণ তার আঙুল নাড়ালো। ওগুলোয় খানিকটা পচা গন্ধ ছিল, টক ছানার মতো।
আমার বাবা ধূমপান করত আর আফ্রিকার শিংয়ের আরও ভেতরে যে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে তার বর্ণনা শুনতো, আর ঘড়িতে আটটা বাজলে নব ঘুরিয়ে মৃত্যুর খবরগুলো শুনতো। তার চেনা কারোর নাম তার কানে লাগতে সময় নিতো না। সে বিষম খেতো আর ধোঁয়া তার গলায় আটকে যেত।
আমার বাবা বলতো, ‘শুনলে ওটা? সোপস্টার চলে গেল! সোপস্টার, মিকাহ’র ছেলে, মিরেকে মাধ্যমিকে যে কৃষি পড়াতো। ঈশ্বর, আমি বলছি, সবাই চলে যাচ্ছে। এমনকি আমিও, আমার নামও খুব শিগগিরই মৃত্যুর খবরে শুনবে’।
আমি তাকে বিকেলের চা নিয়ে এসে দিলাম। বারান্দায় সে তার সিগারেটটা পিষে দিল, তারপর ধীরে ধীরে কাপটা তার ঠোঁটের কাছে তুললো। কাপটা তার পছন্দ মতোই ভরা ছিল, এতটাই যে, একটু ঝাঁকুনিতেই তার আঙুল আর কোল ভেসে যাবে।
আমার বাবা চায়ে একটা চুমুক দিত আর বলত, ‘সোপস্টার আমার ভাইয়ের মতো ছিল। ওর মরার খবর কেন আমায় এমন করে জানতে হবে, এরকম রেডিওতে?’
তারপর আমার বাবা ভাঁজ করা সোফাটায় শুতো, আমি টুলে বসে তাকে দেখতাম, ভয় পেতাম, যদি আমি নজর ফেরাই তাহলে সেও চলে যাবে। সেবারই প্রথম আমি তার মৃত্যু কল্পনা করি, প্রথম আমি শোক করি।
আর তারপরও আমি আসলে আমার বাবার জন্য শোক করছিলাম না, বাবার মৃত্যুর অসম্ভব বার্তাবরণের মাঝে আমার আমির জন্য শোক করছিলাম। আমি কল্পনা করছিলাম এটা কেমন লাগবে : মৃত্যু সংবাদটা জানাবে যে, আমার বাবা একটা নরককুণ্ডের ভিতর ডুবে গেছে, আর মানুষ এমনভাবে আমার দিকে তাকাবে যেন, আমি রাস্তার ম্যানহোলে আটকে পড়া একটা গুঁইসাপ। আমি কল্পনা করলাম যে, যখন আমি খবরটা পাব তখন আমার পরনে একটা সবুজ পোশাক থাকবে—যেটার জমিনে লাল গন্ধরাজ বোনা থাকবে—মানুষ আসবে, আমার কাঁধে চাপড় দেবে আর প্লাস্টিকের কাপে উষ্ণ কোকাকোলা আমার হাতে দিয়ে বলবে, ‘খবরটা পাওয়ার সাথে সাথেই আমি আমার সব শোক একটা ঝুড়িতে ভরে এখানে চলে চলে এসেছি। আর কীভাবে তোমার বাবার আত্মা জানবে যে, তার মৃত্যুতে আমার কোনো দোষ নেই’।
আমার বাবার মাথাটা আমি কেনো স্মরণ করতে পারছিলাম না, তা নিয়ে বউইবোর একটা ব্যাখ্যা ছিল।
ও বলল, ‘যদিও সবার মাথাই তাদের মুখের পেছনে থাকে, কেউ কেউ সহজেই তাদেরটা দেখিয়ে দেয়; যখন তারা তোমার দিকে পেছন ফেরে আর তাদের মাথাটাই শুধু তুমি দেখতে পাও। তোমার বাবা ভালো মানুষ ছিল আর ভালো মানুষেরা কখনও তাদের মাথা দেখায় না; তারা তোমাকে তাদের মুখ দেখায়’।
হয়তো ও ঠিকই বলছিলো। এমনকি যেদিন আমার বাবার সাথের লোকেরা ফোন করে বলছিলো যে শিবালে যাওয়ার পথে একটা আখের ট্র্যাক্টর তাকে রাস্তার সাথে পিষে ফেলেছে, কেউই তার মাথা দেখার কথা কিছু বলেনি। মাপা সূক্ষ্মতায় তারা বাকি শরীরটার বর্ণনা দিচ্ছিল : কীভাবে তার পা রাস্তায় টাটকা পিচে চটচটে আর চকচকে হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল, কীভাবে তখনও তার একটা পা টায়ারের স্যান্ডেলের মধ্যে থেকে বাইসাইকেলের প্যাডেল মেরেই চলেছে, কীভাবে আখের রসে তার মুখ ভর্তি হয়ে গিয়েছিল আর তার পলিয়েস্টার শার্টের কলার ভিজিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে তখনও তার মুখে একটা ধৈর্যশীল প্রশান্তি লেপ্টে ছিল, এমনকি তার চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে বৃষ্টি জলে গড়াচ্ছিল।
