সর্বত্রই শিক্ষা বঞ্চিত রোহিঙ্গা শিশুরা by ফিলিপ্পা এইচ স্টিওয়ার্ট ও বিল ভ্যান এসভেল্ড
১৯৯০
এর দশকের শুরুতে শরণার্থীদের জন্য গড়ে তোলা আশ্রয় শিবিরে জন্মগ্রহণকারী
রোহিঙ্গা শিশুদেরকে বাংলাদেশের স্কুলগুলো থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর
কারণ, তারা জাতিগত রোহিঙ্গা। এটি একটি অসম্ভব পরিস্থিতি। রোহিঙ্গারা, এমনকি
ত্রাণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আশ্রয় শিবিরের স্কুল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে
নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলাদেশী
স্কুলে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসবের কারণ হলো, বাংলাদেশ
সরকার রোহিঙ্গাদেরকে দেখছে অস্থায়ী অভিবাসী হিসেবে।
এসব শিশু ও তাদের পরিবারগুলো বাংলাদেশী পরিচয় সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। কারণ, এটিই হলো মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনা ও তাদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার এখন একমাত্র উপায়।
কিন্তু এ উপায়ে যারাই স্কুলে গিয়েছে সেইসব শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে বহিষ্কার করছে কর্তৃপক্ষ। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এমন কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক বিল ভ্যান এসভেল্ড। এখানে তাদের শুধু দু’জনের কাহিনী তুলে ধরা হলো।
রহিম আর
কান্না চেপে রাখলো রহিম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চেষ্টা করলো তার কাছ থেকে শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ার অর্থ কি তা বোঝাতে। সে বললো- আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে যে, আমি রোহিঙ্গা। আমি জানি না এ বছর কি ঘটেছে।
রহিম আর-এর বয়স খুব বেশি হলেও ১৮ বছর। সাক্ষাতকার দেয়ার সময় পরা ছিল তার স্কুলের নির্ধারিত পোশাকÑ একটি সাদা কলারের শার্ট আর নেভি ট্রাউজার। গোঁড়ালির কাছে তা কিছুটা ভাঁজ করা। জানুয়ারিতে একটি দিন ছিল তার কাছে বেদনার। মাত্র কয়েকটি দিন গেলেই সে শেষ করতে পারতো স্কুলে পড়ার শেষ দিনটি কাটাতে। তার আগেই একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরকারের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। তাতে বলা হয় রোহিঙ্গা সব শিশুকে বহিষ্কার করতে হবে। রহিম বলেছে, ওই চিঠিটি প্রতিটি ক্লাসে জোরে পড়ে শোনানো হয়েছিল। সহপাঠীদের সামনে সব রোহিঙ্গা শিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। রহিম বলে- এতে আমি ওই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিেিয়ছিলাম। আমি লুকিয়ে ছিলাম এবং কেঁদেছি।
মিয়ানমার থেকে পিতামাতা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার ১০ বছর পরে ২০০১ সালে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে রহিম। চার বছর বয়সে সে আশ্রয় শিবিরের ভিতরেই পড়াশোনা শুরু করে। তখন পিতামাতা ও ভাইবোনদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতো। কিন্তু ৫ম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করার পর সে দেখতে পায় ওই আশ্রয়শিবিরের ভিতরে উপরের শ্রেণিগুলোতে পড়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আরো বলা যায়, ওই আশ্রয় শিবিরের ভিতরে শিক্ষার বিষয়টি অনুমোদিত নয়। এর অর্থ হলো আশ্রয়শিবিরের ভিতরে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে। সনদ পাবে। কিন্তু তারা মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষার সুযোগ পাবে না।
রহিমের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। যখন সে আশ্রয় শিবিরের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এলো, বুঝতে পারলো আশ্রয় শিবিরের বাইরে বাংলাদেশী স্কুলগুলোর কোনোটিতেই তার ৫ বছরের শিক্ষাকে বৈধতা দিচ্ছে না। থমকে গেল রহিম। সে বলেছে, যতদিন আমার মধ্যে স্বপ্ন ছিল যে আমি একজন ডাক্তার হয়ে আমার সম্প্রদায়ের মানুষের সেবা করবো, ততদিন আমি অন্য স্কুলে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি।
এমনকি যখন তার বয়স ৯ বছর, তখনও তার ভিতর বড় হওয়ার জিদ ছিল। সে বাংলাদেশী স্কুলের শিক্ষায় ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার একটি সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে অনুমোদন দেয়া হয়। সে পরীক্ষায় এ-প্লাস স্কোর করে। ভর্তি হয় একটি জুনিয়র হাই স্কুলে। আরো তিন বছর পরে সে অষ্টম শ্রেণির পড়া শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায়ও এ-প্লাস স্কোর করে। এরপরে তাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হলো, যাতে সে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে।
রহিম বলে, আমাদের ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র ৫ জন ছাত্র এ-প্লাস পেয়েছে। তাই আরেকটি স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি করতে রাজি হলেন।
আবার শুরু হয় তার লড়াই। ভাল করার অব্যাহত চাপ তার মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার লক্ষ্য ফাঁদে আটকে গেল। ২৮ শে জানুয়ারি তার আশা থমকে গেল। এখন সে তার ছোট ভাইবোনকে পড়ায়। পড়ায় আশ্রয় শিবিরের একটি স্কুলে আরো প্রায় ২০টি শিশুকে। তবুও সে এখনও একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কেন এমন বাসনা তার? সে বলেছে, তার দাদা মারা গিয়েছেন। তার যতটুকু চিকিৎসা দেয়া দরকার ছিল তা তারা দিতে পারে নি। রহিম বলেছে, দাদা মারা যাওয়ার সময় আমি অনেক ছোট। মা আমাকে শিখিয়েছেন, জাতির সেবা করা হলো তোমার দায়িত্ব।
ইউসেফ ওয়াই
কঠোর শ্রমে নিযুক্ত থাকার কারণে হাতে কড়া পড়ে গেছে ইউসেফের। রোদে পুড়ে শরীর গেছে কালো হয়েছে। তবে তার ভিতর যে সুপ্ত বাসনা আছে তার সঙ্গে এসবের মিল নেই। মিল নেই তার ‘হার্ট’ আকৃতির মুখের সঙ্গেও। হাতের তালুতে সেই কড়ার দিকে তাকিয়ে সে বলল, এগুলো অনেক শক্ত। সব সময়ই আমাকে কাজ করতে হয়।
ইউসেফ ইটের ভাটায় কাজ করে। সেখান থেকে তার শারীরিক এই পরিবর্তন। ওই ইটভাটায় সে কাজ করে যাতে স্কুলে পড়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এখন তাকে আর ক্লাসে যেতে দেয়া হয় না। তাই কাজ করেই যায় সে। তার হাতের ওই কড়া আরো শক্ত হচ্ছে।
তার পরিবারও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এখানে ১৯৯১ সালে জন্ম তার। সে পড়াশোনা করতো বার্মিজ, ইংরেজি ও গণিত। আশ্রয় শিবিরের ভিতরে পড়াশোনার কেন্দ্রে তার জন্য এ বিষয়গুলোই ছিল। সেখানে চার বছর সে পড়াশোনা করেছে। তারপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকার শিবিরে নতুন কারিকুলাম চাপিয়ে দেয়। আগে এটা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল।