যখন তারা আমাকে এইসব বলছিল, সেসব শুনেই কাঁদার বদলে আমি ভাবছিলাম, আমার বাবা কী সত্যিই ওবাওয়ামিদের দীর্ঘ ধারা থেকে এসেছিল আর তার লোকেরা তাকে গলায় রাজকীয় কড়ির একটা মালা ঝুলিয়ে বসা অবস্থায় কবর দেবে কিনা।
‘যাই হোক’ বউইবো বলে চলল, ‘তোমার বাবাকে নিয়ে আর চিন্তা করে কী হবে, হ্যাঁ? ও দুধ বহু আগেই উপচে গেছে আর মাটিতে মিশেও গেছে’।
দিনটা আমি ডরমিটরিতে কাটালাম, বিছানা তুললাম, তোষক রোদে দিলাম, পিভিসি ম্যাট্রেস ঘষে পরিষ্কার করলাম। একটা বুড়ো লোক আমার সাথেই থাকলো। সে শোনালো কিভাবে সে তার জীবনের অস্তগামী বছরগুলো কাটানোর জন্যে এই হোমে এসেছিলো—১৯৯৮ সালের আগস্টে সে মোম্বাসায় তার বাড়িতে ফেরার জন্য বিকেলের ট্রেনে উঠতে স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমেরিকান দূতাবাসে বোমা ফাটলে পুলিশ সারা শহরে চিরুনি চালালো আরব বংশোদ্ভূত সব লোককেই হাজত করলো। যেহেতু সে বাহাত্তুরে বুড়ো ছিল আর খুব দ্রুতই ভীমরতির লক্ষণ দেখাচ্ছিল, তাই ওরা তাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে যায়, আর তখন থেকে সে এখানেই আছে।
‘তোমার লোকেরা তোমাকে কখনও নিতে আসেনি?’ হতভম্ব হয়ে আমি জানতে চাইলাম।
বুড়োটা নাক টানলো। ‘আমার লোকেরা?’
‘সবারই তো নিজের নিজের লোকেরা আছে’
বুড়োটা হেসে ফেললো। ‘যে খাবারটা তুমি খেয়ে ফেলেছো কেবল সেটাই তোমার নিজের, বাছা’
পরে বুড়ো মানুষগুলো ঝুলঝুলে গোছা হয়ে উঠানে বসলো। বউইবো আর আমি রান্নাঘরের পেছনের সিঁড়ি থেকে তাই দেখলাম। ঘাসের মধ্যে পিঁপড়েরা একটি শুয়োপোকা সাবাড় করছে। কুকুরটা ঘষা গোলাপি রঙের উপর সবুজ শিরার আঁকিবুঁকি করা নাকটা কুঁচকাচ্ছে। কাঠচাঁপা গাছটার ওপরে পাখিগুলো একটি আরেকটির সাথে পাল্লা দিচ্ছে। ওদের একটি বিদ্যুতের তারে ধাক্কা খেল আর শ্যাওলা-ঢাকা বিদ্যুতের খুঁটিটায় মাথাটা থেতলে ফেলল।
বোলতারা ঘাসের ওপর নিচুতে উড়ছে। শ্যাওলায় দম আটকে ধরা একটি গাছের গুড়ির উপর একটি টিকিটিকি বেয়ে উঠলো। কুকুরটা নিজের পায়ের ভেতর দিকটা চেটে নিল। রাজকীয় নৃত্যশিল্পী প্রজাপতির একটা দল লিলির সারির উপর ভেসে এল, ওদের বর্ণিল নাচের ঘাগরা অশ্রুত বাতাসের দাপটে কাঁপছিল। কুকুরটা ঘাসের উপর পাশ ফিরে শুয়ে নিঃশেষিত শুয়োপোকা আর সেটাকে চিবিয়ে চলা পিঁপড়েদের দলাই-মলাই করছিল। কুকুরটার লোমশ পেট থেকে বেরিয়ে থাকা স্তনের বোঁটাগুলো থুতু লেগে থাকা ছাগলের লাদির মতো লাগছিল।
বউইবো বলল, ‘আমি তোমার বাবার মাথা মনে করতে তোমায় সাহায্য করতে পারি’।
আমি বললাম, ‘কী সব ফ্যালদা কথা শুরু করলে তুমি এখন?’
বউইবো তার তর্জনিটা চাটলো আর পরমবিশ্বাসে তুলে ধরল। ‘লাল বাইবেলের কসম! আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, আর আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি’।
তোমায় বলি : একদিন তুমি তোমার নির্বাসন অস্বীকার করবে, তুমি বাড়ি ফিরে যাবে, আর তোমার মা সবচেয়ে সুন্দর চিনামাটির বাসনগুলো বের করবে, আর তোমার বাবা তোমার জন্য একটি তেজি মোরগ জবাই করবে, আর তোমার বোন তার নেভি ব্লু পি. ই. র্যাপারটা পরবে, আর তোমার ভাই আঙুলের ফাঁক দিয়ে হড়কে যাওয়া ভাত আর সুরুয়া চটকানোর বদলে চামচ দিয়ে খাবে।
আর তুমি তাদের সেই জায়গার গল্প বলবে যেগুলো এখানের না, আর সেইসব লোকদের গল্প : যারা জিক ব্লিচে টেবিল ন্যাপকিন ভেজায় আর লন্ডন নিয়ে এমনভাবে কথা বলে যেন লন্ডন এমন একটা জায়গা যে লাফ দিয়ে একটা বাসে উঠে নাকুরু, আর কিসুমু। এবং কাকামেগার ভিতর দিয়ে গিয়েই ওরা সেখানে পৌঁছে যায়।
তুমি সেইসব লোকেদের গল্প বলবে, যারা তরমুজ ফালি ফালি করে কাটে না বরং তরমুজটাকে দুই ভাগ করে প্রতিটি ভাগ থেকেই চামচ দিয়ে খায় এবং সেইসব মহিলাদের গল্প করবে যারা হাত ধরাধরি করে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের চারিধারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়, ধূসর মাদার ইউনিয়নরঙা ঘটি অন্তর্বাসের ছিটেফোঁটা দেখিয়ে ফেলে এই গানটা গাইতে গাইতে :
কিজেমবে নি কিকালি, পারাম-পারাম
কিলিকাতা মওয়ালিমু, পারাম-পারাম
তুমি মনে কর যে, তোমার লোকেরা আসলে তোমার, সবসময়ই তাদের মনে আর দিলে তোমার জন্যে একটা জায়গা রাখা আছে। তুমি মনে কর যে, তোমার লোকেরা সবসময় তোমার ফেরার পথ চেয়ে থাকে।
হয়তো তুমি যেদিন ঘরে তোমার লোকদের কাছে ফিরে যাবে, বারান্দায় বেতের একটা চেয়ারে তুমি একা বসতে পারবে, একা তামাক টানতে পারবে কারণ তোমার লোকেরা তোমায় ফেরত চাইলেও কেউই আসলে চায়নি যে তুমি থেকে যাও।
আমার বাবা বারান্দায় বেতের চেয়ারটার উপর ঝুলে ছিল, পুরাতন দিনগুলোর মতোই তামাক তানছিল আর হাতরেডিওটা দেখছিল। রেডিও থেকে মৃত্যুসংবাদটা উঠে এলো, আর নিচুতে ভাসতে ভাসতে, বসার ঘরের জানালার শীতল কাঁচে লেপ্টে থাকা ধোঁয়াশা হয়ে গেল।
আমার বাবার জামা বাতাসে ঝাঁপটালো, আর ধোঁয়ার সরু শুড়গুলো তার মুখের সামনে ফট করে ভেঙে গেল। সে আপনমনে শিস দিয়ে উঠলো। প্রথমে সুরটার মুখায়বয়ব ছিল না, যাচ্ছেতাই জিনিস, যেন কেউ পথের উপর একটি বোতল পেয়েছে আর লাথি দিতে দিতে ওটা বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তারপর সুরটা নিজের ভিতর অন্য সুরের খণ্ডগুলি ধরতে পেল, আর তখন নিজের মনখোলা ওঠা-নামাটা হারিয়ে ফেলল।