ক্যাম্পে কি অনুমোদন করা হবে তা সরকার উল্টেপাল্টে ফেলে। এর ফলে শিবিরের ভিতরকার স্কুলগুলোর বহু শিশু পড়াশোনা বাদ দেয়। ক্লাসে বাধ্য করানো থেকে হতাশার জন্য তারা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কারণ, নতুন যে কারিকুলাম দেয়া হয়েছে সে জন্য অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু ইউসেফের পরিবারের পক্ষে তাকে স্কুলে রাখা সম্ভব হয় নি। তাই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সে বলেছে, আমি এখন আশ্রয়শিবিরের পাশেই একটি স্থানীয় ইটভাটায় কাজ করি। সেখান থেকে কিছু অর্থ পাই। তা দিয়ে বাংলাদেশী একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছি।
৯ বছর বয়সে পরীক্ষা পাস করার পর জমানো অর্থ দিয়ে নিজেই একটি স্কুলের ভর্তি ফি পরিশোধ করেছে। যখন সে কাজ করতে পারে না বা কাজ থাকে না, তখন সে নিজে নিজেই পড়াশোনা করে। দু’বছর এভাবে চলার পর সে পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সে প্রতিদিন হেঁটে যেতো এবং হেঁটে ফিরতো।
ইউসেফ বলেছে, অন্য ছাত্রছাত্রীরা আমার কাছে জানতে চাইতো কেন আমি হেঁটে স্কুলে যাই। জবাবে আমি বলতাম আমি শরীরচর্চা করি তো, তাই। কিন্তু এই কথাটি সত্য ছিল না। বলতে বলতে চোখ ভরে ওঠে তার অশ্রুতে। তা মুছে ইউসেফ বলে, গাড়িতে চড়ার মতো অর্থ ছিল না আমার।
সব পরীক্ষায়ই ভালো করেছে ইউসেফ। একের পর এক ক্লাস উতরে যাচ্ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে সরকারের তরফ থেকে নোট আসে। তাতে বলা হয়, স্কুলে রোহিঙ্গা কোনো শিশু এলে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। তাকেও তাই করা হলো। তার পূর্ব পর্যন্ত ইউসেফ মানবিকতার ওপর পড়াশোনা করতে চেয়েছিল যাতে সে তার মূল দেশ মিয়ানমারের মানুষদের সহায়তা করতে পারে, যে মিয়ানমারকে সে কখনোই জানতেই পারে নি। ইউসেফ বলেছে, যদিও আমি কখনো মিয়ানমার যেতে পারি নি, দেখি নি, তবু আমরা মিয়ানমারের নাগরিক। আমি মনে করি একদিন আমার সম্প্রদায়ের একজন নেতা হবো।
এখনও ইউসেফ সেই ধারণাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যখন সে জানতে পারে অন্য রোহিঙ্গা শিশুদেরও বহিষ্কার করা হয়েছে তখন সে জাতিসংঘের স্থানীয় শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সি অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছে। দাবি তুলেছে, শিবিরে শিক্ষা ফিরিয়ে দেয়ার। সে বলেছে, আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মনে করেছি ঠিক আছে। কিন্তু এখন দেখি স্কুল থেকে সব রোহিঙ্গা শিশুকে বের করে দেয়া হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে অনেক স্কুল পরিদর্শন করেছে। সেখানে দেখা গেছে ভগ্নদশা এবং অতিরিক্ত শিক্ষার্থীতে পূর্ণ। তাই দেশের সব শিশুর জন্য পরিস্থিতির বাস্তব উন্নতি প্রয়োজন। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষায় বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার তাদের শিক্ষার অধিকার ও ভবিষ্যতকে প্রত্যাখ্যান করছে।
ইউসেফ ফিরে গেছে ইটভাটায়। কাজ করছে শ্রমিক হিসেবে কৃষিকাজে এবং মাছ ধরার কাজে। যখনই সে সময়, সুযোগ পায় সে মোবাইল ফোনে বাংলায় বই পড়ে তার পড়াশোনাকে নিজে নিজে চালিয়ে নেয়ার জন্য। চার ভাই ও তিন বোনের জন্য তার চিন্তার শেষ নেই। তারা অশিক্ষিতই রয়ে গেছে।