আমার বাবার একটা মাথা ছিল। এখন যখন আমি এটার দিকে তাকাতে মনস্থির করলাম আমি এটা দেখতে পেলাম। তার মাথাটা একটি চালকুমড়োর মতো দেখতে ছিল। সম্ভবত সে কারণেই আমি এটার সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম; এটা ভয়াবহ, মাথা আউলা করে দেওয়ার মতো দেখতে।
আমার বাবা কলের মিস্ত্রি ছিল। সে যে নর্দমার পাইপগুলো সে নাড়াচাড়া করতো তার নখে তখনোও সেগুলোর গায়ের রঙ লাগানো, আর তার বুটে তখনোও যতসব অবর্ণনীয় কিচেনসিংকগুলোর চিটচিটে ময়লায় ছিবড়ানো। তাকে দেখে আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ল যেদিন সে কারোর বর্জ্যের আঁশে একটা সোনার হার পেঁচানো দেখতে পেয়েছিল, আর সে তার কর্ডুরয়ে ময়লাটা মুছে হারটা নাগিনপত্নীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল, আর সেই সন্ধ্যায় কাঁধে করে লাল গ্রেটওয়েল টেলিভিশনটা বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। বসার ঘরের এক কোণায় সে ওটা বসালো আর বলল, ‘দেখতো জিনিসটা কেমন ঝকঝক করছে, যেন এটার ভিতর কোন গু-ই পোরা নেই’।
আর প্রতিদিনই আমি একগোছা লবঙ্গফুল তুলে নিয়ে আসতাম আর ওদের ডাঁটাগুলি তেরছা করে ভেঙে একটা কাঁচের বাটিতে করে টেলিভিশনের উপরে রাখতাম যাতে করে আমার বাবা সন্ধ্যার খবর দেখতে দেখতে গুয়ের কথা না ভাবে।
আমি বউইবোকে বললাম, ‘আমাদের ওকে ফেরত পাঠাতে হবে’
বউইবো বলল, ‘সেই কলিজাটাই তো চাইলে যেটা তুমি খাও’
‘কিন্তু আমি ঠিক তাকে ফেরত চাইনি, আমি শুধু তার মাথাটা দেখতে চেয়েছিলাম’
বউইবো বলল, ‘শেষতক সে তো তোমার কাছে ফিরেই এলো আর এরও তো কিছু একটা ব্যাপার আছে, তাই না?’
সম্ভবত আমার বাবার ফিরে আসায় আর কোনো ব্যাপার নেই, শুধুমাত্র সারাবাড়িটা তার গন্ধ গন্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া—পোড়া ডাল, গলন্ত নখ আর তেতো কুইনিনের বাকল আর ভাঙা সিগারেটের টুকরায় ভেজা নেকড়ার অম্লতা।
আমার বাবার দিকে আমি জিনিসপত্র ছুঁড়ে দিয়েছিলাম; রসুন, আগর, লবণ, শুকরের মাংস, আর যখন কোনোকিছুই তাকে ফেরাতে পারলো না, আমি বাড়িটার শান্তি-সস্ত্যয়ন করে দেওয়ার জন্য ফাদার ইগনাটিয়াসকে অনুরোধ করলাম। উনি এক শিশি পবিত্র জল নিয়ে এলেন, আর সব ঘরে ছিটিয়ে দিলেন, আমার বাবার উপরেও ছিটালেন। ফাদার ইগনাটিয়াস বললেন, আমার আরোও সুরক্ষা দরকার, তার আগে তাকে আমার একটি চেক লিখে দিতে হবে।
একদিন যখন আমি রাস্তার কোণা থেকে পোড়ানো ভুট্টা কিনছিলাম, দোকানদারটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘সবজির দোকানি যা বলছে, এটা কি সত্যি নাকি যে, তুমি শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবাসার মানুষটা খুঁজে পেয়েছো কিন্তু তাকে দরজা দিয়ে ঢুকতেই দিচ্ছ না?’