তার দাবি, আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সব সময়ই ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা এখন আমাদের শিক্ষার অধিকারটুকু চাই।
(ফিলিপ্পা এইচ স্টিওয়ার্ট হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র মিডিয়া অফিসার এবং বিল ভ্যান এসভেল্ড সিনিয়র রিচার্সার, মেনা, শিশু অধিকার বিভাগ। তাদের এই লেখাটি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।)
এসব শিশু ও তাদের পরিবারগুলো বাংলাদেশী পরিচয় সংগ্রহের চেষ্টা করেছে। কারণ, এটিই হলো মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনা ও তাদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার এখন একমাত্র উপায়।
কিন্তু এ উপায়ে যারাই স্কুলে গিয়েছে সেইসব শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে বহিষ্কার করছে কর্তৃপক্ষ। সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে এমন কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গবেষক বিল ভ্যান এসভেল্ড। এখানে তাদের শুধু দু’জনের কাহিনী তুলে ধরা হলো।
রহিম আর
কান্না চেপে রাখলো রহিম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চেষ্টা করলো তার কাছ থেকে শিক্ষা হারিয়ে যাওয়ার অর্থ কি তা বোঝাতে। সে বললো- আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে যে, আমি রোহিঙ্গা। আমি জানি না এ বছর কি ঘটেছে।
রহিম আর-এর বয়স খুব বেশি হলেও ১৮ বছর। সাক্ষাতকার দেয়ার সময় পরা ছিল তার স্কুলের নির্ধারিত পোশাকÑ একটি সাদা কলারের শার্ট আর নেভি ট্রাউজার। গোঁড়ালির কাছে তা কিছুটা ভাঁজ করা। জানুয়ারিতে একটি দিন ছিল তার কাছে বেদনার। মাত্র কয়েকটি দিন গেলেই সে শেষ করতে পারতো স্কুলে পড়ার শেষ দিনটি কাটাতে। তার আগেই একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক সরকারের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। তাতে বলা হয় রোহিঙ্গা সব শিশুকে বহিষ্কার করতে হবে। রহিম বলেছে, ওই চিঠিটি প্রতিটি ক্লাসে জোরে পড়ে শোনানো হয়েছিল। সহপাঠীদের সামনে সব রোহিঙ্গা শিশুকে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। রহিম বলে- এতে আমি ওই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিেিয়ছিলাম। আমি লুকিয়ে ছিলাম এবং কেঁদেছি।
মিয়ানমার থেকে পিতামাতা পালিয়ে বাংলাদেশে আসার ১০ বছর পরে ২০০১ সালে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে রহিম। চার বছর বয়সে সে আশ্রয় শিবিরের ভিতরেই পড়াশোনা শুরু করে। তখন পিতামাতা ও ভাইবোনদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতো। কিন্তু ৫ম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করার পর সে দেখতে পায় ওই আশ্রয়শিবিরের ভিতরে উপরের শ্রেণিগুলোতে পড়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আরো বলা যায়, ওই আশ্রয় শিবিরের ভিতরে শিক্ষার বিষয়টি অনুমোদিত নয়। এর অর্থ হলো আশ্রয়শিবিরের ভিতরে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারবে। সনদ পাবে। কিন্তু তারা মাধ্যমিক পর্যায়ের কোনো শিক্ষার সুযোগ পাবে না।
রহিমের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। যখন সে আশ্রয় শিবিরের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এলো, বুঝতে পারলো আশ্রয় শিবিরের বাইরে বাংলাদেশী স্কুলগুলোর কোনোটিতেই তার ৫ বছরের শিক্ষাকে বৈধতা দিচ্ছে না। থমকে গেল রহিম। সে বলেছে, যতদিন আমার মধ্যে স্বপ্ন ছিল যে আমি একজন ডাক্তার হয়ে আমার সম্প্রদায়ের মানুষের সেবা করবো, ততদিন আমি অন্য স্কুলে পড়াশোনা করার চেষ্টা করেছি।
এমনকি যখন তার বয়স ৯ বছর, তখনও তার ভিতর বড় হওয়ার জিদ ছিল। সে বাংলাদেশী স্কুলের শিক্ষায় ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার একটি সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাকে অনুমোদন দেয়া হয়। সে পরীক্ষায় এ-প্লাস স্কোর করে। ভর্তি হয় একটি জুনিয়র হাই স্কুলে। আরো তিন বছর পরে সে অষ্টম শ্রেণির পড়া শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায়ও এ-প্লাস স্কোর করে। এরপরে তাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হলো, যাতে সে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে।
রহিম বলে, আমাদের ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে মাত্র ৫ জন ছাত্র এ-প্লাস পেয়েছে। তাই আরেকটি স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি করতে রাজি হলেন।
আবার শুরু হয় তার লড়াই। ভাল করার অব্যাহত চাপ তার মধ্যে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার লক্ষ্য ফাঁদে আটকে গেল। ২৮ শে জানুয়ারি তার আশা থমকে গেল। এখন সে তার ছোট ভাইবোনকে পড়ায়। পড়ায় আশ্রয় শিবিরের একটি স্কুলে আরো প্রায় ২০টি শিশুকে। তবুও সে এখনও একজন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কেন এমন বাসনা তার? সে বলেছে, তার দাদা মারা গিয়েছেন। তার যতটুকু চিকিৎসা দেয়া দরকার ছিল তা তারা দিতে পারে নি। রহিম বলেছে, দাদা মারা যাওয়ার সময় আমি অনেক ছোট। মা আমাকে শিখিয়েছেন, জাতির সেবা করা হলো তোমার দায়িত্ব।
ইউসেফ ওয়াই
কঠোর শ্রমে নিযুক্ত থাকার কারণে হাতে কড়া পড়ে গেছে ইউসেফের। রোদে পুড়ে শরীর গেছে কালো হয়েছে। তবে তার ভিতর যে সুপ্ত বাসনা আছে তার সঙ্গে এসবের মিল নেই। মিল নেই তার ‘হার্ট’ আকৃতির মুখের সঙ্গেও। হাতের তালুতে সেই কড়ার দিকে তাকিয়ে সে বলল, এগুলো অনেক শক্ত। সব সময়ই আমাকে কাজ করতে হয়।
ইউসেফ ইটের ভাটায় কাজ করে। সেখান থেকে তার শারীরিক এই পরিবর্তন। ওই ইটভাটায় সে কাজ করে যাতে স্কুলে পড়ার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এখন তাকে আর ক্লাসে যেতে দেয়া হয় না। তাই কাজ করেই যায় সে। তার হাতের ওই কড়া আরো শক্ত হচ্ছে।
তার পরিবারও পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এখানে ১৯৯১ সালে জন্ম তার। সে পড়াশোনা করতো বার্মিজ, ইংরেজি ও গণিত। আশ্রয় শিবিরের ভিতরে পড়াশোনার কেন্দ্রে তার জন্য এ বিষয়গুলোই ছিল। সেখানে চার বছর সে পড়াশোনা করেছে। তারপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকার শিবিরে নতুন কারিকুলাম চাপিয়ে দেয়। আগে এটা রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল।
ক্যাম্পে কি অনুমোদন করা হবে তা সরকার উল্টেপাল্টে ফেলে। এর ফলে শিবিরের ভিতরকার স্কুলগুলোর বহু শিশু পড়াশোনা বাদ দেয়। ক্লাসে বাধ্য করানো থেকে হতাশার জন্য তারা পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। কারণ, নতুন যে কারিকুলাম দেয়া হয়েছে সে জন্য অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু ইউসেফের পরিবারের পক্ষে তাকে স্কুলে রাখা সম্ভব হয় নি। তাই তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সে বলেছে, আমি এখন আশ্রয়শিবিরের পাশেই একটি স্থানীয় ইটভাটায় কাজ করি। সেখান থেকে কিছু অর্থ পাই। তা দিয়ে বাংলাদেশী একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছি।