সেই সন্ধ্যায় আমি আমার বাবাকে ভিতরে ডেকে নিলাম। আমরা ভাঁজ করা সোফাটায় পাশাপাশি বসলাম, আর একটা মাছিকে জানালার কাঁচ আর গ্রিলের মাঝের স্ক্রিনটায় বেয়ে উঠতে দেখলাম। বেয়ে উঠতে উঠতে ওটা একটু ভনভনালো। ছাদের পাখাটা ক্যাঁচকোঁচ করলো আর ওটা করিডোরের মেঝেতে ছায়া বিছালো। ছায়াটা উঁচুতে লাফ দিলো আর দরজায় চড়ে বসলো আর দেয়ালের ঘুলঘুলিতে উঁকি দিল।
বাতাস একটি কাপ উল্টে ফেলল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাপটা জানলার কার্নিশে কাত হয়ে রইলো। তারপর এটি একপাশে গড়িয়ে পড়লো আর মেঝের উপর দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে গেল। আমি ছিটকিনিটা তুলে জানালাটা আটকে দিলাম। কাঁচের গায়ে বাতাস-ভেজা ঠোঁট বুলিয়ে দিল। ধুলো আর লালার একটি দাগ রেখে গেলো, আর গ্লাসের কানা ধরে লালাটা ধীরে গড়িয়ে নেমে গেল। বাতাসের মুখটা লালাভর্তি ছিলো। শিগগিরিই লালায় সারা জানালা ঢেকে গেলো, ততক্ষণ ধরে ছড়াতে লাগলো যতক্ষণে জানালার বাইরের রোজমেরি ব্রাশউডের ঝোপটা ঝাপসা হয়ে যায়। বাইরে জাকারান্ডা নিচু হয়ে ছাদে আঁচল কেটে গেলো। পাশের ঘরে দরজা জানালা দমদম বাড়ি খেলো।
আমি আমার বাবার দিকে তাকালাম। তাকে একইসাথে অচেনা আর চেনা লাগছিলো, একই সাথে দারুণ আর ভীতিকর—সে ঝুরঝুরে ছিলো, চিনামাটির চিড়ধরা হাতলের মতো, আর সে ছিলো পেঁচার শীতল পীতবর্ণ দৃষ্টির মতো।
আমার বাবা আমার হাত ছুঁলো—এতো হাল্কা, এতো নরম করে যেন, ভয় পাচ্ছিলো আমি শিউরে উঠবো আর হাত সরিয়ে নেব। আমি চোখ তোলার সাহস করলাম না, কিন্তু সে আমার চিবুক ছুঁলো আর উপরে তুললো যাতে করে তার দিকে তাকানো ছাড়া আমার আর উপায় রইলো না।
আমার মনে পড়লো সেই সময়ের কথা যখন আমি ছোট ছিলাম, যখন আমি প্রায় এরকমভাবেই আমার বাবার চোখের দিকে তাকাতাম। ওখানে আমি দেখতাম বিভিন্ন আকৃতি; বৃত্ত, ত্রিভুজ আর চতুর্ভুজের একটি মাতাল, বুদ্ধিহীন পিণ্ড। আমি বিস্মিত হতাম আমার বাবার চোখের ভিতরে ওগুলো ঢুকলো কীভাবে। আমি কল্পনা করতাম সে টেবিলে বসে, রঙিন বই থেকে চকচকে স্মৃতিগুলো কেটে নিয়েছে, আর আঠা দিয়ে মেখে ওগুলো চোখের ভিতর দিকে সেটে দিয়েছে যাতে তার মণির ভিতরে একটা উদ্ভট এলোমেলো কোলাজ তৈরি হয়।
আমার বাবা বলল, ‘একটু চা হবে, সিমবি?’
আমি নিয়ে এলাম, আর সে জানতে চাইলো তার পুরনো বন্ধু পাইয়াস ওবোতে এখনো শনিবারগুলোতে বাড়িতে আসে কি না, এখনোও বাদাম সাবান আর কুমড়ো পাতা আর পোস্ট অফিস থেকে আসার পথে তোলা চিঠির গাদা হাতে হাজির হয় কিনা।
আমি বললাম, ‘পাইয়াস ওবোতে চার বছর হলো মারা গেছে’
আমার বাবা তার কাপটা ঠেলে সরিয়ে দিলো। সে বলল, ‘যদি চাও যে তোমার চা না খাই, বললেই পারো, তোমার মুখ দিয়ে লোক মারা-মারা খেলো না’
আমার বাবা খানিকক্ষণ চুপ রইলেন, এই পাইয়াস ওবোতে লোকটার জন্য দুঃখ করলেন, যে আমাকে সবসময় হাঁটুতে হাঁটুতে বাড়ি খাবার কথা মনে করিয়ে দেয়। পাইয়াস ওবোতে খুব চোখ পিটপিট করতো, পকেটের মধ্যে বলপেনের জন্য হাতড়াতো আর হাতে উঠে আসতো একটা মুরগির হাড়, তখনো লালা, তখনো রসালো।
আমার বাবা আমাকে বলল, ‘তোমার সাথে দেখা হলো। তুমি চা খাওয়ালে। এখন আমি যাব’।
‘কোথায় যাবে?’
‘এখান থেকে দূরে কোনো শহরে কাজ খুঁজে নেব। হয়তো এলদোরেতে। ওখানে একসময় আমার লোকেরা ছিল।‘
আমি বললাম, ‘তুমি এখানে আর কয়েকটা দিন থেকে যেতে, বাবা’।
No comments