৯ বছর বয়সে পরীক্ষা পাস করার পর জমানো অর্থ দিয়ে নিজেই একটি স্কুলের ভর্তি ফি পরিশোধ করেছে। যখন সে কাজ করতে পারে না বা কাজ থাকে না, তখন সে নিজে নিজেই পড়াশোনা করে। দু’বছর এভাবে চলার পর সে পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সে প্রতিদিন হেঁটে যেতো এবং হেঁটে ফিরতো।
ইউসেফ বলেছে, অন্য ছাত্রছাত্রীরা আমার কাছে জানতে চাইতো কেন আমি হেঁটে স্কুলে যাই। জবাবে আমি বলতাম আমি শরীরচর্চা করি তো, তাই। কিন্তু এই কথাটি সত্য ছিল না। বলতে বলতে চোখ ভরে ওঠে তার অশ্রুতে। তা মুছে ইউসেফ বলে, গাড়িতে চড়ার মতো অর্থ ছিল না আমার।
সব পরীক্ষায়ই ভালো করেছে ইউসেফ। একের পর এক ক্লাস উতরে যাচ্ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে সরকারের তরফ থেকে নোট আসে। তাতে বলা হয়, স্কুলে রোহিঙ্গা কোনো শিশু এলে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। তাকেও তাই করা হলো। তার পূর্ব পর্যন্ত ইউসেফ মানবিকতার ওপর পড়াশোনা করতে চেয়েছিল যাতে সে তার মূল দেশ মিয়ানমারের মানুষদের সহায়তা করতে পারে, যে মিয়ানমারকে সে কখনোই জানতেই পারে নি। ইউসেফ বলেছে, যদিও আমি কখনো মিয়ানমার যেতে পারি নি, দেখি নি, তবু আমরা মিয়ানমারের নাগরিক। আমি মনে করি একদিন আমার সম্প্রদায়ের একজন নেতা হবো।
এখনও ইউসেফ সেই ধারণাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যখন সে জানতে পারে অন্য রোহিঙ্গা শিশুদেরও বহিষ্কার করা হয়েছে তখন সে জাতিসংঘের স্থানীয় শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সি অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেছে। দাবি তুলেছে, শিবিরে শিক্ষা ফিরিয়ে দেয়ার। সে বলেছে, আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। মনে করেছি ঠিক আছে। কিন্তু এখন দেখি স্কুল থেকে সব রোহিঙ্গা শিশুকে বের করে দেয়া হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশে অনেক স্কুল পরিদর্শন করেছে। সেখানে দেখা গেছে ভগ্নদশা এবং অতিরিক্ত শিক্ষার্থীতে পূর্ণ। তাই দেশের সব শিশুর জন্য পরিস্থিতির বাস্তব উন্নতি প্রয়োজন। কিন্তু রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষায় বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার তাদের শিক্ষার অধিকার ও ভবিষ্যতকে প্রত্যাখ্যান করছে।
ইউসেফ ফিরে গেছে ইটভাটায়। কাজ করছে শ্রমিক হিসেবে কৃষিকাজে এবং মাছ ধরার কাজে। যখনই সে সময়, সুযোগ পায় সে মোবাইল ফোনে বাংলায় বই পড়ে তার পড়াশোনাকে নিজে নিজে চালিয়ে নেয়ার জন্য। চার ভাই ও তিন বোনের জন্য তার চিন্তার শেষ নেই। তারা অশিক্ষিতই রয়ে গেছে।
তার দাবি, আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সব সময়ই ধন্যবাদ জানাই। তারা আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা এখন আমাদের শিক্ষার অধিকারটুকু চাই।
(ফিলিপ্পা এইচ স্টিওয়ার্ট হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র মিডিয়া অফিসার এবং বিল ভ্যান এসভেল্ড সিনিয়র রিচার্সার, মেনা, শিশু অধিকার বিভাগ। তাদের এই লেখাটি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সেখান থেকে অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।)
No comments